আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কানাডায় ৭০ দিন - প্রথম পর্ব

আমার বাবা (তারেক-উল আলম) গত বছর কেনাডা বেড়াতে এসেছিলেন। কেনাডা থেকে দেশে ফিরে একটা বই লিখেছেন – ‘কানাডায় ৭০ দিন’। আজ থেকে ব্লগে ধারাবাহিকভাবে পর্বগুলো শেয়ার করবো। আজ পড়ুন এর প্রথম পর্বঃ কানাডার পথে যাত্রা শুরু ১০ জুন, শুক্রবার ২০১১ চট্টগ্রামের ঈদগাঁ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু কানাডার লন্ডন শহর অভিমুখে। বিকেল ৪টায় আমরা শ্যামলী বাস কাউন্টারে পৌঁছি।

শ্যামলী পরিবহনের সাথে ইত্তিহাদ এয়ার লাইন্সের চুক্তি তাদের চট্টগ্রামের প্যাসেঞ্জার ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছে দেয়ার। মাত্র ৭জন যাত্রী নিয়ে বিকেল ৫টায় বাস চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে। রাত ৮টায় কুমিল্লার চৌদ্দ গ্রামে যাত্রা বিরতি। আমরা নুরজাহান হোটেল থেকে রাতের খানা সেরে আবার যাত্রা শুরু করি। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ তদুপরি তীব্র যানযট।

অতএব ধীরে ধীরে গাড়ি এগোচ্ছিলো। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ঢাকার শাহজালাল আন্ত-র্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছতে রাত ১২টা। ব্যাগ-সুটকেস ট্রলিতে উঠিয়ে আমরা প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে প্রবেশ করি। রাত ৩টায় ইত্তিহাদ কাউন্টার খুলবে। তাই প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে বসে আমাদের অপেক্ষা করা।

ইতিমধ্যে খোঁজ নিতে শুরু করলাম টরন্টোর কোন সহযাত্রী পাই কিনা। কারণ, একে তো দীর্ঘ জার্নি আবার এপথে আমরা নতুন যাত্রী। সহযাত্রী পেলে আলাপ চারিতায় সুন্দর সময় কাটবে এবং ভ্রমনটাও হবে আনন্দময়। ভাগ্য সু-প্রসন্ন। প্রথম যে মহিলা যাত্রীটিকে টার্গেট করলাম তিনিই টরন্টোর যাত্রী।

একলা যাচ্ছেন। টরন্টোয় অনেক দিন থেকে আছেন। মিসেস রুবির সাথে আমাদের আলাপ শুরু হলো। মিসেস রুবির স্বামী ফরেন সার্ভিসে ছিলেন। বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে।

কি কারণে যেন চাকুরী ছেড়ে কানাডায় চলে যান সপরিবারে। কয়েক বছর আগে স্বামী মারা যান স্ত্রী এবং দুই কন্যা রেখে। অনেক দিন থেকে আছেন কানাডায়, থাকেন টরন্টোয়। দুই কন্যা নিয়েই থাকেন। বছর খানেক আগে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিলো আমেরিকান এক বাংলাদেশির সাথে।

কিন্তু কেন যেনো বিয়ে টেকেনি বেশি দিন। এখন চাকুরী করছে টরন্টোর কোন এক ব্যাংকে। ছোট মেয়ে টরন্টোয় ল’ প্র্যাকটিস করছে। এভাবে আলাপ চারিতায় পরস্পর পরস্পরের নৈকট্যে পৌঁছে গেলাম অল্প সময়ের মধ্যেই। মিসেস রুবিকে ও আমাদের মত সহযাত্রী পেয়ে যথেষ্ট আনন্দিত এবং নির্ভার মনে হলো।

ইত্তিহাদ কাউন্টার খুলেছে রাত ৩টায়। আমরা মালপত্র নিয়ে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ালাম। কাউন্টারে ডিউটি অফিসারকে বললাম আমাদের যেনো পাশাপাশি সিট দেয়া হয়। অফিসার আমাদের অনুরোধ রাখলেন। মালপত্র পরীক্ষা করে ওজন নিয়ে আমাদের পাসপোর্ট, বোডিং কার্ড এবং লাগেজের টেক নম্বর দিয়ে মালামাল তাদের হেফাজতে নিয়ে গেলেন।

এরপর কাস্টম চেকিং সেরে আমরা ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করি। ইমিগ্রেশনে অনেক ফর্মালিটিজ। সব ফর্মালিটিজ শেষে আমরা অপেক্ষায় থাকি বিমানে ওঠার। প্রচুর যাত্রী লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছে। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রকান্ড বোয়িং বিমানটি।

এই বিমানের গন্তব্য আবুধাবি। সেখান থেকে যে যার গন্তব্যে চলে যাবে। আমরা ধরবো টরন্টোর ফ্লাইট। এ ফ্লাইটে টরন্টোর যাত্রী খুবই কম। কিছু যাত্রী যাচ্ছে নিউইয়র্ক।

অধিকাংশ যাত্রীর শেষ গন্তব্য আবুধাবি। প্রায়ই যাত্রীই বাংলাদেশি। এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে। ছুটিতে এসেছিলো, আমিরাতের বিভিন্ন জায়গায় চাকুরী করে। একদল বাংলাদেশি মহিলা যাত্রী।

দেখে মনে হয় নতুন যাচ্ছে, হয়তো কোন সেবা প্রতিষ্ঠানে অথবা শেখদের বাসা বাড়িতে কাজ করবে। দু’ চোখে উদ্বিগ্নতা এবং বিষন্নতা। খোদা না করুন এরাই না আবার কখনো খবরের হেডিং হয়ে যায় ! অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। কোমল নারী কন্ঠের ঘোষণা আমাদের বিমানে যাওয়ার। বিমান আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ১নং গেট দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বিমানে প্রবেশ করি। বিমানবালা আমাদের নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দিয়ে এলেন। মনে হলো প্রকান্ড এক পাখির পেটে আমরা নীরবে বসে আরেক নবজম্মের প্রত্যাশায় ! বিমানের ভেতর আমাদের অধীর অপেক্ষা কখন বিমান আকাশে মাথা তুলবে। অবশেষে নির্দেশ এলো আমাদের সিট বেল্ট বেঁধে নেয়ার।

কোমরে সিট বেল্ট বেঁধে আমরা প্রস্তুত। এখনই বিমান আবুধাবির উদ্দেশে রওনা দেবে। সময় ভোর ৫.৩০ মিনিট। আস্তে আস্তে বিমান রানওয়েতে চলতে শুরু করলো। ৫-৭ মিনিট একইভাবে চলতে চলতে গতির পরিবর্তন এবং দ্রুত বেগে সামনের দিকে ছুটতে থাকা।

হঠাৎ শব্দের পরিবর্তন এবং পাখির মতো উপরের দিকে মুখ তুলে উড়তে শুরু করা। আস্তে আস্তে ধাপে ধাপে উপরে উঠতে থাকে বিমান। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি। ঢাকা শহর, রাস্তাঘাট, নদী-নালা, স্থাপনা দেখতে দেখতে মিলিয়ে যাচ্ছে। ভোরের আলোয় কি চমৎকার না দেখাচ্ছে ঢাকা শহর এবং বাংলাদেশের দৃশ্যপট ! অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমান মেঘের সাথে মিশে গেলো এবং এরপর মেঘের উপর।

উপরে দিগন্ত বিস্তৃত নীলাকাশ নিচে মেঘের ভেলা। হাতি ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক মেঘের কতো রকমের খেলা ! কতো রকমের দৃশ্য ! মনে হয় কোন শিল্পী তার মনের মাধুরী দিয়ে সুনিপুনভাবে তার শিল্প কর্মের কাজ করে চলেছে মেঘ মালা দিয়ে। আমরা সিট বেল্ট খুলে আরামে আয়েশে বসলাম। প্রচন্ড গতিতে বিমান ছুটে চলেছে আবুধাবির পথে। ব্রেকফাস্ট দেয়ার জন্যে ইতিমধ্যে বিমানবালাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে।

প্লেট কাপ পিরিজের টুংটাং আওয়াজ। সর্ব প্রথম আমার সিটে অর্থাৎ আমার জন্যে নির্ধারিত ছোট্ট টেবিলটিতে (যা আমার সম্মুখের সিটের পিছনের অংশের সাথে সংযুক্ত) বিমান বালা আমার খাবার প্লেট রেখে মিষ্টি করে বললো, ‘তোমার ডায়াবেটিক খানা’। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। কখন টিকেট কাটার সময় হয়তো ট্রাভেল এজেন্টকে বলেছিলাম আমার ডায়াবেটিস আছে। এতো দিনে আমি তা ভুলেই গিয়েছিলাম ! এখন হঠাৎ মনে হলো আমি বুঝি ডায়াবেটিক রুগী ! আশ্চর্য, বিমানবালা কাউকে জিজ্ঞেস না করেই ঠিক আমার পথ্য নিয়ে হাজির ! আমার জন্যে তাদের এতো আন্তরিক খেয়াল ! ইতিমধ্যে সবার সিটে নাস্তা পৌঁছে গেছে।

সবাই নাস্তা খেতে ব্যস্ত। আমার জন্যে সুগার ফ্রি রুটি-মাখন, সেদ্ধ পেঁপে, ফলমূল ইত্যাদি--স্বাদ বিহীন খাদ্য ! বিমানবালারা সরু প্যাসেজ দিয়ে ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সিটগুলো খুব ঠেসাঠেসি, প্যাসেজও সরু। এক রোতে ৮টি সিট। মাঝে ৪টি এবং প্যাসেজের দুই পাশে ২টি করে সিট।

নড়াচড়া একটু কষ্ট করই বটে। অথচ এই সরু প্যাসেজ দিয়েই বিমান বালারা দিব্যি ছোটাছুটি করছে। কোন বিরক্তি বোধ নেই। সব সময়ই হাসি হাসি মুখ। তদুপরি মধ্য প্রাচ্যের বাংলাদেশি প্যাসেঞ্জার, বিশ্বব্যাপী এ রুটে যাদের বিরূপ ভাবমূর্তি! একবারের জায়গায় পাঁচবার ডাকাডাকি--প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বারবার বিরক্ত করা ! কিন্তু হাসিমুখে সবই সহ্য করে এই বিমানবালারা।

এটাই যে তাদের ট্রেনিং ! আবুধাবি বিমান বন্দর বেলা ১০.২০ মিনিট (বাংলাদেশ সময়)। বিমান আবুধাবির আকাশে। সবাই সিট বেল্ট বেঁধে নামার প্রস্তুতি নিয়ে বসে। পরিস্কার আকাশ, ধূসর মেঘ। বিমান ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো।

নিচে আবুধাবি শহর-- সুন্দর ছবির মতো ! উঁচু উঁচু দালান, সু-প্রশস্ত রাস্তাঘাট। গাড়ি ছুটছে। এক দিকে আরব সাগর, জেলেরা ট্রলার নিয়ে মাছ ধরছে। অপর দিকে ধূ ধূ মরু প্রান্তর। বিমান ল্যান্ড করছে।

বিশাল বিমান বন্দর ! বিশাল রানওয়ে ! বিমানের দৌঁড় যেনো শেষই হয়না। পৃথিবীর সেরা বিমান বন্দরগুলোর মধ্যে আবুধাবি বিমান বন্দর অন্যতম। যৌলুসে, বিস্তৃতিতে, অবকাঠামোগত উন্নয়নে এবং নানান সুযোগ সুবিধায় এর সুনাম বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের প্রায় সব দেশের বিমান এখানে থামে, যাত্রী নামায়, তেল নেয়। অত্যন্ত ব্যস্ত বিমান বন্দর।

আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি। প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষের বসবাস এখানে। এদের প্রেরিত অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়তা করছে। তেল সমৃদ্ধ ধনীদেশ। শেখ শাসিত রাজ্য।

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বিমান কোম্পানী দুইটির মালিক আবুধাবির দুই শেখ-- একটি এমিরাত এয়ার এবং অন্যটি ইত্তিহাদ। আমরা এই ইত্তিহাদ এয়ার লাইন্সের যাত্রী। প্রায় পাঁচ ছয়শ যাত্রী একসঙ্গে বহন করে এক একটি বিমান। এক একজন যাত্রীর সাথে কমপক্ষে ৫০-৬০ কেজি মালামাল। এছাড়া বিমানের নিজস্ব ওজন, যন্ত্রপাতি, ইঞ্জিন প্রভৃতি....।

এতো সব নিয়ে হাজার হাজার মাইল উড়ে যাচ্ছে আকাশে, পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। চিন্তা করলে দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম ! ইতিমধ্যে বিমান ল্যান্ড করেছে। ১ নং রানওয়েতে বিমান। ৩ নং গেটে আমাদের যেতে হবে। টরন্টো ফ্লাইটের জন্যে আমাদের ওখানেই অপেক্ষা করতে হবে।

আমরা হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম বিমান থেকে। মিসেস রুবি আমাদের সাথে আছেন। তিনি এ পথের পুরোনো যাত্রী। সব নিয়ম কানুন পথঘাট তার নখ দর্পনে। আমরা তাকে অনুসরণ করে চলেছি।

তিনি সাথে থাকায় আমরা নির্ভার। এখানে ২ ঘন্টার যাত্রা বিরতি। ৩ নং গেটের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছে নানান দেশ এবং নানান শহর থেকে আসা যাত্রী। সবার গন্তব্য টরন্টো। ভাষা, চেহারা এবং বর্ণের ভিন্নতা।

বসন-ভূষণ ও ভিন্ন মাত্রার। অবশেষে ঘোষকের নির্দেশনায় আমরা ইমিগ্রেশনের চেকিং সেরে টরেন্টোর ফ্লাইটে আরোহনে চলেছি। দীর্ঘতম বিমান ভ্রমন দৈত্যের মতো এক বিশালাকার বিমান আমাদের অপেক্ষায় ৩ নং গেটে। এই বিমানে চড়েই আমরা টরন্টো যাবো। জীবনের দীর্ঘতম বিমান ভ্রমন, এক নাগাড়ে ১৪ ঘন্টা আকাশে উড়বো ! ভয়ে আনন্দে আমরা উচ্ছ্বসিত, রোমাঞ্চিত ! লাইন ধরে ধীরে ধীরে আমরা বিমানে প্রবেশ করছি।

মিসেস রুবি আমাদের সামনে। তাকে ডান দিকের পথ দেখিয়ে দিলো। আমরাও তার পেছন পেছন ডান দিকের পথই ধরতে যাচ্ছিলাম কিন্তু না আমাদের সেই পথে যেতে না দিয়ে বাম দিকের পথ দেখিয়ে দিলো। আমরা মিসেস রুবি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম! বিমানবালা আমাদের বিমানের পেছন দিকে নিয়ে গেলো এবং সিট নম্বর দেখে বসিয়ে দিলো। এবার জানালার পাশের দু’টো সিট আমরা পেলাম।

পাশের অন্য সিটটি তখনো খালি। মিসেস রুবির জন্যে হা- পিত্তেস করলাম! প্রার্থনা করলাম সিটটি যেনো খালি থাকে ! আমরা মিসেস রুবিকে খুঁজে এনে এখানে বসাবো। কিন্তু বিধি বাম ! একটু পরে এক তরুনী এসে পাশের খালি সিটে আসন নিলো। সুন্দরী। জিন্সের প্যান্ট- শার্ট পরা স্মার্ট তরুনী।

সোনালী চুল, কালো ডাগর চোখ, সু-গঠিত চমৎকার দেহ বল্লবী। অপূর্ব সুন্দর দেখতে। ভাবলাম ইরানী হবে বুঝি ! জিজ্ঞেস করতেই বললো পাকিস্তানি। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো ! কারণ পাকিস্তানিদের আমি একদম সহ্য করতে পারিনে ! পাকিস্তান নাম শুনলেই ’৭১ এর ভয়ংকর বর্বরোচিত নারকীয় দৃশ্যাবলী আমার দু’ চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে, আমি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠি! যাই হোক, লতাকে মাঝের সিটে বসিয়ে আমি জানালার পাশে চলে গেলাম ! এবারের বিমান ঢাকার ফ্লাইটের চেয়েও বড়। প্রতিটি রোতে (৩+৪+৩) ১০ জন।

ঢাকায় ছিলো ৮ জন। আমরা বিমানের পেছনের দিকের সিটে। সিট বেল্ট বেঁধে আমরা প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। বিমান ও প্রস্তুত ওড়ার জন্যে। ঘড়িতে ১০টা ২০ মিনিট- আবুধাবি সময় (আবুধাবি-বাংলাদেশ সময় পার্থক্য ২ ঘন্টা)।

বিমান রানওয়েতে দৌঁড়ানো শুরু করলো। বিশাল বিমান বন্দর। ঢাকার বিমান বন্দরের কয়েক গুণ বড়। বিমান মাথা তুললো আকাশের দিকে। প্রচন্ড শব্দ তুলে উড়তে শুরু করলো।

রাস্তাঘাট, বাড়িঘর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকলো। ধীরে ধীরে আবুধাবি শহর দৃষ্টি সীমার আড়ালে চলে গেলো। মেঘের নিচে বিমান। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের সাথে সংঘর্ষ বিমানের। কখনো মেঘ উপরে আবার কখনো বা বিমান।

মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিমান এবার সত্যি সত্যি মেঘের অনেক উপরে উঠে গেলো। উপরে পরিস্কার নীলাকাশ, নিচে পেঁজো তুলোর মেঘ- এছাড়া অন্য কিছু নয়। মেঘের দৃশ্য ভারি সুন্দর ! কখনো দেখা যায় মেঘের পাহাড়। কখনো বশিালাকার দত্তৈরে মতো ডায়নোসর, কখনো বা বাড়ি-ঘর, বাগান ইত্যাদি। মেঘের কতো খেলা ! আপনার কল্পনায় যা আসবে সবই মেঘ দিয়ে সৃষ্টি হয়ে যায়, সবই মেঘ দিয়ে সাজানো হয়ে যায়।

আপনি যে এখানে একজন শিল্পী ! আপনার শিল্প কল্পের মোহনীয়রূপ মনের মাধুরী দিয়ে আপনি সৃষ্টি করে চলেছেন এখানে। এ শিল্প কর্ম আপনার, একান্ত আপনার ! মেঘের সাথে খেলা করতে করতে আমরা মেঘের ভেলায় ছুটে চলেছি আকাশে। কি চমৎকার দৃশ্য, কি আনন্দময় অনুভূতি ! বাইরে উজ্জ্বল রোদ, উপরে নীলাকাশ। বিমান প্রচন্ড বেগে ছুটে চলেছে। সাত আটশ মানুষকে একান্ত নিরাপদে নিজ উদরে ধারণ করে ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে।

হঠাৎ টুংটাং আওয়াজ। দৃষ্টি ফিরে এলো ভেতরে। এয়ার হোস্টেজ ট্রলিতে খাবার নিয়ে, ড্রিংকস নিয়ে ছোটাছুটি করছে। আমার ডায়াবেটিক খানা সবার আগে আমার টেবিলে দিয়ে গেলো। আশ্চর্য, একটু ও ভুল করলো না ! ঢাকা থেকে আসার পথে ঐ একই অবস্থা।

আমাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না আমি কি খাবো ! স্বাদবিহীন খানা, সুগারবিহীন কফি ! টিকেট কাটার সময় কেন যে বলেছিলাম আমার ডায়াবেটিস! ডানাকাটা পরী এক একটা এয়ার হোস্টেজ ! আর্টিফিসিয়াল পরী ! আবার হাবসী নিগ্রো কুচকুচে কালো এয়ার হোস্টেজ ও আছে। দাঁত ঝকঝকে মুক্তোর মতো। চমৎকার ফিগার ! লাজুক, বিনম্র সু করুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। সর্বক্ষণ মুখে হাসি। দেখে মায়া লাগে ভীষণ।

সাদা পরীদের চেয়ে এই কালো পরীদেরই ভালো লাগে বেশি ! প্লেন এশিয়া মহাদেশ পার হয়ে ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে, জার্মানির বার্লিন শহরকে ডাইনে রেখে আল্পস পর্বতের উপর দিয়ে সোজা পশ্চিমে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে এক নাগাড়ে। মনে হয় জেট প্লেন সূর্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ! মাঝে মাঝে একটু বাম্পিং। আকাশের সেই একই দৃশ্য-- উপরে স্বচ্ছ রৌদ্র করোজ্জ্বল নীলাকাশ, নিচে ধূসর মেঘ রাশি! বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। দু’ চোখের পাতা কিছুতেই এক হচ্ছে না। এই আমার এক দোষ, ভ্রমনে কখনো আমার ঘুম আসে না।

প্লেনে, ট্রেনে অথবা বাসে আমি বই পড়ে সময় কাটাতে পারিনে। পড়াতে ধৈর্য থাকেনা, দৃষ্টি থাকেনা অক্ষরে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কল্পনা, এই যা ! পাশে আমার স্ত্রী নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন শিশু যেমন মায়ের কোলে ঘুমায় ! কখনো তার মাথা আমার ঘাড়ে। তার ঘুমের ব্যত্যয় ঘটবে সেই ভয়ে আমি চুল পরিমাণও নড়ছিনে। ঘুম থেকে উঠে বলবে, ‘জানো, একটা মজার স্বপ্ন দেখছিলাম’।

অথবা বলবে, ‘মোটেই ঘুম আসলো না’ ! প্লেনের অধিকাংশ যাত্রী ঘুমে অচেতন। ভেতরের প্রায় আলোই নেভানো। জানালার পর্দা সরানো সম্ভব নয়। কারণ প্রচন্ড দিনের আলো। জেট লেগের কারণে যাত্রীরা ক্লান্ত, অবসন্ন।

ইতিমধ্যে ৭/৮ ঘন্টা তো প্লেনের মধ্যেই কেটে গেলো। আরো অনেক সময় যে প্লেনেই কাটাতে হবে ! বিমানবালারা খাবার নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর পর ট্রলি ঠেলে এদিক থেকে ওদিক আসছে যাচ্ছে কিন্তু নীরবে, যাতে অন্যের ঘুমের বিঘ না ঘটে। ক্ষিদে নিয়ে তো আর বসে থাকা যায়না ! তাই খাবার খেতে মাঝে মাঝে জেগে ওঠা। চা-নাস্তা, জুস যার যা প্রয়োজন খেয়ে নিচ্ছে। একটু গল্প তারপর আবার ঘুম ! বাইরে সেই একই দৃশ্য-- রোদ, নীলাকাশ এবং নিচে মেঘের খেলা ! মেঘ কেটে গেলে আটলান্টিকের পানি চোখে পড়ে।

অনেক সময় বোঝা যায়না পানি নাকি মেঘের পাহাড় ! আরেক যন্ত্রনা বাথরুম ! পানির ব্যবহার নেই বলে লতা তো বাথরুমে যাবেই না ! সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকলেও সংস্কার। পানি ছাড়া কি ওয়াস হয় ! আমার আবার ওসবের বালাই নেই। জীবন যেখানে যেমন ! শুধু কষ্ট লাইন ধরে অপেক্ষা করা ! দিন যে আর শেষ হয়না ! জানালার সাটার সরালেই প্রচন্ড রোদ। তাই বাধ্য হয়েই সাটার বন্ধ রাখতে হয়। মনিটরে দেখা যাচ্ছে আমরা বেশ আগেই উত্তর আমেরিকার আকাশে এসে পড়েছি।

দেখা যাচ্ছে ওয়াশিংটনকে পাশে রেখে আমরা কানাডার বেশ কাছেই চলে এসেছি। তারপরও ঘন্টা তিনেক বাকি টরন্টো পৌঁছার ! শেষ বারের মতো প্লেনে আমাদের লাঞ্চ দিচ্ছে। এবারে আর আমাকে ডায়াবেটিক খানা দেয়নি, নর্মাল খানা দিয়েছে। বোধ হয় ভুলে গেছে ! আমি ও খুব তাড়াতাড়ি খাবার সাবাড় করে দিয়েছি। না জানি আবার যদি ডায়াবেটিক খানা দিয়ে যায় ! পোলাও, মাংস, মাখন পনির সবজি ইত্যাদি এবং হাল্কা মিষ্টি।

খেতে ভালই লাগলো ! খাবারের পর ড্রিংকস। আমি হাল্কা কফি খেলাম। সময় ঘনিয়ে আসছে আমাদের টরন্টো পৌঁছার । একবার মিসেস রুবির খোঁজ নিতে ঘুরে এলাম। এতো বড় বিমান, কোথায় যে বসে আছে ! টরন্টো নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।

আমরা ও মালামাল গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। সবাই ক্লান্ত। এতো দীর্ঘ পথ ! টরন্টোর পিয়ারসন বিমান বন্দর প্রায় ১৪ ঘন্টা একটানা ওড়ার পর বিমান এসে পড়েছে টরন্টোর আকাশে। বিমানের গতি শ্লথ। আস্তে আস্তে বিমান নিচে নামছে।

একবার মেঘের ভিতর আবার মেঘের উপর। এভাবে মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বিমান সত্যি সত্যি মেঘের নিচে নেমে এলো ! নিচে টরন্টো শহর দেখা যাচ্ছে। উঁচু উঁচু দালান, ছবির মতো রাস্তাঘাট, লেক, বনাঞ্চল সব কিছু স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। গাড়ি ছুটছে রাস্তায়। রাস্তা আর গাড়ি, গাড়ি আর রাস্তা।

মনে হচ্ছে গাড়ির শহর ! প্রকান্ড বিমান বন্দর ! কতো যে বিশাল তা ধারণা করতে পারলাম না। প্রচুর বিমান পার্কিং লটে। দু’চার মিনিট পরপর বিমান উঠছে আর নামছে। আকাশে সব সময় দুই একটি বিমান আছেই। আমাদের বিমান ১নং টার্মিনালে এসে থামলো।

যাত্রীরা সব একসঙ্গে উঠে দাড়িয়েছে। মনে হচ্ছে সবাই একই সাথে নেমে পড়বে। সবারই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। আর কতোক্ষণই বা বসে থাকা যায় ! কিন্তু বিমানের দরজা খুলছেই না। ১০-১৫ মিনিট সবাই অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে।

যাত্রীর অধিকাংশই এশিয়ান। এর মধ্যে বেশির ভাগই পাকিস্তানি। অন্যরা ইন্ডিয়ান, মধ্যপ্রাচ্য, শ্রীলংকান এবং বাংলাদেশি। অন্যান্য দেশের যৎসামান্য। মনে হলো প্রচুর পাকিস্তানি কানাডায় থাকে।

বেশ কিছুক্ষণ পর মানুষের নড়াচড়া শুরু হলো। বিমানের দরজা খুলেছে। আমরা আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলাম বিমান বালাদের গুড বাই, টেককেয়ার ইত্যাদি বিদায় সম্ভাষনের মধ্যে। বিমান বালাদের মুখে বিষন্ন বিদায়ের হাসি ! আমরা বিমান থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন আমাদের যেতে হবে ইমিগ্রেশনে।

আমরা হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটছি তো হাঁটছিই পথ যেনো শেষ হয়না ! মাঝে মাঝে স্কেলেটর আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাঁটার কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে। স্কেলেটরে আমরা উপরে উঠলাম। এখানে আবার লাইন ধরে এগোনো! অবশেষে আমরা ইমিগ্রেশনের কাস্টম কাউন্টারে এসে পৌঁছলাম এবং ইমিগ্রেশন অফিসারের মুখোমুখি হলাম। পাসপোর্ট, টিকেট, এরাইভ্যাল কার্ড ইত্যাদি তাকে দিতে হলো।

এরপর তার প্রশ্নের মুখোমুখি। কেন এলাম, কতোদিন থাকবো ইত্যাদি সব মামুলি প্রশ্ন। তিনি আমাদের কাগজপত্র দেখলেন, কম্পিউটারে দেখলেন আমাদের রেকর্ড। অবশেষে স্মিত হাসি এবং ধন্যবাদ ! কানাডা ভ্রমন আমাদের সুন্দর হোক, শান্তিময় হোক- এ আশীষ বাণী দিয়ে আমাদের পাসপোর্ট, টিকেট ইত্যাদি ফেরত দিলেন। আমরা ছাড়া পেয়ে মালপত্র নিতে ছুটলাম।

নির্দেশক আমাদের ১৩ নং বেল্টে যেতে বললো। সেখানে গিয়ে দেখলাম প্রচন্ড ভিড়। বেল্টের মাধ্যমে লাগেজ আসছে আবার ঘুরে অন্য বেল্টে চলে যাচ্ছে। যার যেটা আসছে টেনে নামিয়ে নিচ্ছে। আবার অন্যটির জন্যে অপেক্ষা।

প্রচুর মালামাল চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভুলক্রমে কেউ নিজের স্যুটকেস ভেবে অন্যেরটা নামিয়েছে কিন্তু বেল্টে পুনরায় তুলে না দিয়ে পাশে ফ্লোরে ফেলে রেখেছে। এরকম একটির পর অন্যটি। শুধু এই একটি জায়গায় শৃংখলাহীন অবস্থা দেখতে পেলাম। অনেক সময় লাগেজ তো পাওয়াই যায়না ! ২/৪ দিন পর খবর মেলে ‘তোমার লাগেজ পাওয়া গেছে, নিয়ে যাও’।

সেই ‘নেওয়া’ টা যে কতো ঝক্কির, কতো ঝামেলার ! আপনি তো আর টরন্টোতে নেই-- হয়তো দুই-চারশো মাইল দূরে চলে গেছেন। আমাদের বৌমার বেলায় তাই হয়েছিলো। আমার স্ত্রী লতা বড় হুঁশিয়ার আদমি ! বাসা থেকে রওনা দেয়ার পূর্বে তিনি প্রতিটি ব্যাগ এবং স্যুটকেসের হ্যান্ডেলে কাপড়ের লাল ফিতার ফুল বানিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন। আমি দ্রুত দু’টি স্যুটকেস পেয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে লতা দুই কানাডিয়ান ডলার দিয়ে ১টি বড় ট্রলি নিয়ে এলো।

স্যুটকেস ট্রলিতে উঠিয়ে অন্য দু’টির অপেক্ষায় থাকলাম। না অন্য দু’টি আসছেনা। বেল্টের বাইরে ফ্লোরে যে সব মালামাল এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে খোঁজা শুরু করলাম। অবশেষে অন্য প্রান্তে অনেক লাগেজের মধ্যে আমাদের স্যুটকেস দু’টির সন্ধান মিললো। লতার বাধা লাল ফিতার কারণে সহজে খুঁজে বের করা গেলো ! আমরা হা্ফঁ ছেড়ে বাঁচলাম ! ট্রলি নিয়ে বাইরে এলাম।

বাইরে এসে শুভকে খুঁজছি। শুভ তো এখানে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করার কথা ! আপনজন নিতে অনেকে এখানে অপেক্ষা করছে। প্রিয়জন পেয়ে আনন্দ চিত্তে চলে যাচ্ছে অনেকে। আবার কারো ধৈর্যহীন অপেক্ষা প্রিয়জন কখন আসে। শুভ তো অনেক আগেই এখানে আসার কথা ! এখান থেকে সে আমাদের লন্ডন শহরে নিয়ে যাবে।

কই, সে তো এখনো এলোনা ! তার কোন অসুবিধা হয়নি তো ? ভীষণ নার্ভাস লাগছে। মিসেস রুবিকে দেখে দ্রুত তার দিকে এগোলাম। মনে হলো তিনি ও আমাদের দেখেছেন কিন্তু না দেখার ভান করে কন্যাদের নিয়ে (সম্ভবতঃ সাথের মেয়ে দু’টি তার কন্যারাই হবে) আরো দ্রুততার সঙ্গে চলে গেলেন ! আমরা অসহায় বিহ্বলতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম ! ইতিমধ্যে প্রায় সব যাত্রীই চলে গেছে। আমরা হতাশায় পড়লাম। পথে স্বল্প পরিচিত এক বাঙালি পরিবারের শরণাপন্ন হলাম।

তাদের ফোন দিয়ে শুভকে ফোন করা হলো। শুভ এখনো পথে, আসতে আরো কিছু সময় লাগবে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ওয়েটিং রুমে বসে ওদের অপেক্ষায় থাকলাম । (ক্রমশ) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।