আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারতের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশীর ভাবনা



আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচন আগামী ৭ এপ্রিল শুরু হবে। জমজমাট প্রচারণা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। ঐতিহাসিক কারণে এ উপমহাদেশের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিবেশী দেশের প্রসঙ্গ আসে প্রায়ই। বাংলাদেশের নির্বাচনে যেমন ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যা ও পানি সমস্যার বিষয়টি গুরুত্ব পায়, তেমনি ভারতেও বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীদের স্বীকৃতির বিষয়টি আলোচিত হয়। উভয় দেশেই অনেক আলোচনা হয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সমস্যার ওপর সঠিকভাবে আলোকপাত করা হয়।

উভয় দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। বাংলাদেশে যে সম্প্রদায় সংখ্যালঘু, ভারতে তারা সংখ্যাগুরু, বিপরীতভাবে ভারতে যে সম্প্রদায় সংখ্যালঘু, বাংলাদেশে তারা সংখ্যাগুরু। সংখ্যালঘু কার্ড উভয় দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতেই খেলা হয়। তবে সত্যিকার সমস্যাগুলোর সমাধান হয় বলে মনে হয় না।
ভারত বিশাল দেশ।

বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস সে দেশে। ফলে মানুষের মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্য। ধর্ম, নৃ-গোষ্ঠী ও ভাষার তারতম্যের কারণেই এ বৈচিত্র্য। তবে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রধান দুটি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান। ঐতিহাসিক কারণে এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে বিভেদ।

ধর্মীয় বিভেদকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় প্রায়ই। বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বিভেদ আরও প্রকট হয়েছে। সর্বশেষ গুজরাটের নিষ্ঠুর মুসলিম নিধনযজ্ঞের পর বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির অভ্যন্তরীণ দুর্বল দিকটি অবলোকনের সুযোগ পেয়েছে। গুজরাটের ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য উগ্র হিন্দুদের দায়ী করা হয়। তাদের সহযোগী হিসেবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম বারবার ভারতসহ বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে, যদিও আদালত এই অভিযোগ থেকে মোদিকে মুক্তি দিয়েছেন।

নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি এবারের নির্বাচনে জয়ী হবে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আর বিজেপি নির্বাচনে বিজয়ী হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন নরেন্দ্র মোদি। মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিখ্যাত গান্ধী পরিবারের সদস্য রাহুল গান্ধী- যিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সহ-সভাপতি।
ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত এ দুই ব্যক্তি সম্প্রতি আমাদের সীমান্তের সঙ্গে লাগোয়া ভারতের আসাম প্রদেশ সফর করেছেন। আসাম বাংলাদেশের সিলেট জেলার সীমান্তের শুধু কাছেই নয়, ঐতিহাসিক কারণে খুবই ঘনিষ্ঠ।

একসময় ব্রিটিশ আমলে সিলেট আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা আসাম থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তানে যোগ দেয়। গণভোটের ফলাফল উপেক্ষা করে করিমগঞ্জ, বদরপুর, রাতাবাড়ি ও হাইলাকান্দি (সাড়ে তিন থানা) প্রশাসনিক নির্দেশে ভারতের সঙ্গে থেকে যায়। ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে এসব এলাকার মানুষের সঙ্গে সিলেটের মানুষের কোনো ভিন্নতা নেই। অবিভক্ত ভারতে সিলেটের পূর্বাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সিলেট শহরের চেয়ে বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ, বদরপুর ও শিলচর শহরের সঙ্গে বেশি ছিল।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির প্রয়োজনে অনেকে আসামের রাজধানী গৌহাটিও যেতেন।
সম্প্রতি কংগ্রেসের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী রাহুল গান্ধী ও বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদির আসাম সফর দুটি ভিন্ন কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাহুল গান্ধী এসেছিলেন আসামের জোড়হাটে। সেখানে কংগ্রেসের মহিলা কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি এ অঞ্চলের মহিলাদের প্রতিভা ও সাহসের প্রশংসা করেন। তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের এক ফাঁকে একজন মহিলা রাহুল গান্ধীর গালে চুমু দেন।

আচমকা চুমুতে চমকিত রাহুল গান্ধীর মাথায় আরও কয়েকজন চুমু দেন। পরদিন খবরের কাগজে তা শিরোনাম হলেও সবচেয়ে করুণ কাহিনী হল- গালে চুমু দেয়া মহিলা বান্টিকে পরে তার স্বামী শরীরে আগুন দিয়ে হত্যা করে। সে নিজের শরীরেও আগুন দিয়ে আÍহত্যার চেষ্টা করে। রাহুল গান্ধী হয়তো এবার না হলেও অন্য কোনো বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তখন এই মহিলার করুণ মৃত্যু শোক তাকে কতটা ভারতের নির্যাতিত মহিলাদের উদ্ধারে অনুপ্রাণিত করবে কিংবা আদৌ মহিলাটির কথা তার মনে থাকবে কি-না, জানি না।

তবে বিশ্বের অনেক মানুষ ঘটনাটি মনে রাখবে।
অন্যদিকে শিলচর শহরে নরেন্দ্র মোদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন, যা বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অনেক বছর থেকে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা ভারতে যাচ্ছেন দলে দলে। এ অজুহাতে আসামের বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের হয়রানিও করা হয় বলে শোনা যায় বিভিন্ন সময়ে। যদিও ১৯৪৭-এর পর মুসলমানরা ভারতে শরণার্থী হিসেবে যাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

বরং উল্টো অনেকেই এসেছেন রাজনৈতিক কারণে। একইভাবে অনেক হিন্দুও রাজনৈতিক কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। বাংলাদেশ হওয়ার পরও অনেকে গিয়েছেন। বিশেষ করে দরিদ্র হিন্দুরা গিয়েছেন বেশি। তারা ভারতেও ভালো অবস্থায় নেই।

তাদেরও রিফিউজি হিসেবে অনেক সুবিধাবঞ্চিত করে রাখা হয় বলে শোনা যায়। এবারের শিলচর সফরে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, বিজেপি ক্ষমতায় গেলে আসামে যেসব হিন্দু বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন তাদের পূর্ণ নাগরিক সুবিধা দেয়া হবে। এ ঘোষণা শরণার্থীদের আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দীর্ঘদিনের বিজেপি নীতির কিছুটা পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন অনেকেই। অনেক সমালোচকের মতে, এক্ষেত্রেও মোদি হিন্দুত্ববাদী নীতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন শুধু হিন্দুদের কথা বলে। তবে এটা পুরোপুরি সঠিক বলে মনে হয় না।

বরং নরেন্দ্র মোদি যা বলেছেন তা সঠিক। কারণ মুসলমানরা যেখানে শরণার্থী হিসেবে যায়নি, সেখানে মুসলমানদের কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। শরণার্থী হিন্দুদের পুনর্বাসনের কথা বলে পরোক্ষভাবে সত্য স্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক কাজটিই করেছেন তিনি।
নরেন্দ্র মোদি আদালতের রায়ে গুজরাট দাঙ্গার দায় থেকে মুক্তি পেলেও ভারতসহ বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে তার নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের মতো ভারতীয় সেলিব্রিটিও নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানতে নারাজ।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জনমত জরিপ অনুযায়ী কংগ্রেসের চেয়ে মোদির বিজেপি অনেক এগিয়ে রয়েছে। সম্প্রতি নিউইয়র্কভিত্তিক পিউ রিসার্চের জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৬৩ শতাংশ ভারতীয় নরেন্দ্র মোদির দলকে নির্বাচিত করতে চায়। নীতির প্রশ্নে কেউ বিজেপিকে অপছন্দ করলে বা ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে পছন্দ না করলেও জনরায়কে সম্মান দেখাতে হবে। ভারতের দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ এ ব্যাপারে ভুল করবে বলে মনে হয় না। কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় দলের জনসমর্থন হ্রাস, ধর্মভিত্তিক ও আঞ্চলিক দলগুলোর জনসমর্থন বৃদ্ধিতে অনেকেই অখণ্ড ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা প্রকাশ করে থাকেন।

কিন্তু তারা সম্ভবত ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব ভারতীয় নাগরিকের দেশপ্রেম ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্ত ভিত্তির ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে এমন আশংকা করে থাকেন। হিন্দু-মুসলিম, ধনী-গরিব নির্বিশেষে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। কোনো ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে তার দেশের কোনো সমালোচনা শোনা অত্যন্ত কঠিন। আমরা যদি স্টার প্লাস ও জি-বাংলার সিরিয়াল আসক্ত না হয়ে ভারতবাসীর কাছ থেকে দেশপ্রেমের সবক নিতে পারতাম, তাহলে বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারত না।
আসন্ন নির্বাচনে যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, তার কাছে যেমন ভারতীয় জনগণের অনেক প্রত্যাশা থাকবে, তেমনি নিকট প্রতিবেশী হিসেবে আমাদেরও কিছু প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক।

আমাদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের কিছু পারসেপশন রয়েছে। কারও কারও মতে, বিজেপি নির্বাচিত হলে ভারত হয়তো এত সরাসরি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাবে না। আবার কারও আশংকা, কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের বর্তমান সরকারের এগিয়ে নেয়া ভালো সম্পর্ক হোঁচট খাবে। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সম্ভবত প্রতিবেশীদের এ রকম শংকার বিষয়ে বিজেপিও সচেতন।

তাই বিজেপির পক্ষ থেকে তাদের সংসদ সদস্য তরুণ বিজয় আশ্বস্ত করেছেন যে, নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নীতি অনুসরণ করবেন। এ প্রসঙ্গে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় তিনি বলেছেন, আমাদের সরকারের প্রচেষ্টা থাকবে আমাদের সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করা। সবাই ভালো করেই জানেন, চীন ও পাকিস্তানসহ আমাদের সব প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো ছিল বাজপেয়ি সরকারের আমলে। তিনি তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তির বিষয়েও ইতিবাচক কথা বলেছেন। বর্তমান বিরোধিতার বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, বিজেপি চুক্তিগুলোর বিরোধী নয়, বরং যে প্রক্রিয়ায় এসব তাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তারা তার বিরোধিতা করছেন।


ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণেরও ভারতের যে কোনো সরকারের কাছে প্রত্যাশা, তারা যেন উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে এগিয়ে আসেন, যাতে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক হয় সৎ প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। - See more at: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.