আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খ্যাতনামা পল্লীগীতি শিল্পী ও সুরকার আব্বাসউদ্দিন আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী আজঃ প্রখ্যাত বাংলা লোকসঙ্গীত গায়কের মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমি সত্য জানতে চাই প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী ও সুরকার আব্বাসউদ্দিন আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আব্বাসউদ্দিন আহমদের পরিচিতি দেশজোড়া। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি।

প্রখ্যাত বাংলা লোকসঙ্গীত গায়কের মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন।

এখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। শৈশব থেকেই গানের দিকে আব্বাসউদ্দিনের নেশা। কুচবিহার ভাওয়াইয়া গানের অঞ্চল। বালক আব্বাস লোকমুখে যে গান শোনেন তা-ই শিখে ফেলেন। গ্রামের স্কুল শেষ করে আসেন কুচবিহারে, সেখান থেকে তুফানগঞ্জে।

সেখানকার সরকারি ডাক্তার মোবারক হোসেন সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। স্কুল ছুটির পর আব্বাস তাঁর কাছে গিয়ে গান শেখেন। গানের জগতে তার ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। আপন প্রতিভাবলে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক।

যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছিলেন। রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল চটকা গেয়ে আব্বাস উদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি , মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন। তিনি তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লি গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়।

শৈলেন রায়ের লেখা 'স্মরণপারের ওগো প্রিয়' এবং 'কোন বিরহীর নয়ন জলে' গান দু'টি তিনি প্রথম রেকর্ড করেন। দু'টি গানই জনপ্রিয় হয়। এই সাফল্যে গান গাওয়াকেই জীবনের লক্ষ্য হিসোবে স্থির করে তিনি কুচবিহার থেকে কলিকাতায় চলে আসে। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম তখন গ্রামোফোন কোম্পানির গীতিকার, সুরকার ও প্রশিক্ষক।

নজরুলের বেশ কয়েকটি গান আব্বাসউদ্দিন-এর মধ্যেই রেকর্ডে গেয়েছেন। নজরুল আব্বাসউদ্দিনকে গভীরভাবে স্নেহ করেন। আব্বাসউদ্দিন একদিন নজরুলকে ইসলামী গান রচনা করতে বলেন এবং এ শ্রেণীর গান রেকর্ড করার জন্য গ্রামোফোন কোম্পানির সমর্থন আদায় করেন। 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে' ও 'ইসলামের ঐ সওদা লয়ে' নজরুল ইসলামের প্রথম রচিত দু'টি ইসলামী গান আব্বাসউদ্দিন রেকর্ড করেন। গান দু'টি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।

এর পর নজরুলও রচনা করে চললেন একের পর এক ইসলামী গান, আব্বাসউদ্দিন নিজে রেকর্ড করলেন অনেক, অন্যদের দিয়েও রেকর্ড করালেন। নজরুল ইসলামের ইসলামী গান রচনার পেছনে ও সেসব রচনাকে জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে আব্বাসউদ্দিনের এই ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। গানের নানা ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করলেও আব্বাসউদ্দিনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল লোকসঙ্গীত। কলকাতাতেই পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। এঁরা উভয়ে মিলে কলিকাতা শহরে লোকসঙ্গীত প্রচারে ব্রতী হন।

এঁদের প্রচেষ্টা সফল হয় ও লোকসঙ্গীত সম্পর্কে কলকাতা তথা নগরবাসী মানুষের মনে গভীর উৎসাহ জাগে। লোকসঙ্গীতের মধ্যে প্রথম দিকে আব্বাসউদ্দিন কিছু ভাটিয়ালি গান রেকর্ড করেন। এর পরই আসে তাঁর ভাওয়াইয়া গান রেকর্ড করার পালা। ভাওয়াইয়া তো তাঁর এলাকার গান। শৈশব থেকেই এ গান তিনি গাইছেন।

মাঝে মাঝে সুর ভেঙে যাওয়া সুরে তাঁর আশ্চর্য দখল। ভাওয়াইয়া গানে আব্বাসউদ্দিন অসামান্য সাফল্য অর্জন করলেন। তাঁদের আঞ্চলিক ভাষায় ছোট ভাই আবদুল করিমের লেখা কয়েকটি পালাও রেকর্ড করেন। বিখ্যাত দোতারাবাদক কানাইলাল শীলের সঙ্গে আব্বাসউদ্দিনের যোগাযোগ অত্যন্ত ফলদায়ক হয়েছিল। কানাইলাল লোকসঙ্গীতের সংগ্রাহক ছিলেন।

তাঁর সঙ্গীতসংগ্রহ যেমন আব্বাসউদ্দিন ব্যবহার করতে সমর্থ হন, তেমনি তাঁর গানের সঙ্গে কানাইলালের দোতারা বাদন অভাবনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসল্মান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ড গুলো ছিল বাণিজ্যিক ভাবে ভীষণ সফল। তাই অন্যান্য হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান করতে থাকে। আব্বাস উদ্দীন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন।

প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাস উদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগের (১৯৪৭ সালে) সঙ্গে সঙ্গে আব্বাসউদ্দিন ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন।

ঢাকায় নতুন করে তাঁর জীবন শুরু হল। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট রাত ১২টার পর ঢাকা বেতার থেকে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় আয়োজিত এশীয় সঙ্গীত সম্মেলনে বাংলা লোকসঙ্গীত সম্পর্কে ভাষণ দেন। সেখান থেকে ফেরার পথে রেঙ্গুনে কয়েকটি সভায় যোগ দেন ও গান গেয়ে শোনান। ১৯৫৬ সালে তিনি জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে আয়োজিত আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনে যোগ দেন।

বাংলা লোকসঙ্গীত সম্পর্কে বিশ্বসভায় প্রদত্ত তাঁর ভাষণ ও তাঁর গান শ্রোতৃমন্ডলীর অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে। ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তার্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। গান পরিবেশন ও সুরকারা ছাড়াও আব্বাসউদ্দিন আহমেদ মোট ৪টি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই ৪টি সিনেমা হলো 'বিষ্ণুমায়া' (১৯৩২),'মহানিশা' (১৯৩৬),'একটি কথা' ও 'ঠিকাদার'(১৯৪০)। ঠিকাদার সিনেমাতে আব্বাস উদ্দিন একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

ধারণা করা হয় যে তিনি এর চেয়ে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও তা উল্লেখ করেন নি। কারণ সেই চরিত্রগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এসব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন। তখনকার দিনে মুসলমান ব্যাক্তির সিনেমা করা ছিল একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। তাই হয়ত ‘বিষ্ণুমায়া’ ছবিতে অভিনয়ের পরও এর ভূমিকা লিপিতে আব্বাস উদ্দিনের নাম ছিল না যার তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল কানন দেবীর কাছ থেকে।

আমার শিল্পীজীবনের কথা’ (১৯৬০) আব্বাস উদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। আব্বাস উদ্দিন তাঁর সময়কালের আকাঙ্খা ও সংগ্রামকে ধারণ করেছিলেন,সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল এবং আরো অনেকে। “তাঁর সন্তান ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসীও গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন। পল্লীগানের এই মহান সম্রাট দীর্ঘ জীবন লাভ করেননি।

তিনি ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুদিন আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। তথ্যসূত্রঃ ১। উইকিপিডিয়া। ২।

মোরশেদ, হেদায়েত হোসেন (২০০১). চলচ্চিত্রে আব্বাস উদ্দিন এবং সাপ্তাহিক ২০০০  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.