আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাচন কেমন ভোটকেন্দ্রেই তা দেখা যায়

সময় কত বড় নিয়ামক ব্যাপার! সে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা। ১৬ আগস্ট ধলাপাড়ার মাকরাইয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে হাতে-পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। দুষ্কৃতকারী কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়া যুদ্ধে মারা গেছে রটিয়ে মিষ্টি খেয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার এবং তার দোসররা। যদিও তাদের সে সাধ পূর্ণ হয়নি। আজও আমি বেঁচে আছি।

আবার প্রায় হানাদারদের মতোই দেখলাম ২৬ ফেব্রুয়ারি সখীপুর-বাসাইল উপনির্বাচনে মিথ্যা অজুহাতে রিটার্নিং অফিসার আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করায় নব্য আওয়ামী লীগাররা মিষ্টি খেয়েছে। তারা একবারও ভাবেনি আমি না হলে আজকের আওয়ামী লীগ কবরে থাকত। ওয়ান-ইলেভেনের সময় জনাব শাজাহান সিরাজের শাস্তির খবরে বিএনপির এক অংশ কালিহাতীতে মিষ্টি খেয়েছিল। কি চমৎকার মিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অমঙ্গলে হানাদার এবং তার সহযোগীরা খুশি হতো, মিষ্টি খেত, এখনো সরকার পক্ষ মিষ্টি খায়।

স্বার্থের চেহারা সব সময়ই এক।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিছু বনিবনা না হওয়ায় '৯৯ সালের ২৯ আগস্ট সখীপুর-বাসাইলের সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করেছিলাম। ১৫ নভেম্বর সেখানে উপনির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে ইতিহাসের এক জঘন্য ভোট ডাকাতি হয়। তখনকার চিফ ইলেকশন কমিশনার আবু হেনা ফলাফল প্রকাশ না করে কারচুপি তদন্তের আদেশ দেন। সেই তদন্ত এবং হাইকোর্টে মামলা চলে অনেক দিন।

৫ জানুয়ারি ২০১৪ ছিল একটি জাতীয় নির্বাচনী প্রহসন। এতে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারাও জানেন এবং বোঝেন। জাতীয় অগ্রগতি এবং সুস্থির প্রশ্নে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দেশবাসী আশা করে। যত তাড়াতাড়ি তা হবে ততই মঙ্গল। ২০ জানুয়ারি টাঙ্গাইল-৮ আসন মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য হয়।

যে সখীপুর-বাসাইল উপনির্বাচনের মাধ্যমে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম, আবার সে আসনের উপনির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে যতসব ভানুমতির খেল।

মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন সাতজন। একজনের নির্বাচনী আয়-ব্যয়ের বিবরণী ছিল না, যা পরে ঠিক করে দেওয়া হয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর দলের সাদেক সিদ্দিকীর মনোনয়নপত্রে অন্যের স্বাক্ষর ছিল, এমনকি বেশ কিছু কাগজপত্র ছিল না।

তাকে ঢাকার পথে কালিয়াকৈর থেকে ফিরিয়ে নিয়ে ঠিক করা হয়। অথচ এই ভদ্রলোক ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রধানমন্ত্রীকে অপমান-অপদস্ত করতে এমন কোনো কাজ ছিল না যা করেনি। অন্যদিকে সাঈদ আজাদের হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় তা বাতিল করা হয়েছে। অথচ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, ছোটখাটো ভুলের জন্য কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল হবে না। সাধারণত নোটারি বা ম্যাজিস্ট্রেটের দ্বারা যেসব এফিডেভিট করা হয় তাতে স্বাক্ষর আছে কি নেই তা তারাই দেখেন।

তাছাড়া মনোনয়ন জমা নেওয়ার সময় রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং অফিসার দেখে সংশোধন করে দেন। সর্বোপরি যাচাই-বাছাইয়ের সময়ও ওসব ছোটখাটো ত্রুটি ঠিকঠাক করে দেওয়া হয়। জানি না কোন অদৃশ্য কারণে এসব হচ্ছে, সরকারের গোচরে না অগোচরে কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে গামছার মনোনয়ন বাতিল শুনে, যে পাহাড়ের বীরেরা অবলীলায় পাকিস্তানি হানাদারদের মোকাবিলা করেছে তাদের সন্তানরা কেঁদে কেটে অস্থির। শুনেছি পর দিন যে উপজেলা নির্বাচন ছিল তাতেও নাকি অনেকে ভোট দিতে যাননি।

তাতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। দলীয় প্রার্থীর পরাজয়। উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দলের জয়ের জন্য এটা একটা কৌশলও হতে পারে। তা যাই হোক আমার নির্বাচন বাতিল হওয়া নির্বাচনী এলাকায় একটা বিরাট প্রভাব পড়েছে। কেউ বলছে, কাদের সিদ্দিকীকে সরকার সংসদে যেতে দিতে চায় না তাই নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

হতেও পারে। আবার অন্য ষড়যন্ত্রও হতে পারে। এখনো আমার কাছে সব কিছু স্পষ্ট নয়। তবে যা কিছু হোক নির্বাচনকেও আমরা সংগ্রামের একটা অংশ হিসেবেই বিবেচনা করব। ২৭ ফেব্রুয়ারি ছিল দ্বিতীয় পর্বের উপজেলা নির্বাচন।

এ দিনে টাঙ্গাইলে একমাত্র সখীপুর উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে। দু'একটি ঘটনা ছাড়া নির্বাচন ভালো হয়েছে। জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত শওকত শিকদার। কারচুপির জামানায় বিনাভোটের নির্বাচনের যুগে নিজের চোখে দেখে এ নির্বাচনকে ভালো হয়নি বলতে পারছি না। যদিও অন্য অনেক স্থানে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে।

নির্বাচনের দিন নিজে সখীপুরে না থাকলে হয়তো অন্যদের মতো বলতাম, প্রভাব খাটানো হয়েছে, কারচুপি হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তুমি যা দেখ তাই বল। সে জন্য বলছি, ২৭ ফেব্রুয়ারি সখীপুর উপজেলা নির্বাচনে অল্প কয়েকটি ছাড়া কোনো ভোটকেন্দ্রে জালিয়াতি, কোনো দলের প্রভাব অথবা বাইরের শক্তি প্রয়োগের ঘটনা আমার চোখে পড়েনি। বলতে গেলে প্রভাবহীনভাবে ভোটাররা ভোট দিয়েছে। কে কত টাকা খরচ করেছে, রাতে কাকে কে কি দিয়েছে সেটা ভিন্ন কথা।

তবে কেন্দ্রে তেমন কোনো জাল ভোট পড়েনি, কালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল এবং তার ছেলে সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য চাঁদ দু-একটি কেন্দ্র জোরজবরদস্তি করার চেষ্টা ছাড়া আর কেউ কোথাও কোনো প্রভাব বা জোরজুলুম করতে পারেনি। ভোটাররা আপন ইচ্ছায় ভোট দিয়েছে। তাই নির্বাচিতদের আমি আমার এবং আমার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

উপজেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল হালিম লাল দলীয় প্রার্থী ছিল। সে এক নম্বর কালিয়া ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। তার বড় ভাই ইদ্রিস কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ইদ্রিস কমান্ডারের সহায়তা না পেলে কাদেরিয়া বাহিনী গঠনে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। কস্তুরিপাড়ার মনির, শামসু, পাহাড়ের হামিদুল হক, শওকত মোমেন শাজাহান, খোরশেদ আলম আর. ও. ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের পথপ্রদর্শক। প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশের অস্ত্র ইদ্রিস কমান্ডার এবং কলিয়াপাড়া ঘোনারচালা আফসার খলিফার ছেলে খোরশেদ মাস্টার সাফল্যের সঙ্গে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

সেই ইদ্রিস কমান্ডারের ছোট ভাই আবদুল হালিম লাল তার সময় টাঙ্গাইল জেলার ১০৪টি ইউনিয়নের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের স্বর্ণপদক পেয়ে সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ করেছে। তবে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসেবে সারা উপজেলায় তেমন পরিচিতি ছিল না। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় সে তার সাধ্যমতো সময় দিয়েছে। তাই নির্বাচিত না হলেও দলের প্রধান হিসেবে তাকেও আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। অন্যদিকে বিএনপির দুই প্রার্থী, একজন দলীয়, অন্যটি বিদ্রোহী।

দলীয় প্রার্থী হতেয়া স্কুলের হেডমাস্টার খোরশেদেরও সারা উপজেলায় তেমন পরিচিতি ছিল না। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ হাবিব গতবারও নির্বাচন করেছিল। অনেকের ধারণা সেবার তাকে জোর করে হারানো হয়েছিল। কিন্তু এবার তাকে কেউ হারায়নি। সখিপুরের ভোটাররা তাকে যে ভোট দিয়েছে সেটা সে পেয়েছে।

নির্বাচিত চেয়ারম্যানের চেয়ে পরাজিতরা সবাই মিলে প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছে। সবার ধারণা, এই ফলের পেছনে একটি মারাত্দক কৌশল বা প্রতারণা কাজ করেছে। ২৭ তারিখ ছিল উপজেলা নির্বাচন কিন্তু ওই আসনের সংসদ সদস্যের মৃত্যুজনিত কারণে আসনটি শূন্য হয়। যেখানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পক্ষে ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়। জামানতের টাকা নিতে সহকারী রিটার্নিং অফিসার এক-দেড় ঘণ্টা টালবাহানা করেন।

তিনি নগদ টাকা নেবেন না। নির্বাচনী নীতিমালায় জামানত হিসেবে নগদ, ব্যাংক ড্রাফট অথবা ট্রেজারি চালানের বিধান থাকলেও প্রাথমিক অবস্থায় তিনি নগদ টাকা নিতে অস্বীকার করেন। পরে অনেক বাহানা করে হাতে লিখে জামানতের অর্থ প্রাপ্তি স্বীকার করেন। নির্বাচনের দিনক্ষণ ছিল ২৩ মার্চ। মনে হয় আমি মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছি শুনে ২৩ মার্চ থেকে পিছিয়ে ২৯ মার্চ দেন।

কিন্তু মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারিই রেখে দেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের সময় জাতীয় পার্টির আশরাফ সিদ্দিকী এবং আমার মনোনয়ন সিআইবি রিপোর্টের এক অংশের ভিত্তিতে সরাসরি খারিজ করে দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যান্য পরিপত্র এবং ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের কোনো কথা না শুনে গায়ের জোরেই রিটার্নিং অফিসার কাজটি করেন। অন্যদিকে লিয়াকত নামে এক প্রার্থীর নির্বাচনী অর্থ বিবরণী ছিল না, তা পরে ঠিক করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি মঞ্জুর প্রার্থীর অনেক কাগজপত্রই ছিল না, তাই প্রথমে মনোনয়নপত্র বাতিল এবং পরে সব ঠিকঠাক করে গ্রহণ করা হয়।

বহুদিন পর আগের রাতে সবাইকে নিয়ে কালিয়ানের বাড়িতে ছিলাম। স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা একসঙ্গে ভোট দিয়েছি। সঙ্গে মামনি কুশিমনিও ছিল। ভোট দিয়ে দীপ-কুঁড়ি-কুশির মা ঢাকায় চলে যায়। আমি থেকে যাই।

মূল সড়কের আশপাশে প্রায় ১৫-২০টি কেন্দ্রে দেখেছি কোথাও তেমন হলাহল নেই। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে কোনো অনিয়ম মনে হয়নি। বেলা ২টার দিকে কুতুবপুরে শুনলাম কালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামালের পুত্র চাঁদ কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। একটু আগে নান্দারপুর কেন্দ্রে পাওয়ার দেখাতে গেলে লোকজন তাড়া করলে কুতুবপুরের দিকে সে পালিয়ে আসে। সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হয়।

জামালের ছেলে চাঁদকে কখনো দেখিছি বলে মনে হয় না। চেয়ারম্যান জামাল কয়েক বছর আগেও একজন সাদাসিধা নিরীহ মানুষ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের কারণে পাহাড়ের সব মানুষই আমায় ভালোবাসে, সম্মান করে। গুণ্ডাবাহিনী ছাড়া দলমত নির্বিশেষে এখনো সবাই আগের মতোই মান্যগণ্য, সম্মান করে। তাকে চিনতে পারিনি বলে চাঁদের বাবা জামাল চেয়ারম্যান বলছিল, স্যার, ছেলেবেলায় ওকে কোলে নিয়েছেন।

বাড়িতে এখনও সে ছবি আছে। সে যাক, অন্য কোনো দলের কোনো প্রার্থী অথবা কোনো লোক অবাধে ঘোরাফিরা করার কোনো কাগজ পাইনি। সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে সখিপুরের ইউএনও তাদের কীভাবে কাগজ দিয়েছে তা তিনিই জানেন। উপজেলা নির্বাচনে এই একটি দুষ্টখদ না থাকলে আরও ভালো হতো। নির্বাচন শেষে গিয়েছিলাম কন্ট্রোল রুমে।

অব্যবস্থাপনা দেখে যারপরনাই ব্যথিত হয়েছি। সারা দিন ভোটাররা যে শৃঙ্খলা দেখিয়েছে, এলাকাবাসী যে সৌহার্দ্যের পরিচয় দিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তার বিন্দুমাত্র দেখিনি। তবু একটি সুন্দর উপজেলা নির্বাচন হয়েছে সে জন্য আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের প্রতি লাখ কোটি শুকরিয়া।

লেখক : রাজনীতিক।

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.