আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাঁঝের হাটের আবদুল্লা/ মনোবর

জাঁদরেল এক ওসি এসেছেন এবার সাঁঝের হাট থানায়। এর আগে যে থানায় ছিলেন সেখানকার সব বাঘ গরুকে এক ঘাটে জল খাওয়ানোর অভ্যেস কায়েম করে দিয়ে এবার উনি এই থানায় এসেছেন

এঃ! কত এল আর কত গেল ! তুই যা যা! বড় বড় গল্প অন্য জায়গায় মারিস, আবদুল্লা দার সামনে যেন এসব বলে বাহাদুরি মারতে যাস নি। এই বলে নূরুদ্দীন সতর্ক করে কেলে শংকর কে। এই মালটা ইদানীং আবদুল্লার ঠেকে এসে ঘুর ঘুর করছে এবং নূরুদ্দীন ছেলেটাকে পছন্দ করেনা। একটু মোসাহেব ধরণের ছেলে আর কি!

কেলে শংকর কথাটা তেমন গায়ে মাখল না কারণ তার খবর যথাযথ আর নূরুদ্দীন তো ফ্রী চা চপ খাবার জন্য সন্ধ্যেবেলা ঠেকে এসে হাজিরা দেয়।

সেই কবে একটু মস্তানি তে নাম করেছিল সেই গল্প মেরে এখনও খাতির দাবী করে। তা কি আর হয়!

এলাকায় সৎ বলে আব্দুল্লার যথেষ্ট খ্যাতি। তাদের বৃহৎ পরিবারের মধ্যে তারই সুখ্যাতি বেশী। আবদুল্লা ব্যবসা করে যথেষ্ট রোজগার করলেও খুব টাকাকড়ি জমাতে পারে না। লোকের দায় বিপদে হাত বাড়ানো স্বভাব তার।



আবদুল্লার মহৎগুন হল সন্ধ্যেবেলা এই ঠেকে যারাই হাজির থাকবে সকলেই অন্ততঃ দু দফা চা চপ ইত্যাদি পাবে। ফলে মাঝারি ঘরটায় প্রায় কোন সন্ধ্যাতেই আসন শূন্য থাকে না। আর আবদুল্লাও তা চায় না। ন্যায় বিচার করে বলে আবদুল্লার খ্যাতি আছে আর তার জনসমর্থনের পাল্লাও বেশ ভারী। কিন্তু খানিকটা জেদী এবং রগচটা বলে তার রাজনৈতিক যোগসূত্র খুব একটা গভীর নয়।

তারই এলাকার এক লোকাল নেতা যিনি শাসক দলের সমর্থক তার ইচ্ছা আবদুল্লাকে হটিয়ে এলাকায় নিজের প্রভাব মজবুত করার। কিন্তু তার জনবল আবদুল্লার তুলনায় দুর্বল।

কেলে শংকর যে দারোগার গল্প ছড়াচ্ছে তার নাম তমাল সেন। বেশ লম্বা চওড়া মেজাজী অফিসার। থানায় আসার আগে থেকেই তিনি খোঁজ খবর করা শুরু করেছিলেন এবং স্থানীয় রজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই তিনি হুঁসিয়ারী দিয়েছেন যে ইদানীং এই থানায় যে দৌরাত্ম্য চলছে তার লাগাম ধরার জন্যই তিনি এসেছেন অতএব নেতারা যেন আশা না করেন যে তিনি সর্বদাই তাদের আবদার রাখতে পারবেন।

কথাটা শুনে স্থানীয় নেতারা গুম খেয়ে উপরমহলে খোঁজখবর শুরু করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ঠিক কি তা এখনও বিশদে জানা সম্ভব হয়নি।

সাঁঝের হাট একটি পরিপূর্ণ থানা। বিশাল এলাকা জুড়ে তার অবস্থান নানা গৌরব গাঁথায় ভরপূর। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষন, বধূহত্যা, খুন খারাপি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ এখানে প্রচুর ঘটে থাকে।

ইদানীং এই মুকুটে পালক স্বরূপ যুক্ত হয়েছে সাট্টা খেলা এবং বে-আইনি বেপরোয়া মদ ব্যবসা। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই থানায় পোষ্টিং পুলিশ বিভাগে প্রাইজ পোষ্টিং হিসাবে ধরা হয়। এবং স্বাভাবিক ভাবেই নূতন অফিসার থানায় এসেই একটু বেশী হম্বিতম্বি করে নিজের জায়গাটা পোক্ত করে নিয়ে প্রাইজ গোছানোয় মন দেন। এটা সে ধরণের একটা চাল বলে যারা মনে করেছিলেন তাদের অচিরেই ভুল ভাঙল। প্রথমেই সিনেমা হলের সামনের যে জুয়া পার্টি চাকতি জুয়া চালাত তাদের ধরে চালান করা হল।

তারপর আবগারীর সঙ্গে যোগসাজশে বেশ কয়েকটি মদের ঠেক ভেঙ্গে দেওয়া হল। একটি বধূনির্যাতন কেসে আসামীদের ছাড়াতে এসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সাংঘাতিক ভাবে অপমানিত হলেন।

আপনি কি আমাদের সুপারিশ কে গ্রাহ্যই করবেন না?
কি সুপারিশ আপনার?
আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি আপনি যাদের আসামী করেছেন তারা নির্দোষ। আসলে তাদের হেনস্থা করার জন্যই এসব ষড়যন্ত্র করে করা হয়েছে।
বেশ।

আমি আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করব আপনি যদি যথাযথ উত্তর দিতে পারেন তাহলে আপনার কথা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করব।
নেতা বিগলিত হয়ে বললেন, করুন না কত প্রশ্ন করবেন।
আসামীদের নামগুলো বলুন।
কেন? ঐ তো হাফিজুর রহমান, তার বাবা, ঐ ইয়ে নামটা পেটে আসছে মুখে আসছে না।
কি করে আসবে? আপনি তো ওদের ভাল করে চেনেনই না, তাই না?
কি বলছেন? চিনি না?
হাফিজুর রহমানের স্ত্রীর নাম কি?
ঐ তো, কি যেন, বড্ড নাম ভুলে যাই আজকাল।


আপনার বাবার নাম কি?
তার মানে?
এই ধরণের দালালি আবার যদি করতে আসেন আমি ওটা আপনাকে ভুলিয়ে দেব।
তার মানে? এটা কি ধরণের ব্যবহার?
দু মিনিট সময় দিলাম থানা ছেড়ে বের হবার জন্য, তারপর আপনাকেও আসামী করে হাজতে ঢুকিয়ে দেব।

তা বলতে নেই, গণতন্ত্রের পক্ষে লজ্জার কথা, উনি দু মিনিটের মধ্যে থানা থেকে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে চলে গিয়েছিলেন।

শুধু উনি নন, অনেক দাগী এবং উঠতি মালও দূরত্ব যথেষ্ট নিরাপদ করবার জন্য দারোগাগিরির উপর একরাশ ঘৃনা নিয়ে এই থানা ছেড়ে অন্য থানায় আস্তানা গেড়েও যখন ছাড় পেল না তখন পুলিশী আতংক সাঁঝের হাটের আড়ালে থাকা অন্ধকার জগৎ এবং উপরে ভেসে থাকা রাজনৈতিক জগৎ দুটোকেই গ্রাস করল।

এই সময় তৎপর স্বার্থান্বেষী মহল সভা, সমিতি ইত্যাদি সংবিধান সম্মত পদ্ধতিতে পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করল।

কারণ বহু তদ্বির সত্ত্বেও উপর থেকে বদলির আদেশ জারী হলনা। এই ধরণের একটি সভায় আবদুল্লা কে বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানান হল। বিনয়ী আবদুল্লা সাতপাঁচ না জেনেই মান্যগণ্য লোকের অনুরোধ রক্ষায় সভায় গিয়ে হাজির হল। সভায় পুলিশী অত্যাচারের আবেগদৃপ্ত বর্ণনা শুনে আবদুল্লা ক্রুদ্ধ হয়ে এসব সত্যি কি না তার সাকরেদ দের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা আপন আপন স্বার্থানুযায়ী সত্য মিথ্যার এক মিশ্রণ পরিবেশন করল। এইসব সাকরেদদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা চোর ডাকাত থেকে ভাল মন্দ উভয় প্রকার লোক ছিল।



সভা শেষে মানব কল্যানের অগ্রগামী সৈনিক রা আবদুল্লা কে সামনে রেখে পরদিন পুলিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার প্রস্ততি নিলেন। আসলে আবদুল্লার পতন কামী ধুরন্ধর আলিম মোল্লা এই ষড়যন্ত্রটি রচনার অন্যতম কারিগর ছিলেন। প্রস্তাব মত ঠিক হল আবদুল্লার লরি আগামীকাল রাস্তা আটকে মাল খালাস করবে কারণ সাঁঝের হাট বাজারে লরি সাইড করবার মত জায়গা নেই। অনিবার্য্য ভাবে ওসি র কানে এই খবর পৌঁছালে তিনি কনেষ্টবল পাঠাবেন এবং তাদের মেরে ভাগিয়ে দিয়ে ওস্তাদ সমাজবিরোধীরা আসরে নামবে। এরপর ঘটনা বড়সড় আকার নিলে তার দায় ওসির ঘাড়ে পড়বে এবং তার পক্ষে আর এই থানায় থাকা সম্ভব হবেনা।


কিন্তু যে কোন প্রশাসনের দক্ষতা নির্ভর করে তার আগাম পরিস্থিতির খবর পাবার মেশিনারির উপর। অতএব ধুরন্ধরদের অজান্তে ওসির কাছে পুরো পরিকল্পনার খবর চলে গেল।
পরদিন রাস্তা আটকে থাকা লরি এবং তজ্জনিত অসুবিধার কথা যথারীতি থানায় পৌঁছালে ওসি কনেষ্টবলের পরিবর্তে চারজন ব্ল্যাকক্যাট এবং রিজার্ভ ফোর্স সমেত মোট ২০ জন সশস্ত্র পুলিশের এক বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হলে সমাজ বিরোধীরা ঝুঁকি নেবার সাহস পেল না। তারা অবিলম্বে স্থানত্যাগ করে দুরতম নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাড়ি দিল।
ওসি ড্রাইভার কে নামিয়ে জানতে চাইলেন লরির মালিক কে।

ড্রাইভার আবদুল্লার নাম জানালে ওসি জানতে চাইলেন তিনি কোথায়। এই সময় ড্রাইভার নীরবতা অবলম্বন করায় ওসি তাকে সতর্ক করেন যে অবিলম্বে উত্তর না দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ড্রাইভার তার নিজের ভূমিকা যথাযথ পালন করার জন্য তেরিয়া হয়ে উত্তর দিল যে সে কোন অন্যায় করেনি এবং ওসির ক্ষমতা নেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার। এই সময় উত্তেজিত ওসি সপাটে ড্রাইভারের গালে একটি চড় কষান। ড্রাইভার কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

থানার ড্রাইভার গাড়ীটি ড্রাইভ করে থানায় নিয়ে গেলে জানজট মুক্ত হয়ে লোকচলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়।

নিরাপদ স্থানে অবস্থিত আব্দুল্লার কাছে এই খবর পৌঁছালে তার শুভানুধ্যায়ীরা এই সময় তাকে থানায় যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু আলিম মোল্লা জানান এই হল থানায় যাবার উপযুক্ত সময় কারণ একবার কেস দিয়ে দিলে ঐ গাড়ী মালসহ কতকাল থানায় পচবে তা অনিশ্চিত। তখন সাকরেদরা দাবী করে তবে আলিম নিজেও আবদুল্লার সঙ্গে যাক কিন্তু আলিম তাতে রাজী হয়না। তার যুক্তি এই ওসি তাকে জব্দ করার সুযোগ খুঁজছে তাই এই সময়ে গিয়ে তাকে সুবিধা দেওয়া যায়না।

এই প্রথম আলিমের ভূমিকা নিয়ে আবদুল্লার মনে সংশয় আসে কিন্তু সাহসী আবদুল্লা একাই থানায় চলে যায়।

সেদিন থানায় ওসির ঘরে কি নিভৃতে আলোচনা হয়েছিল তার কোন সাক্ষী পাওয়া যায় না। কয়েক ঘন্টা পর আবদুল্লা তার গাড়ীসহ থানা থেকে বেরিয়ে আসে। এই খবর শুনে আলিম মোল্লা মনে নিদারুণ আঘাত পায়। আবদুল্লার জয় জয়াকার পড়ে যায়।

দু লাখ টাকায় রফা হয়েছে এমন একটি গল্প আলিম মোল্লা ছাড়লেও কেউ তা খায়নি কারণ সবাই জানত আবদুল্লা কখনও অমন রফা করবে না। একবার এক স্থানীয় ডাকাত চা দোকানে মস্তানি করে দোকানদার কে মারধোর করায় নিরীহ দোকানদার আবদুল্লার কাছে বিচার জানায়। এই দোকানদার হিন্দু ছিল এবং অনেকেই আশা করেছিল বিচারে ডাকাতের কিছুই হবে না। কিন্তু সর্বসমক্ষে ডাকাত কে কান ধরে দোকানদারের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় এবং ভাংচূরের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

কিন্তু কি হয়েছিল সেদিন যে অমন ডাকসাইটে দারোগা আবদুল্লার ড্রাইভার সহ গাড়ীটি বিনা প্রশ্নে মুক্ত করে দিল?

এই উত্তর আবদুল্লা হজে যাবার আগে দিয়েছিল।

ততদিনে সে ঘোষণা করেছে সে রাজনীতি করবে না। আবদুল্লা তার ভক্তদের সামনে বলল তবে তোদের সেদিনের কথাটা বলি, দারোগা চেয়ার থেকে উঠে বলল, যান আমার চেয়ারে গিয়ে বসুন। আজ আপনি দারোগা, আর আমি হচ্ছি আবদুল্লা। এবার বলুন আজ আমি যা করেছি আপনি দারোগা হলে তার জন্য কি ব্যবস্থা নিতেন? ভক্তরা সব চুপ। নুরউদ্দীন আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি করলে?
আবদুল্লা বলল, বললুম, আমার এ কাজ করা উচিত হয়নি।

এবার আপনি যা করার করুন আমি আপনার চেয়ারে বসার যোগ্য নই। তারপর যা হল তোমরা তো জানো। কেস টেস কিছুই দেয়নি। বলল আপনার নাম শুনেছি। নিজের নামের উপর সুবিচার করুন ।

আপনার মধ্যে তো আমি নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি।

ভুলটা আমার বুঝলি। এসব দারোগাকে সেলাম দিতে হয়।

তা তুমি রাজনীতিতে থাকলে পাঁচটা লোকের ভাল হত সেটা ছেড়ে দিলে কেন?

ওর চেয়ে ভাল জিনিষ ধরলুম। মালিকের কাছে দোয়া করি তোদের সাচ্চাপথে রাখুক এই বলে আবদুল্লা লাজুক ভাবে হাসে।

আর আব্দুল্লা হাসলে ভক্তদের না হেসে উপায় আছে!।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।