আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বর্ণের খনি দুই বিমানবন্দর

শরীরে বাঁধা স্বর্ণ। ব্যাগের ভেতর স্বর্ণ। প্যান্টের পকেটে স্বর্ণ। জুতায় স্বর্ণ। মোজায় স্বর্ণ।

উড়োজাহাজে স্বর্ণ। টয়লেটে স্বর্ণ। কোথায় নেই স্বর্ণ! ঢাকা শাহজালাল ও চট্টগ্রাম শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই এমন কোথাও না কোথাও তল্লাশি চালানো হচ্ছে। মিলছে শুধু স্বর্ণ। সুইপার থেকে উড়োজাহাজের যাত্রী_ যারাই আটক হচ্ছেন, স্বর্ণ নিয়েই আটক হচ্ছেন।

বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের চালান আটক হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের এই দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেন নিজেদের আসল পরিচয় হারাতে বসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ দুটি বিমানবন্দর যেন এখন স্বর্ণের খনি। শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আজ থেকে এক বছর আগেও বিমানবন্দর এলাকায় মালিকবিহীন কোনো ব্যাগ বা বস্তু পড়ে থাকতে দেখলে অজানা আশঙ্কায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু বিমানবন্দরের এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এ ধরনের কিছু পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের ভাবনায় প্রথমেই আসে স্বর্ণের চালানের কথা।

কাস্টমস সূত্র জানায়, গত ১৫ মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের ৬৫০ কেজি স্বর্ণ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে বিগত তিন মাসে উদ্ধার করা হয় ২২০ কেজি স্বর্ণ। সর্বশেষ গতকাল চট্টগ্রাম শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণের চালান আটক করা হয়। এ চালানে উদ্ধার করা হয়েছে ৫৪টি স্বর্ণের বার। বেলা ১১টায় দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের (বিজি-০৪৮) ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে ওসমান গণি, মো. আইয়ুব ও রেজাউদ্দিন রানা নামে তিন যাত্রীকে আটক করা হয়েছে।

তাদের প্রত্যেকের জুতার ভেতর থেকে উদ্ধার হয় এই স্বর্ণের চালান। এর একদিন আগে একই বিমানবন্দরে স্মরণকালের বৃহত্তর স্বর্ণের চালান (১০৫ কেজি) আটক করা হয়। এ সময় ১০ জন যাত্রীকেও আটক করা হয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যে পরিমাণ স্বর্ণ আটক হয়েছে, তার ১০ গুণ বেশি চোরাচালানের স্বর্ণ ঢুকেছে দেশে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে পরিমাণ স্বর্ণ বাংলাদেশে ঢুকছে, সে পরিমাণ স্বর্ণের চাহিদা নেই বাংলাদেশে।

গত এক বছরে দেশে এক ভরি স্বর্ণও বাণিজ্যিকভাবে বৈধ পথে আসেনি। চোরাচালানের বেশির ভাগ স্বর্ণ পাচার হচ্ছে ভারতে। আকাশপথে যে স্বর্ণ দেশে আসছে, তা আবার স্থলপথে বেরিয়ে যাচ্ছে। বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। স্বর্ণের চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে নিরাপদ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন।

শুল্ক, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মঈনুল খান বলেন, স্বর্ণ আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে ভারত সরকার। ফলে দেশটিতে স্বর্ণ আমদানি ৯৫ শতাংশ কমে আসে। তা ছাড়া স্বর্ণ আমদানিতে শুল্কহার ৬ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এতে স্বর্ণ আমদানিতে আরও ধস নামে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বর্ণ ব্যবহারকারী দেশ ভারতে স্বর্ণ পাচার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়।

তাই দুই বাংলার চোরাকারবারিদের কাছে স্বর্ণ পাচার এখন অধিকতর লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই থেকে অবৈধভাবে স্বর্ণ চোরাচালান হয়ে বাংলাদেশে আসছে। আবার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারতে ঢুকছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশেও কিছু স্বর্ণ রয়ে যায়। দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে ভরিতে স্বর্ণের মূল্যে ফারাক ৮ হাজার টাকা।

সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ীও চোরাচালানে সক্রিয়। তিনি আরও বলেন, স্বর্ণের বার চোরাচালানেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভারত থেকে মাদক ও অস্ত্র আসছে, আসছে গরুসহ অন্যান্য মালামাল। এসব পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা হয় স্বর্ণের বার দিয়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে চোরাচালানের স্বর্গদ্বার হিসেবে ব্যবহার করছে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা।

এ ছাড়া সীমান্তের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রুট দিয়ে চালান সরাসরি ভারতীয় স্বর্ণ কারবারিদের হাতে চলে যায়। একটি চালান নিরাপদে গন্তব্যে পেঁৗছাতে পাচারকারী সিন্ডিকেটকে ঘাটে ঘাটে টাকা গুনতে হয়। তবেই কাঙ্ক্ষিত চালান হাতে পায়। চক্রের মূল হোতারা সিঙ্গাপুর, দুবাই, পাকিস্তান ও ভারতে বসেই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে সোনা পাচারকে কেন্দ্র করে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গোয়েন্দা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগ, কাস্টমস ও বাংলাদেশ বিমানের শতাধিক কর্মী টাকার বিনিময়ে পাচারকারীদের সহায়তা করছেন। মাঝে-মধ্যে বিমানবন্দরে কর্মরত এসব লোক স্বর্ণ চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়ছেন। অথচ মূল হোতারা বিদেশে বসেই তাদের এজেন্ট দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন তারা। ঢাকা কাস্টম হাউসের হিসাব মতে, গত ১৩ মাসে বিমানবন্দরে ১১০টি স্বর্ণের চালান আটকের ঘটনায় থানা ও বিভাগীয়সহ ৭৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক মামলা ধামাচাপা পড়ে গেছে। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তিলাভ করেছেন। কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে হওয়া মামলার আসামিরা কীভাবে জামিনে মুক্তি পান, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, কাস্টমসের নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ না থাকায় এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পুলিশের মতো কাস্টমসকে যদি এসব মামলার তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এ সমস্যা দূর হতো। আসামিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে মামলা দায়েরের পর পুরো বিষয়টি পুলিশের কাছে চলে যায়। তদন্তে কোনো ফাঁকফোকর থাকে কিনা, তা কাস্টমসের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে যখন পর্যালোচনা করা হয়, তখনই আমরা জানতে পারি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.