আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোটা দেশ তখন উত্তাল

একাত্তরের স্বাধীনতার এই মাসটি বাঙালি জাতির স্বকীয় ঐতিহ্য, নিজস্ব সত্তা তথা আবেগময় একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ঘটনাবহুল এ মাসেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে জাতি পদার্পণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি অধ্যায়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ যেমন একদিকে ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের সমাপনী, অন্যদিকে ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা; পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন জাতি সৃষ্টির প্রয়াসে একটি স্বপ্ন; এবং পুরো জাতির জন্য চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত একটি সার্বিক দিকনির্দেশনা, দৃঢ় অঙ্গীকার ও শপথ। আমি তখন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার অফিসার হলেও আমরা বৈষম্যের শিকার ছিলাম। সব সময় বাঁকা চোখে দেখা হতো আমাদের।

এই মার্চ মাসের ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই লক্ষ করলাম আমাদের সঙ্গে তাদের বিমাতাসুলভ ব্যবহার। আমাদের প্রতি তাদের বিশ্বাসের ঘাটতি চরমে পৌঁছেছিল। নজরদারি বৃদ্ধি করা হয় এ মাসে। অধিকাংশ অফিসার ও সৈনিক (যারা পরবর্তী সময়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বোপরি ৭ মার্চের ভাষণে এত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, অনেকে তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ না করে চাপিয়ে রাখতে পারেননি। সবাই একটি মুহূর্তের জন্য অপেক্ষায় ছিল কখন আসবে আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য দেশের জনগণকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার সে সুযোগ।

এ মাসে আমরা লক্ষ করেছি, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান এ অঞ্চলে বাড়তি সৈনিক ও গোলাবারুদ আসা অব্যাহত রেখেছে। ৭ মার্চের ভাষণের পর এ মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। লক্ষ করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তারা আলোচনার নামে তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সময়ক্ষেপণ করছিল। রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও তাদের এ কৌশল বুঝতে পেরেছিলেন বলেই আলোচনার পাশাপাশি তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তুত করে গড়ে তুলছিলেন পুরো জাতিকে। এ মাসেই আমার কমান্ডিং অফিসার আমার সম্পর্কে একটি গোপনীয় নোট পাঠিয়েছিল সংশ্লিষ্টদের কাছে এই বলে যে, 'এই অফিসারটি প্রাদেশিক ইজমে মটিভেটেড।

একে ঠিকমতো গাইড না করলে যে কোনো সময় চলার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। ' এ ধরনের উক্তি আরও অনেক বাঙালি অফিসার সম্পর্কে করা হয়েছিল।

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ মাসেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রশ্নে সেদিন দলমত নির্বিশেষে মুক্তিকামী মানুষের এক বৃহত্তম ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই যেন বঙ্গবন্ধুর শেষ বাঁশির আওয়াজ শোনার অপেক্ষায় ছিল। গোটা দেশ তখন উত্তাল।

এ অঞ্চলের বিভিন্ন সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনাদের চলছিল যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। বাঙালি অফিসারদের ইতোমধ্যে নিরস্ত্রীকরণ করা হয়েছে। ২৫ মার্চ সে কালরাত। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল ঢাকার পিলখানা এবং রাজারবাগের ইপিআর ও পুলিশের ওপর। শুরু করল হত্যাযজ্ঞ।

পাশাপাশি তারা বেরিয়ে পড়ল বাংলার বিভিন্ন জনপদে। হাটবাজার, বাড়িঘরে আগুন লাগাতে শুরু করল। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল বাংলার জনপদ। এক বিভীষিকাময় চিত্র প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। বিশ্ববাসী সেদিন শুনতে পেয়েছিল মানবতার আর্তনাদ।

এ হাহাকার মুক্তিকামী মানুষের চেতনাকে করেছিল আরও শানিত। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ সর্বস্তরের জনগণ যার যা কিছু ছিল তা নিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করল বাংলার প্রতিটি জনপদে। একটি অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের নেতার মন্ত্রে দীক্ষিত জনগোষ্ঠী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই ব্যারিকেড যুদ্ধে। এ শুধু অতুলনীয় সাহসিকতার নিদর্শনই নয়, একটি যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভে এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই তুমুল ব্যারিকেড যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র কয়েক দিন।

এই ছাত্র-জনতা-শ্রমিকরাই সশস্ত্র গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আমি গর্বিত তৎকালীন সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশের অফিসার এবং সৈনিকদের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে শামিল হয়ে নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলাম বলে। স্বাধীন বাংলা সরকারের অধীনে সৃষ্টি হয়েছিল ১১টি সেক্টর। পর্যায়ক্রমে গঠিত হলো 'এস', 'জেড' ও 'কে' ফোর্স এবং স্বীকৃত বাহিনী। এ পর্যায়ে তৎকালীন ভারত আমাদের আশ্রয়, অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ, কিংবা আমাদের মুক্তিবাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ যদি না দিত, তাহলে এত কম সময়ে আমরা সংগঠিত হতে পারতাম না।

এ ছাড়া ভারত প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য-বস্ত্র-স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার মহান ও হিমালয়সম নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে, সর্বোপরি দেশবাসীর স্বপ্নসাধ পূরণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে, পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বের ২৬টি দেশ সফর করে আমাদের দাবি তুলে ধরেছেন। এমনকি আমাদের দাবির সপক্ষে তিনি জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন, সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব জনমত। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ, সর্বাত্দক সহযোগিতা পেয়েছিলাম। আর এর মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রায় দুর্বল ও পর্যুদস্ত করে চূড়ান্ত আঘাত হানার লক্ষ্যে জেনারেল অরোরার নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী গঠন করা হয়।

১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ৯ মাসের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চার হাজার অফিসার ও সৈনিক হতাহত হন। প্রশ্ন জাগে, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু ভারত কী পেয়েছে। কারণ তাদের এ আত্দাহুতি ছাড়া এত কম সময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ছিল না। ঘটনাবহুল এই মার্চ মাস শুধু ৭ মার্চের ভাষণ নয়।

এ ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এসেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান 'জয় বাংলা' বলে এ ঘোষণাপত্র পাঠ শেষ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের এ ঘোষণাকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না। জিয়াউর রহমানের এ ঘোষণায় যুদ্ধকামী জনগণ, বিশেষ করে বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা বাড়তি একটা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।

আমি মনে করি, এ বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক কাদা-ছোড়াছুড়ির ঊধের্্ব থাকাই সমীচীন।

অনুলিখন : শফিকুল ইসলাম সোহাগ

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.