আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেবুর একটা লেখা খুব ভালো লাগল বলে শেয়ার করলাম

সাধারন একজন অপ্সরা , অধরা , অপার বিস্ময় । কোঁকড়ানো চুল । টলটলে চোখ । বাবার কোলে আড়াই বছরের ছোট্ট প্রিন্সেস । ‘অপ্সরা, আংকেলকে সালাম দাও’ , কয়েক সেকেন্ড ধরে EYE CONTACT এর চেষ্টা করছি বদ বুড়ি পাত্তাই দিচ্ছেনা ।

কড়ে আঙ্গুলে তুলতুলে স্পর্শে পেছন ফিরে দেখি দেখি হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়েছে আরেক রাজকন্যা । ‘ওর নাম অধরা , ও অনেক মিশুক’ । “ওমা ওটা আবার কে” ! ‘তোমাদের ভাবী ওর নাম রেখেছে অপার বিস্ময়’ । আমার দেখা প্রথম ট্রিপলেট । ট্টিপলেটের বাংলা শব্দ জানিনা , তবে আমার কাছে ট্টিপলেট মানে অপার বিস্ময় ।

নিউনেটাল ওয়ার্ডে দ্বিতীয় বারের মত অবাক বিস্ময়ের দেখা পেলাম । NICU তে চার দিনে তৃতীয় নাইট করছি । তৃষ্ণা কাকে বলে , ক্লান্তি কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি । বেবি ওয়ার্মারের তাপে , সাকার মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দে তখন আমি সপ্তম স্বর্গে । একটু পরপর বাচ্চা খারাপ হচ্ছে ।

CPR,UMBO BAG ADRENALINE AMINOPHYLLIN । এক বেডে ৩টা ৪টা করে পুটলি , কোনটা কাঁদে বুঝিনা , কান্নার হেভি মেটাল মিউজিক । বিরক্ত হয়ে বাচ্চা ঠান্ডা করতে মিনি রাউন্ড দিলাম । লাইন ধরে একেকটার মুখে লিটল ফিঙ্গার ধরছি আর এটেন্ড্যান্টগুলোকে ধমকাচ্ছি –শুধু শুধু বুড়ো হইছেন কিম্বা আপনি কেমন মা, একটা বাচ্চার কান্না থামতে পারেন না । মনে মনে হেভি পার্ট নীরব দা গ্রেট PACIFIER ।

যে গল্পে ছিলাম – সেই তিন রাজপুত্র । দেড় কেজি করে ওজন , NVD হয়েছে , একজন PNA STAGE-1 । সারা রাত বাচ্চার বেডের পাশে বসে থাকা সেই সব মা , তুলোয় মোড়া আদরের টুকরা ANGEL এবং EVER FRUSTRATED DOCTORS নিয়ে এই লেখা । পিউ চোখ আর মিউ চোখ । থার্ড ইয়ারে পেডি ওয়ার্ডের সময় এই নাম দেই ।

যে সব পিচ্চিগুলোর চোখ বড় বড় , কেমন বোকা বোকা ভোঁতা দৃষ্টি , টলটলে ঝাড়ি দিলে মনে হয় কেঁদে ফেলবে তারা হচ্ছে মিউ চোখ । কারো আবার চোখ শার্প , দুষ্ট দুষ্ট , দৃষ্টি অনেক ডিপ । মনে হয় চোখ দিয়ে কিছু বলছে সব সময় । এরা হচ্ছে পিউ চোখ । আমি মিউ চোখ , আপনি ? বাচ্চাগুলো কত নিশ্চিন্তে ঘুমায় ।

কোন এক ঘুম পরীর দেশ পেরিয়ে এসে গুমোট NICUতে কী সুন্দর করে আড়মোড়া ভাঙে । SUCKING REFLEX দেখার জন্যে বাচ্চাগুলোর মুখে আঙুল দিলে আঙুল টেনে নেয় আলতো করে । কী অদ্ভুত সেই স্পর্শ । অনেক নরম DELICATE তাই খুব কম ছোট বাচ্চা কোলে নেবার সাহস করেছি আগে । অথছ শুধুমাত্র ডাক্তার হয়েছি বলে নির্দ্বিধায় বাচ্চা খারাপ হলে বুকে চাপ দিচ্ছি (CPR) , মুখে UMBO করছি ।

বাচ্চা SHOCK এ থাকলে বা EXPIRE করলে বুকে আঙুলের দাগ বসে থাকে । PNAর বাচ্চাগুলোর SECRETION এসে যখন নাক মুখ ভরে যায় সাকার মেশিনের NOZZOLE যান্ত্রিক হাতে ওদের বুক পরিষ্কার করি । প্রত্যেকটা DEATH CERTIFICATE লেখা কষ্টের , প্রত্যেক মৃত্যু কান্নার । অনেক হাসি অনেক কান্না লুকিয়ে আমরা কসাই(ডাক্তার) হই । ‘হাসপাতালে একমাত্র OBSTETRICIANরাই রোগীর লোকদের সুখবর দেন , তাই আমি এই গাইনী এন্ড অবসের ডাক্তার হতে চেয়েছি’ ।

থার্ড ইয়ারে থাকতে কোন এক MALE GYNAE & OBS CONSULTANT বলেছিলেন । সে হিসেবে নিউনেটের ডাক্তাররা সম্ভবত সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ দেন । পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র মানুষের স্পর্শ তাঁরা পান আবার কুৎসিততম মানুষের দেখাও তাঁরা পান । প্রফেসর স্যারকে বলতে শুনেছি প্রায়ই কিছু বাচ্চা পাওয়া যায় যাদেরকে বাবা/মা(!) হাসপাতালে ফেলে রেখে গেছে । ‘বেওয়ারিশ’ শব্দটা জীবিত মানুষের সাথে মানায় না লাশ হলে অন্য কথা ।

‘দুই সন্তানের বেশী সন্তান নিলে সরকার পরবর্তি সন্তানকে চিকিৎসা দেয়া বন্ধ করে দিবে সামনে’ – সাথের সিনিয়র নতুন রোগী রিসিভ করতে করতে বলছিলেন পার্টিকে । যমজ বাচ্চা কিন্তু তারা তাদের পিতামাতার ৫-৬নম্বর সন্তান । রাত ১২টার পর ভাল-খারাপ যত রোগী পেডি বা নিউনেটে ভর্তি হয় সবগুলো ক্লিনিক থেকে ফেরত দেয়া । এক বেডে ৩-৪জন করে যায়গা দেয়া হয় , সরকারী হাসপাতাল এমন একটা যায়গা যেখানে কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হয়না । মিডিয়া-কখনো কখনো সরকার নিজেই সরকারী হাসপাতালের বদনাম করে আমি তাই সুযোগ পেলে একটু ADD দেই ।

আপনি যত রাত করেই আসুন না কেন , হয়ত মাটিতে থাকতে হবে , মাসি ওয়ার্ডবয় বখরা চাইতে পারে , নার্সেরা হয়ত ততটা চকচকে না , আমি নিজেই হয়ত আপনাকে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলব কিন্তু আপনি চিকিৎসা পাবেন প্রায় বিনামূল্যে । চিকিৎসা একটা টিম ওয়ার্ক ডাক্তার কখনো একলা কসাই না । কিছু গল্প কখনো বলা হয় না । কিছু অনুভূতি কখনো প্রকাশ করা যায় না । ধরেন আপনি NICU (NEONATAL ICU) তে ডিউটি করছেন ।

সকাল ৮টা । ওয়ার্ডে ঢুকেই দেখলেন একটা বাচ্চা খারাপ । কোন দিক না তাকিয়ে CPR(CARDIO PULMONARY RESUSCITATION) এবং UMBO BAG চাপা শুরু করলেন । একদিনের অপুষ্ট বাচ্চা (PRETERM 7MONTH) । তার সর্বশক্তি দিয়ে বুকে বাতাস টেনে নিতে পারছেনা ।

নীল হয়ে আসছে শরীর । যন্ত্রের মত ছোট বুকে চাপ দিচ্ছেন , SUCKER MACHINE দিয়ে SECRETION CLEAR করছেন , দিদিকে ADRIN-AMINOPHYLLIN দিতে বলছেন , মাসিকে OXYGEN HOOD ঠিক করতে চিৎকার করছেন , বাচ্চার মাকে UMBO চাপতে শেখাচ্ছেন । যে মা পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন ৩টা মেয়ের পর অবশেষে এটা তাঁর প্রথম ছেলে সন্তান । পুতুল খেলার বয়স থেকে একটা ছেলে পুতুলের বড় শখ তাঁর । কৈশোর পেরোতেই যখন সংসারের জোয়াল কাঁধে , একটা ছেলে সন্তানের জন্য কত চাবুক পড়েছে পিঠে তার হিসেব কেউ রাখেনি ।

বার বার মেয়ে পেটে আসায় একটা মেয়ে ভ্রুণকে ওরা জন্মের আগেই মেরে ফেলেছ । আর আপনি গত রাতে ডিনার করতে পারেননি , আজ সকালে কখন নাস্তা করবেন , কখন FOLLOW UP দিবেন , ROUND এ স্যারের কাছে BED এর রোগী মারা যাওয়ায় জবাবদিহি করতে হবে , DISSERTATION এর কাজও বাকি-এই টেনশন করছেন । বাচ্চাটা যুদ্ধ করছে , তার মা যুদ্ধ করছে , হতাশার সাথে যুদ্ধ করছি আমরাও , আমরা সবাই সহযোদ্ধা । “দিদি 30CC NORMAL SALINE RUNNING দেন”-বলে CA আপু অন্য পাশে রুটিন ফলো আপ দেয়া শুরু করছেন । ‘আপু আমি করি’ ? (মনে মনে চাচ্ছি-আপু প্লিজ আর দুই মিনিট CPR , UMBO করেন) NICUতে জয়েন করতে মাত্রই এসেছি , সাত দিনের প্লেসমেন্ট ।

CPR দেয়ার শুরু এভাবেই । আপু এই বাচ্চাগুলোর FATE জানেন GONE CASE , আমি জানিনা তাই আমি চেষ্টা করবো , যতক্ষণ থাকে । এভাবেই ঐ বাচ্চা এবং পরের টানা দুই রাতের ডিউটিতে একই কাজ করেছি । একই কাজ আমার সিনিয়রেরা HMO IMO CAরা মাসের পর মাস করে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীন , আমাদের স্যারেরা রাউন্ডের সময় কতটা দরদ দিয়ে বাচ্চাগুলোর পাশে বসছেন , প্রত্যেকটা বাচ্চার অক্সিজেন কানেকশন ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখছেন তাঁদের ধন্যবাদ দিতে এই লেখা । যে মুহুর্তে আপনি এ লেখাটি পড়ছেন , বাংলাদেশের কোন না কোন হাসপাতালে ক্লিনিকে কিম্বা ব্যাক্তিগতভাবে একজন কসাই আপনারই কোন বন্ধু-আত্মীয়ের বাচ্চাকে CPR দিচ্ছে, চেষ্টা করছে যেন বাচ্চাটা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে ।

সবকিছু টাকায় কেনা যায়না , ধন্যবাদ না দিন অন্তত কসাইয়ের গালি দিয়েন না । (বি.দ্র. বদ পিচ্চি গুলার দুইটা মাত্র রিফ্লেক্ষ ঘুম ভেঙ্গে কাঁদবে , মুখে আঙুল দিলে ঠান্ডা(এই কথা অনেক বার বলেছি) আর ওরা ব্যাথা পেলে বা ভয় পেলে হিসু করবে , বদ তিনটাকে CBG করতে গিয়ে ওদের হিসুতে মাখামাখি হয়ে গেছি) চিকিৎসক সমাচার পেজ থেকে নেয়া.. ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.