আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারী নেতৃত্ব না নারীবান্ধব নেতৃত্ব?

২০১৪ সালের বিশ্ব নারী দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বললেন, দু্জন রাজনৈতিক নেত্রী যখন রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তখন লোকে বলে 'দুই মহিলার ঝগড়া। অথচ একই কাজ দুজন পুরুষ রাজনীতিবিদ করলে সেটিকে কেউ দুজন পুরুষ মানুষের ঝগড়া বলে উপহাস করে না। ' একজন নারী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে থেকেও নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আক্রমণ থেকে রেহাই পান না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'লোকে বলে', কিন্তু সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরব যাদের তারা কি ভিন্ন কথা বলে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বর্তমান সহকর্মী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে উদ্ধৃত করে সহকর্মীর দৃষ্টিতে নারীর মর্যাদা বিশ্লেষণ করলে দেশে নারীর মর্যাদার চিত্র আরও স্পষ্ট হতো। মন্ত্রী পদমর্যাদার বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির নেতা।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের জনগণ দুই মহিলার হাত থেকে মুক্তি চায়। এই দেশে নারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে এখন পুরুষের শাসন কায়েম করা প্রয়োজন। ' এরশাদ পুরুষের শাসনকে যদি সুশাসনের সমার্থক অর্থে ব্যবহার করে থাকেন তাহলে তার তল্পিবাহক ছাড়া তাকে সমর্থন দেওয়ার মতো নির্বোধ বাংলাদেশে একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নেতা হিসেবে বিশেষ কোনো যোগ্যতা এরশাদ সাহেব জনগণকে দেখাতে পারেননি বলে স্রেফ পুরুষ হিসেবে তিনি জনগণের কাছে প্রিভিলেজ দাবি করছেন।

জনগণ তার আব্দার কীভাবে বিবেচনা করবে সেটি জনগণের বিষয়।

আমরা শুধু বলতে পারি, এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে সে সময় অনেক তরুণ প্রাণকে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছিল। চরম নির্লজ্জতার সঙ্গে ক্ষমতা অাঁকড়ে ধরে এরশাদ বিশ্ব বেহায়ার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। এরশাদ সাহেবের শাসনামলের চরম লজ্জাকর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করে উপায় নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরশাদ সাহেবের আগে কোনো শাসক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বসে প্রকাশ্যে নির্লজ্জ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়নি। নারীর প্রতি এরশাদ সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গি তার জীবনাচরণ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়।

কাজেই তিনি যখন দুই বড় দলের নেত্রীকে তাচ্ছিল্যভরে 'দুই মহিলা' বলে সম্বোধন করেন তখন আমরা বিস্মিত হই না।

পুরুষ শাসিত সমাজে রাজনীতির ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে পুরুষ চরম হীনম্মন্যতায় ভোগে। নিজেদের যোগ্যতার ঘাটতি পুষিয়ে নিয়ে মানুষ হিসেবে সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে তারা ভয় পায় বলে স্রেফ পুরুষ বলে নিজেকে জাহির করতে চায়। হীনম্মন্যতা বোধ থেকে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশের সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, মিসরের রানী ক্লিওপেট্রা হীনম্মন্য পুরুষের তাচ্ছিল্যের নির্মম শিকার।

পুরুষ রচিত ইতিহাসে রানী ক্লিওপেট্রা স্রেফ সুন্দরী লাস্যময়ী একজন নারীর চেয়ে বেশি কিছু নয়। অথচ পুরাতাত্তি্বক অনুসন্ধানে ক্লিওপেট্রার যত মূর্তি পাওয়া গেছে তার কোনোটিতেই তাকে সুন্দরী কিংবা লাস্যময়ী নারী বলে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তবুও ক্লিওপেট্রার চরিত্র হননের জন্য ইতিহাসের পাতায় এত উদ্যোগ আয়োজন কেন? ক্লিওপেট্রার অপরাধ তিনি পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে সবল বিদ্রোহে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। রোমান শাসক টলেমি বংশের মেয়ে হিসেবে বংশের রেওয়াজ অনুযায়ী তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট দুই ভাইকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামীদের সঙ্গে যৌথভাবে মিসর শাসন করা উচিত ছিল। বিদ্রোহী ক্লিওপেট্রা সে রেওয়াজ ভেঙে নিজেকে মিসরের একক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং মুদ্রার ওপর তার একার মূর্তির ছাপ দিয়েছিলেন।

রানী ক্লিওপেট্রার প্রবল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেশপ্রেম যুক্ত হয়ে তাকে প্রবল সাহসী করে তুলেছিল যে তথ্য পুরুষ ইতিহাসবিদরা বিশেষভাবে এড়িয়ে যান। ক্লিওপেট্রা প্রথম টলেমি শাসক যিনি নিজে যত্ন করে মিসরীয় ভাষা শিখেছিলেন এবং মিসরীয় ভাষাকে গ্রিক ভাষার সমমর্যাদায় রাজভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রার আগে গ্রিক বংশোদ্ভূত টলেমি শাসকরা মিসরে বসে গ্রিক ভাষায় রাজকার্য চালাতেন। অর্থাৎ নারী ক্লিওপেট্রা যে মাটির সন্তান সেই মাটিকে ভালোবাসতে জানতেন। রানী ক্লিওপেট্রার অসীম সাহস, নিপুণ যুদ্ধবিদ্যা এবং দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে পরাজিত জেনারেলরা তাদের পুরুষ সত্তা নিয়ে নারীর চরিত্র হননের নোংরা পথে হেঁটে গেছে।

তারা দাবি করেছিলেন, ক্লিওপেট্রার শৌর্য বীর্যের কাছে নয়, রোমান পুরুষ জেনারেলরা ক্লিওপেট্রার রূপের কাছে পরাজিত হয়েছে। ক্লিওপেট্রার পক্ষে-বিপক্ষে যত রাজপুরুষের আনাগোনা ঘটেছে তারা সবাই নারীলোলুপ ছিলেন বলে তারা ক্লিওপেট্রার পায়ের তলে স্বেচ্ছায় তাদের তরবারি নামিয়ে রাখতেন। নারীর শৌর্য-বীর্যের স্বীকৃতি দেওয়ার চেয়ে সে সময়েও পুরুষ নিজেকে দুশ্চরিত্র লম্পট বলে হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আজও নারীর প্রতি পুরুষের আদি দৃষ্টিভঙ্গির দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। শুধু দেশ কাল এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ভেদে হীনম্মন্যতা প্রকাশের ভাষা এবং পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে।

ইদানীং ভারতে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গুজরাটের নরেন্দ্র মোদির নাম সরবে উচ্চারিত হচ্ছে। হয়তো আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কয়েক সপ্তাহ আগে মোদি তার ব্যক্তিগত সততার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বললেন, 'আমার স্ত্রী কিংবা পরিবার নেই। অতএব আমার দুর্নীতি করার কোনো কারণ নেই। ' মোদির ভাষ্যানুযায়ী যেসব পুরুষের ঘরে স্ত্রী নেই সেসব পুরুষের দুর্নীতি করার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মোদির এমন মতামত ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, ভারতের পুরুষ রাজনীতিবিদ এবং আমলারা যত দুর্নীতি করছে সেটা তাদের স্বেচ্ছাকৃত নয়। বরং সেই দুর্নীতির দায় তাদের স্ত্রীদের। মোদির থিওরি অনুযায়ী পুরুষরা নির্লোভ কিন্তু স্ত্রীর প্ররোচনায় তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মোদির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় তিনি প্রথম জীবনে যথারীতি বিয়ে করেছিলেন এবং অল্প কয়েক দিন পরেই তার স্ত্রী তাকে ফেলে চলে গেছেন। কী ধরনের দুর্নীতি-সুনীতির বিতর্কে জড়িয়ে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছেন সেটি মোদি নিজে ভালো বলতে পারবেন।

এখন ঘরে স্ত্রী নেই বলে তিনি দুর্নীতি করবেন না এমন ঘোষণা দিয়ে পরোক্ষভাবে স্ত্রী জাতির চরিত্র হননে নেমেছেন। গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় মদদ দেওয়ার অপরাধ মোদির বিরুদ্ধে কোর্টে প্রমাণ করা যায়নি বলে তিনি বেনেফিট অব ডাউট পেয়ে বেঁচে গেছেন। আইন-আদালতের মারপ্যাঁচে অনেক অপরাধী এমন সুবিধা পেয়ে থাকে, এটা নতুন কিছু নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, মোদি শুধু মুসলিমবিদ্বেষী নন, তার অতি রক্ষণশীল মন নারীর প্রতি বিদ্বেষ দিয়ে ঠাসা। এমন নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির একজন রাজনীতিককে নেতা হিসেবে বরণ করে নেওয়ার আগে ভারতীয় নারী ভোটারদের দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা উচিত।

আমাদের দেশের নারী রাজনীতিকরা নারীর ক্ষমতা এবং মর্যাদার প্রশ্নে কি আন্তরিক? বাংলাদেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেত্রীর কথা এবং কাজ ব্যাখ্যা করলে নারীর অধিকার এবং মর্যাদা বিষয়ে তাদের অসচেতন বলে মনে হয়। তারা উভয়ে নিজ নিজ দলকে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ধরে রাখা কিংবা রাষ্ট্র ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য সব মহলের সমর্থন চান। হেফাজতে ইসলামীর বয়োবৃদ্ধ নেতা যিনি নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে এখন তেঁতুল হুজুর বলে পরিচিতি পেয়েছেন তাকে বেগম খালেদা জিয়া প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। একজন নারী হিসেবে বেগম জিয়া কি হেফাজতের ১৩ দফা সমর্থন করেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজতিদের আশ্বস্ত করে বলেন, আওয়ামী লীগ কোরআন সুন্না বিরোধী কোনো আইন দেশে প্রণয়ন করবেন না। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে আইয়ুব খান মোল্লা-মৌলভীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানের পারিবারিক আইন সংশোধন করেছিলেন, যার সুফল আমরা নারীরা আজও ভোগ করছি।

সেই বিবেচনায় দেখা যায়, নারী অধিকার প্রশ্নে আমাদের নেত্রীরা নারীবান্ধব নয় বরং আইয়ুব খানের চেয়ে আপসকামী।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

Email: tusharkona.khandker7@gmail.com

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.