আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিজাত এলাকায় জুনায়েদের তিন অপরাধ সাম্রাজ্য

ওরা কখনো প্রেমিক-প্রেমিকা। প্রেমের ফাঁদ ফেলে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ে। সময়-সুযোগমতো দলের সদস্যরাও ঢুকে পড়ছে ওই বাসায়। এরপর লুটে নেয় দামি মালামাল। এরাই আবার কখনো পুলিশ হয়।

রাজধানীতে শিকারের খোঁজে চষে বেড়ায় গাড়ি নিয়ে। হাতে থাকে ওয়াকিটকি, পিস্তল, হ্যান্ডকাফ। রাস্তা বা গাড়ি থেকে নামিয়ে তুলে নেয় নিজেদের গাড়িতে। মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে রাস্তার ওপর ফেলে রেখে দেয় চম্পট। স্মার্ট এ তরুণ-তরুণীরাই অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের চালান বহন করে পেঁৗছে দেয় রাজধানীর এক মাথা থেকে আরেক মাথায়।

এরা সবাই ধনাঢ্য পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। প্রত্যেকেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী। ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত তারা।

ধনাঢ্য পরিবারের বখে যাওয়া এ সন্তানদের নিয়ে গড়ে তোলা 'হাইটেক ভয়ঙ্কর চক্র'-এর হোতা বনানীর আলোচিত সেই জুনায়েদের কাছ থেকে অপরাধের নানা তথ্য পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা হতবাক। পুলিশ জানিয়েছে, এই জুনায়েদ রাজধানীর অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা ও গাড়ি চোর চক্রের অন্যতম হোতা।

তার চলাফেরা ধনাঢ্য ও সমাজের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বলে নীরবে নিভৃতে তার মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের সাম্রাজ্য দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানা অপরাধে যুক্ত জুনায়েদের চালচলন নাটক-সিনেমার মাফিয়া ডনকেও হার মানিয়েছে। দেহরক্ষী ও স্মার্ট তরুণ-তরুণীদের নিয়ে দামি গাড়িতে চলাফেরাই শুধু নয়, সে যেখানে যেত সেখানেই অন্যদের মোবাইল ফোন অকার্যকর হয়ে যেত। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জুনায়েদ অন্যদের মোবাইল ফোন অকার্যকর করে রাখত। যে কারণে বার বার চেষ্টা করেও পুলিশ তাকে ধরতে পারছিল না।

অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার জন্য সে ব্যবহার করত স্মার্ট তরুণ-তরুণীদের। জুনায়েদের নির্দেশে এরাই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পেঁৗছে দিয়ে আসত অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের চালান। এ ধরনের অন্তত ২০ তরুণ-তরুণীর নাম-ঠিকানা এখন পুলিশের হাতে। পুলিশ তাদের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, জুনায়েদের আরও অস্ত্র ও মাদক সাম্রাজ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে।

সেখানে অভিযানে নেমেছে পুলিশ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও পুলিশের অভিযান চলছে সাভার ও নারায়ণগঞ্জে। জুনায়েদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী অবৈধ অস্ত্র-মাদক ও গাড়ি চোর সিন্ডিকেট ধরতেই চলছে পুলিশের এ অভিযান।

রবিবার ভোরে জুনায়েদকে বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকা থেকে দুটি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। পরে তার বাড়ির কক্ষ তল্লাশি চালিয়ে আরও তিনটি অস্ত্র উদ্ধারে সক্ষম হয় পুলিশ।

পাঁচটি অস্ত্রসসহ জুনায়েদের কাছ থেকে ২৭ রাউন্ড গুলি, ৪টি পেট্রলবোমা, পুলিশের ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, ধারাল কতগুলো ছোরা ও বিভিন্ন পশুর চামড়া উদ্ধার করা হয়। তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আরও তিনজনকে। এর মধ্যে রয়েছেন জুনায়েদের মা রুখসান ইয়াসমিন, তার কথিত বান্ধবী আফসারা রশিদ ও সহযোগী তুষার। প্রভাবশালী পরিবারের এই ধনীর দুলাল জুনায়েদ বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও এবার তাকে ছাড়িয়ে নিতে জোর তদবির করা হয়। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এরা এখন বনানী থানায় রিমান্ডে রয়েছে। তবে জুনায়েদের মাকে গতকাল পাঠানো হয়েছে কারাগারে।

ধনীর দুলাল জুনায়েদের অপকর্মের দীর্ঘ নথি বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে রয়েছে। মাসখানেক আগে বনানীর একটি পয়েন্টে জুনায়েদকে আটকের জন্য সাদা পোশাকে অবস্থান নিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। কিন্তু ধূর্ত জুনায়েদ বাহারি গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে কূটনৈতিকপাড়ার একটি বাসায়।

ওই বাড়ি থেকে দুই দিনেও বের হয়নি সে। পরে গোয়েন্দারা তাকে গ্রেফতারে হাল ছেড়ে দেন।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী শনিবার রাতের কথা- জনৈক সৌহার্দ্য নামে এক তরুণ মোবাইল ফোন সেট বিক্রির জন্য তার বন্ধু হামজার কাছে আসে। কাহিনীর শুরু সেখান থেকেই। কিন্তু হামজা আবার কৌশলে সৌহার্দ্যকে আফসারার নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে।

পরে সৌহার্দ্য একটি সাদা রঙের প্রিমিও গাড়ি নিয়ে বনানীর ১১ নম্বর রোডে যায়। আগে ফোনে কয়েক দফা কথা বলার পর তারা একটি রেস্টুরেন্টে বসবে বলে আয়োজন করে। কিন্তু আফসারার বন্ধু জুনায়েদ ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি নিয়ে সৌহার্দ্যের গাড়ি অতিক্রম করার মুহূর্তে ধাক্কা লাগার অভিনয় করে। জুনায়েদ গাড়ি থেকে নেমে সৌহার্দ্যকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। পরে জুনায়েদের সহযোগীরা সৌহার্দ্যের গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়।

বিষয়টি নিয়ে রাতেই হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটে। ঘটনার পরে গোয়েন্দারা ছুটে যান। থানা পুলিশও অভিযান শুরু করে। আগেই গাইডলাইন অনুযায়ী চেয়ারম্যানবাড়ির একটি বাসা থেকে অস্ত্রসহ জুনায়েদ ও তার বান্ধবী আফসারাকে আটক করা হয়। জুনায়েদের গাড়ি তল্লাশি করে লোহার রড ও দুটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।

পরে তার স্বীকারোক্তিতে বাকি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অভিনব কৌশলে গাড়ি ছিনতাই ছাড়াও বিভিন্ন রকমের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত জুনায়েদ। বনানী থানা পুলিশের নথিতে দেখা যায়, মহাখালীর আরজতপাড়া কড়াইল বস্তির যত অপরাধী সবার সঙ্গে যোগসূত্র থাকা জুনায়েদের রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। জুনায়েদ দামি গাড়িতে লোকদের উঠিয়ে জোর করে চাঁদা আদায় করত। এমনকি আফসারা নামে তার বান্ধবীকে লেলিয়ে দিয়ে জোর করে ছবি তুলে কৌশলে বড় দাগের অর্থ হাতিয়ে নিত।

পুলিশ জানায়, আফসারা উত্তরায় থাকে। তার বিরুদ্ধেও একাধিক ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ আছে। এর আগে গাড়ি চুরির অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হলেও পরে সে দেশের বাইরে চলে যায়। জানা গেছে, মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসার পর একই কৌশলে অপরাধ শুরু করে আফসারা। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নানা অপরাধ চালিয়ে আসছিল জুনায়েদ।

অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাও চালিয়ে আসছে সে দীর্ঘ দিন ধরে। দামি গাড়ি নিয়ে ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধের তথ্য তারা পেয়েছেন। বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আশরাফুল ইসলাম জানান, নির্দিষ্ট কয়েকটি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের টার্গেট করেই জুনায়েদ তার চক্রটি গড়ে তুলেছে। প্রথম পর্যায়ে বিনা পয়সায় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ইয়াবা সরবরাহ করত। পরে তারা আসক্ত হয়ে গেলে তার অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় কাজে লাগাতে শুরু করে।

দামি গাড়ি নিয়ে গুলশান-বনানীতে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে বেড়ায়। কোনো গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হতো। সঙ্গে থাকা তরুণীরাও এতে অংশ নিয়ে অন্য গাড়ির চালককে অন্যমনস্ক করে দেয়। এ সুযোগে গাড়ির চালকের সিটে বসেই গাড়ি নিয়ে চম্পট দিত জুনায়েদ। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছে জুনায়েদ গ্রুপ।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.