আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাটি ও মানুষ ।

খুব নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিতে পুরো ব্যাপারটি পর্যালোচনা করার চেস্টা করেছি। এখানে প্রচলিত কারণ যেমন আছে; তেমনি কিছু অপ্রচলিত কারণও আছে। যা পড়ে অনেকেই বলতে পারেন, ধুর মিয়া, কিসব আবোল-তাবোল বকছেন”। তবে আমি খুব সিরিয়াস এ ব্যাপারে। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা।

এ ব্যাপারে। আপনাদের মতামত কামনা করছি। আজকে আলোচনা হলো এর প্রথম পর্ব।


সদ্যই শেষ হয়ে গেল আইসিসি T20 বিশ্বকাপ ২০১৪। T20 বিশ্বকাপের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

আর ‘আনবিটেন’ রানারআপ ভারতেকেও শুভেচ্ছা!!! বিশ্বকাপের মত একটি বড় আসর সফল, সুন্দর, সুচারু ও সুশৃংখলাভাবে আয়োজন করার জন্য বিসিবিসহ বাংলাদেশ সরকারকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ ছিল এই বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ। আয়োজক দেশ হিসেবে আমাদের সুবিধা পাওয়া ত দুরের কথা। বাংলাদেশকে মূল পর্বে খেলতেই পরীক্ষা দিতে হয়েছে!!! প্রথম পর্বে বাংলাদেশসহ সর্বমোট ৮টি দলকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। দু’গ্রুপ থেকে টপ টু মূলপর্বে খেলার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ তার মধ্যে একটা। যদিও পুচকে হংকং এর সাথে হেরে বসে প্রায় ছিটকে পরেছিল বাংলাদেশ। এক অনন্যসাধারণ বিজয়ে তাদের সাথে যোগ দেয় নেদারল্যান্ড।

T20 বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরমেন্স কেমন ছিল এটা সবার জানা। তবু আরকবার স্মরণ করি।

বাছাই ও মূলপর্ব মিলিয়ে সর্বমোট ৭টি খেলার মধ্যে ৫টি খেলায় তারা পরাজয় বরণ করে। এর মধ্যে বাছাইপর্বে হংকং এর সাথে হার ছিল সবচেয়ে লজ্জাজনক। হংকং যদি বাংলাদেশের ১০২ রান ১২/১৩ ওভারে করে ফেলত তাহলে কি যে হত এটা ভাবলে মুশিফিকদের হয়ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। যাইহোক, কোনমতে আমরা পার পেয়ে গেলেও হার এড়াতে পারিনি।

মূলপর্বের বাকী ৮টি দল মহাশক্তিশালী।

এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপ-২ এ বাংলাদেশের জায়গা হয়। অন্য দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলাফল কেমন ছিল এই আলোচনা পানসে হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, পরাজয়ের ধরণ। বাংলাদেশ একটা ম্যাচও তার নিজস্ব মান অনুযায়ী খেলতে পারেনি; একটা ম্যাচেও ন্যুনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি; একটা ম্যাচে ১৫০+ রান করতে পেরেছিল তারা, তবে এতে ফলাফলে কোন হেরফের হয়নি।

কোন ম্যাচেই বিপক্ষ দলের ৫টির বেশী উইকেট ফেলতে পারেনি; একটা ম্যাচেও মনে হয়নি বাংলাদেশ জিততে পারে। মোটের উপর বড়ই হতাশাব্যঞ্জক পারফরমেন্স। বাংলাদেশের জন্য আইসিসি T20 বিশ্বকাপে-২০১৪ ছিল ঐ আপ্তবাক্যটির মত “হারজিত বড় কথা নয় অংশগ্রহণই বড় কথা”।

কিন্তু সময় পাল্টেছে। কালপ্রবাহে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার পানিতে অনেক রঙ ধরেছে (পানি গড়িয়েছে-র একালের রুপ)।

তাই মহামতি হেনরি ডুন্যান্টের এই অমর বাণীটি এখন আর হজম হচ্ছে না। এত হার আর কাহাতক সহ্য হয়? তাই একটু খতিয়ে দেখার চেস্টা করছি, ‘কেন এমন হার?’

চলুন খুব নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিতে পুরো ব্যাপারটি পর্যালোচনা করি। এখানে প্রচলিত কারণ যেমন থাকবে; তেমনি কিছু অপ্রচলিত কারণেরও উল্লেখ থাকবে। যা পড়ে অনেকেই বলতে পারেন, ধুর মিয়া, কিসব আবোল-তাবোল বকছেন”। তবে আমি খুব সিরিয়াস এ ব্যাপারে।

এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা।

দক্ষতার অভাবঃ বাংলাদেশের খেলোয়ারদের দক্ষতার অভাবই পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ। আমরা বাকী ৮টি দলের দক্ষতা বা সক্ষমতার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে এখনো আমরা তাদের কাছাকাছিও যেতে পারিনি। কেউ কেউ অমত করতে পারেন।

তবে এটাই বাস্তবতা। এ ব্যাপারে তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে। যেকোন র্যাং কিং-এ বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে নিউজিল্যান্ড বা অনেক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিউজিল্যান্ড নিয়েই আলাপ করি। দু’দলের প্লেয়ার টু প্লেয়ার তুলনা করেন।

ওদের তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। বিশ্ব ক্রিকেটে ওদের অর্জন কম হলেও শক্তিতে ওরা একেবারে পিছিয়ে নেই। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং সবক্ষেত্রেই ওরা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কেউ কেউ বলতে পারেন, তাদেরকে বাংলাদেশ ‘বাংলাওয়াশ’ করলো। তারপরেও ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেটার টীম।

বিশ্বের সকল দল ওদের যোগ্য সম্মান করে।

পক্ষান্তরে ইদানিং আমাদের জাতীয় দলের দিকে তাকান। আমাদের সব গড়পড়তা মানের খেলোয়ার। এর উপর আছে ধারাবাহকতার অভাব। একমাত্র সাকিব ছাড়া আর কেউ বিশ্ব ক্রিকেটে তেমন পরিচিত বা কেউকেটা কোন মুখ নয়।

এর প্রমাণ এখন ভারতের আইপিএলসহ বিভিন্ন দেশের T20 ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়। একমাত্র সাকিব ছাড়া আর কেউ ডাক পায় না। তামিম গতবার সুযোগ পেলেও এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে ডাক পাননি। অথচ অন্য সকল দেশের একাধিক ক্রিকেটার ওইসব টুর্নামেন্ট-এ নিয়মিত খেলে। যে যাই বলেন, এসব টুর্নামেন্ট-এ সেরা খেলোয়ারগণই ডাক পায়।

পয়সা খরচ করে আপনি ভাল জিনিষই কিনবেন।

তিন মোড়লের প্রস্তাব নিয়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে তখন বিসিবি সভাপতির একটা কথা এখনও মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন যে, আগামী ১০ বছরেও নাকি বাংলাদেশের টেস্ট র্যাং কিং-এ কোন চেঞ্জ আসার কোন সম্ভাবনা নেই। আবার সাকিব আল হাসান যখন বলে “আমাদের কাছে বেশী আশা করবেন না” বা “প্রত্যাশার সীমাটা বোঝা উচিত” তখন নিশ্চয়ই এর কোন শক্ত ব্যাখ্যা আছে। আমার ধারণা এর ভেতরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আসল শক্তির পরিচয় বিদ্যমান।



অনেকেই বলবেন, আমাদের প্লেয়াররা এখন out-of-form আছে। তাই এমন হচ্ছে। আমিও বলছি, “Form is temporary but class is permanent”. আমাদের দলের ক্লাস প্লেয়ার কয়জন আছে? কয়জন ম্যাচ উইনার আছে? কয়জন পাওয়ার হিটার আছে? এদের কারো পক্ষে কি একাই যেকোন ম্যাচের গতিপথ পালটে দেয়া সম্ভব? ২/৩ বছর ধরে কতজন ধারাবাহিকতা নিয়ে খেলে যাচ্ছেন? কয়টা বড় ইনিংস আছে আমাদের? আইসিসি-র যেকোন র্যা ঙ্কিং-এ (দলগত বা ব্যক্তিগত) আমাদের অবস্থান কেমন? বছর বছর আইসিসি র্যাং কিং করে ওখানে আমাদের কয়জনের নাম আছে বা কোনকালে ছিল? সাকিবকে বাদ দিলে ওটা আমাদের জন্য ধু ধু বালুচর। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি২০ সবখানেই সর্বশেষ পজিশনটা যেন আমাদের জন্য রেজিস্ট্রি করা। সবশেষ টি২০ র্যা ঙ্কিং-এ আমাদের অবস্থান ১০! এগুলো আমাদের অদক্ষতারই প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

আমাদের এখানে কোন গ্রেট প্লেয়ার আগে যেমন ছিল না; এখনো নেই (একমাত্র সাকিব ছাড়া)। এমনকি জিম্বাবুয়ে ডেভিড হাটন, ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়, হিথ স্ট্রিকসহ অনেক গ্রেট প্লেয়ার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক ক্যাচাল না লাগলে জিম্বাবুয়ে এতদিনে অন্যরকম দল থাকত।

অভিজ্ঞতার কথা কেউ কেউ বলতে পারেন। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই টি২০ খেলছে; ৩৫ বছরের বেশী সময় ধরে ওয়ানডে খেলছে; টেস্ট খেলছে ১৫ বছর হলো।

টেস্ট বাদ দেন। টি২০ বা ওয়ানডেতে আমাদের বেটার পারফরমেন্স দেখানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ১০-১৫ ম্যাচ পর পর একটা করে ম্যাচ জেতা কোন সফলতা নয়। ধারাবাহিকভাবে জেতাই সফলতা। বাংলাদেশ যেদিন টপ এইটের মধ্যে ঢুকতে পারবে সেদিন থেকেই আমাদের সত্যিকারের সফলতার যাত্রা শুরু হবে।



ক্রিকেট বিশেষজ্ঞগণও বলছেন যে, সকল বিভাগে দক্ষতা বাড়াতে হবে বাংলাদেশকে। কাজেই ‘অন্য রকম কিছু’ দেখাতে হলে আমাদের দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নাই। দক্ষতা বাড়ানো যায় কিভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন বিশেষজ্ঞগণ। সকল সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেই বলছি, আমাদের পক্ষে আরো উন্নতি করা সম্ভব। তবে তার জন্য “যেতে হবে বহুদূর...”।

সাফল্যের সূত্র নিজের হাতেই। আর এর কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। এই পথ অনেক লম্বা। ক্রিকেটারদের সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা ক্রিকেট ক্রিকেট আর ক্রিকেট কেন্দ্রীক হতে হবে। তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

নিজেদের উইকনেস দূর করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সাতারু মাইকেল ফেলপ্স এর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, “আমি জীবনে দুইটি কাজ শিখেছি; সাঁতার ও খাওয়া-দাওয়া”।

শক্তিশালী ঘরোয়া লীগের অভাবঃ আমাদের ঘরোয়া লীগ বা টুর্নামেন্টগুলা খুব নিম্নমানের। বছরের মাত্র কয়েকমাস কয়েকটি দলের সমন্বয়ে খেলা হয়।

মাত্র বছর কয়েক আগেও একটা ২০০ রানের ইংনিংস চোখে পড়ত না। ইদানিং দু’একটা দেখা যাচ্ছে। তার মানে বড় ইনিংস খেলার যোগ্যতা আমাদের ৯৯% ব্যাটসম্যানেরই নেই। বড় ইনিংস খেলতে না পারার মানে হলো স্কিল, টেম্পারমেন্ট ও বেসিকের সমস্যা। তাহলে কিভাবে বিশ্ব মাতাবে আমাদের এইসব খেলোয়ারগণ? ক্রিকেট কি কয়েক মাসের খেলা? আর সেই রকম প্রতিযোগিতা কোথায়? ঢাকার কয়েকটা ক্লাব ছাড়া সারা দেশে কয়টা ক্লাব আছে? সেখানে নিয়মিত লীগ বা টুর্নামেন্ট হয় কি? আমাদের স্কুল ক্রিকেটের কি অবস্থা? উপরের সবগুলো প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়।

তাহলে খেলোয়ার পয়দা হবে কিভাবে? ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষুদে ক্রিকেটাররা আসবে; তাদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হবে-তবেই না ক্লাস খেলোয়ার পাবেন। আর এখন কি হচ্ছে? সব ‘বিড়াল বনে শেয়াল রাজা’। খুব বেশী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই আমাদের প্লেয়াররা এমনকি জাতীয় দলেও চান্স পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের বেসিক ভালভাবে তৈরী হওয়ার আগেই যুদ্ধে নেমে পরছেন। ফলে তুমুল স্রোতে (পড়ুন বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা সেরা প্রতিভার দাপটে) অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের পায়ের নিচের শক্ত জমিন আলগা হয়ে যাচ্ছে।



দেখা যাচ্ছে আতুর ঘরেই শিশুটি নানা রোগজীবাণু নিয়ে দৌড়ানোর চেস্টা করছে। তাতে দৌড়ে গতি সঞ্চার হচ্ছে না। ফলে অন্যের চেয়ে পেছনে পড়ে যাচ্ছি আমরা। কাজেই অবিলম্বে দীর্ঘমেয়াদী একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে; আজই। বিভাগীয় পযায়ে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক লীগ বা টুর্নামেন্ট আয়োজন করা এক্ষেত্রে জরুরী।

প্রতিবছর এসব লীগ বা টুর্নামেন্ট থেকে প্রতিভা বাছাই করে তাদের উত্তমরুপে গড়ে তুলতে হবে।

বিশ্বমানের ক্রিকেট একাডেমীর অভাবঃ এটা বিশেষ দরকার। বিকেএসপি এক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা রাখার চেস্টা করছে। কিন্তু ওখানে জ্যাম হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান প্রায় সকল খেলার আতুরঘর ওটা।

তবু সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে বলছি এটাকেই ঘষে-মেজে তৈরী করতে হবে। পাশাপাশি সারা দেশব্যাপী ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রোগ্রাম করে নতুন প্রতিভা খুজতে হবে। তার আগে দরকার দক্ষ, ক্ষুরধার কয়েকটি ক্রিকেট মস্তিস্ক। আছে আমাদের? না থাকলে হায়ার করতে হবে।

আশার কথা, বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারে একটি ‘ক্রিকেট একাডেমী’ করার পরিকল্পনা করছেন।

এটা হলে খুবই ভাল হবে।

আগামী পর্বে সমাপ্ত। পাশে থাকুন।

সবাইকে ধন্যবাদ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।