আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুলিবিদ্ধ বরকতকে দেখেছিলো ফরিদ




(১)

পান গাঁও থেকে আনুমানিক ১১ মাইল দূরের কুর্মিটোলা অর্ডন্যান্স ডিপো অফিসে যেতে হবে সাইকেল চালিয়ে।

সূর্য ওঠার আগেই কেরানীগঞ্জের পান গাঁও-এর জায়গীরদারের বাড়িতে হারিকেনের আলোয় শীতের মধ্যে বসে দু-মুঠো ঠান্ডা ও শক্ত ‘কড়কড়া’ ভাত একটু বাসী তরকারী দিয়ে খেল ফরিদ। সে কি খাওয়া যায়! ঠান্ডায় পেটের নাড়ীতে পর্যন্ত ‘টাশ’ ধরে আসে। তারপর অতি প্রত্যুষে বের হয়ে কুয়াশা ও হিমেল বাতাসের মধ্যে খেয়া নৌকায় বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে পাগলা এসে সাইকেলে উঠলো।

কার্জন হলের সামনের মোড় থেকে ‘ময়মনসিংহ গেট’-এর মধ্য দিয়ে তেজগাঁও রোড ধরে যাওয়ার কালে বাতাসের মধ্যে ঠান্ডায় দুই হাতের আঙ্গুলগুলো প্রায় সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেল।

সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় দু’হাত কোটের পকেটের মধ্যে ভরে হ্যান্ডেল সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েই সাইকেল চালাতে লাগলো। ভোরবেলায় রাস্তায় যানবাহন একেবারেই কম। তাই ওভাবে সাইকেল চালানো ওর কাছে কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে না।

সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট ও প্রতিবাদ দিবস পালণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখটি বেছে নেওয়ার কারণ এই যে আজ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আজ ঢাকায় ‘এক বিশাল বিক্ষোভ সভা’রও আয়োজন করেছে। এ পরিস্থিতিতে আইন-শৃংখলা রক্ষার খাতিরে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক গতকাল ২০ তারিখ বিকাল ৫টা থেকে সমগ্র ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে যাতে ‘‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ব অনুমতি ছাড়া মিছিল, বিক্ষোভ এবং কোন উন্মুক্ত স্থানে অথবা রাস্তায় পাঁচ বা তার বেশী সংখ্যক লোকের সমাবেশ নিষিদ্ধ’’ হয়েছে।

আগে থেকেই ভাষা আন্দোলনকারীদের প্রচারণা চলছে ২১শে ফেব্রুয়ারীর হরতাল ও বিক্ষোভ সভা সম্পর্কে। অন্যদিকে ২০শে ফেব্রুয়ারী বিকাল থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারীর প্রচারণাও চলছে খুব জোরে সোরে।



ঢাকা শহর খুব থমথমে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে অ্যাসেমব্লি হাউসে যেতে পারে এই ভয়ে মোড়ে মোড়ে পুলিশ, ই. পি. আর. মোতায়েন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, অ্যাসেমব্লি হল (জগন্নাথ হল)-এর দিকেই বেশী। ঢাকা শহরের সর্বত্রই এটাই আলোচ্য বিষয়।

ফরিদের বাড়ি উত্তরবঙ্গে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রায় দুই বছর অধ্যয়ন করার পর 1st M. B., B. S. পরীক্ষার পূর্বে পিতার মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথে মেডিকেল কলেজের একটা ছাত্রের পিছনে শক্ত আর্থিক বুনিয়াদ ও অর্থ সংস্থানের নিশ্চয়তারও মৃত্যু হওয়ায় সে আর্থিক অনটনে পতিত হলে এবং নিকটাত্মীয়দের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষুকের মত বার বার সাহায্য চেয়েও টাকার জোগাড় না করতে পারায় শুধুমাত্র টাকার অভাবে সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। ফলে গত বছর ১৯৫১ সালের নভেম্বর মাসে সে চাকরিতে যোগ দিয়েছে।

আটটার সময় সে অফিসে ঢুকলো।

অফিস চলার মধ্যে আধা ঘণ্টার ‘টিফিন’ হলো। কেউ পয়সা দিয়ে কেন্টিনে, কেউ বা ‘টিফিন বক্স’-এ আনা বাড়ির খাবার দিয়ে টিফিন করলো।

কিন্তু ফরিদের পয়সাও নেই, বাড়ির খাবারও নেই। তাই ওর প্রতিদিনের টিফিন ‘‘কী হতে গিয়েছিলাম, আর কী হলাম! এম. বি., বি. এস. ডাক্তার থেকে একেবারে নিম্নমান কেরানী!’’ কথাটা গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবা হলেও আজ সেই টিফিনও করতে পারছে না।

(২)

স্কুল-কলেজ বর্জন করে দীর্ঘ পথ হেঁটে সবাই একে একে এসে জমায়েত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। ইউনিয়ন অফিস, মধুর রেস্তোরা, পুকুরপাড়। গমগম করছে অসংখ্য কণ্ঠস্বরে।



বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সামনের রাস্তায় ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলোর নিচে অনেকগুলো পুলিশের গাড়ি সার বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে।

রাস্তায় পুলিশের কর্তারা পায়চারি করছে। আর হুকুমের অপেক্ষায় কনস্টেবলগুলো দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের রোদে চিকচিক করছে রাইফেলের নলগুলো। ইউক্যালিপ্টাসের অসংখ্য পাতা বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে নিচে।



হঠাৎ অসংখ্য কন্ঠের চিৎকারে চমকে সেদিকে তাকালো পুলিশের বড় কর্তারা। আমতলায় ছাত্রদের সভা শুরু হয়েছে।

নেতারা বলছেন, না, ১৪৪ ধারা ভাঙা যাবে না। আমরা স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চালাবো। স্বাক্ষর সংগ্রহ করেই আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাবো।



না! না!! না!!! আমরা তোমাদের কথা মানবো না।

বিশ্বাসঘাতক, এরা সব বিশ্বাসঘাতক!!
তোমাদের কথা আমরা শুনতে চাই না। আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবো। ভাঙবো! ভাঙবো!! ভাঙবো!!!
অসংখ্য কন্ঠের চিৎকারে চমকে উঠলো পুলিশের বড় কর্তারা।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।


অসংখ্য কন্ঠের গগন-বিদারি চিৎকারে দ্রুত গাড়ি থেকে নিচে নেমে এলো পুলিশের বড় কর্তারা। হুকুমের দাস সেপাইগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো রাস্তার মাঝখানে।

প্রথম দশজন ছাত্রের দল তখন তৈরি হচ্ছে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্যে। একজন ছেলে প্রথম দশজনের নাম-ঠিকানা কাগজে লিখে নিচ্ছে।
প্রচন্ড শব্দে লোহার গেটটা খুলে গেল।

পুলিশের দল আরো দু-পা এগিয়ে এল সামনে। শপথ ও সংকল্পের ইস্পাত কঠিন দীপ্তিতে উজ্জ্বল দশজন ছাত্র। দশটি মুখ। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলো আকাশের দিকে তুলে পুলিশের মুখোমুখি রাস্তায় বেরিয়ে এল।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।


সেপাইরা ছুটে এসে চক্রাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের। সবার বুকের সামনে একটা করে রাইফেলের নল চিকচিক করছে।
ইউনিয়ন অফিস।
মধুর রেস্তোরা।
আমতলা।


পুকুরপাড়।
চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠলো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
ততক্ষণে ছাত্রদের দ্বিতীয় দলটা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়।
তৃতীয় দল এল।
চতুর্থ দল এল।


সবাইকে ধরে ধরে খালি ট্রাকে তুলে নিল সেপাইরা। পুলিশের বড় কর্তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।
কত ধরবো? কত নেব জেলখানায়?
ছাত্ররা ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মত বাইরে বেরিয়ে আসছে।

সহসা ওদের চোখ-মুখ জ্বালা করে উঠলো। ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু।

দু’চোখ দিয়ে দর দর করে পানি ঝরছে। চিৎকার দিয়ে উঠলো কে যেন, কাঁদুনে গ্যাস ছেড়েছে ওরা।
ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে পুরো এলাকাটা।
১৪৪ ধারা ভাঙলো ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়াল টপকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্ররা এগিয়ে গেল মেডিকেল ব্যারাকের দিকে।


মেডিকেল ব্যারাকের উপর তখন অজস্র কাঁদুনে গ্যাসের বর্ষণ চলছে।
স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দ্বিগুণ গতি নিয়েছে।
অ্যাসেমব্লির দিকে একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে একজন ছাত্র নেতা। তার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন একজন কবি, আন্দোলন সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে। কার সাধ্য আছে একে স্তব্ধ করে দেয়?

সহসা শব্দ হলো।

গুলির শব্দ। আবার! আবার!!
মুহূর্তে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। ছাত্র। জনতা। মানুষ।


হঠাৎ কোত্থেকে যেন ছুটে এসে এক ঝলক দমকা বাতাস ধাক্কা খেল ব্যারাকের এক কোণে দাঁড়ানো আমগাছটিতে। অনেকগুলো মুকুল ঝরে পড়লো মাটিতে।
দাবানলের ন্যায় খবরটা ছড়িয়ে পড়লো পুরো শহরে।
গুলি করেছে ওরা। ওরা ছাত্রদের উপরে গুলি চালিয়েছে।


কয়জন মারা গেছে?
হয়তো একজন। কিংবা দুইজন। কিংবা কয়েকজন। অথবা অনেক, অনেক।
ঝড়ের বেগে দোকান-পাটগুলো সব বন্ধ হতে শুরু হলো।

রাস্তায় নেমে এল দোকানিরা।
কল-কারখানা বন্ধ। বাসের চাকা বন্ধ।
ট্রেনের ড্রাইভার বিকট আওয়াজে হুঁহসেল বাজিয়ে ইঞ্জিন ছেড়ে নিচে নেমে গেল।
কি ঘটেছে সে ব্যাপারে সবাই খোঁজ নিতে এগিয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।

মেডিকেলের দিকে।
এটা খুবই অন্যায়। এই অন্যায় আমরা সহ্য করবো না।
মেডিকেলের কাছাকাছি এসে জনতা এক বিশাল মিছিলে পরিণত হলো। ক্ষুব্ধ আক্রোশে ফেটে পড়ছে মানুষগুলো।


এ হত্যার বিচার চাই আমরা।
যারা খুন করেছে আমাদের ভাইদেরকে তাদের বিচার চাই আমরা।

(৩)

দিনটি একটু মেঘলা-মেঘলা গোছের, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী শীত শীত। ফরিদ চাকরি করলেও মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছাত্র ভাব তার মধ্যে এখনো পূরামাত্রায় আছে; মনে ক্ষীণ হলেও একটা আশা পোষণ করে যে কোনভাবে টাকা জোগাড় হয়ে যাবে এবং সে সামনের পরীক্ষা দেওয়ার একটা চান্স করে নিতে পারবে।

মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সে না থাকলেও ১৫/১-এ ওর সিটটা এখনো আছে; তার নিজের কেনা চৌকিটা তার সিটেই আছে।

তার সিটে আপাততঃ অন্য একজন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র থাকলেও সিট তার নামেই বরাদ্দ আছে। কলেজ ও বন্ধুদের মায়ায় এখনো সপ্তাহে দু-একদিন হোস্টেলে যায় অফিস থেকে ফেরার পথে এবং কখনো কখনো ছুটি-ছাটায় ও রবিবারেও; সব অফিসেরই সাপ্তাহিক ছুটি রবিবারেই। এখনো মনে ক্ষীণ হলেও একটা আশা আছে, যদি কোন উপায়ে 1st M. B., B. S. পরীক্ষাটা দিতে পারে!

অর্ডন্যান্স অফিস থেকে বের হয়েই ফরিদ শুনলো যে ঢাকা শহরে খুব গোলমাল চলছে পুলিশ, ই. পি. আর. ও ছাত্রদের মধ্যে। ছাত্রদের ইট-পাটকেল ও পুলিশ, ই. পি. আর. এর লাঠি ও রাইফেলের বাড়িতে বহু লোক নাকি আহত হয়েছে ও অনেক লোক নাকি গ্রেফতারও হয়েছে। গুলি-গোলা বা নিহত হওয়ার কথা ও শুনতে পেল না; ছাত্র-জনতার হাতে কোন অস্ত্র থাকার কথা তো চিন্তাই করা যায় না।



এই খবর যখন শুনলো তখন ৩টার কিছু বেশী বাজে, ওদের অফিস ছুটি হয় ৩টায়। সামনে কি ঘটে, কি না ঘটে এই ভয়ে ধীরে ধীরেই যাচ্ছে ফরিদ। শাহবাগের একটু উত্তরে হাতীরপূলের রাস্তার তে-মাথায় একটা মিলিটারী পূলিশ (M. P.)-এর চেক পোস্ট আছে। ওখানকার M. P.-দেরকে অস্বাভাবিক মাত্রায় সজাগ দেখে মনে হলো যেন সামনে সত্যি সত্যি কিছু একটা ঘটেছে। আর একটু এগুলেই দেখলো যে লোকজন সব কেমন যেন ‘তাড়া খাওয়া’ হরিণের মত যে যেভাবে পারছে দৌড়ে, রিক্সায়, সাইকেলে-ছুটে পালাচ্ছে, অনেকে রেসকোর্স-এর মধ্যে দিয়ে ওপারের দিকে দৌড়াচ্ছে।

সাইকেল থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো ফরিদ। পলায়নপররা হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে বলতে যাচ্ছে ‘‘শিগগীর পালান, পুলিশ গুলি করতে করতে আসছে-অনেক লোক মারা গেছে!’’

গুলির কোন আওয়াজ ফরিদ শুনতে পেল না এবং লোকজনের পালিয়ে আসাও যখন থেমে গেল বলে মনে হলো তখন আবার সাইকেলে উঠে আস্তে আস্তে এগুতে থাকলো এবং পরীবাগের শাহ সাহেবের বাড়ি পার হয়ে নীলক্ষেত ব্যারাকের দিকে যে রাস্তা গেছে সেই রাস্তার মোড় পর্যন্ত গেল।

ওখান থেকে কার্জন হলের দিকে আর এগুতে সাহস হলো না। ডানে ঘুরে নীলক্ষেতের দিকে যেতে থাকলো। ‘চামেলী হাউস’ (ওরা ওটাকে চামেলী হাউস-ই বলে, ওদের কাছে ‘চামেলী’ শব্দটা মেয়েদের প্রতীকস্বরূপ), ইউনিভার্সিটির মেয়েদের হোস্টেল–এর দিকে একটু এগিয়ে গেলেই আর যে রাস্তাটা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও অ্যাসেমব্লি হলের দিকে গেছে সে রাস্তায় যেতেও সাহস হলো না, কারণ সে শুনলো যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের মধ্যে পুলিশের গুলি হয়েছে এবং ‘বহু’ ছাত্র মারা গেছে।

ওখান থেকেও ডানে গিয়ে ‘চামেলী হাউস’-এর সামনে দিয়ে নীলক্ষেত ব্যারাকের দিকে গেল এবং ঐ দিক দিয়ে ঘুরে আজিমপুর কলোনিতে চলে গেল।

ফরিদের দূর সম্পর্কের ‘সাত্তার মামা’ আজিমপুর কলোনিতেই থাকেন। তার বাসায় গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ‘মারামারি’-র সঠিক খবর শোনার ও বেলা ডোবার আশায়। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের মধ্যেই যখন গুলি হয়েছে এবং বহু ছাত্রও মারা গেছে তখন বন্ধু-বান্ধবদের বিশেষ করে মঞ্জু ও রুমমেটদের জন্য খুব চিন্তাও হলো আবার ওখানে খোঁজ নিতে যেতে ভয়ও হচ্ছিলো। এদিকে মাগরিবের নামাজের ওয়াক্তও সামনে।



নামাজ পড়ে আর দেরী না করে তৎক্ষণাৎ বের হয়ে পড়লো। সোজা না এসে আজাদ অফিসের সামনে দিয়ে ‘মূক ও বধির (Deaf and Dumb)’ স্কুলের সম্মুখ হয়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা রেল লাইনের দিকে এসেছে তারই ‘লেবেল ক্রসিং’ পার হয়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের মধ্য দিয়ে যাওয়া যে রাস্তাটা হোস্টেলের দক্ষিণ দিক দিয়ে রেল লাইনের দিকে বের হয়ে গেছে সেই রাস্তা দিয়ে হোস্টেলের মধ্যে ঢুকলো। তখনো একটু ভয় ভয় থাকলেও বহু লোকজন অকুস্থলগুলো দেখতে আসছে ও দেখে যাচ্ছে বলে তাদের সঙ্গে মিশে সেও দেখতে লাগলো।

১৫/১ নাম্বার রুমটা বন্ধ দেখলো, তবে জানলো যে তার রুমমেটরা ভালো আছে এবং আরও জানলো যে মেডিকেল কলেজের কোন ছাত্র মারা যায় নি বা আহতও হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের কোনায় নাকি একজন মারা গেছে।

হোস্টেলের মধ্যেই রফিক অথবা জব্বার নামের একজনের মারা যাওয়ার জায়গা দেখলো-শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখা গেল। আরও ক’জন নাকি মারা গেছে বা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে-পুলিশ তাদের লাশ নিয়ে চলে গেছে-কোথায় এবং তারা কতজন তা জানা যায় নি। বরকত নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. ক্লাসের এক ছাত্র-সে নাকি গুলি খেয়ে রাস্তার উপর পড়ে গিয়েছিল-তাকে নাকি ধরাধরি করে প্রথমে ১২ নম্বর ব্লকের এক রুমে আনা হয় এবং সেখান থেকে তাকে নাকি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

মঞ্জুর রুমে তার দেখা পাওয়া গেল না; যে ছটফটে-কোথায় যে চলে গেছে তার ঠিক নেই; তবে ওর ব্লকমেটদের কয়েকজনের সাথে দেখা হলো, শুনলো যে ও ভালো আছে। বরকতকে ওরাই নাকি ধরাধরি করে প্রথমে ১২ নাম্বার-এ এনেছিল।

বেলা ৩-২০ এ যখন গুলিবর্ষণ হয় তখন সব ছাত্র হোস্টেলেই ছিল। সাইকেলটা ‘আলী মিয়ার হোটেলে’-আলী মিয়ার হেফাজতে রেখে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো।

আহত বরকতকে দেখলো। লম্বা ছিপছিপে সে-বয়স ফরিদের চেয়ে বেশীই। জবান নেই, সেলাইন দেওয়া আছে; তার নাকি ডান উরুতে গুলি লেগেছিল।

একটাই, তবে তা Femoral Artery ছিঁড়ে ফেলেছে-যার ফলে এত রক্ত পড়েছে যে তার শরীরে রক্ত বলতে আর কিছুই একরূপ নেই বলা যায়। মেডিকেল কলেজে এখনো Blood Bank-ই হয় নি এবং রক্তদানেরও কোন ব্যবস্থা নেই। অনেকেই বলছিল যে সে মনে হয় বাঁচবে না।

আরও কয়েকজন আহতকে দেখলো; তাদেরও চিকিৎসা চলছিল।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সাইকেলটা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের পথে রওয়ানা হলো ফরিদ।

ওর পুরো নাম মোঃ আব্দুল ওয়াহাব। হল-হোস্টেলগুলোতে ঘটনার পর থেকেই মাইকযোগে যে কোরান তেলাওয়াত ও সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ধিক্কার এবং নুরুল আমীনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা চলছিল-পিছনে তা ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে হতে একসময়ে আর শোনা গেল না। নুরুল আমীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী; তার ছেলে মেডিকেল কলেজে ফরিদের সহপাঠী।

অফিস করে প্রতিদিন সে সাইকেলে ওঠে এবং ডাইনে বাঁয়ে না তাকিয়ে সকালে যে পথে আসে সেই পথ, ঢাকার কেন্দ্র ও ব্যস্ততম এলাকা নবাবপুর রাস্তা ধরে ফিরে যায়। পান গাঁও পৌঁছুতে প্রায় সাড়ে ৪টা বেজে যায়, শীতের দিনে যা প্রায় বেলা ডোবার সময়।

তখন আর কিছু খায় না, খিদের জ্বালা প্রায় অসহ্য হলেও! খায় একেবারে রাত্রে। কিন্তু আজ পেটও যেন খাওয়ার কথা ভুলে গেছে।

সাইকেলে যেতে যেতে গত কয়েক বছরের কথা তার মনে পড়লো।

(৪)

সাধারণ ছাত্রদের সহায়তায় রাষ্ট্রভাষার দাবী একটা ব্যাপকতর স্বীকৃতি পেতে শুরু করে এবং ১৯৪৭ সাল শেষ হওয়ার মধ্যেই তা একটা প্রায় গণ আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করতে থাকে। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে কয়েকটি ছাত্র ও অছাত্র সংগঠন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

পাকিস্তানের গণ পরিষদেও বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সে দাবী গণ পরিষদ প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই সময়েই কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র ঢাকা সফরের কথা হয় এবং ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ তার ঢাকা আসার কথা ঠিক হয়। তাই কায়েদে আজমের ঢাকা আসার পূর্বক্ষণে সরকারের উপর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে একটা চাপ সৃষ্টি করার মানসে সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে গণ পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রত্যাখান করার প্রতিবাদে ১১ই মার্চ একটা সাধারণ ধর্মঘট ও প্রতিবাদ দিবস পালণ করে। সরকার শক্তি প্রয়োগে এই ধর্মঘট বন্ধ করার চেষ্টা করলে যে সংঘর্ষ হয় তাতে বহু লোক আহত এবং আরো অনেক লোক গ্রেফতারও হয়।

এতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানীরাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কায়েদে আজমের ঢাকা আগমনের ঠিক পূর্বক্ষণে পরিস্থিতি এহেন গোলমেলে হয়ে যাওয়ায় সরকার বিব্রত হয়ে পড়ে। কারণ কায়েদে আজম এসে যদি সবকিছু এরূপ গোলমেলে দেখেন তাহলে তা সরকারের পক্ষে খুব দোষের কথা হবে। তাই পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাজিমুদ্দীন সরকার তড়িঘড়ি সকলের সঙ্গে একটা আপোষ করেন। এতে ঠিক হয় যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার ব্যবস্থা করা হবে এবং যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের সকলকেই ছেড়ে দেওয়া হবে এবং এই ধরণের আরো অনেক কিছু।



১৯শে মার্চ কায়েদে আজম ঢাকার মাটিতে পদার্পণ করার আগেই সব কিছু শান্ত হয়ে গেল এবং ছাত্ররাও পরম উৎসাহে কায়েদে আজমকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তেজগাঁও বিমান বন্দরে গিয়েছিল; ফরিদও গিয়েছিল। তবে সে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে না গিয়ে পুরনো ঢাকার যে বাড়িতে সে থেকে পড়াশোনা করতো সেই বাড়ির মালিকের ছেলে জনাব তফিজ মিয়ার সাথে জীপে চড়ে গিয়েছিল। সেদিন বিকালে কাল বৈশাখীর ঝড় ও বেশ বৃষ্টিও হয়েছিল। ঝড়ের সময় ওরা কাকরাইল মসজিদের মধ্যে ছিল; তখন কাকরাইল মসজিদ ছিল চৌদ্দ-পনের হাত একটা টিনের ঘরে।

ঝড়-বৃষ্টির পরে বেলা ডোবার অল্প পূর্বে কায়েদে আজমের বিমানটি রানওয়ের একেবারে উত্তর মাথায় ভূমি স্পর্শ করেছিল এবং মেঘমুক্ত ও রৌদ্র-করোজ্বল পরিবেশে বিমানের চাকাগুলো যখন রানওয়েতে নেমেছিল তখন রানওয়েতে জমে থাকা পানি যে কী রূপ সুন্দরভাবে দু-দিকে ছিটকে পড়েছিল সে দৃশ্য ওর এখনো মনে আছে।

তারপর রানওয়ের উপর দিয়ে এসে প্লেনটা ওদের সামনে দিয়ে ঘুরে উত্তর মুখে চলে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থেমেছিল; ওরা রানওয়ের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লোক চারদিক থেকে ছুটে গিয়ে বিমানটিকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল যে পুলিশ-মিলিটারী তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। ওরূপ অবস্থায় কায়েদে আজমকে দেখতে পারা অসম্ভব ভেবে ওরা আগে ভাগেই জীপ চালিয়ে বাসায় চলে এসেছিল-ফিরতি মানুষের ভীড় শুরু হওয়ার আগেই। ঐ দিনই ওর নতুন হাতঘড়িটা কিভাবে যেন হারিয়ে গিয়েছিল।

২১শে মার্চ তারিখে রেসকোর্সের ময়দানে কায়েদে আজমের জনসভা।

তখন রেসকোর্স ময়দান খোলা ময়দানই ছিল-মাঝখানের রমনা মন্দির ও কালীবাড়ি ছাড়া। চারদিক দিয়ে কাঠের রেলিং করা যে চওড়া প্যাসেজ ছিল তার মধ্যে দিয়েই ঘোড় দৌড় হত, খুব সম্ভব প্রতি শনিবারে এই দৌড় হত এবং এতে বিরাট সব টাকার বাজী খেলা হত।

রেসকোর্সের একেবারে উত্তরে ঢাকা ক্লাবের দিকের একটি উঁচু পাহাড়ের মত জায়গা ও একটি বটগাছের সামনে অর্থাৎ দক্ষিণে বক্তৃতা মঞ্চ করা হয়েছিল মাথার উপরে চাঁদোয়া দিয়ে। সমস্ত ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য; মধ্যে মধ্যে বাঁশের খুঁটি পূঁতে সে সবের সাথে কত যে মাইক বাঁধা হয়েছিল তার আর ইয়ত্তা নেই। মুহুর্মুহু করতালি আর ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে জিন্নাহ সাহেব মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং চারদিক ঘুরে ঘুরে হাসিমুখে হাত নেড়ে নেড়ে জনগণের অভিবাদন ও অভিনন্দন গ্রহণ করেছিলেন।

ছিপছিপে পাতলা গড়নের দীর্ঘদেহী ও ‘জিন্নাহ ক্যাপ’ পরিহিত জিন্নাহ সাহেবকে সেদিনই সামনা-সামনি ফরিদ দেখেছিল, ওরা মঞ্চের খুব কাছাকাছিই ছিল। তারপর এক সময়ে জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা শুরু হয়েছিল। সহজবোধ্য ইংরেজিতে, অতিশয় স্পষ্ট উচ্চারণে ধীরে ধীরে ও টেনে টেনে তিনি কথা বলতেন এক ভাবে-এক স্বরে; কোন আবেগ বা উচ্ছাস বিবর্জিতভাবে। প্রত্যেকটা বাক্যের শেষের দিকে ডান হাত একটু উপরে তুলে ধীরে ধীরে নামানোর অভ্যাস তার ছিল-যেন তিনি কথার ভারটা তার শ্রোতাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। শ্রোতারা যে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার বক্তৃতা শুনছিল এবং সমগ্র ময়দানে প্রায় ‘পিন পতন নীরবতা’ বিরাজ করছিল তা ওর মনে আছে।



বক্তৃতার এক পর্যায়ে যখন রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গ এসেছিল তখন ওরা ছাত্ররা অত্যন্ত উন্মুখ হয়ে এবং নড়ে চড়ে বসেছিল। ওরা ঢাকা কলেজের ছাত্ররা সব এক জায়গাতেই ছিল। ওদের সামনেই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আশে পাশে ছিল মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ও কলেজ, মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল, জগন্নাথ কলেজ এবং অন্যান্য স্কুলের ছাত্রবৃন্দ; তখন ঢাকায় অন্য কোন কলেজ ছিল না। মেয়েদের জন্য একটাই মাত্র কলেজ ছিল-ইডেন কলেজ।

অর্থাৎ ওরা ছাত্ররা সব এক জায়গা দিয়েই বসেছিল; মেয়েরা কোনদিক ছিল তা ওর মনে নেই।

যাহোক, বক্তৃতার মধ্যে যখন রাষ্ট্রভাষার কথা এসেছিল তখন জিন্নাহ সাহেব সম্ভবতঃ ‘Every Nation has got a State Language of its own’-ধরণের একটা কথা বলে নিয়ে যে অত্যন্ত ভর দিয়ে ‘‘And in Pakistan it shall be Urdu’’ কথা ক’টি বলেছিলেন এবং ‘‘--- it shall be Urdu’’ কথা ক’টি উচ্চারণের সময় নিজের দেহের ঊর্ধ্বাংশ একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়েছিলেন এবং তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে ডান হাতটাও একটু উপরে তুলে ধীরে ধীরে এবং ভর দিয়ে নীচে নামিয়েছিলেন এবং এর দ্বারা তিনি যেন রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে উপস্থিত শ্রোতাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলেন তা ওর খুব মনে আছে। ২৪শে মার্চ তারিখে কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে তিনি বলে থাকতে পারেন যে, ‘‘Urdu and only Urdu shall be State Language of Pakistan’’। কিন্তু ফরিদ সেখানে উপস্থিত ছিল না। রেসকোর্সের সভায় তার মুখ থেকে ‘‘--- it shall be Urdu’’ বের হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, তারপর ওরা এবং আশেপাশের সমস্ত ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে ‘‘No, No’’ এবং কতক কতক ‘‘No, No’’-এর সঙ্গে ‘‘Shame, Shame’’ বলেও চিৎকার করে উঠেছিল এবং হাত নেড়ে বাস্তবেও ‘‘No, No’’-এর ইশারা দেখিয়েছিল। ভাব দেখে কায়েদে আজম তৎক্ষণাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ায় ছাত্ররা বসে পড়ে এবং ওরাও বসে পড়ে।



দু’দিন পর ২৪ তারিখে কার্জন হলের সমাবর্তন সভাতেও তিনি ‘‘Urdu and only Urdu shall be State Language of Pakistan’’ বলে ঘোষণা দিলে ছাত্ররা একইভাবে ‘‘No, No’’ বলে প্রতিবাদ করেছিল। কারণ কায়েদে আজমের এ ঘোষণা ছিল ১৫ই মার্চে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন কৃত চুক্তির সম্পূর্ণ বরখেলাপ। ছাত্ররা এটা মেনে নিতে পারে নি।

এরপর রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়া হয়েছিল প্রতিবছর ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষার দাবী দিবস হিসাবে পালনের মাধ্যমে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে দুইটি ঘটনা ঘটে যা ভাষা সংগ্রামকে আরও গতিবেগ প্রদান করে।

এর প্রথমটি হচ্ছে, ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আকস্মিক মৃত্যু এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এর মাত্র তিন বছর পর ১৯৫১ সালের ৩রা অক্টোবর তারিখে রাওয়ালপিন্ডির প্রকাশ্য জনসভায় আততায়ীর গুলিতে কায়েদে আজমের দক্ষিণ হস্ত এবং পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কায়েদে মিল্লাত নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু। যে দু’জন ব্যক্তিত্বের মোকাবেলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হতে পারছিল না, মাত্র তিন বছর সময়ের মধ্যে তাদের দু’জনেরই পরলোকগমন ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করে।

অবশেষে ১৯৫২ সালে এসে ভাষা সমস্যাটা আবার তাজা হয়ে ওঠে এবং তা করেন পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেবই। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা যে কথাটি দু-একবার উচ্চারণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মনোভাবের কথা আঁচ করতে পেরে জীবনে আর কখনো সে কথা বলেন নি, লিয়াকত আলী খানের মত ব্যক্তিত্ব যে উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার কথা বলেন নি বা তা করার সাহস পান নি, খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার সেই কথাটিই নতুন করে বললেন এবং সেই দুঃসাহসিক কাজটিই করতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারী তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

’’ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ তারিখে কায়েদে আজমের ঢাকা আগমনের ঠিক পূর্বলগ্নে ১৫ই মার্চ তারিখে যে নাজিমুদ্দিন সাহেব ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের’ সঙ্গে যে আট দফার আপোষ রফা করেন এবং প্রথম দু’টি দফা ছিল ‘‘প্রাদেশিক পরিষদে প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করা’’ এবং ‘‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে সুপারিশ করা’’ এবং যে সব দফা তিনি মেনেও নিয়েছিলেন এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদও ধৈর্যধারণ ও আশা করেই ছিল যে যথাসময়ে সরকার সে সব ওয়াদা কার্যকরও করবেন, সেই নাজিমুদ্দীন সাহেবই যখন সেই সব ওয়াদা সম্পূর্ণ ভঙ্গ করে প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’’, তখন তার এই ঘোষণা রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবীর আপাতঃ স্তিমিত আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো এবং প্রজ্বলিত ‘‘সে আগুন ছড়িয়ে পড়লো সবখানে’’-সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ৩০শে জানুয়ারী তারিখে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরী হলে জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা করা হয় এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে পুনর্গঠিত করা হয়।

(৫)


পরদিন ১৯৫২ এর ২২শে ফেব্রুয়ারী ফরিদ অফিসে গেল যথারীতিই। গিয়েই বিভিন্নরকম জল্পনা-কল্পনা শুনতে পেল। এ কথাও জানতে পারলো যে বরকত নামের যে ছাত্রকে সে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল সে মারা গেছে।

খুব দুঃখ অনুভব করলো ফরিদ।

গতকাল বেলা ১১টার পর থেকে ৩-২০ মিনিট পর্যন্ত ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে ইট-পাটকেল ছোঁড়া-ছুঁড়ি, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ ইত্যাদি উপায়ে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রায় পরাজয়ের মুখে এসে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং এতে নাকি বেশ কিছু ছাত্র সহ বহু লোক হতাহত হয়।

পাঁচজন থেকে হাজার হাজার পর্যন্ত হতাহতের সংখ্যা সম্বলিত বিভিন্ন কথা বিভিন্ন জনের মুখ থেকে শুনতে পেল সে, তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে কেউ দেখেছে-এমন কি ঘটনার পরেও-এমন কেউই নেই।

আসলে গুলি চালানো এবং পাবলিককে মারার কাজটি তো ভালো নয়-খুব খারাপই। তাই অফিসে সে কাজ খুব একটা করতে পারলো না ভালোভাবে।

ছুটির পর ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে গেল। মঞ্জু ও রুমমেটদের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে-গতকাল তাদের সাথে দেখা হয় নি। তবে শুনেছিল যে তারা ভালো আছে; সেটাই একটা শান্তি ও সান্তনা। আজ আর তাই ওদিকে গেল না-মনের মধ্যে যাবার একটা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। মেডিকেল কলেজ ডাইনে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ বাঁয়ে রেখে রশীদ বিল্ডিং-ও ডাইনে রেখে রেডিও অফিসের দিকে যে রাস্তাটা গেছে রেল লাইন পার হয়ে সেই রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে নিমতলী দিয়ে কায়াতটুলী এবং আগামসী লেন দিয়ে ফুলবাড়িয়া রোডে উঠে শূলসুধায় গিয়ে পৌঁছালো।

ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালীন সে ঐ বাড়িতেই থাকতো।

শূলসুধাতেও ঐ একই ধরণের সব জল্পনা-কল্পনা শুনলো-গতকালের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ড সম্পর্কে। ওখানেও হতাহতের সংখ্যা পাঁচ থেকে শুরু করে অসংখ্য বলে শুনলো-সঠিক সংখ্যা যে কত তার আর ঠিক নেই। এখানেও দেখলো-আজ পর্যন্তও ঘটনাস্থলেও কেউই যায় নি-সবই শোনা কথা বা গুজবের উপর যার যার মন্তব্য করে যাচ্ছে। শূলসুধাতেও খুব ভালো লাগলো না।

মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অশান্তি, আতংক আর ভয়-ভয় করছিল। আগের দিন পান গাঁও যেতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল; তাই আজ আর মোটেই রাত করলো না; মাগরিবের নামাজের আগেই রওয়ানা হলো।

পরদিন ২৩শে ফেব্রুয়ারী। ভালো লাগছে না। ঘটনার পর বন্ধু-বান্ধব, বিশেষ করে মঞ্জুর সাথেও দেখা না হওয়ায় মন খুবই খারাপ।

তাই বিশেষভাবে মঞ্জুর সাথে দেখা করার জন্যই ঢাকা রওয়ানা হলো।

বেলা এগারটার দিকে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে পৌঁছে দেখলো, তথায় বহু ছাত্র-জনতার ভীড়। শুনলো যে শহীদ মিনারের উদ্বোধন হবে; উদ্বোধন করবেন আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামছুদ্দীন সাহেব। আগের দিনই শুনেছিল যে জনাব আবুল কালাম শামছুদ্দীন সাহেব ঢাকার এই ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। রুমমেটদের বা মঞ্জুর-কারও সঙ্গেই দেখা হলো না।

ইট দিয়ে একটা শহীদ মিনার করা হয়েছে দেখলো; চারদিক সুতলি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। শামছুদ্দীন সাহেব এসে শহীদ মিনার উদ্বোধন করলেন একটা শোকাহত ভাবগম্ভীর পরিবেশের মধ্যে। আগে তিনি ছোট্ট একটু বক্তৃতা দিলেন। সঙ্গে সাইকেল আছে বলে ভীড়ের মধ্যে খুব একটা কাছে ঘেঁষে যেতে পারলো না ফরিদ, সুতরাং বক্তৃতায় তিনি কি সব কথা বললেন তা ভালো করে শুনতেই পারলো না। তবে তিনি যে উচ্ছাসে প্রায় কেঁদে ফেললেন এবং উপস্থিত অনেকের অবস্থাই যে প্রায় তদ্রূপই হলো তা সে দেখতে পেল এবং ওর অবস্থাও সেরূপই হলো।

সাদা পায়জামা ও কালো শেরওয়ানী পরিহিত শামছুদ্দীন সাহেবের চেহারা মনে গেঁথে গেল।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর আর বিশেষ দেরী করলো না, সোজা জায়গীর বাড়ি চলে গেল।

শহীদ মিনারটি ঐ দিনই পুলিশ ভেঙ্গে দিল।

দুই দিন আগের হত্যাকান্ডের ঘটনাটিতে মন খুবই খারাপ হয়ে গেছে ফরিদের। কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছে না।

চাকরি-বাকরি, অফিস কিছুই ভালো লাগছে না। এমনিতেই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওর মনের উপর সব সময়ে একটা চরম হতাশা ও অশান্তি বিরাজ করছে-তার উপর এই একুশের হত্যাকান্ড! যদিও ও এখন নিয়মিত ছাত্র না কিন্তু তবুও এখনো সে নিজেকে একজন অছাত্র ভাবতে পারছে না। মনের কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আশা এখনো আছে যে হয়তো আবার ও পরীক্ষা দিতে পারবে-হয়তো আবার কোনদিন ডাক্তার হবে। মানুষের ব্যর্থতারও তো একটা ইতিহাস ও সীমা থাকে। তাই কয়েক বছর আগে ১৯৪৮ সালে সে ঢাকা কলেজ থেকে আই. এস-সি. তে ২৮ তম স্থান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র হিসাবে জীবন শুরু করেছিল বলে আবার পরীক্ষা দেওয়ার আশা আসলে সে ছাড়তে পারছে না।

সে কারণে ছাত্রদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ভাবে, ছাত্রদের উপর গুলিকে নিজের উপর গুলি বলে মনে করে; রাগে-দুঃখে মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যারা গুলি চালায়, গুলি করে যারা ছাত্র হত্যা করে, মানুষ হত্যা করে, কেড়ে নিতে চায় তাদের মাতৃভাষাকে, সেইসব পুলিশ, ই. পি. আর. ও মিলিটারীদের উপরই মন অত্যন্ত ক্ষেপে ওঠে, মিলিটারী অফিসে চাকরি করাটাই একটা অপরাধ-ছাত্র সমাজ, তথা বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র মানুষের সঙ্গে একটা বিশ্বাস ঘাতকতা বলে মনে হয়; ইচ্ছা হয়, এই মুহূর্তে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে আসে ঐ মিলিটারী, ঐ রাইফেলধারীদের অফিস থেকে।

এরপর আর বেশিদিন ফরিদ ঐ চাকরি করলো না। ২১শে ফেব্রুয়ারীর বেদনাদায়ক ও ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি নিয়ে ১৯৫২ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহেই সে চাকরি ছেড়ে দিল।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.