আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বচ্ছ দেয়াল

আমি অতি সাধারণ মানুষ

[গল্পের ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা]



//১//


শীতকাল। রাত নয়টার মত বাজে। রাস্তায় মানুষজন খুব একটা নেই। এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে একটা লোককে ২০ নং রোড দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।

একটা বড় চাদর দিয়ে লোকটার পুরো শরীর ঢাকা। শীতের কারণে লোকটা কিছুটা কাঁপছে। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার কারণে তার চেহারা এই রাতের অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে লোকটা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল।

বাড়ির মালিক একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা।

তার রাজনৈতিক দল “লাল দল” এখন ক্ষমতায়। বাড়ির নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীরা লোকটার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটা বাড়ির দিকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চাদরের ভিতরে বোম লুকিয়ে রেখেছে কি? কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। লোকটা আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে।

নিরাপত্তা রক্ষীরা আসন্ন সাম্ভাব্য বিপদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

গেটের সামনে এসে লোকটা গেটে টোকা দিলো। একজন সিকিউরিটি গার্ড গেটের ওপাশ থেকে প্রশ্ন করল- কি চাই?

ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটা জবাব দিলো- আমি একটু ইকবাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করবো।

-আপনি কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন?

মাথা নাড়ল লোকটা। -না।



-তাহলে তো দেখা করা যাবে না। এত রাতে স্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারো সাথে দেখা করেন না।

-দেখুন বিষয়টা জরুরি। আমার দেখা করতেই হইব।

সিকিউরিটি গার্ড অনড়।

-সম্ভব না।

লোকটা নাছোড়বান্দা। -আমাকে দেখা করতেই হবে। আপনি বলেন গিয়া যে তার কলেজ লাইফের বন্ধু “মোটকা মতিন” তার সাথে দেখা করতে এসেছে।

সিকিউরিটি গার্ড তাও ভিতরে ঢুকল না।

কিন্তু লোকটার পুনঃ পুনঃ অনুরোধের কারণে শেষ পর্যন্ত একজন সিকিউরিটি গার্ড ভিতরে গেল।

একটু পরে সিকিউরিটি গার্ড ভিতর থেকে গেট খুলে দিলে লোকটা ভিতরে ঢুকল। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তার পুরো শরীর চেক-আপ করে দেখে গার্ডরা। তারপর একজন সিকিউরিটি গার্ড তাকে ভিতরে নিয়ে যায়।






//২//


হলের সামনের টঙের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলো রমিজ আর আরিফ, এমন সময় তারেক ভাই ঐ দোকানে এসে ঢুকল।

রমিজ আর আরিফ দুজনই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। -স্লামালাইকুম ভাই, একসাথেই সালাম দিল দুজন।

তারেক একটা সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে লাইটার দিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে বসতে বসতে বলল- ওয়ালাইকুমআস-সালাম। বসো। তোমরা ফার্স্ট ইয়ার না?

রমিজ আর আরিফ পাশের বেঞ্চটায় বসতে বসতে বলল- জ্বী ভাইয়া।



তারেক ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল-কেমন লাগছে তোমাদের? এই ভার্সিটি লাইফ?

রমিজ উত্তর দেয়- জ্বী ভাইয়া,ভাল।

-নাম কি তোমাদের?

আরিফ আর রমিজ তাদের নাম বলে।

-আমাকে চিনো? নাম জানো আমার?

রমিজ উত্তর দেয়- আপনার নাম তারেক। আপনি থার্ড ইয়ারে পড়েন।

মাথা নাড়ে তারেক।

তারপর জিজ্ঞেস করে- বাড়ি কই?

আরিফের বাড়ি ফেনী, রমিজের জামালপুর।

-ফেনী কোথায়?

-দাগনভূঁইয়া, আরিফ জবাব দেয়।

-আমার বাড়ি ছাগলনাইয়া।

-তাই নাকি ভাইয়া?

-হুম। হলে কয়জন উঠেছে ফেনীর তোমাদের সাথে?

-আছে ভাইয়া দুই-তিন জন।



-তোমরা দুইজন কি পূর্ব পরিচিত?

-হ্যাঁ ভাইয়া। আমি আর রমিজ একসাথে ঢাকা কলেজে পড়েছি।

তারেক মাথা নাড়ল। -ও। তারপর দোকানদারের দিকে ফিরে বলল- ঐ জামাল ভাই, কত হইছে বিল?

জামাল আরিফ আর রমিজকে দেখিয়ে বলল- ওগোরে শুদ্ধা?

তারেক মাথা নাড়ে।

আরিফ আর রমিজ হা হা করে উঠে। -আরে ভাইয়া আমরা দিয়ে দিবো বিল। আপনি দিয়েন না।

তারেক মৃদু ধমক দেয় ওদের। -আরে তোমরা বসো তো।

এই কত হইছে বিল?

-পাঁচ টাকা, জবাব দেয় জামাল।

তারেক বিল মিটিয়ে উঠতে উঠতে আরিফকে বলল- তুমি সন্ধ্যায় একটু আমার রুমে এসো। আমার রুম চিনো?

-না ভাইয়া।

-আমি ৩০৩ নাম্বার রুমে থাকি। তিনতলায়।



-ওকে ভাইয়া।

তারেক উঠে চলে যায়।



সন্ধ্যা ৭টার দিকে আরিফ রুম থেকে বের হয় তারেকের রুমে যাওয়ার জন্য। রমিজকে কিছুক্ষণ সাধাসাধি করেছে আসার জন্য। কিন্তু রমিজ যেতে রাজি হয়নি।

আরিফ একা একাই ৩০৩ নাম্বার রুমের দিকে রওনা হয়।

৩০৩ নাম্বার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করল আরিফ। -তারেক ভাইয়া আছেন?

-কে?

-আমি আরিফ।

-ভিতরে আসো আরিফ।

আরিফ ভিতরে ঢুকল।

রুমে ছড়ানো ছিটানো তিনটা খাট। কোনো খাটই গুছানো নয়। সবগুলো খাটের কোনায় মশারি ঝুলছে। চেয়ারের ওপর জামাকাপড়ের স্তুপ। তিনটা টেবিলেই ছাড়ানো ছিটানো বইপত্র।

রুমের দেয়ালে হলিউডের একজন বডিবিল্ডার নায়কের পোষ্টার আটকানো আছে। আরিফ মনে করতে পারল না নায়কের নাম কি। যদিও এই বডিবিল্ডারের বেশ কয়েকটা সিনেমা সে দেখেছে।

তারেক ভাই একাই রুমে ছিলেন। খাটে আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতে বসতে খাটের ওপর প্রান্তটা দেখিয়ে বললেন- বস আরিফ।



আরিফ বসতে বসতে বলল- ভাইয়া কি ঘুমাচ্ছিলেন নাকি?

-না না, ঘুমাচ্ছিলাম না। এমনি শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিলো। তাই শুয়েছিলাম একটু।

আরিফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল-তাহলে ভাইয়া আপনি রেস্ট নেন। আমি না হয় পরে আসব।



-আরে বস। তুমি আসাতে ভালই হয়েছে। রুমে কেউ নাই, তুমি আসাতে একটু গল্পগুজব করে সময় কাটানো যাবে।

আরিফ আবার খাটের কোনায় বসে পড়ল। তারেক বলল- তা তোমাদের ঐ টিনশেড রুমে কেমন লাগছে?

আরিফ মৃদু হেসে বলল- এইতো ভাইয়া!

-মাস্টার্সের পরীক্ষাতো কিছুদিনের মধ্যেই শেষ।

আগামী একমাসের মধ্যেই তারা আস্তে আস্তে হল ছাড়তে শুরু করবে। তখন তোমরা এই বিল্ডিঙে উঠবে।

-হুম।

-তা তোমার রুমমেট কে কে হবে সিলেক্ট করেছো?

-এখনো সিলেক্ট হয় নাই ভাইয়া। কথাবার্তা বলছি।



-ঐ জামালপুরের ছেলেটাও কি তোমার রুমমেট হবে নাকি?

-রমিজের কথা বলছেন? ও মনে হয় অন্য রুমে উঠবে। ওর দুজন স্কুল ফ্রেন্ড এই হলে উঠেছে। ও ওদের সাথেই থাকবে। আমি অন্য রুমে উঠব।

-ঢাকায় তোমার কোনো আত্মীয়স্বজন আছে?

আরিফ দুই সাইডে মাথা নাড়ে।

-না ভাইয়া।

আরিফ আরো আধাঘন্টা বিভিন্ন ব্যাপারে তারেক ভাইয়ের সাথে কথা বলে। তারপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে তারেক বলে- তুমি কালকে বিকালে ফ্রী আছো?

-কেন ভাইয়া?

-একটু মার্কেটে যাবো। তুমি ফ্রী থাকলে তোমাকে নিয়ে যেতাম।

আরিফ একটু চিন্তাভাবনা করে বলে-হ্যাঁ ভাইয়া, ফ্রী আছি।



-তাহলে বিকাল ৫টায় মার্কেটে যাচ্ছি।

আরিফ রুম থেকে বেড়িয়ে আসে।




পরদিন তারেক আর আরিফ নিউমার্কেটে যায়। একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট কিনে তারেক। তারপর দুজন মিলে পুরান ঢাকায় বিরানী খেতে যায়।

এখানে আগে কখনো আসেনি আরিফ। পুরান ঢাকার ঐতিয্যবাহী সুস্বাদু বিরানীর প্রশংসা খালি শুনেছে, কিন্তু কখনো খায় নি। আজকে খেয়ে বুঝতে পারছে প্রশংসাটা অমূলক নয়।

এভাবেই আস্তে আস্তে তারেক ভাইয়ের সাথে আরিফের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। প্রথম প্রথম আড়ালে সিগারেট খেলেও এখন তারেক ভাইয়ের সাথেই একসাথে সিগারেট খায়।

তারেক ভাইয়ের মারফতে আরো অনেক বড় ভাইয়ের সাথেই সখ্য গড়ে উঠে আরিফের। অনেকটা নিজের অজান্তেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পরে আরিফ।

হলের রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছুই আগে থেকে শুনেছিলো আরিফ। যেই দল ক্ষমতায় থাকে তার দলের নেতাকর্মীদের দাপট থাকে হলে। আর বিপক্ষ দলের নেতাকর্মীরা একেবারে কোণঠাসা থাকে।

রুম দখলেরও একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। যদিও এখনো সেরকম কিছু দেখছে না। হলে উঠার পর এখনো কোনো মারামারিও দেখেনি আরিফ। তবে আস্তে আস্তে যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তা বুঝতে পারছে। আর কয়েক মাস পরেই জাতীয় নির্বাচন।

এই নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলও আস্তে আস্তে নিজেদের কাজকর্ম শুরু করেছে। এতদিন যেসব নেতাকর্মী চুপচাপ ছিলো তারাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে।

রমিজের সাথে বিকালে মালেকের দোকানে নাস্তা খেতে গিয়ে আরিফের দেখা হয়ে গেল। রমিজ একা বসে বসে শিঙ্গাড়া খাচ্ছে। আরিফ রমিজের সামনে চেয়ার টেনে বসে নিজেও শিঙ্গাড়ার অর্ডার দিলো।



-কি অবস্থা রমিজ? খবর কি তোর?

-আছি দোস্ত ভালই। তোর কি খবর? শিঙ্গাড়া মুখে দিতে দিতে জবাব দেয় রমিজ।

-এইতো ভালই। তা কি বুঝছিস দেশের হালচাল?

-কেন? কি হয়েছে আবার?

-না, নির্বাচন নিয়ে তোর ভাবনা জানতে চাচ্ছিলাম আর কি।

-নির্বাচন হবে, একদল হারবে, আরেক দল জিতবে।

দ্যাটস ইট। সোজা হিসাব।

-কে জিতবে?

-তা তো বলতে পারছি না।

-শুনলাম তুই নাকি মারুফ ভাইয়ের সাথে লাল দলের কোন এক মিটিঙে গিয়েছিলি পরশু?

রমিজ মাথা নাড়ে। -হুম।



-তুইও তাইলে রাজনীতিতে ঢুকে গেলি?

-কেন আমার ঢুকতে কি কোনো মানা আছে নাকি?

ওয়েটার এসে আরিফের সামনে শিঙ্গাড়া দিয়ে গেল।

-না, মানা থাকবে কেন? কিন্তু তুই হঠাৎ লাল দলে যোগ দিলি কেন?

-মারুফ ভাইয়ের বাড়ি আমার এলাকায়। ওনার সাথে ভার্সিটি ভর্তির আগে থেকেই আমার যোগাযোগ ছিল তা তো জানিস। তাই আস্তে আস্তে ওনার সাথে মিশতে মিশতে রাজনীতিতে যোগ দিলাম আর কি!

-কিন্তু তোদের দল যদি আবার নির্বাচনে হেরে যায়?

-হেরে গেলে কি হবে?

-কথাটা খুব খারাপ শোনায়, তাও বলি, নির্বাচনে আমরা যদি জিতে যাই তাহলে তোদের সবাইকেই হল থেকে বের করে দেয়া হবে। আর আমাদের জেতার সম্ভাবনাই বেশি।



রমিজ শিঙ্গাড়া হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ আরিফের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল- তার মানে তুই আমাকে বের করে দিবি হল থেকে?

আরিফ সরাসরি কথাটার জবাব না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলে- যখন মারপিট হয়, তখন কিন্তু দোস্ত নেতারা খুব একটা মার খায় না। চেলাপেলাই বেশি মার খায়।

রমিজ আস্তে আস্তে তার শেষ শিঙ্গাড়াটা ভেঙে মুখে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল- যদি নির্বাচনের ফলাফল উল্টাটা হয় তাহলে তোদের কি অবস্থা হবে তাও একটু হিসাব করে দেখিস।

আরিফকে বসিয়ে রেখে বেড়িয়ে গেল রমিজ।




**************************


নির্বাচনের দিন রাত বারোটার দিকে হলের সামনের রাস্তায় রমিজের সাথে দেখা হয় আরিফের। আরিফের মুখ থমথমে। তার দলের অবস্থা মোটেই ভাল না। এখন পর্যন্ত যা খবর সে পেয়েছে তাতে তার দলের খুব বড় ব্যবধানেই এই নির্বাচনে পরাজয় হবে বলে বোঝা যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে সে যেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল সব মাঠে মারা যাবে।

এমনকি হলেও আর থাকতে পারবে কিনা কে জানে!

রমিজ আরিফের সামনে এসে হাসিহাসি মুখে বলল- কি অবস্থা আরিফ?

আরিফ মুখ গম্ভির রেখেই বলল- এইতো।

রমিজ আরিফের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল- দ্যাখ আরিফ, তোর সাথে কলেজ লাইফ থেকেই আমার বন্ধুত্ব। আমি খুব ভাল করেই জানি তুই কেমন। তুইও জানিস আমি কেমন। এখন হয়ত আগের মতো আর একসাথে চলাফেরা করা হয়না, তুই হয়ত রাজনীতির কারণে আমার প্রতিপক্ষ হয়ে গেছিস, কিন্তু আমি চাই না তোর কোনো ক্ষতি হোক।

তাই তোকে একটা কথা বলি। আশা করি তুই শুনবি।

আরিফ একটু অবাক হয়েই রমিজের দিকে তাকাল। -কি কথা?

-তুই আজকে রাতের মধ্যেই হল ছেড়ে চলে যা। তোর ভালর জন্যই বলছি।

আমাদের দল যে নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। যতটুকু বুঝতে পারছি কালকে তোদের সবার রুমেই হামলা চালাবে আমাদের দলের ছেলেরা। রুম দখল করবে। আমারও ওদের সাথে থাকতে হবে। তখন তোদের কাউকে হলে পেয়ে গেলে কিন্তু ওর খবরই আছে।

আমার সামনেই হয়ত তোকে মার খেতে হবে। আমি তোকে বাঁচাতে পারব না। তুই বরং আজকে রাতেই অন্য কোথাও চলে যা। আর তোর রুমের চাবিটা আমাকে দিয়ে যা। তোর জিনিসপত্র আমি যতটুকু পারি সেভ করার চেষ্টা করব।

আমি না বলা পর্যন্ত আর হলে আসিস না। এমনকি ক্যাম্পাসেও আসিস না আপাতত।

আরিফ খুব অবাক হয়ে রমিজের দিকে তাকিয়ে রইল। এ কোন রমিজ? ও কি তার প্রতিপক্ষ? প্রতিপক্ষ হলে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে কেন? নাকি ওর কলেজ জীবনের সেই বন্ধু? আরিফ মিলাতে পারে না। তবে এতটুকু বুঝতে পারে এতদিন সে আসলে মরিচিকার পিছনে দৌড়িয়েছে সুখের আশায়, শান্তির আশায়।

তার চারপাশেই অনেক সুখ-আনন্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, যা সে খুঁজে পায়নি। আর কখনো পাবে কিনা কে জানে!

আরিফের চোখ হঠাৎ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এই ভেজা চোখ রমিজকে দেখানোর ইচ্ছা তার নেই। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। একবার ধন্যবাদ বলাও হয় না।

পাছে রমিজ বুঝে যায় সে কাঁদছে।

আরিফ ধীরে ধীরে হেঁটে রমিজের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। রমিজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরিফের চলে যাওয়া দেখে। আরিফ পিছনে ফিরে তাকায় না। তাকালে হয়ত দেখত এক জোড়া অশ্রুসজল চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।







//৩//


সারা গায়ে চাদরে জড়ানো লোকটা দাঁড়িয়ে আছে ইকবাল আহমেদের স্টাডিতে। ওপাশে একটা চেয়ারে বসে আছে ইকবাল আহমেদ। রুমে আর কেউ নেই। লোকটা স্টাডিতে আসার পর ইকবাল আহমেদ দরজা ভিতর থেকে আটকিয়ে দিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসেছেন। কিন্তু লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

যেন অনুমতির অপেক্ষা করছে বসার জন্য।

ইকবাল সাহেব মুখ খুললেন- দাঁড়িয়ে আছিস কেন আরিফ? চেয়ার টেনে বয়। আর চাদর দিয়ে মুখ ঢাকার তো এখন আর কোনো প্রয়োজন দেখছি না। এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই। দাড়ি-টাড়ি রেখে এমনি তো চেহারা পুরো পাল্টে ফেলেছিস।



আরিফ গা থেকে তার চাদর সরিয়ে চেয়ার টেনে বসে।

ইকবাল সাহেব জিজ্ঞেস করেন- তা কি খবর তোর? এত রাতে হঠাৎ আমার কাছে কি প্রয়োজনে?

আরিফ মুখ খুলল- তুই খুব ভাল করেই জানিস রমিজ আমি কেন এখানে এসেছি।

রমিজ মানে ইকবাল সাহেব বললেন- তা তুই খুলেই বল না।

-দেখ আমি একটা মিথ্যা কেসে ফেঁসে গেছি। আমি কাউকে খুনের অর্ডার দিতে পারি এটা কি তুই বিশ্বাস করিস?

রমিজ খুব আস্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন- রাজনীতিতে সবই সম্ভব আরিফ।



আরিফ হঠাৎ ক্ষেপে গেল যেন। -তার মানে তুই বলতে চাস তোদের ঐ নেতাকে আমি লোক লাগিয়ে খুন করিয়েছি?

-তোর সাথে সামাদ ভাইয়ের অনেকদিন ধরেই গ্যাঞ্জাম ছিল। আর ওর পরিবারও তোকে আসামী করেই কেস করেছে।

-বিলিভ মি, আমি খুন করাইনি। আমার সাথে সামাদের গ্যাঞ্জাম ছিল এটা সত্যি, কিন্তু কখনই ওকে খুন করার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

তুই আমাকে বাঁচা। দিনরাত পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

-আমি তোকে কিভাবে বাঁচাবো?

-তোর দল এখন ক্ষমতায়। তোর নিজেরও উপরের লেভেলে অনেক কানেকশন আছে। তুই চাইলেই আমাকে বাঁচাতে পারিস।

তুই একটু চেষ্টা কর প্লিজ।

রমিজ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়াচারি করল কিছুক্ষণ। তারপর আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল- তোকে বাঁচানোর জন্য উপরের লেভেলে আমি যদি তদবির করি তার ফল কি হবে জানিস?

-কি?

-দ্যাখ আরিফ, আমি এখন ঢাকা মহানগরী লাল দলের প্রচার সম্পাদক। সামনের বার পার্লামেন্ট ইলেকশনে দাঁড়াবো। এখন যদি আমি তোকে বাঁচানোর জন্য তদবির করি তাহলে আমার পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটাই হুমকির মুখে পরে যাবে।

আমার এতদিনের সমস্ত পরিশ্রমের রেজাল্ট শূন্য হয়ে যাবে।

আরিফ নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ রমিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে- তার মানে তুই আমাকে বাঁচাবি না? এই মিথ্যা মামলায় আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে?

-আসলে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। তুই দ্যাখ.........

আরিফ রমিজকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলে- তুই আমাকে বাঁচাবি কিনা তাই বল?

-আসলে দোস্ত ব্যাপারটা হল............

-তুই আজ থেকে ১৫ বছর আগে একবার আমাকে বাঁচিয়েছিলি, মনে আছে?

-তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন আরিফ।

-অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন তা আমি জানি রমিজ।

কিন্তু মানুষ যে পুরোপুরি ভিন্ন হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি।

রমিজ কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আরিফ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে- তোকে শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি রমিজ, তুই কি আমাকে এই কেস থেকে বাঁচাবি? হ্যাঁ অথবা না?

রমিজ আগের মতই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটা সম্পূর্ণ নির্দোষ। এই মানুষটার প্রতি এখনো তার একটা আত্মার টান রয়েছে।

তাই কলেজ লাইফে পয়লা বৈশাখের ফাংশনে করা নাটকের সেই “মোটকা মতিন” যখন শুনল তার সাথে দেখা করতে এসেছে তখন তাকে ভিতরে ডেকে এনেছে। নির্দোষ এই “ফেরারি আসামী”কে পুলিশে দেয়নি এখনো। সে খুব করে চাইছে আরিফের যেন কিছু না হয়। সে যেন বেকসুর খালাস পায়। কিন্তু কাজটা সে নিজে করতে পারছে না।

একটা স্বচ্ছ দেয়াল তাদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এ দেয়ালের ভিতর দিয়ে সবকিছু দেখা যায়, কিন্তু দেয়াল টপকে অন্যপাশে যাওয়া যায় না। কালেভদ্রে কিছু অসাধারণ মানুষকে দেখা যায় যারা এই দেয়ালটা পেরিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

রমিজ কি পারবে সেই কালেভদ্রে দেখা মানুষ হতে?




উৎসর্গঃ এদেশের রাজনীতিবিদদের। আপনারা এবার মানুষ হন।




©Muhit Alam

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।