আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্ফুট স্বর ছাড়া যাদের কোন আশ্রয় থাকেনা

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

কয়েকদিন আগের ঢালাই করা পিচের মধ্যে উনসত্তর কেজির পুরুষ্ট গোঁফওয়ালা শরীরটা নতুন পরিচয় “ লাশ “ হিসাবে মাটিতে গোলাপের ছেঁটে ফেলা ডালপালার মতো অবহেলাসমেত শুয়ে আছে । চারপাশে যারা গোল হয়ে থ্যাঁতলানো এই মাংসপিন্ড দেখে শিউরে উঠবার অভিনয় করতে করতে নানারকম স্পেকুলেশন করে যাচ্ছে তাদের কারো চৌদ্দবাপেও জানেনা কিভাবে খয়েরী রঙের হাফশার্ট পরা এই মাঝবয়সী লোক রাতে এভাবে বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে থাকতে পারে । আসলে ঘটনাগুলা একটা আরেকটার সাথে যুক্ত । রাস্তায় বেওয়ারিশ লাশটার একটা দফারফা করার পর যা যা হবে সেগুলোও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ।

সেই প্রায় বছর দুইশো আগে গ্রামের মৌলবীর মতো “ সমৃদ্ধ “ দাঁড়ির অধিকারী দার্শনিক মার্ক্স সাহেব “ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ “ নামক দুর্বোধ্য এক টার্ম ব্যবহার করে যেই সারাংশটুকু জানিয়ে গোটা মানবজাতির চিন্তাকে এক ধাক্কায় অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন ঠিক তেমনই এই ঘটনার পরস্পরা । এতোটুকুও নড়নচড়ন নেই ।

বিষয়টা বেশ সহজ আসলে । প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই সেখানকার হোমরাচোমরাদের নির্লজ্জ মাগিবাজী দেখতে দেখতে অসহ্যবোধ হলে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলে ফেলেছিলেন বিধায় মাস দুয়েক যাবত অফিসের বড়কর্তার চ্যালাদের সাথে উপরিউক্ত চরিত্র বদরুল ইসলামের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিলো । নিজেদের বয়স , অর্জিত শিক্ষা , স্বযত্নে লালন করা কালচারাল ভ্যালুজ ইত্যাদি সব গুলে খেয়ে পারলে অফিসেই পরস্পরকে মারানীর পুত , চোদানীর পুত বলে একে অপরের সাথে হাতাহাতি হয়ে যায় এমন অবস্থা ।

আজন্ম ভোন্দা থাকতে বাধ্য হওয়া সামান্য কেরাণীর ঘটে অপ্রত্যাশিতভাবে যতোই বুদ্ধি থাকুক কিংবা সে যতোই রাষ্ট্র , সমাজ , দেশ , সামাজিক সম্পর্কের খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য হৃদয়ের গহীনে ধারণ করুক দিনের শেষে তাদের এসব বিবেচনা অথবা মূল্যায়নের কোন বালাই দুঃখজনকভাবে যাদের কাছেই জ্ঞানগর্ভ বাণী নামক অন্তঃসারশূন্য ট্র্যাশ শুনতে আপামর জাতি হা – হাপিত্যেশ করে বসে থাকে । তো যাই হোক সেই দ্বন্দ্ব আর কোনভাবেই মীমাংসার যোগ্য না হবার অবস্থায় চলে আসলে অনিবার্যভাবেই বদরুল ইসলামের আর চাকরী টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়না । কিন্তু তার শত্রুপক্ষ অশিক্ষিত গ্রাম্য মোড়লের মতোই প্রতিশোধপরায়নতার চরমতম দৃশ্য দেখতে চেয়েছিলো বলে তার চাকরী নট করে দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ করার ফিকশন স্টোরী তৈরী করে বসে আছে । তবে তার পরে এক সপ্তাহের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে দিলে বদরুল সাহেব আর আগপিছু না ভেবে কল্যাণপুর থেকে নওগা যাওয়ার বাসে চেপে সোজা বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নেন ।


নওগার উদ্দেশ্যে বাস যথারীতিই চলছিলো ।

দেশের কোথাও কোন রাজনৈতিক ক্যাচাল বা গন্ডগোল ছিলোনা বিধায় বাসের যাত্রীরা নির্ভার ছিলেন । রাতেরবেলায় মদমত্ত অবস্থায় বাসের ড্রাইভারেরা যেরকম র্যাাশ চালায় এই ড্রাইভার তাও করছেনা । বাসে মাথায় একরাশ দুঃশ্চিন্তা নিয়ে কেবল বদরুল সাহেব বসে আছেন । বাড়ীতেও আগে থেকে তার এই যাত্রার হেতু সম্পর্কে কিছুই জানাননি । মাস চারেক পর হলো বাড়ী যাচ্ছেন তবুও মনে খুশীর সামান্যতম ছাপও নেই ।

এদিকে দিন দশেক পরেই ছোট মেয়েটার এসএসসি পরীক্ষা শুরু । ঠিক করে রেখেছিলেন পরীক্ষার আগে আগে মেয়েটার জন্য উপহার কিছু নিয়ে যাবেন । যা কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন সেটা এখনো হাতে আছে কিন্তু পরিস্থিতির তাড়াহুড়ার কারণে কিছু কিনে নিয়ে যেতে পারলেন না ।

মাঝপথে বিরতির জন্য বাস থামলে যাত্রীরা সব নেমে যায় । সামনের কোন এক হোটেলে রাতের খাবার সেরে নেবে প্রত্যেকে ।

বদরুল সাহেব বাক্সপেটরা ঠিক ঠিক জায়গায় আছে কিনা দেখে নিয়ে তবেই বাস থেকে নামলেন । বাস যাত্রায় বহুবার তার অনেক কিছু চুরি গেছে বলে সাবধানতার এই পরাকাষ্ঠা । মিনিট দশেক যেতেই চায়ের দাগে নোংরা সাদা প্যান্টের ডানদিকের পকেট ভাইব্রেট করতে করতে উদ্ভট এক মোবাইলের রিঙটোন বেজে উঠলে অজস্র বলিরেখাসম্পন্ন হাত দিয়ে সেটা বের করতেই দেখেন ফোনটা এসেছে বাড়ী থেকে । একসেপ্ট করতেই অপরজন পাশ থেকে গুছিয়ে কোন বাক্য শেষ করতে পারলোনা । চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো ।

মিনিট দুয়েক যাবত সেই ফোঁপানী চললো । বদরুল সাহেবের বুঝতে দেরী হলোনা বিপদ কিছু একটা হয়েছে । এদিকে কথা বলতে বলতে এই শুনশান রাস্তার মাঝে কখন এসে পড়েছিলেন খেয়াল করেননি । রাস্তাটা শুনশান হলেও দূরগামী বাস চলাচল করেনা এমন তো নয় । যতোক্ষণে তার হুঁশ হয়েছে ততোমধ্যে বাসের ধাক্কায় ক্রমশ প্রায় অন্ধকার হয়ে আসতে থাকা স্মৃতিতে আসন্ন পরিক্ষার্থী ছোট মেয়েটার মুখ ছাড়া আর কিছু তার চোখের সামনে ভেসে উঠলোনা ।

বাসের অন্য যাত্রীরা ছুটে আসতে আসতে বদরুল সাহেব অস্ফুট কিছু একটা বলে নিস্পন্দ হয়ে গেলেন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।