আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষ নামের কলঙ্ক : তেজগাঁও এসি ল্যান্ড আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার

তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেল এসি ল্যান্ডের (সহকারি কমিশনার ভূমি) দুর্নীতি, ঘুষপ্রীতি ও অদক্ষতা সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে তাকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মহাপুরুষের আমলনামা: তেজগাঁও এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) কার্যালয়ে প্রতিদিন যেসব ফাইল নথিভুক্ত হয়, তার বেশির ভাগ আদেশপত্রের (অর্ডারশিট) এক কোণে ১০,০০০, ১৫,০০০, ২০,০০০, ২৫,০০০, ৩০,০০০, ৩৫,০০০; আবার কখনো সংক্ষেপে ১০, ২০, ৩০, ৪০, ৫০, ১০০ প্রভৃতি সংকেত লেখা থাকে। যার পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৪০ হাজার, ৫০ হাজার এবং এক লাখ টাকা। আর এসব হচ্ছে ঘুষের পরিমাণ বোঝানোর সংকেত। বেশির ভাগ ফাইলের ওপরই এভাবে ঘুষের অঙ্ক লেখা থাকে।

স্বয়ং এসি ল্যান্ড আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার নিজ হাতে ঘুষের অঙ্কগুলো লিখে দেন। জমির নামজারি কিংবা মিস কেস করতে আসা কোনো ব্যক্তি উল্লিখিত টাকা ঘুষ হিসেবে না দিলে তার ফাইল নামঞ্জুর করে গোডাউনের স্তূপে ফেলে রাখা হয়। এটাকে ভূমি প্রশাসনে নজিরবিহীন দুর্নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নগরীতে কর্মরত একাধিক এসি ল্যান্ড। এ দুর্নীতির প্রমাণ এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। তেজগাঁও এসি ল্যান্ড কার্যালয়ে মিস কেসের ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমাণটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

জমিসংক্রান্ত ছোটখাটো সমস্যা সংশোধনের জন্য দাখিল করা আবেদনকে মিস কেস বলা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫০ হাজার টাকার কমে কোনো মিস কেসের নিষ্পত্তি হয় না। সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে লেনদেন হয়। দাবিকৃত ঘুষ না পেলে মামলা নিষ্পত্তি না করে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়। এসি ল্যান্ড অফিসে কথা হয় মিস মামলার একাধিক বাদীর সঙ্গে।

তাঁরা জানান, এসি ল্যান্ড কারো ফাইলের এক কোণে ৫০, কারো ফাইলে ৬০ হাজার টাকা ঘুষের সংকেত নিজ হাতে লিখে দিয়েছেন। নামজারি করতে আসা একজন মহিলা জানান, অনেক কষ্টে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করে তিনি এসি ল্যান্ডের হাতে দেন। ঘুষের টাকা কম হওয়ায় এসি ল্যান্ড রেগে যান। উল্টো ওই মহিলার বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ তুলে তাকে অফিসে আটকে রাখা হয়। পরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান।

এটি গত মার্চের ঘটনা। সম্প্রতি বেশ কয়েক দিন তেজগাঁও এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে এমন শত শত ভুক্তভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা মাসের পর মাস ঘুরেও তাদের জমির নামজারি সম্পন্ন করতে পারছেন না। মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিতে পারার কারণে এ হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। তেজগাঁও কুনিপাড়ার বাসিন্দা হামিদুল হক বলেন, নামজারির ক্ষেত্রে সরকারি খরচ আড়াই শ’ টাকা হলেও তার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে। এ ঘুষ দিতে পারেননি বলে তার ফাইল নামঞ্জুর করা হয়েছে।

এর কারণ জানতে চাইলে এসি ল্যান্ড তাকে অপমান করে রুম থেকে বের করে দেন বলে হামিদুল অভিযোগ করেন। তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলের এসি ল্যান্ড স্বাক্ষরিত বেশ কিছু আদেশপত্র প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। প্রতিটি আদেশপত্রে এসি ল্যান্ড নিজেই ঘুষের পরিমাণ লিখে দিয়েছেন। দেখা গেছে, ২৩৬১/১২-১৩ নম্বর ফাইলের আদেশপত্রে ৩০ হাজার, ২৩০৪/১২-১৩ নম্বরে ২০ হাজার, ২৫৬৬/১২-১৩ নম্বরে ২০ হাজার, ২২০৩ নম্বরে ৫০ হাজার, ২৪৭৬/১২-১৩ নম্বরে ৩০ হাজার, ৪১৩২/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার, ৪১০৯/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার, ৪১৭০/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার, ৪১৬৭/১২-১৩ নম্বরে ৩৫ হাজার, ২৪১০/১২-১৩ নম্বরে ৩০ হাজার, ২৪৯২/১২-১৩ নম্বরে ১৫ হাজার এবং ২৪৭৮/১২-১৩ নম্বর ফাইলের আদেশপত্রে ১০ হাজার টাকা লিখা রয়েছে। যারা সংকেত অনুযায়ী ঠিকমতো ঘুষ দিয়েছেন তাদের ফাইল মঞ্জুর হয়েছে, যারা দেননি তাদের ফাইল নামঞ্জুর করে গোডাউনে ফেলে রাখা হয়েছে বলে একাধিক জমির মালিক অভিযোগ করেন।

অর্ডারশিটে সংক্ষেপে টাকার অঙ্ক লিখে দিয়ে কিংবা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ঘুষ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে ভূমি প্রশাসনে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে নজিরবিহীন হিসেবেও উল্লেখ করছেন। কারণ এর আগে আর কোনো এসি ল্যান্ড এভাবে দালিলিক প্রমাণ রেখে ঘুষ আদায় করেননি। ঘুষ নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসি ল্যান্ডের সুসম্পর্ক থাকায় বিষয়টি নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করতে সাহস পাচ্ছেন না বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মন্তব্য করেন। একজন এসি ল্যান্ড এ প্রতিবেদককে বলেন, “এসি ল্যান্ডের চাকরিটা সেবামূলক।

বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজ এসি ল্যান্ডের করা উচিত না। ” অভিযোগ পাওয়া গেছে, শুধু সাধারণ ভূমি মালিক নন, ভূমি প্রশাসনে কর্মরতদের কাছ থেকেও কাঙ্ক্ষিত ঘুষ না পেলে এসি ল্যান্ড কোনো কাজ করেন না। তার অফিসে কর্মরত কেউ সাধারণ একটি নামজারি ফাইল জমা দিলেও ফাইলপিছু ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। কেউ এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি সরাসরি বলে দেন, “সবাই ঘুষ খায়। তাকে দিতে অসুবিধা কোথায়!” বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রাজু আহমেদ তার নিজের একটি ফাইল নামজারি করার জন্য জমা দিলে তহসিলদার, কানুনগো, সার্ভেয়ার সবাই যাচাই-বাছাই করে কাগজপত্র সঠিক আছে বলে মতামত দেন।

কিন্তু এসি ল্যান্ড তার চাহিদামতো ঘুষ পাননি বলে সেই ফাইল (নামজারি নম্বর ৫০০৭/১২-১৩) নামঞ্জুর করে ফেলে রাখেন। অভিযোগ উঠেছে, নগরীর অন্য কোনো এসি ল্যান্ডও তাদের স্বজনদের নামজারির জন্য তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলে ফাইল জমা দিলে সেগুলোও ঘুষ না পেলে মঞ্জুর করেন না আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার। একাধিক এসি ল্যান্ড নাম প্রকাশ না করে এমন অভিযোগ করেছেন। দাবি অনুযায়ী ঘুষ দিয়েছেন এমন একাধিক ভুক্তভোগী বাংলানিউজকে জানান, বর্তমান তেজগাঁওয়ের এসি ল্যান্ড নিজ হাতে ঘুষ নেন। ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল তিনি মঞ্জুর করেন না।

তার চাহিদা মেটাতে না পারলে নানা অজুহাতে তিনি ফাইল আটকে রাখেন। এর ফলে প্রতিদিন তার অফিসে সেবাপ্রার্থীদের ব্যাপক ভিড় জমে। সাঁতারকুল এলাকার বাসিন্দা হাসনা বেগম জানান, তিনি তিন মাস ধরে এসি ল্যান্ড অফিসে ঘুরছেন। মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে না পারায় তিনি নামজারি শেষ করতে পারছেন না। অথচ এই নামজারি শেষে তিনি জমি বিক্রি করে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করাবেন।

ঢাকায় কর্মরত কয়েকজন এসি ল্যান্ড বলেন, “ভূমি অফিসে ঘুষ লেনদেনের ব্যাপারটি নতুন নয়; কিন্তু আদেশপত্রে নিজ হাতে সংকেত দিয়ে ঘুষ আদায় করার বিষয়টি নজিরবিহীন। ” ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান এসি ল্যান্ড তেজগাঁও রাজস্ব সার্কেলে যোগদানের পর থেকে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছে। এই সার্কেলের ফাইলেই সে প্রমাণ রয়েছে। দাখিল করা ফাইলের মধ্যে ৮০ শতাংশ নানা অজুহাতে আটকে রাখা কিংবা নামঞ্জুর করে গোডাউনে ফেলে রাখা হয়। এতে এই সার্কেলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তহসিলদার (সহকারী ভূমি কর্মকর্তা) বাংলানিউজকে জানান।

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মনোজ কুমার রায় বলেন, “এই এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেসব অভিযোগ তলিয়ে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ” ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনে বলা হয়েছে, নামজারি করার মূল উদ্দেশ্য হলো খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) আদায় করা। অন্যদিকে জমির মালিকানা পরিবর্তনের পর নামজারির মাধ্যমে রেকর্ড সংশোধন করে থাকেন ভূমি মালিকরা।

এ ক্ষেত্রে এসি ল্যান্ডের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। অথচ তেজগাঁও সার্কেলের এসি ল্যান্ড নামজারি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য খাজনা আদায়কে বাধাগ্রস্ত করছেন বলে তহসিল অফিস সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসি ল্যান্ড ঢাকা জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলে তার দপ্তরকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। কথায় কথায় তিনি তাদের নাম আওড়ান বলে মন্তব্য করেন নামজারি করতে আসা ভুক্তভোগী ইসমাইল হোসেন ইমু। অনুসন্ধানে জানা যায়, অফিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি এসি ল্যান্ড তার বাসায় নিয়ে যান।

বাসায় বসে ফাইলের গুরুত্ব বুঝে তিনি ঘুষের পরিমাণ নির্ণয় করে থাকেন। তার এ কাজে সহযোগিতা করে থাকেন বিশ্বস্ত কয়েকজন এমএলএসএস ও উমেদার (বহিরাগত সহকারী)। তারা ফাইলে উল্লিখিত আবেদনকারীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে এসি ল্যান্ডের পক্ষে ঘুষ নেওয়ার দেন-দরদার করে থাকেন। কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, ফোনে বলে দেওয়া হয় কত টাকা ঘুষ দিতে হবে। এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হলো, তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত অফিসে থাকেন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কর্মচারীদের অফিসে হাজির থাকতে বাধ্য করেন। বেশ কয়েক দিন সরেজমিনে তেজগাঁও এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। কা নগরীর ১৯১টি মৌজায় সিটি জরিপ অনুযায়ী জমির নামজারি, খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) আদায় ও মিস কেস সম্পূর্ণ করার কথা থাকলেও এসি আব্দুল্লাহ আল মামুন তালুকদার ঢাকার সাবেক এক ডিসির একটি পরিপত্রের অজুহাতে হাজার হাজার ভূমি মালিকদের হয়রানি করছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। ভূমি আইনে অতীতে রেকর্ডকৃত জরিপ সিএস, এস. এ এবং আর. এস তামাদি (বাতিল) হয়ে গেলেও তিনি সেসব জরিপ রেকর্ডে সামান্য খুঁত বের করে কাজ আটকে রাখেন। আবার মোটা অংকের ঘুষ দিলে সে কাজ ছেড়ে দেন।

তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা রহমতউল্লাহ জানান, আর, এস পর্চায় সামান্য কাটাকাটি থাকার কারণে এসি ল্যান্ড তার নামজারি বাতিল করে দেন। পরে তার কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। বাংলাদেশ ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনে বলা হয়েছে, সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট ম্যানুয়েলের ৫৩৩, ৫৩৪ ও ৫৩৭ বিধি অনুযায়ী দেশের প্রতিটি মৌজার জরিপ কাজ চূড়ান্ত হয়ে থাকে। যা একই আইনের ৩৪ (২) বিধি মোতাবেক গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এ গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে পূর্ববর্তী জরিপের রেকর্ড বাতিল হয়ে যায়।

নতুন জরিপের ওপর ভিত্তি করেই জমিজমা সংক্রান্ত সব রকম কার্যক্রম শুরু করতে হয়। সেভাবেই ঢাকার মাঠ পর্যায়ের ভূমি প্রশাসনে সিটি জরিপ অনুযায়ী খাজনা আদায় এবং নামজারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এসি ল্যান্ড আব্দুল্লাহ আল মামুন তালুকদার এ সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখান।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.