আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবিশঙ্করের মৃদু ধমক

১৯৮৩,বেইজিংএ পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথম সেতার বাদন অনুষ্ঠান । টিকেট নেই । আমার ভারতীয় বন্ধুরা ম্যানেজ করে ফেলল । এটি সেপ্টেম্বর মাসেই হয়েছিল । নতুন জাপানি টেপ রেকর্ডার আর ১৮০ মিনিটের টেপ সবই হংকং থেকে এনে দিয়েছিলেন প্রথম সচিব আজাদ ভাই।

দুদিকের স্পিকার খুলে মাঝের ইউনিট নিয়ে পৌঁছে গেলাম শিতানের কাছে একটি কনসার্ট হলে । হল ভর্তি মানুষ , সবচে বেশী বেইজিং থাকা বিদেশি ছাত্র আর কুটনিতিক । আমার সিট দোতালায়, ঝামেলা হয়ে গেল , রেকর্ডার ম্যানেজ করবে কে? মঞ্চের সামনে বিশাল স্পিকারের সারি । রেকর্ডারটা স্পিকারের সামনে বসিয়ে ভাবতে লাগলাম আর সামনের যারা বসা রয়েছে তারা কেঁউ কি আমার পরিচিত কিনা দেখতে লাগলাম। পাওয়া গেল যুগোস্লাভিয়ার ছাত্রকে, মুখ চেনা , তাঁকে অনুরোধ করলাম ।

ও সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল । আমি দোতালার ব্যালকনির সিটে বসে তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করছিলাম । পরদা উঠলো এবং দেখা গেল উপমহাদেশীয় স্টাইলে পণ্ডিত তার বাজিয়েদের নিয়ে বসে। যুগস্লাভিয়ান ছেলেটিকে দেখা গেল রেকর্ডারের কাছে যেতে, নিশ্চিন্ত হলাম । স্বাগত বক্তব্য দিয়ে বাদন শুরু করলেন ।

একজন অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী গাঢ় রঙের ভেলভেট পোশাক পরা তার অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন চীনা ভাষায় । খুব সহজিয়া রাগ দিয়ে শুরু করলেন । আলাপ দ্রুত সেরে বিস্তারে গিয়ে ঝালায় একটু সময় নিলেন । প্রায় সব রাগেই বাংলার পল্লীগীতি বা ভাটিয়ালির ছোঁয়া পাচ্ছিলাম । বিরতিতে নেমে দেখলাম সব ঠিক মতো আছে এবং ও পজ এ চেপে রেখেছে ।


দ্বিতীয় পর্ব শুরুতে রাগ কি এবং যন্ত্রের বর্ণনা দিলেন । সব যন্ত্র আলাদা করে বাজিয়ে দেখান হল । সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন । কিছুক্ষন বাদেই তার ছিঁড়ে গেল । তানপুরা চলতে লাগলো সাথে তবলার ধীর লয় ।

আমি আশ্বস্ত হওয়ার জন্য ব্যালকনির রেলিং ধরে বুঝতে চেষ্টা করছি আমার রেকর্ডার চলছে কিনা! পেছন থেকে সিস সিস আওয়াজ এলো , মাথা ঘুরাতেই দেখি কিছু বৃদ্ধ চীনা আমায় সতর্ক করছেন সরে দাড়াবার জন্য । মঞ্চের আলোয় ওদের মুখ দেখা যাচ্ছিল । আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম । কিছু বাদে ঘুরে বসে চীনাদের দেখতে শুরু করলাম । শিক্ষা দীক্ষা এবং আভিজাত্যের ছাপ বসে থাকা মানুসগুলোর মধ্যে ।

ওদের প্রায় সবারি হাতে ছোট টেপ রেকর্ডার এবং তা খুব আধুনিক, চীনে এসব পাওয়া যায়না , সবাই অনুষ্ঠান রেকর্ড করছে । এরা অবশ্যই উচু পদের এবং পার্টি মেম্বার বা রিটায়ার্ড শিক্ষক হবেন । আমার জন্য নতুন অনুভূতি কারন এই রাজসিক মুখগুলো রাস্তা ঘাটে সচরাচর দেখা যায়না ।
অনুষ্ঠান শেষ । দৌড়ে নীচে নেমে রেকর্ডার নিয়ে কারো একটা ছোট হেডফোনে একটু শুনলাম।

আমার আশার তুলনায় প্রচণ্ড ভালো রেকর্ডিং হয়েছে । এবার ছুটলাম পিছন দিকে বাইরের করিডর ধরে । আমি খুব নিশ্চিত ছিলামনা আমার লুকিয়ে রাখা ইচ্ছে গুলোর ব্যাপারে । উইংসের পাশ দিয়ে মঞ্চের পিছনের বড় ঘর টিতে পৌঁছে দেখি উনি একাই রেডিও বেইজিংকে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। আমি একটু দূরে দাড়িয়ে, হাতে ক্যাসেট আর সাইন পেন ।

আমার ঝোলার মধ্যে রেকর্ডার । একটি লোক, হলের স্টাফ হবে , বেয়াদবের মতো একটা মই নিয়ে ঠিক পণ্ডিত ও রেডিওর লোকদের মাঝ দিয়ে চলে গেল। তার মুখে একটা মজাক ভাব নিয়ে সে পণ্ডিত রবিশঙ্করের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল । ভাবখানা এই কি বাজালে গুরু , নাচ নেই গান নেই ,হুহ ! রেডিওর লোকটি তাঁকে আরও ভদ্র হবার জন্য কিছুটা ধমকে দিলো। আমি দাড়িয়ে অপেক্ষায় , কখন শেষ হবে সাক্ষাতকার ।

শেষ হতেই এগিয়ে ইংরেজিতে তাঁকে বললাম আমায় যদি অটোগ্রাফ দিতে তাহলে খুশী হতাম । ক্যাসেট দেখে তিনি আমায় শুধোলেন কি আছে এই ক্যাসেটে ? আমি অকপটে বললাম আপনার আজকের অনুষ্ঠান ধারন করেছি আমি । বিস্ময়ে কপালে চোখ তুললেন এবং একটু কড়া ভাষায় বললেন আমি তো বলে দিয়েছিলাম যে কোন প্রকার রেকর্ডিং নিষিদ্ধ । আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম আমি আসলে হলে ঢুকেছি দেরিতে তাই আপনার ঘোষণা শুনতে পাইনি । এবার বলে নেয়া দরকার রবিশঙ্করের জাতিগত পরিচয় আমার জানা ছিলোনা।

উদয়শঙ্করের দীর্ঘ নাসা আর ব্যালের ছবি দেখে আমি ধরে নিতাম এরা ভারতের পশ্চিম অঞ্চলের লোক । তো পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমার হাত থেকে কভারের কাগজটি নিয়ে কিছু বিরক্তি সহকারে বলতে থাকলেন আর কখনো এই কাজটি করবেনা । আমি দ্রুত তালে মাথা দুলিয়ে বললাম “কক্ষনই না” । আমরা ইংরেজিতেই কথা বলছিলাম । সাইন করতে করতে সেই মৃদু ধমকেই জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে এসেছ ? বাংলাদেশ ।

এবার তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমায় চমকে দিয়ে বাংলায় বলে উঠলেন এবং স্বর একদম নিচুতালে, বাংলাদেশের কোথায়? খুলনাতে । নিজেই টেনে নিলেন ক্যাসেট টি এবং তার চিরাচরিত নরম আর আদুরে কণ্ঠে বলতে থাকলেন জানতো কপিরাইটের ব্যাপার থাকে! ক্যাসেটের উপর বাংলায় সাইন দিলেন, আমি অভয় দিলাম আমি কাউকেই দেবনা এই ক্যাসেট । কেমন লাগছে চায়না? জী ভালো । কিসে কি করছ ? আমি ভাস্কর্যের ছাত্র , মাস্টারস করতে এসেছি । পরে জানলাম ওনার পূর্ব পুরুষদের বাড়ী খুলনার কাছে ফুলতলায় ।

তাইতো এতো আদর করে সাইন দিলেন একটি নয় দুটি ।
পিতৃভূমি বা মাতৃভূমির লোক পেলে আর তা যদি হয় পাশাপাশি গ্রামের তাহলে সবাই আপন ভেবে আদর করে,পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাই করেছিলেন। একজন খবর দিলো টি ভির লোক এসে গ্যাছে । উনি বিদায় নিলেন না হয় বোধকরি দেশীর সাথে একটু খোঁজখবর নিতেন কৌতুহলী হয়ে ।

ক্যাসেটটি এই ৩২ বছরে ফাঙ্গাস পড়ে গেছে ।

ওটা দোকানে দিয়ে সাফ করিয়ে আরেকটি ক্যাসেটে তুলে নিয়েছি । এখন সি ডি তে তুলব । রবিশঙ্করের মহাপ্রয়ানে ব্যাথিত হয়েছিলাম আর জেনেছিলাম মাইহার ঘরানার শেষ বাতি ছিলেন তিনি । জগত সংসারকে আলোকিত করে গেছেন পণ্ডিতজী যার কথা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ র ভাষায় রবি যখন মেঘমল্লার বাজায় তখন বৃষ্টি নামিয়ে ছাড়ে, ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল । রবি ছাড়া অন্যদের বেত দিয়ে পেটাতেন ভুল হওয়ার জন্য ।

উস্তাদ আকবর আলিকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন বাজনাতে ভুল করার জন্য । রবির সাথে নিজ কন্যাকে বিয়ে দিয়েছিলেন । এক বর্ণাঢ্য জীবন ছিল পণ্ডিত রবিশঙ্করের । আবারো নত শিরে স্মরণ করি যে আমায় মূল্যবান একটি সম্পদ দিয়ে গিয়েছিলেন । আমি তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি।











অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।