আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি মজাদার জার্নি -- ঢাকা টু খুলনা

সেদিন রাত ১০ টার গাড়ি ছিলো... কাউন্টারে গিয়ে জানলাম বাস টার্মিনালে আছে। ওইখান থেকে ঊঠতে হবে। মনের মধ্যে চিক্কুর দিয়ে উঠল। কারণ সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল আমার কাছে ভুলভুলাইয়ার মত লাগে, ছোট বড় অসংখ্য বাস লাইনের পর লাইনে এইদিক সেদিক দাঁড়িয়ে থাকলে কোন চিপায় কাংখিত বাস আছে খুজে পাওয়া আসলেই কষ্টের। অবশেষে অনেকক্ষন ঘুরঘুর করার পর বাসের দেখা.. ওখানকার মানুষদের মস্তিষ্ক অতিশয় উন্নত বলতে হবে, কারণ হাজার হাজার বাসের মধ্যে কোন চিপায় কোন বাস লুকিয়ে আছে তা হরহর করে বলে দেয়।

বাসের কাছে পৌঁছে দেখি বাবাজীর নতুন টায়ার লাগানো হচ্ছে... অতঃপর টায়ার লাগিয়ে , ইদঁরের গর্তের মত সায়দাবাদের কোন চিপার মধ্যে থেকে অসংখ্য বাস ঠেলে বের হয়ে যাত্রাবাড়ির মেইন রাস্তায় ঊঠতে সাড়ে ১১ টা বাজালো... পোস্তগোলা আসার পর বাস হুট করে থেমে যাই..এভাবে অনেক সময় দাঁড়িয়ে ছিলো। এদিকে পাবলিকরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছে এত দেরী কেন? বেচারা ড্রাইভারকে মনের সুখে অথবা দুঃখে বেধড়ক গালি ছুটছে.. এদিকে ড্রাইভার বেচারা অসহায়। আসল কারণ হল সেই বাসের কোন এক বড়সাহেব তার একজন ভি। আই। পি লোককে নিয়ে আসছে।

তিনি নাকি বাস মিছ করেছে। সেই একা লোকটির জন্য বাসের বাকি বহু যাত্রীর কষ্ট পেতে হল। ভি আই পি লোকদের কমন্সেন্স যে কেমন থাকে তা নিয়ে আমার আসলেই প্রশ্ন... কিন্তু তারা বুঝে না তাদের এই সময়ানুবর্তি না হওয়ার জন্য বাসের অন্য সকল যাত্রীদের অনেক দূর্ভোগ পেতে হয়। তারাও তো তার মতই একজন যাত্রী... আজ বাদে কাল ঈদ... স্বভাবতই বিভিন্ন দূরপাল্লার বাসে নাড়ীর টানে বাড়িমুখো মানুষদের উপছে পড়া ভীড় থাকবেই। ভয় হচ্ছিলো আদৌ টিকেট পাবো কিনা, সৌভাগ্যবশত কাঙ্ক্ষিত দুটো টিকেট পেয়ে গেলাম।

কিন্তু ৩০০ টাকার টিকেট পেতে আমায় ৪২০ টাকা গুণতে হল। দাম বাড়ার কারণ ঈদের টাইম... আমি তো লাকিলি সাথে সাথে টিকেট পেয়ে গেলাম অনেক নাকি টানা ১০ ঘন্টা ওয়েট করে তারপর টিকেট পেল , আর দাম যথারিতি বেটিং এর মত বেড়ে ৫০০ হয়ে গেলো। যাত্রীদের হয়রানী করার মোক্ষম সুযোগ তারা একটুও হাতছাড়া করে না। এই হল বাংলাদেশের মানুষ!!! চেয়ারকোচ গাড়ি লোকালের মত চলে এই সময়ে। কাল বাসে ভিতরে সীটছাড়া অনেক মানুষ তো ছিলো সাথে সাথে ছাদেও অনেক মানুষ ছিল... ছাদে চড়ে বাস জার্নি করার প্রবল ইচ্ছা আছে, করব একসময়।

পোস্তগোলা থেকে লেট করে গাড়ি ছেড়ে মাওয়া ঘাটে পৌছঁলাম কোন অসুবিধা ছাড়া। গিয়ে দেখি এইমাত্র একটা ফেরী ছেড়েছে। আরো একটু আগে আসলে ওই ফেরী ধরা যেত। যাত্রীরা সবাই খেপে চিল্লিয়ে ঊঠল- ওই জমিদারের জন্য এই ফেরীটা হাতছাড়া হয়ে গেলো। হওয়ারই কথা।

একজনের জন্য সবার দূর্ভোগের শেষ নেই। নতুন ফেরী আসা, ফেরীতে থাকা সব গাড়ি আনলোড করা তারপর আবার নতুন গাড়ি লোড করা অনেক সময়ের ব্যাপার। এভাবে বেশ কিছু সময় লেট হল। নদীমাতৃক দেশ আমাদের বাংলাদেশের নদীতে চলাফেরার জন্য আমার কাছে সবচাইতে সেইফ জার্নি মনে হয় ফেরী জার্নি। এবং কথাটা আসলেই সত্য।

আমি বহু লঞ্চ, স্প্রিডবোট, নৌকা ডুবতে শুনেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো কোন ফেরী ডুবতে শুনি নি। পদ্মার মাঝে লুকোনো বালুর চরে কখনো কখনো ফেরী আটকে যায় , এটা হয়। কিন্তু ডুবে না। আর ফেরিতে চলাফেরার মাঝে মজা হল এটি লঞ্চের মত দোল দোল দুলুনি স্টাইলে চলে না। লঞ্চের বদভ্যাস হল এটি চলে কম, দুলে বেশি... একেকটা ঢেঊ এর ঝাপটায় যেভাবে মুন্নী, শীলার কোমড় দোলানোর মত দুলতে থাকে তাতে জান বাবাজী গলার কাছে এসে আফ্রিকান ড্যান্স দিতে থাকে।

মনে হয় এই বুঝি গেলো গেলো কাত হয়ে পড়ে গেলো... বুঝেন অবস্থা দূর্বল হৃদয়ের মানুষের জন্য এটা কত ভয়ংকর। আমিও খুব ভয় পাই লঞ্চ জার্নি। আরেকটা হল স্প্রীড বোট। এটার কথা আর কি বলব। ঢেউ এর সাথে সাথে ধুম স্টাইলে যেভাবে একেকটা জাম্প দেয় , আমার ভাষায় উষ্টা খায় :p তাতে তো পেটের কোন নাড়ি ভুড়ি আস্ত থাকার কথা না... (অবশ্যই দূর্বল হৃদয়ের মানুষ দের জন্য) :p আর স্প্রীড বোটের উল্টানোর হার একটু বেশি ই বলা যায়।

বুঝেন তো ছোট জিনিস, যেকোন সময় ঠুসঃপ কিন্তু ফেরি তে চড়ে এমন কিছুই হবে না। যদিও ফেরীতে গন্তব্যে পৌছঁতে বেশি সময় লাগে তবুও আমার এটাকেই বেশি ভাল লাগে। গতকাল আকাশের অবস্থা আর নদীর অবস্থা দুটই খারাপ ছিলো বোধহয়। আমি কোন ফেরীতে উঠে এত দুলুনি খায় নি.. মনে হচ্ছিলো এই বুঝি গেলো গেলো... এভাবে হালকা পাতলা দুলতে দুলতে ফেরী ঘাটে পৌছল। সম্ভবত কাওড়াকান্দি ঘাট এটা।

ঘাটে এসে আবার সেই ফেরী সমস্যা। মাওয়া এপার, অপারের ঘাট অবশ্যই বড় নয় দুটো ফেরী একসাথে ভীড়ে থাকার জন্য। আরিচা ঘাটে আবার এই সমস্যা নেই। অখানের ফেরী গুলো যেমন বড়, ঘাট তেমন বড়। সমস্যার জন্য আগে থেকে ভীরে থাকা ফেরীকে আনলোড অবস্থায় সরে যেতে হল, তারপর আমাদের ফেরী ভীড়ে গাড়ি আনলোড হল।

আহ! ফেরী জার্নি এখানেই সমাপ্ত। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। কিছুদূর যেতেই এক মহিলার চিৎকারে ড্রাইভার বাধ্য হয়ে গাড়ি থামাল। মহিলা তার হাসব্যান্ডকে খুজে পাচ্ছে না। তার হাসব্যান্ডের কাছে কোন মোবাইল নেই।

যোগাযোগ ও করতে পারছে না। এইতো বাধল আরেক ফ্যাকড়া। এখন তাকে কই খুজবে সবাই। এদিকে সবাই খেপে এক্কেবারে গরম তাওয়া। সবাই চিৎকার করে বলছে ড্রাইভার সাহেব গাড়ি ছাড়েন।

দরকার নাই ওরে ঊঠানোর। কোন কমন্সেন্স নাই না কি?? অনেকে তো বলেই বসল এমন জমিদারগুলারে গাড়ি থেকে বাইর করে দেওয়া দরকার। আবার কেউ কেউ শৌল্পিক খুলনা ভাষায় গালি দিচ্ছে, গালি শুনে রাগার চাইতে হাসতে হাসতে পেটে খিল। তারপর হটাৎ হাসব্যান্ডের খোজ পাওয়া গেলো। তিনি মনের সুখে বাসের ছাদে বসে হাওয়া গিলছেন... মানুষ খেপে গিয়ে বলে—......:p না থাক শৈল্পিক ভাষার গালি এখানে না বলাই বাঞ্চনীয়।

পুরা বাস ব্যাটাকে খুজে হয়রান আর ব্যাটা কিছু না বলে ছাদে বসে আছে। পিনিক আর পিনিক :p বাসের ভীতর অদ্ভুত মানুষের কমতি ছিল না... একেক জনের একেক কর্মকান্ড। একজন কিছুক্ষন পর পর নিজের পকেট থেকে একই টাকা বারবার বের করে গুণছে। তিনি মনে হয় তার পকেটে টাকা নিয়ে সন্দিহান, কেউ চুরি টুরি করে নিলো নাকি। অথবা এ ও হতে পারে রোজার মাসে কোন মুযিজা হয়ে তার টাকা কাকতালীয় ভাবে বেড়েও যেতে পারে।

হেহে। পুরাই অদ্ভুত। আরেক পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক নিজের মোবাইলে হাই সাউন্ডে গান ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা শুনছে। বন্ধ করার নাম ই নেই। মানুষ তার জ্বালায় ঠিকমত ঘুমুতেও পারছে না।

একজন সাহস করে বলেই বসল- ঘুমাতে পারছি না, গান বন্ধু করুন না হলে হেডফোন লাগান। উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা ভদ্রলোকের মুখের চাহনী কেমন হয়েছিলো অন্ধকারে দেখতে পারি নি কিন্তু আমার মুখ হা ... পুরাই হা!!! পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক বললেন- এখানে ত কারো ডিস্টার্ব হচ্ছে না, কেউ তো কিছু বলছে না, না আপনার একার ই সমস্যা হচ্ছে, এখন ঈদের সময়। বাড়ি যাচ্ছে সবাই, মজা করেন, আনন্দ করেন!! আরেক মহিলার মোবাইলে একবার মুন্নী বাদনাম হুয়ি, শিলা কী জাওয়ানি গান হচ্ছিলো। এতে অল্পবয়স্ক এক মহিলা(কথাবার্তা শুনে মনে হয়ছে বাড়ি বরিশালে, নতুন বিয়ে, গ্রামের মেয়ে) বলে ঊঠল- ছি ছি কি গান শুনে ? এইগুলো কোন গান হইলো, লজ্জ্বা করে না একটুও... আরো হইলো ওই দুই জমিদার... :p আমার ভাষাতে নয় তাদের ভাষাতে কাওরাকান্দি ঘাটের কাছাকাছি ফরিদপুর জেলে সদর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে মালিগ্রাম হাটবাজার নামে এক যায়গায় এসে দেখি পাটের আশেঁর বিশাল হাট বসেছে। সব আড়তদার, পাইকারী , খুচরা বিক্রেতা হাজির... ভ্যান, ট্রাক্টরে আশঁ তুলছে... কেউ কেউ হাতে ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসেব কষছে আর কেউ কেউ টাকা গুণছে... বাংলাদেশের এই সোনালী আশঁ যে কতটা সোনার মত মুল্যবান তা আজ দেখলাম... রাস্তা ব্লক করে গড়ে ঊঠা বিশাল হাট পেরুতে অনেক বেশ কিছু সময় লেগে গেলো... পাটের আশঁ এর গন্ধটা ঠিক পচাঁ গোবরের মত।

হাটে এসেই নাকে বিধছিলো গন্ধটা। পাট পচিয়ে আশ ছাড়িয়ে তারপর আবার পচিয়ে সেই আশ অবশেষে হাটে তুলা হয় ... কেনা , বিক্রির জন্য। একজন কে জিজ্ঞেস করা হল- ভাই আপনারা রাস্তা বন্ধ করে পাটের ব্যাবসা কেন করছেন?? উত্তরে সে বলে- দুই ঘন্টা বসে থাকেন, পুলিশ, ডিবি পুলিশ এখানে এসে আমাদের পিটালেও এই হাট বন্ধ হবে না। চিন্তা করে দেখলাম। আসলেই ঠিক।

এই জীবিকা করে এক সম্প্রদায়ের মানুষ এভাবে দিন দিন প্রচুর টাকা অর্জন করছে আর এক দিক দিয়ে দেশের সমৃদ্ধি। অনেক সময় পাটের আশসহ টলার নৌকা ডুবির কথা শোনা যায়। যার এমন হয় তার মাথায় হাত পড়ে যায়, সর্বসান্ত হয়ে যায়। তারপর মানুষগুলো নিয়তির সাথে পাল্লা দিয়ে সোনালী আশের এই সোনার পিছনে ছুটে যায়... এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে অবশেষে খুলনা আসা... আমাদের চারপাশে বিচিত্র সব মানুষ, বিচিত্র সবকিছু, জীবনযাপন... এসবের খোজে বের হলে দেখা যায় এসবের বিচিত্রতার মাঝে নিজের জীবন ও একটা অন্যন্য বিচিত্রতার অধিকারী। এসব অভিজ্ঞতা জিবনের চলার পথে অনেক কাজে লাগে... জীবনে নতুন স্বাদ আনে।

কবি বলেছেন জীবনকে চিনতে হলে বাইরে বের হও... বিচিত্রতা তোমায় নিজেই খুজে নেবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.