আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মূর্ত বিমূর্তের মিলনে নিসর্গের কাব্য

এম, এ, মান্নান জলরঙে বাংলার প্রকৃতিকে জয়নুল আবেদিন হাত ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন, সুরেলা স্বরে জানিয়ে দিয়েছেন রঙের এই রহস্য। তাঁরই শিষ্য সৈয়দ জাহাঙ্গীর আমাদের পঞ্চাশ দশকের খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন। তার জীবন ও কর্ম পরস্পরের পরিপূরক এবং পরস্পরকে করেছে সমৃদ্ধ। তিনি জীবন থেকে পান আনুপ্রেরনা, প্রণোদন এবং তার কাজে তাঁর প্রভাব পড়ে। জীবনাভিজ্ঞতার সারাৎসার এবং নির্যাসকে তাঁর কাজে তিনি পরিবেশন করেন এক অত্যন্ত পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত উপায়ে।

সংবেদনশীল এই শিল্পীস্বত্বা তাঁর ক্যানভাসে একই সাথে শক্তি ও ঋজুতার প্রকাশ ঘটান। বলা যায়, জীবনের বিপরীত অনেক গুলি ভাব ও বোধের সম্মিলন ঘটিয়েছেন তাঁর ছবিতে। সৈয়দ জাহাঙ্গীর তাঁর সমাজ, পৃথিবী, ও মানুষকে নিবিড় ভাবে অবলোকন করেন এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা পৃথিবীর সত্য হয়ে তুলির মাধ্যমে ক্যানভাসে ধরা দেয়। তা তিনি নিজের মত করে সাজান- বিভিন্ন ফর্মে, রং, রেখা, ও চিত্রপটের নিজেস্ব বিন্যাসে। বিমূর্তায়নকে এবং বিমুর্ত প্রকাশবাদকে তিনি নতুন ব্যাঞ্জনায় উপস্থাপন করেন, আবার ক্যালিগ্রাফি ধর্মী কাজে থাকে এক ধরনের ধ্যানমগ্নতা, যা গভীর অনুসন্ধানী হয়ে ধরা দেয়।

আপন সৃজন ও মননে দেশের শিল্পকলা ভুবনকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছেন এই চিত্রশিল্পী। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ক্ষেত্রেই সমকালীন চিত্রকলা অঙ্গনে রেখেছেন সাফল্যের স্বাক্ষর। দেশের মাটি ও মানুষের মর্মযাতনার অনুভব তাঁর সৃজনধারাকে করেছে বৈশিষ্ট্যময়। চিত্রপটে নানা ভঙ্গিমায় চিত্রিত হয়েছে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা ও বেঁচে থাকার আর্তি। এভাবেই শিল্পীর সৃষ্টির বৈভবে রূপময় হয়েছে দেশজ চারুকলার আঙ্গিনা।

তাঁর চিত্রপটে মানুষের আশা-আকাঙ্খা ও বেঁচে থাকার আর্তি নানাভাবে ও ভঙ্গিতে চিত্রিত হয়েছে। মাটি ও মানুষের দৃশ্যকাব্যে উদ্ভাসিত শিল্পীর ক্যানভাস। এছাড়াও শিল্পীর প্রাজ্ঞ চোখে দেখা স্বদেশের মায়াময় নিসর্গের রূপও সযত্নে ঠাঁই পেয়েছে ক্যানভাসে। সময়ের বহমানতায় এবছর আশিতম বর্ষে পদার্পণ করছেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এই বিশিষ্ট শিল্পী। আর আশিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে শিল্পীর ৩৬তম একক চিত্রকলা প্রদর্শনী।

ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর শিরোনাম মাটি ও মানুষ। শিল্পীর ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে হাল আমলের আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রদর্শনী। এ্যাক্রিলিক, তেলরং, জলরং ও ড্রইং মাধ্যমে সৃজন করা চিত্রকর্মগুলো। আধা-বিমূর্ত ও মূর্ত ছবিগুলোয় আছে প্রাণের স্পন্দন। রঙের ব্যবহারে আছে সজীবতার ছোঁয়া।

পাওয়া যায় বর্ণের উল্লাস। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ৬০ বছর ধরে ছবি আঁকছেন। মনে প্রানে প্রবীণ যুবা, বেশভূষা এবং চিন্তায় তিনি চির তরুন যুবকের নিরীক্ষা, সাহস এবং উদ্দীপনাসমূহ তাঁর ছবিতে এখনো ভাস্বর। প্রথমে শুরু করেছিলেন জলরঙের মাধ্যমে । এর আগে ছিল ড্রইং নৈপুণ্য যা সে সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল।

বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকের মাঝামঝি সময়ে প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত একচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে। এরপর বাস্তববাদে খরখরে তুলি ও দৃঢ় রেখার ফর্ম, কিউবিক রীতিতে কাজ করে সফলতা প্রমান করেছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরের কাজে জলরঙের পথে এক নতুন এলো পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে। এসময় তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান জলরং শিল্পী জন মারিনের কাজ নতুন করে উদ্দীপিত করে জাহাঙ্গীরকে।

বর্নের উল্লাস ও উদ্দাম উধাও বেগটা তিনি প্রকৃতিতে একটা আলাদা ভাব হিসেবে ধরে রাখতে চাইলেন। কিন্তু শৈলী বিদেশী হলেও মনে প্রানে স্বদেশী হওয়ার কারনে ছবি গুলো হয়ে উঠে ভিকশনারি। সত্তরের দশকের শুরু থেকে আশির দশকের শেষ অবধি পর্যন্ত তিনি মরমি ভাবনায় প্রকৃতি অন্ততাকে আঁকেন “অজানার অন্বেষায়” শীর্ষক সিরিজে। অন্য অনেক ছবিতে তিনি বর্নের বিচিত্র বিচরণ ভেদ করে প্রস্ফুটিত ফুল ও কালির মত গড়েন। শিল্পী জাহাঙ্গীরের ‘মাটি ও মানুষ’ নামক একক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত ছবি গুলোতে প্রকৃতি ও মানুষের নানা অনুষঙ্গ খুবই যত্ন ও অভিনিবেশ-সহকারে তুলির ছোঁয়ায় উঠে এসেছে।

নির্মাণ শৈলীতে এসেছে আশ্চর্য এক সহজ ছন্দ, যা তাঁর সৃষ্টিকে করে তুলেছে তাৎপর্যময়। কাজের বড় অংশজুড়ে আছে নিসর্গ, নদী ও মানুষের বেচে থাকার প্রাণপণ সংগ্রামের আলেখ্য। অবয়ব গঠনের শৃঙ্খলা শিল্পীকে করে তুলেছে বিশিষ্ট। শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ছবির প্রধান উপজীব্য শ্রমজীবী মানুষ। কৃষিজীবন ও জেলেজীবনকে রং, রেখা ও বিন্যাসের সমন্বয়ে উপস্থাপন করেছেন ক্যানভাসে।

আর এই কৃষি ও জেলেজীবনের সঙ্গে সহজাতভাবে চিত্রপটে উঠে এসেছে প্রকৃতির রূপময়তা। এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা “সমঅধিকার” শিরোনামের ছবিতে আছে বেঁচে থাকার জন্য নারী-পুরুষের সম্মিলিত শ্রমের কথা। একটি গ্রাম্য খালকে দুই ভাগে ভাগ করে মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে মেঠোপথ। আর পূর্ণিমার রাতে সে মেঠোপথে সমানতালে শ্রমে নিয়োজিত একদল নারী-পুরুষ। প্রকৃতি ও মানুষের এক অপূর্ব মেলবন্ধন এই ছবি।

এ যেন উজ্জ্বল বর্ণের বিপরীতে বিপুল ফর্মের সন্নিবেশ। এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা “ধৈর্যময় অপেক্ষা” নামের অপর ছবিটি যেন বলে যায় জীবনের এক অন্যরকম গল্প। নদীর ধারে নৌকায় বসে থাকা এক গ্রাম্য নারী অধীর অপেক্ষার প্রহর গুনছে তার প্রিয়জনের জন্য। “গন্তব্য অভিমুখী” শীর্ষক চিত্রকর্মে জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরের পথে পা বাড়ানো প্রান্তিক মানুষের দেখা মেলে। “জীবনের প্রয়োজনে ১ ও ২” ছবিতে জীবনের প্রয়োজনে নগরায়ন হচ্ছে টা বুঝাতে চেয়েছেন।

পানির ট্যাংক, ইটভাটার বিশাল চিমনিগুলো এবং ধুঁয়া উদগিরন ইত্যাদিতে নাটকীয় ভাব উদ্ভাসিত হয়েছে। “পূর্ণিমায় প্রেম” শিরোনামের ছবিতে উদ্ভাসিত হয়েছে ভালবাসার দৃশ্যকাব্য। নীল জমিনে আঁকা চিত্রপটের এক কোণে উঁকি দিয়েছে আলোময় চাঁদ। আর সে স্নিগ্ধ আলোয় চরম আবেগে একে অপরকে আলিঙ্গনে বাঁধছে প্রেমিকযুগল। “মা ও শিশু” শিরোনামের ছবিতে সন্তানকে পরম যত্নে বুকে আগলে রেখেছে মমতাময়ী এক নারী।

এভাবেই সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ছবিতে মানুষের শ্রম-ঘাম, ভালবাসা ও বন্ধনের দৃশ্যকাব্য উঠে এসেছে। কাগজের ওপর অ্যাক্রিলিকের কালো রেখায় গ্রামবাংলা, ফসলের ক্ষেত, ঘাটে বাঁধা নৌকার সারি - এসব বিষয়ও যেন হুট করে শিল্পীর রৈখিক দক্ষতা আর বৈশিষ্ট্যের আলোকে ভিন্ন আরেক বিষয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায় - যেখানে চিত্রকর্মকে শিল্পীর তুলির টানের কিংবা আঁচড়ের পথ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া যায়, আবার একই সঙ্গে চিত্রকর্মের সমগ্র শিল্পযাত্রাকে খুঁজে পাওয়া যায় বিস্ময়ে। মাটি ও মানুষ প্রদর্শনিতে তিনি বেশির ভাগ ছবিতে ফিগারেটিভ থিম ও নের্যে টিভ কম্পোজিশন ব্যবহার করেছেন। ছবিতে নীল, হলুদ, সবুজ ও গোল্ডেন কালারের অপুর্ব কম্পোজিশন দেখিয়েছেন। পাশে নীল রং ব্যবহার করে তিনি গভীরতা বুঝিয়েছন,হলুদ এবং গোল্ডেন কালার এখানে ফসল পাকা ও কাটার প্রতিনিধিত্ব করছে।

গ্রাম্য বা লোকশিল্পের ইঙ্গিত দিয়েছেন নদীর পাড় ও সুর্য, চাঁদ ব্যবহার করে। শিল্পী জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলে জানা গেল তিনি ২০০৭ সালে “নদী ও মাটি” নামে একটি একক প্রদর্শনী করেছেন। এতে আবার প্রমান হয়ে গেল দেশের সাথে তাঁর আত্মিক বন্ধন রয়েছে আর তার প্রভাব বার বার উঠে শিল্পকর্মে। ৮০টি চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজিত “মাটি ও মানুষ” শীর্ষক প্রদর্শনীটি শুক্রবার সন্ধ্যায় বেঙ্গল শিল্পালয়ে উদ্বোধন করেন শিল্পীর বন্ধু ও সুহৃদ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বেঙ্গল গ্যালারি অফ ফাইন আর্টসের পরিচালক সুবীর চৌধুরী।

এ সময় উপস্থিত সুহৃদ, বান্ধব ও শুভাকাঙ্খীরা এ অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে শুভেচ্ছা জানান। আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী সবশ্রেণীর দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রসঙ্গত, শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৫৫ সালে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। এটি তার ৩৬তম একক প্রদর্শনী।

চারুকলায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে 'একুশে পদক' লাভ করেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।