আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খেলারাম খেলে যা: ট্রমাক্রান্তের মনোজগতের গল্প



[সৈয়দ শামসুল হক-এর উপন্যাস 'খেলারাম খেলে যা' নিয়ে রচিত হয় এই নিবন্ধ। হক-এর ৭৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শিল্প ও সাহিত্যের কাগজ 'অ্যা লিটল বিট' এবং বাংলাদেশ শিল্পকলএকাডেমী যৌথভাবে ২২ ফর্মার একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সেখানেই আছে এই নিবন্ধ। তবে, ফেসবুকেও তুলে দিলাম, আগ্রহী যে কেউ এসে এখানে ঘুরে যেতে পারেন। ]


বাবর আলী।

সুন্দর নিপাট গোছানো মানুষ। কথার মায়াজাল বুনায় তার জুড়ি মেলা ভার। জীবন নিয়েও আপাত অর্থে তার কোনো টানাপোড়েন নেই। ব্যাবসার টাকায় বেশ আয়েশে, নিশ্চিন্তিতে দিন কাটে তার।

নিজের বাড়ি, গাড়ি, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুবাদে সমাজের কাছে পরিচিতি— সবই আছে তার।

ফলে, বলা যায় নির্ভার আনন্দময় জীবন বাবরের।

শিক্ষিত, সুদর্শন, অবিবাহিত, সুকথক, সমাজের অন্য দশজনের থেকে বিত্তবান, মাঝবয়সী এই বাবরের যেন কোনো দুঃখ নেই। পিছু টান নেই। মনে হয়, যেন নিজের শরীরের সুখের জন্যই, শিশ্নের ইচ্ছেকে চরিতার্থ করবার জন্যেই সে কেবল উদগ্রীব।

নিজের বন্ধুর মেয়ে লতিফা, যার সাথে তার শরীরের সম্পর্ক, সেই লতিফাকে ঢাকায় নোটিশবিহীন অনুপস্থিত দেখে তার খোঁজ নিতে সে ময়মনসিংহে গিয়ে হাজির হয়।

সেখানে গিয়ে লতিফার বাবার সামনে বাবরের ভাবটি এমন যে, লতিফা যেন তার মেয়েরই মতন। আবার রাতের বেলায় সেই বাড়িতেই লতিফার মধ্যে প্রবেশ করার জন্য ব্যাকুল হয় বাবর। লতিফাতে সে প্রবেশ করতে পারে না। অপমানিত হয়। ফিরে আসে ঢাকায়।



শুধু এই ফিরে আসা পর্যন্ত পড়েই অবশ্য পাঠকের ধারণা হবার কথা নয় যে বাবর “লম্পট” কিসিমের একজন মানুষ। বাবরের লাম্পট্য দর্শকের কাছে উন্মোচিত হয় বাবলীকে দিয়ে। বাবরের হাঁটুর বয়সী মেয়ে বাবলী। এই বাবলীকে পাবার জন্যই বাবর উতলা হয়।

কেবল বাবলীর নামের ধ্বনিতেই “বাবর টের পায় আবার তার দু’পায়ের মাঝখানে উত্তাপ বাড়ছে।

বড় হচ্ছে। তার দেহকে ছাপিয়ে উঠছে আয়তনে। [...] উত্তাপে উত্তেজনায় যেন সেখানে ছোটো ছোটো ড্রাম বাজানোর কাঠিতে বাড়ি পড়তে লাগলো। সৃষ্টি হতে লাগলো একটা দ্রুত লয়ের ছন্দ। লয়টা দ্রুত থেকে আরো দ্রুত হতে লাগলো।

চোখের ভেতরে বাবলীকে সে দেখতে পেল স্পষ্ট। নির্বাক। নগ্ন। কাছে, আরো কাছে”।

লতিফা বা বাবলী বা জাহেদাই শেষ নয়।

জাহেদা, টুনি, রিক্তা, জলি, পপি, সুসমা, মমতাজ, আয়েশা, ডেইজি— সব মেয়েকেই তার এক মনে হয়। মনে হয়, প্রেম-টেম কিছু নয়। পাজামা খোলাটাই মূল কথা। কত সহজে কত বিশ্বাসযোগ্যভাবে পাজামাটা খোলা গেলো সেটিই বাবরের লক্ষ্য। সেজন্যই বাবরের এতো শ্রম-সাধনা।



অবশ্য একটি জায়গায় মেয়েতে-মেয়েতে পার্থক্য খুঁজে পায় সে। পার্থ্যক্যটি হলো শরীরের গন্ধের রকমফের। বাবরের মতে “কারো গায়ে লেবুর গন্ধ। কারো গায়ে দৈয়ের। খবরের কাগজের।

বন্ধ সবুজ পানির। মিষ্টি কফ সিরাপের। পনিরের। কী করে যে ঐ বিচিত্র বিভিন্ন বস্তুর গন্ধ ওরা সংগ্রহ করেছে কে জানে। রিক্তার পিঠে মুখ রাখলেই তার মনে হতো সদ্য খোলা খবরের কাগজে সকালবেলা নাক ডুবিয়ে আছে সে।



অল্পবয়সী মেয়েদেরকে কথার মায়াজালে মুগ্ধ করে, কৌশলে উরু ছুঁয়ে দিয়ে, চকিতে ছুঁয়ে দিয়ে কাঁধ, কারো সাথে কথার পিঠে কথা বলার ছলে যৌনতার প্রসঙ্গ টেনে এনে বাবর তৈরি করে সহজ সম্পর্ক। শুরুতে সে সুঁতো ছাড়ে, সুঁতো ছাড়ে। তারপর মোক্ষম সময়ে লাটাইয়ে দেয় উল্টো টান। তখন আর মেয়েটির ফেরার পথ নেই। বাবরের শিশ্নেরই তখন জয়।



বাবর শরীর চায়। কিন্ত সম্পর্কের বন্ধন চায় না। “বিয়ে সে করবে কেন? শরীরের জন্য? সে প্রয়োজন বিয়ে না করেও মেটান যায়। বরং তাতে তৃপ্তি আরো অনেক। বিবাহিত বন্ধুদের কি সে শোনেনি স্বীকারোক্তি করতে? বৌয়ের সঙ্গে শুয়ে সুখ নেই।

বন্ধুরা কি তাকে বলে নি, দে না একটা মেয়েটেয়ে যোগাড় করে?”

শরীর চিন্তার বাইরেও বিয়ে নিয়ে বাবরের আলাদা আরো ভাবনা আছে। বাবর ভাবে “বিয়ে করবে সন্তানের জন্য?সন্তান সে চায় না। চায় না তার উত্তরাধিকার কারো উপরে গিয়ে বর্তাক। আমার জীবনের প্রসারণ আমি চাই না। মৃত্যুর পরেও আমি বেঁচে থাকতে চাই না।

[...] এ জীবন আমি চাই নি, অতএব কারো জীবনের কারণও আমি হতে চাই না। ”

বিয়ের বন্ধন চায় না বাবর। নতুন আরেকটি জীবন তৈরি করে তার উত্তরাধিকারও রেখে যেতে চায় না। সে ভালোবাসে অবাধ যৌনাচার। কচিকচি মেয়েদের সাথে বিছানায় যাবার জন্যে সেব্যাকুল হয়ে থাকে।

কিন্তু ধর্ষণ সে করে না। বহু বুদ্ধি খরচ করে, সময় খরচ করে, অর্থ খরচ করে কচি মেয়েদের মন জয় করে সে। কেননা বাবর জানে, মন জয় হলে শরীরটা জয় করা সহজ হয়; হয় আনন্দময়।

এমনি হীন, কামুক, লম্পট, দূরাচারী যে, তার কেন মাঝে মাঝে খুব একা একা লাগে? কেন তার কান্না কান্না পায়? কেন তার মনে হয় কী জানি কী নেই! কী যেনো কী এক অদ্ভুত হাহাকার, শূন্যতা কেন তাকে আমূল গ্রাস করে নেয় বারবার?

হ্যাঁ, কামকাতর বাবরকে যখন প্রথমবার আমি দেখলাম যে, “আজ বড্ড একা একা লাগছে তার। অনেকদিন এরকম মনে হয় নি।

মনে হচ্ছে, তার ভীষণ একটা কিছু হতে যাচ্ছে; সেটা ভালো না মন্দ তা বোঝা যাচ্ছে না। ”— হঠাৎ করে তার এই একা একা লাগার ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অপ্রত্যাশিত লেগেছে। অপ্রত্যাশিত মনে হলেও ভেবেছি— হ্যাঁ, হয়তো হতেই পারে। থাকতেই পারে তার কোনো নিজস্ব নির্জনতা বা হয়তো সহসা এরকম একা একা লাগতেই পারে মানুষের।

কিন্তু একটু এগিয়ে গিয়ে যখন দেখলাম আবারো “আজ বড় একা লাগছে বাবরের।

আজ নয়, কাল থেকে একা লাগছে। কিন্তু কেন লাগছে তা এখনো বুঝতে পারেনি। ”—তখন আমার একটু কেমন যেনো খটকার মতন লেগেছে। মানে, এই শিশ্নসর্বস্ব বাবরের কাছে এমন একটা দীর্ঘশ্বাস— যা আবার বড় চাপা— একটা খটকা হয়ে ঠেকেছে। সেই খটকাটা নিয়েই এগিয়েছি।



এগুতে এগুতে যখন দেখিবাবর “অসহায়ের মত টের পেতে লাগলো সেই সব কিছু শূন্য করে তোলা অনুভূতিটা বৃহৎ থেকে কেবলি বৃহত্তর হচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠেছে আত্মা। ভেতরটা ছটফট করছে। কী করলে যে শান্ত হবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। ” তখনই চকিতে মনে হলো যে, আমার খটকাটা ঠিক।

এইখানেই গল্পটা হয়তো আছে— এই খটকায়। হয়তো শিশ্নপ্রধান বাবরের আড়ালে আছেঅন্য কোনো বাবর। হয়তো সেই বাবরই আমাদের মূল গল্প।

তারপর যখন দেখলাম “বাবর বালিশে মুখ ডুবিয়ে রইলো অনেক্ষণ। ভেতর থেকে একটা কান্না পাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই বাইরে আসছে না।

বাইরে আসছে না বলে ভীষন ভয় করছে। ভয় করছে এই ভেবে যে স্মৃতিও বুঝি তার কাছে আর যথেষ্ট নয়। ”— তখন থেকেই শিশ্নসর্বস্ব বাবরই তার দিকে সাগ্রহে ফিরতে বাধ্য করেছে আমাকে। খুঁজতে বাধ্য করেছে তার দুঃখ, তার গভীরে গোপন থাকা একাকীত্বের কারণ।

গল্পের ভেতর আরেকটু এগিয়ে যখন পেলাম: “এখন আরো একা লাগলো বাবরের।

রক্তের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তাদের কথা মনে পড়তেই এই বোধটা বিরাট হয়ে উঠেছে যে এখন তার চারপাশে এ দেশে কেউ নেই। আপন কাকে বলে সে ভুলে গেছে বলেই যারা আপন তারা তাকে এমন একা করে যাচ্ছে। ”

যখন দেখলাম, একটা অভিমানী শিশুর মত বাবর নিজেকে বলছে “আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কোনো কিছু আমার নয়।

না মাটি, না মন, না মানুষ। ” তখন বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিল আমার।

বাবর যখন বর্ধমানে ফেলে আসা লেবু গাছটার কথা ভাবে, কানা ফকিরটা বেঁচে আছে না মরে গেছে বলে হাসনু নামের কারো কাছে জানতে চায় তখন আমি অজান্তেই বাবরের ব্যাথার দোসর হয়ে ওঠি।

একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাও হাহাকারের ভেতরে গোপনে কাতড়াতে থাকা বাবরকে লক্ষ করতে করতে আমি জেনে গেছি যে, এটি কামুক বাবরের গল্প নয়। এটি সব হারানো, অভিমানী, নিজের থেকে পলাতক কোনো এক বাবরের গল্প— যে বারবার একা হয়ে যায়, যে ভোগে বিচ্ছিন্নতায়, হাজারজনের মাঝে থেকেও যে বাস করে “লোনলি ক্রাউড”-এর ভেতর।



তারপর তো গল্প এগিয়েছে। আমরা জেনেছি হাসনুর কথা। জেনেছি, সেই মেলার বিকেলের গল্প। দাঙ্গার ভয়ে মেলা ভেঙে যাবার গল্প। মেলা থেকে সন্ত্রস্ত দুই ভাই-বোন বাবর ও হাসনুর ত্রস্ত বাড়ি ফিরে আসার গল্প।

বাড়ি ফেরার পথে মাঝপথে হাসনুকে দাঙ্গাকারীদের তুলে নেবার গল্প। হাসনু যখন দাদা দাদা বলে তারস্বরে ডাকছে দাদাকে, জেনেছি, প্রাণভয়ে সেই দাদার পালিয়ে আসার গল্প। জেনেছি, দেশহারা, মাটি হারা, বাবরের আর্তনাদ। জেনেছি, ট্রামাক্রান্ত বাবরের উলটপালট হয়ে যাওয়া মনোজগত।

সৈয়দ শামসুল হককে ধন্যবাদ।

অদ্ভুত মুন্সিয়ানায়, অসাধারণ আকর্ষনীয় ভাষায়ও বর্ণনায়, বিচ্ছিন্ন এক মানুষের মনোজগতে তিনি ঘুরিয়ে এনেছেন পাঠকদের।

সমাজে থেকেও ট্রমার প্রভাবে কী করে একজন মানুষ হয়ে পড়ে সকল কিছুর প্রতি উদাসিন, অঙ্গিাকারহীন, বিচ্ছিন্ন — পরোক্ষে তারই এক সাইকো-অ্যানালাইসিস তুলে ধরেছেন হক। ঘটনার ঘাতে মানুষের মনোজগতের ভাঙচুর নিয়ে যে সাইকিক-জার্নি তিনি তৈরি করেছেন খেলারাম খেলে যা তে, তা হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী।

খেলা রাম খেলে যা একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। রাজনৈতিক কারনে, সমাজ-বাস্তবতার ঘাতে মানুষের মনোজগতে যে ঘূর্ণিপাক তৈরি হয়; হয়েছে সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় দাঙ্গামুখর সেই রক্তস্নাত বিশ্বাসহীনতার দিনগুলোতে, সেই সব কথা তিনি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য খরচ না করেই তুলে এনেছেন কামুক এক চরিত্রের ভেতর দিয়ে।



সৈয়দ শামসুল হক অবশ্য খেলারাম খেলে যা-এর গায়ে কোনো বিশেষ বিষয়ের লেবেল এঁটে দেন নি। তিনি বলেন নি যে, বিরাট ট্রমা নিয়ে সাতচল্লিশে দেশান্তরিত হওয়া এক মানুষের মনোভূমি তিনি এঁকেছেন। বলেন নি যে, তিনি সাইকো-অ্যানালাইসিস করেছেন দাঙ্গাহত, দেশহারানো এক ভিকটিমের।

কোনো কিছু না বলেই হক আমাদের টেনে নিয়েছেন ইতিহাসের মধ্যে। সব থাকার পরেও সব হারানো এক মানুষের মনোজগতের শূন্যতা, অস্থিরতা, অসুস্থতা ও বিকৃত প্রকাশের মধ্যে।



হক নিজেই বইয়ের মুখবন্ধে আমাদের জানিয়েছেন যে, মনসুরদা’র কাছে শোনা এক পলাতক দাদা আর ছোটো বোনের গল্পটিকে নিজের করোটির মধ্যে নিয়ে বহুদিন ঘুরেছেন তিনি। হক-ও যেনো পলাতক দাদা হিসেবে বারবারই শুনেছেন দাদা দাদা ডাক। সেই ডাককে অনেক দিন নিজের মধ্যে নিয়ে ঘোরার পর তিনি রচনা করলেন খেলারাম খেলে যা।

আজ থেকে ৪০ বছর আগে, ১৯৭৩-এ হক তার সময়ের চেয়ে যতটা এগিয়ে ছিলেন, আজ ৪০ বছর পরেও আমরা বোধহয় এখনো সেই ৪০ বছর আগের হক-এর চিন্তার কাছাকাছি যেতে পারি নি। পারি নি বলেই রাজনৈতিক ও সমাজ-বাস্তবতার এই দলিলকে আমরা পর্নো বা চটিবই বলতেও দ্বিধা করি নি।



কেন করি নি? বিশেষ সময়ে শরীরের বিশেষ অংশ “দপদপ” করে ওঠার বর্ণনা, বাবরের “তারাবাতি” জাহেদার হাতে ধরিয়ে দেবার বর্ণনা, “তারপর হঠাৎ সচল হয়ে দুই ঠোঁটে ব্যগ্রতার সঙ্গে সবুজ একটা অশ্বথ পাতার মতো স্তন মুখে তুলে” নেয়ার বর্ণনা, শিশ্নের মাথায় লাল লিপস্টিক মেখে দেয়ার বর্ননা পড়ে?

এই বর্ণনা কোথাও কি আরোপিত, অতিরিক্ত? এই বর্ণনা কি বাবর নামের পারভার্ট লোকটির চরিত্রটিকে একেবারেই বাস্তব আর বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে নি পাঠকের কাছে? তবে? তবে আর আপত্তি কেন?

হ্যাঁ, কেউ হয়তো বলতে পারে, এই দপদপ হবার বর্ণনা লেখক দিলো কী করে? যদি সে নিজে এমন কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না যায়? কিন্তু এই দপদপ বা তারাবাতি’র বর্ণনা দেবার জন্য তো লেখকের নিজের পারভার্ট হবার কোনো দরকার নেই। লেখক তাঁর নিজের লাভ মেকিং-এর অভিজ্ঞতার সঙ্গে লেখক-মনের কল্পনা মিশিয়ে দিয়ে পারভার্ট মানুষের শারিরীক অনুভূতির, চিন্তার কাছাকাছি যেতে পারেন।

সন্তু, খুনী বা ধর্ষক— এই চরিত্রগুলো আঁকার জন্য লেখকের নিজের সন্তু বা খুনী বা ধর্ষক হতে হয় না। শুধু গল্পের পরিস্থিতির প্রয়োজনে সন্তু, খুনী ও ধর্ষকের মতন করে ভাবতে জানতে হয়। হক সে কাজটি দূর্দান্ত দক্ষতা দিয়েই করেছেন।



হলিউডি ফিল্মের বিখ্যাত এক চরিত্র আছে। নাম তার হ্যানিবল লেকটার। যারা হ্যানিবল রাইজিং সিনেমাটি দেখেছেন তারা জানেন কেন, কী কারণে নরখাদক হয়ে উঠেছিলো হ্যানিবল লেকটার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ান সৈন্যরা হ্যানিবলের বাড়িতে আসে। বাড়ির সকলকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে।

সবাই বেরিয়ে আসে। বোঝা যায় কেউ রক্ষা পাবে না সৈন্যদের হাত থেকে। এমন সময় রাশিয়ান সৈন্যদের চিহ্নিত করে জার্মান সৈন্যদল এবং শুরু করে বোম্বিং। সেই বোম্বিং-এ লেকটারের মা-বাবা মারা যায়। তবে, ঘরের ভেতর পালিয়ে কোনো মতে বেঁচে যায় লেকটার আর তার ছোটো বোন মিশা।



কিন্তু সেই পালিয়ে বাঁচার দিনে লেকটারের ঘরের ভেতর এসে আশ্রয় নেয় রাশিয়ান সৈনিকের একটি ছোটো দল। একদিকে ভয়ংকর শীত তখন সেখানে, অন্যদিকে খাবারেরকোনো চিহ্নইনেই কোথাও। সেই অবস্থায়, নিজেদের ক্ষুধা মেটানোর জন্যে ঐ সৈনিকেরা লেকটারের ছোটো বোন মিশাকে তার সামনেই খেয়ে ফেলে। আর ঘটনাক্রমে সেসময়ও বেঁচে যায় লেকটার।

হ্যানিবল রাইজিং সিনেমায় খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, সেই দিন মিশার মৃত্যুর সাথে সাথেই মৃত্যু হয়েছিল প্রকৃত লেকটার-এরও।

আর লেকটার নামে যে শিশু বেঁচে ছিলো শৈশবের তীব্র ট্রমা নিয়ে— সেই ট্রমার ঘাতে তছনছ হয়ে গেছে তার সারাটি জীবন।

দিনে দিনে লেকটার হয়ে উঠেছে ভয়ংকর এক দানব। নিজের বোনের খুনীদের বহুবছর পর খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করেছে এবং প্রতিশোধ নেবার নেশায় সেই খুনীদের গায়ের কাঁচা মাংস শরীর থেকে পশুর মতই দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে লেকটার।

তারপর এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিশোধ নিতে নিতে হ্যানিবল একদিন মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়ে যায়। সেই মাংসের স্বাদ পেয়েই নগরে সে হয়ে উঠে সুবেশী নরখাদক।



কামুক বাবর-এর গল্পটাও কি লেকটার এর গল্পের কাছাকাছি নয়? কৈশোরের ভয়ংকর ট্রমায় তছনছ হয়ে গেছে তারও সারাটি জীবন । সিরিয়াল কিলার হ্যানিবল লেক্টরকে নিয়ে সিনেমাটি তৈরি হয়েছে ২০০৭ সালে। আর আমাদের সৈয়দ হক আজ থেকে আরো চল্লিশ বছর আগেই এঁকেছেন রাজনৈতিক ঘটনার ঘাতে বর্ধমানে জন্ম নিয়ে বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা এক মানুষের এলোমেলো হয়ে যাওয়া মনোজগতের গল্প।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর দ্বিতীয় বিশ্বোযুদ্ধোত্তর ভারতের দাঙ্গা ও বিভাজনের দশকটা একই। এক যুদ্ধে এক বোনকে হারিয়ে মানুষ-খেকো হয়ে উঠেছে এক ভাই।

আরেক দাঙ্গায় আরেক ছোটো বোনকে হারিয়ে নারীলোলুপ হয়ে উঠেছে আরেক দাদা।

হ্যানিবল রাইজিং সিনেমাটিতে অবশ্য সরাসরি কারণটা দেখানো হয়েছে। কিন্তু সৈয়দ হক সরাসরি কিছুই বলেন নি। কিছু না বললেও আমাদের বুঝে নিতে সমস্যা হয় না যে, বাবরের মনোজগত ওলট-পালট করে দিয়েছে একটি সন্ধ্যা। যে সন্ধ্যায় হাসনুকে রেখে পালিয়ে এসেছিল সে।



এই উপন্যাসে বাবর একটি কথা বারবার বলে। সেটি হলো: “তুমি কোথায় আছ? অতীতে ও ভবিষ্যতের মাঝখানে, যেখানে আগেও ছিলে, এখন আছ এবং পরেও থাকবে”।

কিন্তু বাবরের অলক্ষ্যেই বাবরের ক্ষেত্রেই তার এই কথা খাটে নি। সচেতন মনে বাবর বারবার চেষ্টা করেছে তার বর্তমানে থাকতে। কিন্তু সে পারে নি।

পারে না। কেননা তার অতীত, তার ট্রমা এতই তীব্র হয়ে রয়েছে তার অবচেতনে যে, নিজের অজান্তেই বাবর অতীতে চলে যায়; অতীতে বাস করে। আর অতীত যত তীব্র হয়, ততই আরো একাকীত্ব বাড়ে বাবরের।

অর্থাৎ “সবার সঙ্গে থেকেও সে আলাদা। যেনো সে একটা ভিন্ন সময়ের ভিন্ন জগতের মানুষ।

” কেননা একই সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে অতীত ও বর্তমানের দু’টো জগতকে সে বয়ে বেড়াচ্ছে তার মধ্যে; একই সময়ে দুটি জগতের ভেতর প্যারালাল ভাবে বাস করছে সে।

এই দূর্দান্ত রাজনৈতিক উপন্যাস, যা কি-না এক সামাজিক দলিলও বটে, তাকে আমরা যখন অশ্লীল, যৌনতার উদ্রেগকারী চটি বইয়ের সাথে তুলনা করি, একে নিষিদ্ধ করি— তখন, বলতেই হয় লেখক হিসেবে সৈয়দ হক তার চিন্তায় যতখানি এগিয়ে ছিলেন, পাঠক হিসেবে আমরা সেখানে ছিলাম না।

সকল নিন্দা মাথায় নিয়ে যদি মেনেও নিই যে, নিজের উপন্যাসের কাটতি বাড়ানোর জন্যেই যৌনতাকে প্রাধান্য দিয়ে উপন্যাস লিখেছেন তিনি, তাতেও তো খেলারাম খেলে যা-এর বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ ধোপে টেকে না!

শরীরের বর্ণনা দিয়ে, যৌনতার আশ্রয় নিয়ে সৈয়দ হক পাঠককে শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে গেছেন, কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন, সেটিই তো মূল বিবেচ্য।

একজন সেক্স-মেনিয়াককে টোপ হিসেবে ছেড়ে দিয়ে সৈয়দ হক পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন বিরাট এক ঐতিহাসিক ঘটনায়; বিপুল ঘটনাবহুল দিনে; যেই দিনগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মরেছে; লাখে লাখে লোক উদ্বাস্তু হয়ে ছেড়েছে নিজের জন্মভিটে।

একটি যুদ্ধের ঘাত, একটি দাঙ্গার ঘাত, একটি রাজনৈতিক ঘটনার ঘাত কেবলি সম্পদহানি, প্রাণহানি দিয়েই শেষ হয়ে যায় না।

যুদ্ধের, দাঙ্গার লিগেসি বহন করতে হয় বহু রকমভাবে, বহু বহু বছর ধরে। হিরোশিমা আজও সেই লিগেসি বহন করছে। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুরা সেই লিগেসি বহন করছে। ৭১-এ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়া অনেক নারীই আজও সেই লিগেসি বহন করে চলেছে।

আজকের বাংলাদেশেও, পান থেকে চুন খসার আগেই রাজনৈতিক কারণে বা সামাজিক মনস্তত্তের কারণে হিন্দুদের উপরে যখন-তখন আক্রমন করা, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করা, “মালু” বলে“আদার” করে রাখা হচ্ছে।

এই যে অস্ফুট নির্যাতন, মনোজগতে সে কি গভীর ঘাত রাখছে না? কেবল দেশান্তরি হয়ে যাওয়াতেই শেষ হয়ে যাবে সংখ্যালঘু নারীর ধর্ষনের ঘাত, নিজের ভূমিতে ধর্মের জন্যে ম্লান হয়ে থাকার ঘাত? না, অতো সহজ নয়।

২০০১ এর নির্বাচনের পর যা ঘটেছে, এইবার ২০১৩-তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে যে নির্যাতন হয়েছে তার পরিণতিতে হিন্দু সম্প্রদায় যে কেবলি “মিউটেট গ্রুপ” হয়ে থাকবে তা তো নয়। মিয়ানমারে যে সব মুসলিমকে মেরে-কেটে তছনছ করে দেয়া হচ্ছে তাদের ঘটনাও হয়তো সেখানেই শেষ হবে না।

হয়তো তাদের মধ্য থেকেই তৈরি হবে নতুন কোনো হ্যানিবল লেকটার। জন্ম হবে আরো অনেক বাবরের।

ভেতরে ভেতরে যাদের কেউ হয়তো হবে অভিমানী, কেউ হবে নিজের বাড়ির উঠোনে লাগানো লেবু গাছটার জন্য কাতর, কেউ হবে পুকুর পাড়ে দুপুরের রোদে নিত্য ডেকে ওঠা একটি ঘুঘুর জন্য ব্যাথাতুর, কেউ হবে তার শৈশবের ভূমিটির জন্য বিষন্ন। এই নতুন বাবরেরা হয়তো প্রত্যেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদবে। অথচ বাইরের মানুষ হয়তো জানবে না কোথায় তাদের ক্ষত, কেন তারা হয়ে উঠেছে লেকটারের মত এমন নির্মম; বাবরের মত এমন লোলুপ।

খেলারাম খেলে যা পড়ে কোন্ পাঠক কী নেবেন সেটি একেবারেই তার নিজের ব্যাপার। কী অসাধারণ, দূর্দান্ত রচনা শৈলীতে, ভাষার কারুকার্য দিয়ে সৈয়দ হক নির্মাণ করেছেন এই কাহিনী।

অতএব এইখানে, এই গ্রন্থের জন্য আমি কবি আবুল হোসেনের উক্তিটিকেই তুলে দেয়া জরুরি মনে করছি: “না, এটি অশ্লীল তো নয়ই বরং এর ভিতরে ষাটের দশকের আমাদের দ্রুত বিবর্তমান সমাজের একটা ছবি পাওয়া যায়। ”
উপন্যাসের শেষটিও দূর্দান্ত। একেবারেই আনপ্রেডিক্টেবল।

শেষ দৃশ্যে জাহেদাকে যখন ধর্ষণ করতে জঙ্গলের ভেতর টেনে নিয়ে গেছে গ্রামবাসী কয়েকজন, জাহেদা যখন প্রাণপনে আর্তনাদ করছে, বাবর সেই আর্তনাদে সাড়া দেয় নি। তার এই সাড়া না দেয়ায় পাঠকের রাগ আরো বেড়েছে বাবরের প্রতি।



কিন্তু বাবরের অচেতনের ভেতর ছিল আরেক বাবর। যে ছিল ব্যাথাতুর, তীব্র অপরাধবোধে ছিল লজ্জিত, ছিল বোনকে ছেড়ে পালিয়ে আসার মর্মযাতনায় মরা। তো, সেই বাবর— যে কি-না থাকে সচেতন, সুচতুর, সুদর্শন বাবরের গহীনে গোপন, সন্তর্পনে সকল হতে লুক্কায়িত সবসময়— সেই বাবর হঠাৎই বেরিয়ে আসে জাহেদার ডাক শোনে।

মূলত জাহেদার ডাক নয়, হাসনুর ডাক শোনে এক ছোট্ট কিশোর। শোনে ডাক আসছে— দাদা দাদা।

বাবর ছুটে যায় সেই ডাকের দিকে। যায় তাকে উদ্ধার করতে।

যে বাবর জাহেদাকে উদ্ধার করে এই বাবর সেই বাবর নয়। এই বাবর বর্তমানে নেই। তার শরীরটা বর্তমানে।

আর ভেতরটা অতীতে। অতীত থেকেই সে জাহেদার শরীর দিয়ে উদ্ধার করেছে হাসনুকে।

দা-এর কোপ খেয়ে আহত হয়ে, অতীত ও বর্তমানের দোলাচলে সবকিছু গুলিয়ে ফেলে গাড়ী চালাতে গিয়ে টাল সামলানো মুস্কিলই বটে। অতএব, সে সময় যে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়, গাড়ীটা যে নদীর মধ্যে নেমে যায় সেটিও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চকিতে আমার জানতে ইচ্ছে হলো, হাসনুর এই উদ্ধার কি বাবরেরও উদ্ধার?

মানে খেলারাম খেলে যা তো আসলে এক বাবরের আড়ালে দুই বাবরের গল্প।

এক বাবর ইনোসেন্ট। ট্রামাক্রান্ত। কাতর। ব্যাথাতুর। স্মৃতির দুনিয়ার বাসিন্দা।

নিজের জন্মভিটে, জন্মগ্রাম, চেনা বাতাস, চেনা ঘ্রানের জন্য যে কাঙাল। আরেক বাবর কামকাতর। সুচতুর। নারী তার কাছে প্রেমাষ্পদা নয়, শিশ্নের আনন্দের উৎসমাত্র।

এই দুই বাবরের দু’জনেই বর্তমান।

আবার একজনও বর্তমান নয়। অদৃশ্য ইনোসেন্ট বাবর, যে আছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে, তার সাথে প্রতিনিয়ত ক্ল্যাশ বা বিরোধ হচ্ছে রিয়েলিটির বাবরের। আবার সেই বিরোধের মধ্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আর রিয়েল লাইফের রিয়েলিটি মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো।

বাবরের এই বাস্তবতার সাথে এইখানে এসে মিলে যায় সেল নামে সাইকোলোজিকেল থ্রিলার ধর্মী একটি সায়েন্স ফিকশন মুভ্যির এক চরিত্রের গল্প।

সেই সিনেমায় স্টারগের নামে এক সিরিয়াল কিলারের চরিত্র আছে।

স্টারগের একজন করে তরুনীকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে আটকে রাখে ছোট্ট একটি কাঁচের ঘর বা চ্যাম্বারের ভেতর। সেই চ্যাম্বারটি ধীরে ধীরে পানি দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। বন্দী নারীটি সাহায্যের জন্য কাতরায়। কাতরাতে কাতরাতে ডুবে মরে পানিভর্তি চেম্বারের ভেতর।



একটি মেয়েকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করার ঘটনায় একদিন এই সিরিয়াল কিলারকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং ঐদিনই মাথায় আঘাতজনিত কারণে সে ক্লিনিকেলি ডেড হয়ে যায়। অর্থাৎ তার থেকে কথা আদায়ের আর কোনো উপায় থাকে না। অথচ মেয়েটিকে উদ্ধার করা দরকার। তখন সেই অবস্থায়, সেই খুনীর মনের মধ্যে বিশেষ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করানো হয় চাইল্ড সাইকোলোজিস্ট ক্যাথরিন-এর মন। মনের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে সেখানে ক্যাথরিন খুঁজতে থাকে মেয়েটিকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেই তথ্য।



মনের মধ্যে ঢোকার পর নানা রকম ঘটনা ঘটতে থাকে। সেই ঘটনার ঘনঘটায় দর্শক জানতে পায়, স্টারগের আসলে তার পিতার হাতে নিগৃহিত হওয়া এক শিশু। সারাটি শৈশব ধরে সে পিতার হাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপিড়ীত হয়েছে। এমনকি শিশুকে শাস্তি দেয়ার অভিনব প্রক্রিয়া হিসেবে— তার সৎমায়ের যৌনাঙ্গ দেখতেও তাকে বাধ্য করা হয়। জবরদস্তিমূলকভাবে সৎমাকেও বাধ্য করানো হয় শিশুটির চোখের সামনে নিজের যৌনাঙ্গ মেলে ধরার জন্য।



সেইসব নিগ্রহ ও পীড়ন, শিশু স্টারগের-এর মনোজগতকে এলোমেলো করে দিয়েছে। শিশুটি বড় হতে হতে ইনোসেন্ট অংশটিকে ছাপিয়ে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠে তার মনের ডার্ক পার্ট, তার খুনী মন।

কিন্তু মাইন্ড শেয়ারিং-মেথডলজির মাধ্যমে মাইন্ড জার্নি-তে গিয়ে বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন খুঁজে বের করে নিগৃহিত ও ব্যাথাতুর সেই শিশুটিকে। যে শিশুটি ভালোবাসা ও মমতার জন্য কাঙাল।

সিরিয়াল কিলারের মনের ভেতর মাইন্ড জার্নিতে গিয়ে হারানো সে শিশুটির প্রতি খুবই সমব্যাথী হয়ে উঠে ক্যাথরিন।

তাঁকে, সেই স্মৃতির শিশুটিকে, ইনোসেন্ট পার্টটিকে— শশ্রুষা দিয়ে, নির্ভয়, নির্ভরতা আর ভালোবাসা দিয়ে আবার ফিরিয়ে আনতে চায় ক্যাথরিন। কিন্তু সে বারবারই বাধাগ্রস্থ হয়। কেননা মনের অন্ধকার দিকটি এতই শক্তিশালী, এতই কৌশল সে জানে যে, তার কাছে বারবার পরাজিত হয় ক্যাথরিনের কৌশল। কিন্তু হিংস্র, খুনী সেই ডার্ক পার্টটিকে সে মারতেও পারছে না কারণ এই পার্টটির জীবনের সঙ্গেই বাঁধা আছে ইনোসেন্ট পার্টটির প্রাণ। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ডার্ক পার্টটিকে হত্যাই কওর ক্যাথরিন।

কেননা এছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না তার।

মাইন্ড-জার্নি থেকে বাস্তবে ফিরে এসেও সেই ইনোসেন্ট শিশুটির জন্য ক্যাথরিনের মমতা রয়ে যায়। সেই মমতা থেকেই বাস্তবের সিরিয়াল কিলার স্টারগের— যে কি-না এখন মৃত— তার পালিত কুকুরটিকে সে নিয়ে আসে তার নিজের কাছে, লালন-পালনের জন্য।

খেলারাম খেলে যা উপন্যাসেও বাবরের মনের দু’টো পার্ট। ইনোসেন্ট ও ডার্ক।

ডার্ক পার্টটির ক্ষমতা প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইনোসেন্ট পার্টটি ধীরে ধীরে আড়াল হতে-হতে বলতে গেলে একেবারে হারিয়েই গেছে বাবরের অস্তিত্ব থেকে। কিন্তু, মনোভ্রমনের মাধ্যমে লেখক সৈয়দ হক আমাদের দেখিয়েছেন যে, লম্পট, পারভার্ট এই বাবরের মাঝেও অন্য এক বাবর আছে— যে বর্ধমানের লেবু গাছটির কথা ভেবে বিষন্ন হয়, যে এলাকার কানা ফকিরটার কুশল জানতে চায়, যে অন্তহীনভাবে ডুবে আছে হারানোর বেদনায় ও হাহাকারে।

হক-এর এই মনোভ্রমণ শেষে গল্পের পরিণতিতে আমরা দেখতে পাই যে, অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে। গাড়ি নেমে গেছে সোজা নদীর ভেতর। তবে, সেই অ্যাক্সিডেন্টে বাবর মরেছে কি বেঁচেছে তা স্পষ্ট করেন নি লেখক।



ইনোসেন্ট পার্টটিকে কি রক্ষা করতে চান গল্পের বাবরের ঈশ্বর সৈয়দ শামসুল হক? যদি চান, তো কোন তরিকায় তিনি এড়াবেন বাবরের পরাক্রমশীল ডার্ক পার্টটিকে? না-কি ডার্ক পার্টটিকে কিছুতেই আর এড়াতে না পেরে— ইনোসেন্ট পার্টটির প্রতি অঢেল মমতা থাকার পরেও— নদীতে ডুবিয়ে একত্রে মেরেছেন দু’টোকেই?

এই অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে, এইখানে কি পাঠক এই ভেবে আশাবাদী হয়ে উঠবে যে, বাবর যদি বেঁচে থাকে, যদি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসে জীবনে আবার, সে এবার পরিবর্তিত মানুষ হবে? না-কি হবে ডক্টর হ্যানিবল লেক্টর? বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া হয়ে যাবার পরেও এখনো যার মুখে লেগে আছে মানুষের মাংসের স্বাদ? পাঠক কি আশা করবে, ৪০ বছর পর সৈয়দ হক এবার বাবরকে নিয়ে একটি সিকুয়াল লিখবেন?

অথবা তিনি কি লিখবেন খেলারাম খেলে যা-এর প্রিকুয়াল? যেখানে পাঠক এবার দেখবে ইনোসেন্ট বাবরের গ্রাম, তার বাড়ির উঠোনে সুবাস ছড়ানো কামিনী বা বেলি বা অন্য কোনো সুগন্ধী সাদা ফুল, বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা লেবু গাছ, কানা ফকির, হাসনু ও তার দাদার খুনসুটি, মেলার মাঠ, দাঙ্গার প্রস্তুতি?

সিকুয়াল, প্রিকুয়াল কোনোটিই না লেখলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। বাবরের পূর্বাপর জানা না জানা দিয়ে খেলারাম খেলে যা-এর কিছুই আসবে যাবে না। খেলারাম খেলে যা এক অব্যার্থ রচনা। পাঠকের অন্তরে গানের মতই এই বইয়ের রেশ রয়ে যাবে। দূর্নাম নিয়েও, চটি বইয়ের কলঙ্ক নিয়েও বাংলা সাহিত্যে খেলারাম খেলে যা নিজেই হয়ে রবে নিজের পরিচয়।



২০.১০.১৩





















অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।