আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পটুয়াখালীতে দস্যুরা দেয় নিরাপত্তা টোকেন

মৎস্য সম্পদের মধ্যে অন্যতম রুপালি ইলিশ আহরণে সাগরে জলদস্যুদের তাণ্ডব, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং ট্রলারে থাকা সর্বস্ব হারিয়েও জীবন বাজি রেখে অধিক মুনাফার আশায় জেলেরা পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে রাজস্ব আয়ে রাখছেন ব্যাপক ভূমিকা। ট্রলারপ্রতি দুই থেকে তিন লাখ টাকায় সাগরে নিরাপদে মাছ আহরণ করতে 'নিরাপত্তা টোকেন' সংগ্রহ করতে হচ্ছে জলদস্যুদের কাছ থেকে।

লাখ লাখ টাকা দাদন ও ঋণের টাকায় ট্রলার, জাল, বরফ, খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানি নিয়ে মাছের আশায় জেলেরা সাগরে নেমে পড়েন মৌসুমের শুরুতে। চাহিদামাফিক ইলিশ ধরা না পড়ায় এবং সাগরে একাধিক জলদস্যু বাহিনীর লুটপাট, নির্যাতন আর অব্যাহত হুমকির মুখে আতঙ্কিত থাকতে হয় জেলে ও তাদের পরিবারকে। টোকেন ছাড়া গভীর সাগরে মাছ আহরণ করলে জলদস্যু বাহিনী অপহরণ করে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়। সাগরে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের সময় জলদস্যুদের তাণ্ডবে আহত হয়ে সাগরে পড়ে জেলেরা থাকেন নিখোঁজ। কেউ হন জীবনের তরে পঙ্গু। আবার জীবনও দিতে হয় কাউকে কাউকে। নিহত-আহতদের পরিবারের করুণ দশায় প্রথমে আড়তদাররা সাহায্য-সহযোগিতা করলেও পরে কেউই খোঁজ নেয় না। পটুয়াখালীর উপকূলের বেশ কিছু এলাকায় বেশির ভাগ মানুষ মাছ আহরণ করে জীবিকা অর্জন করে। তারা দুই বেলা দুই মুঠো খেতে আর পরতে দিতে না পেরে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের পাঠিয়ে দেয় মাছ শিকারে সাগরে। কোনো কোনো ট্রলারের মাঝি জীবন বাজি রেখে রুপালি ইলিশ শিকারের নেশায় ছুটছেন গভীর সাগরে। আর সেখানে গিয়ে জলদস্যুদের কবলে পড়ে কেউ ফিরছেন জাল আর ট্রলার হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে। আবার কেউ অপহরণের শিকার হয়ে লক্ষাধিক টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হচ্ছেন জলদস্যুদের আস্তানা থেকে। এতে তারা সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসছেন। জেলেরা দাবি জানিয়ে বলেন, জলদস্যুদের কবল থকে তাদের বাঁচাতে হলে স্থলভাগে থাকা গডফাদারদের আগে দমন করতে হবে। জেলে ও মালিকদের সূত্র জানায়, বৈশাখ মাসের প্রথমে ইলিশ মৌসুম শুরু হওয়ার নিয়ম থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইলিশ মৌসুম পিছিয়ে গেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে কিংবা আষাঢ় মাসের প্রথমে কিছু ইলিশ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। উপকূলীয় কলাপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা উপজেলার অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার ট্রলারের ৭০ হাজার জেলে ইলিশ আহরণ করে থাকে সাগরে। আর ওই সময়ই জলদস্যুরা তাণ্ডব চালায় জেলেদের ওপর। জেলেরা অভিযোগ করে জানান, দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন জেলার একাধিক উপজেলার মৎস্য বন্দর ও বাজারজাতকরণ এলাকার সদস্যরা এক হয়ে বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে ডাকাতি করে জেলেদের ট্রলারে। এর মধ্যে আব্বাস বাহিনী, আকাশ বাহিনী, জুলফিকার বাহিনী, মোতালেব বাহিনী, জিহাদ বাহিনী, আবুল কোম্পানি, রাজু বাহিনী ও আলম মোল্লা বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাগর। এদের অত্যাচারে ইলিশ মৌসুমের শুরুতেই জেলেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এসব জলদস্যু বাহিনী তীরবর্তী এলাকা, দুধমুখীর খাল, শেলা নদী ও সুপতি এলাকায় অবস্থান করে। পূর্ব সুন্দরবন ও বলেশ্বর থেকে পাথরঘাটা মোহনার শত কিলোমিটার এলাকায় সবচেয়ে বেশি ডাকাতি সংঘটিত হয়। আর এ এলাকায় সবচেয়ে বেশি জলদস্যুদের কবলে পড়েন পাথরঘাটার পূর্ব উপকূলীয় কলাপাড়া, গলাচিপা, দশমিনা, রাঙ্গাবালী উপজেলার জেলেরা। জেলেরা জানান, জলদস্যুরা ওই এলাকার হওয়ায় একই অঞ্চলের ট্রলারে ডাকাতি করে না বললেই চলে। এর মধ্যে পাথারঘাটার দস্যু সর্দার আলম মোল্লা বাহিনীর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন কলাপাড়াসহ পূর্ব উপকূলের জেলেরা। টোকেন না নিয়ে জেলেরা সাগরে নামলে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয় বলে জেলেদের অভিযোগ। সাগরে ডাকাতির জন্য তারা শক্তিশালী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ব্যবহার করে থাকে। এর সাহায্যে সহজেই ধরে মাছ, জাল, বরফ, তেল, জ্বালানি লুট করে জলেদের ট্রলার ডুবিয়ে দেয় এবং অপহরণ করে নিয়ে যায় মাঝিসহ জেলেদের।

মৌসুমের শুরুতে টোকেন হিসেবে জলদস্যুরা ভিজিটিং কার্ড, ১০ বা ২০ টাকার নোট দিচ্ছে এবং নোটের নম্বর তারা লিখে নিয়ে যাচ্ছে। জেলেরা ওই কার্ড বা নোট লেমিনেটিং করে ট্রলারে সংরক্ষণ করে রাখে। তবে সাগরে একাধিক বাহিনীর রাজত্ব থাকায় টোকেন নিয়েও রেহাই মিলছে না তাদের। জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে যখন জলদস্যুদের কবলে পড়েন, তখন টোকেন দেখালে তারা বলে, 'আমাদের টোকেনের সঙ্গে তোদের টোকেনের মিল নেই। আমরা অন্য গ্রুপের।' এর পর তারা ট্রলারের মালামালসহ জেলেদের তুলে নিয়ে যায়। এর পর ডাকাতরা সুন্দরবনে নিয়ে জেলেদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। তারা মোবাইলের মাধ্যমে ট্রলার মালিকদের নির্যাতনের শব্দ শোনায় এবং মুক্তিপণ হিসেবে দুই-তিন লাখ টাকা দাবি করে। ট্রলার মালিকরা বাধ্য হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে জেলেদের মুক্ত করে আনেন। এভাবে একেকটি ডাকাত গ্রুপ প্রতিবছর মুক্তিপণ আদায় করছে কোটি কোটি টাকা। জেলেদের সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলার গঙ্গামতি এলাকার আলাল গাজী, আদম গাজী, কাউয়ারচর এলাকার হাবিব, আলাউদ্দিন, কুয়াকাটার হারুন ও মাহাসাব মাঝির ট্রলারসহ মধ্য উপকূলের অন্তত অর্ধশতাধিক মাছধরা ট্রলারে ডাকাতি করেছে জলদস্যুরা। লুটপাট করে অপহরণ করেছে তাদের। প্রত্যেক জেলে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাহিনীর আস্তানা থেকে ফিরে এসেছে বলে তারা জানান।

জলদস্যুদের নিবৃত্ত করতে সাগর ও সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় অভিযান চালায় র্যাব। এ অভিযানের সময় বিপুল অস্ত্রসহ র্যাবের হাতে আটক হয়েছে বহু সদস্য এবং বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে জলদস্যু বাহিনীর প্রধানরা। এ ব্যাপারে কোস্টগার্ডের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের জনবল ও নৌযানের অভাব রয়েছে। এর পরও আমরা সব স্টেশনে নিয়মিত টহল চালু রেখেছি। এ ছাড়া সন্দেহপ্রবণ এলাকায় চালু রয়েছে বিশেষ টহল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.