আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মূর্ত মরণ-মায়া

এক শব্দহীন শব্দের শাব্দিক অনুভূতি বালুর উপর খালি পায়ে হাঁটছে আলপনা। স্যান্ডেল দুটো হাতে নিয়ে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে পানির গা ঘেষে। হেঁটে যাচ্ছে আর বালির গায়ে পায়ের সেঁটে যাওয়া ছাপগুল দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে। কত পথ এ পা মাড়িয়ে এসেছে, এ পায়ের চিহ্ন কী আছে কোথাও ঠিক এমন করে ?মনে মনে একটু হাসলো,আর ভাবলো, কি সব ভাবছি আমি ! আজ আলপনার কি হয়েছে বুঝতে পারছে না। সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।

কোন কিছুই ভালো লাগছিলো না বলেই কাজের শেষে অফিস থেকে বের হয়ে সোজা চলে এসেছে এই ওন্টারিও লেকের ধারে। এ জায়গাটা আলপনার ভীষন প্রিয়। যখনই মনটা উথাল পাথাল করে তখনই চলে আসে নিরিবিলি এই লেকের ধারে। অবশ্য এখানে আসার একটা কারনও আছে বটে, যদিও বিষয়টা প্রকাশ্যে আনতে চায় না আলপনা , তবুও অবচেতন মনে সব কিছু উপচিয়ে ,সব জরা যন্ত্রণাকে উৎ ড়িয়ে একটি নাম বিদ্রোহ করে উঠে, জানিয়ে দিতে চায়, ‘আমি আছি ঠিক এইখানে’। কোথায় আছে রাতুল এখন? বলেছিলো অষ্ট্রেলিয়া নাকি অষ্ট্রিয়াতে চলে যাবে।

‘রাতুল, তুমি এখন কেমন আছো? এ কোন পায়ের আওয়াজ শুনছে আলপনা ? হঠাৎ করে জলের উপর চোখ পরতেই কা্র যেন ছাঁয়া মুখ দেখতে পেলো । আতঁকে উঠে একরকম চিৎকার করে ডেকেই ফেললো ‘রাতুল’! কি ব্যাপার ভয় পেয়ে গেলেন?- গম্ভির এক পুরুষ কন্ঠ। আচমকা জলের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে আলপনা লোকটির মুখপানে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। চিনতে চেষ্টা করলো, নাহ চিনতে পারছে না । লোকটি একটু হেসে আবার বললো, কি চিনতে পারছেন না? আমি জানি আপনি আলপনা আর আপনার স্বামী হাসিব।

এবার সত্যই লজ্জা পেয়ে গেলো আলপনা, দু;খিত আমি আসলেই চিনতে পারছি না। ‘কোন অসুবিধা নেই, আমাকে মনে না রাখারই কথা। আমি আপনাদের বাসায় একদিনেই এসেছিলাম আমার এক সিনিয়র বন্ধু কমলের সাথে। আপনার স্বামীর বন্ধু, বুয়েটে তারা এক সাথে পড়াশুনা করেছিল। আমিও বুয়েটের ছাত্র।

‘ অনেকগুলো কথা এক সাথে বলে অঞ্জন একটু লজ্জা পেলো। আলপনা কি আসলে চিনার চেষ্টা করছে অঞ্জনকে? আলপনার মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর আলপনা বললো,’মনে পড়েছে, সেতো অনেক আগের কথা। একদিনের দেখা তার উপর এতদিন পর ; আমাকে দেখে চিনে ফেললেন? ‘ একটু অবাক হয়ে আলপনা জিজ্ঞেস করলো। অঞ্জন জলের উপর চোখ ফিরিয়ে একটু মৃদু হেসে বলল , ‘হ্যাঁ চিনলাম , গাড়ি থেকে নেমে যখন হাঁটতে শুরু করলেন, তখনই মনে হচ্ছিলো আপনি সেই আলপনা।

তাই সাহস করে পিছু নিতে লাগলাম এবং অবশেষে আবিষ্কার করে ফেললাম। ‘অঞ্জনের মুখে স্বস্তির হাসি দেখে আলপনা ভাবতে শুরু করলো ‘আমাকে আবিষ্কার করার পিছনে তার আনন্দ কোথায় !’ ‘বাই দা বাই, আমার নামটা নিশ্চয় মনে নেই। ‘ বলেই অধির আগ্রহে উত্তরের অপেক্ষায় অঞ্জন। আলপনা একটু মুচকি হেসে বললো , ‘ না , আসলেই মনে নেই। ‘ ‘ আমি অঞ্জন।

‘ আলপনা আর কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। মনে মনে ভীষন বিরক্ত হচ্ছিলো, কেনো যে আমার নির্জনতাকে নষ্ট করতে এলো, এই লোকটা। অঞ্জন হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে বললো , ‘আমি কি আপনাকে ডিসটার্ভ করছি?’ ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে এই পৃথিবীতে, তা না হলে পৃথিবীটা কবে জঙ্গলে পরিনত হতো, মানুষে পশুতে কোন ভেদাভেদ থাকতো না। তারই রেশ ধরে আলপনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বললো, ‘না না , ঠিক আছে’। কথা কটা বলেই আবার চুপ হয়ে গেলো।

দুজন হাঁটছে বালুকাবেলায়। আর পায়ের চিহ্ন এঁটে দিচ্ছে বালুর বুকে। অঞ্জন লক্ষ করলো আলপনা পা টিপে টিপে হাঁটছে আর যেন কি ভাবছে। এলোমেলো বাতাসে আলপনার চুলগুলো উড়ছে, কেমন যেন আলুথালু লাগছে আলপনাকে। খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে পাশ থেকে অঞ্জন আলপনাকে লক্ষ্য করছে।

আচমকা প্রশ্ন করেই ফেললো, ‘আপনার কি খুব মন খারাপ?’ ‘ না না , চলুন ঐ পাথরটার উপর বসি’ বলেই আলপনা পানির গাঁ ঘেষা পাথরটার উপরে গিয়ে বসলো। অঞ্জনও পাশে বসতে বসতে বললো,’ আপনাকে কিন্তু দেখে বুঝা্র উপায় নেই যে , আপনি একজন বাঙ্গালী’ আলপনা একটু খেদোক্তি করে বললো, ‘আমি মনে প্রাণে বাঙ্গালী’ -তা আপনার সাথে কথা বলে বেশ বুঝতে পারছি। প্রথমদিন যেমন দেখেছিলাম আপনাকে , আপনি মাত্র কলেজ থেকে ফিরলেন, ঠিক আজোও এতদিন পরেও আমার কাছে একই রকম লাগছে। -এতে অবাক হওয়ার কি কিছু আছে ? প্রশ্নটা তিক্ষ্ণ করেই ছুঁড়ে দিলো অঞ্জনের দিকে। -না অবাক হচ্ছিনা।

ভাবছি একটা নারী কতটা সচেতন হলে যত্ন করে সব কিছু ঠিক রেখে; মানে স্বামী ,সন্তান, সংসার ঠিক রেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে। -ইচ্ছে আর চেষ্টা থাকলেই পারে। মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই পৃথিবীতে। -তবুও আপনাকে আমার ব্যাতিক্রম মনে হয়। আর অন্যসব নারীদের চেয়ে আলাদা।

-আমি নিজেকে মানুষ মনে করি, আর অন্যদের চেয়ে একদম নিজেকে আলাদা ভাবি না। সবার সাথে সুখে দুঃখে জড়িয়ে থাকতে চাই। আলপনা মনে মনে ভীষন বিরক্ত হচ্ছিল। এধরনের কথা শুনতে শুনতে কানের মধ্যে একটা তেতোভাব জন্ম নিতে শুরু করেছে। আর এ সব কথা ভালো লাগে না , কেন যে মানুষ এভাবে বলে বুঝতে পারে না ।

সে কি আলপনার বিশেষ দৃষ্টি আর মন আকর্ষনের জন্য বলে? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। আলপনা নিজেকে খুব ভালো করে বুঝে এবং জানে, অগত্যা এসবে কর্ণপাত না করে নীরবতা পালন করা শ্রেয় বলে মনে করে । অঞ্জন পানিতে ছোট্ট একটা ঢিল ছুঁড়ে আলপনার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলো, কি, চুপ করে গেলেন যে?’আলপনা স্বভাব সুলভ মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, ‘সন্ধ্যা নেমে এলো, চলুন ফিরা যাক’। প্রথম দেখার সেই দূর্লভ হাসিটা এক পলকে অঞ্জনের হৃদয়ে কাঁপনের ঝড় তুললো। অনিচ্ছ্বাসত্বেও অঞ্জনকে উঠে দাঁড়াতে হলো।

আলপনা আর কোন কথা না বলে হাঁটতে শুরু করলো, সাথে সাথে অঞ্জনও। পাশাপাশি দুটো মানুষ, চেনা অচেনার মধ্যবর্তী অবস্থানে রেললাইনের মত সমান্তরাল গতিতে চলছে। কারো মুখে কোন কথা নেই, যেন প্রকৃতির সকল নীরবতা তাদের উপর এসে ভর করেছে। অঞ্জনের খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আর কখনো কি আলপনার সাথে দেখা হবে কিনা !হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে চলে এসেছে পার্কিং স্পট এ। আলপনা হঠাৎ করেই বললো,’ ভালো লাগলো আপনার সাথে দেখা হয়ে, কথা বলে।

ভালো থাকবেন। আবার কখনো দেখা হলেও হতে পারে, কথা হলেও হতে পারে। ‘ কথা ক’টা বলেই গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই অঞ্জন আগ বাড়িয়ে বললো, ‘যদি কিছু মনে না করেন , তাহলে আমার এই কার্ডটা কি রাখবেন? বলেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কার্ড সহ হাতটি বাড়িয়ে দিল । । -‘ও, সিউর সিউর, থ্যাংস।

টেক কেয়ার, বাই নাও। ‘আলপনা অনিচ্ছ্বাসত্বেও হাত বাড়িয়ে কার্ডটি নিলো আর গাড়িতে বসেই স্টার্ট দিয়ে ধীরে ধীরে পার্কিং স্পট থেকে বের হয়ে গেল। আর অঞ্জন নির্বিকার চিত্তে আলপনার চলে যাওয়ার দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।