আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রকৃতির প্রতিশোধ ... বদরুদ্দীন উমর

আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত সামুদ্রিক ঝড় স্যান্ডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে প্রায় এক হাজার ২০০ মাইলজুড়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। ১০টি রাজ্য এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির ওপর আঘাতই সব থেকে বেশি। এ দুই রাজ্য প্রকৃতপক্ষে লণ্ডভণ্ড হয়েছে।

বিগত দুই দশকে অনেক সামুদ্রিক ঝড় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও পূর্ব উপকূল অল্পবিস্তর বিধ্বস্ত করলেও এবারকার এই ঝড়ের ব্যাপকতা ও তীব্রতা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সামুদ্রিক ঝড়ের এই গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে মনে হয়, এর মাত্রা ও ব্যাপকতা আরও বাড়বে এবং ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র উপকূল নিয়মিত বড় থেকে আরও বড় আকারে বিধ্বস্ত হবে। বিশ্বের জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকাই যে এই সামুদ্রিক ঝড়ের কারণ, এ নিয়ে কারও কোন সংশয় নেই। কিন্তু শুধু সামুদ্রিক ঝড়ই নয়, অন্য অনেক সমস্যা এই পরিবর্তনের ফলে ঘটছে। বিশ্বের বায়ুমণ্ডল ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে এবং এই উত্তাপের কারণে বনাঞ্চল ও কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গত আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যে উষ্ণতা দেখা গেছে, সেটা পূর্ববর্তী রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ এ ধরনের উচ্চমাত্রার উষ্ণতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। এর ফলে একদিকে বিশাল অঞ্চলজুড়ে দেখা গেছে খরা পরিস্থিতি এবং অন্যদিকে দেখা গেছে বনাঞ্চলগুলোতে অগ্নিকাণ্ড। শস্য উৎপাদন কমে এসেছে এবং অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৮০ লাখ একর বনভূমিজুড়ে গাছ ধ্বংস হয়েছে। সবেমাত্র সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির আঘাতে ক্ষতি মোটা দাগের হিসাব অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের মতো।

এতদিন দুনিয়াজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশ, বিশেষত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়মিতভাবে ও বর্ধিত আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চললেও এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মার্কিন পুঁজি মালিক ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা এই পরিবর্তন রোধ করার কোন চেষ্টাই করেনি। উপরন্তু একের পর এক মার্কিন প্রশাসন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে নিজেদের দেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে অঙ্গীকার করে এসেছে। অনুন্নত দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন যে ক্ষতি করছে তা পূরণ করা এবং এই পরিবর্তন রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে এসেছে। অথচ বিশ্বে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ সব থেকে বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হয়ে থাকে। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য তারাই সব থেকে বেশি দায়ী।

এদিক দিয়ে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করার কারণ নেই। উপরন্তু মার্কিন পুঁজির রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা যে এ ব্যাপারে কতখানি উদাসীন, সেটা সবেমাত্র শেষ হতে চলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিতর্ক, প্রচারণা ইত্যাদির মধ্যেও দেখা গেছে। দুই প্রার্থী ও তাদের শিবির তেল-গ্যাস নিয়ে সোচ্চার থাকলেও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করার সমস্যা নিয়ে কেউই একটি বাক্য ব্যয় করেননি, যা আগের কয়েকটি নির্বাচনের সময় তারা নমো নমো করে হলেও করেছিলেন। মজার ব্যাপার এই যে, ঠিক এ পরিস্থিতিতেই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রকৃতি এক ভয়ংকর প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। বিগত আশির দশক থেকেই বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হতে থাকার পরিস্থিতি এক মস্ত ভাবনার বিষয় হয়েছে।

কারণ এই পর্যায়ে এসে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস প্রকৃতিতে লক্ষণীয়ভাবে অনেক পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। আবহাওয়া পরিবর্তন, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, ধান, গম ভুট্টার মতো ফসলহানি, বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটা বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়ে যেসব পরিবর্তন এভাবে দেখা দিচ্ছে, এটা কোন বিশেষ ক্ষেত্রে থেমে থাকার ব্যাপার নয়। এই পরিবর্তন অদূর ভবিষ্যতেই এমন এক প্রাকৃতিক মহাসংকট ও বিপর্যয় ডেকে আনবে যা মানবজাতির অস্তিত্বকেই হুমকির সম্মুখীন করবে। এই উপলব্ধি থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টায় নিযুক্ত হয়। এ চেষ্টার উদ্যোগ যারা নেয় তারা হল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।

এই ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বিপুল অধিকাংশই আবার হল বিশ্বের দরিদ্র দেশ। বছরের পর বছর ধরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়ে এলেও এখনও পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলো গ্রহণ করেনি। এসব দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি ক্ষতির কারণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিল ও ভারত। এর সঙ্গে আছে অগ্রসর ইউরোপীয় দেশগুলো। এদিক দিয়ে জার্মানি ও জাপানের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন হলেও এরাই বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সব থেকে বেশি দায়ী।

একদিকে এ অবস্থা এবং অন্যদিকে আছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চল, আছে হিমালয় ও আলপসের মতো বরফ আবৃত পর্বতমালা। আছে আইসল্যান্ড। এগুলোতে বরফ গলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ বড় আকারে গলতে থাকায় সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ছে। এভাবে উচ্চতা বাড়লে হাজার হাজার দ্বীপ প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরে পানির নিচে চলে যাবে।

বাংলাদেশসহ সব দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল ক্রমশ যেতে থাকবে পানির নিচে। অন্যদিকে হিমালয়ের মতো পর্বতমালার বরফ গলতে থাকায় সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে কিছুকাল ধরে বিশাল আকারে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেবে। তারপর এমন সময় আসবে যখন হিমালয়ে আর এখনকার মতো বরফ থাকবে না এবং এই নদীগুলো শুকিয়ে যাবে। এই ভয়াবহ আসন্ন পরিস্থিতি কাল্পনিক নয়, বরং খুবই বাস্তব। বাস্তব ও ভয়ংকর যা ভাবতেও ভয় করে।

এই থেকে যে সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত তা হচ্ছে, পুঁজিবাদ শুধু শ্রমিকশ্রেণী ও সব শ্রমজীবী গরিবের শত্র“ নয়, এরা একই সঙ্গে মানবজাতির শত্র“। এমনকি এরা নিজেদের শ্রেণীর, নিজেদের পরবর্তী প্রজšে§রও শত্র“। কারণ প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হচ্ছে এটা কোন বিশেষ দেশের ব্যাপার নয়, এ এক বৈশ্বিক ব্যাপার। এই পরিবর্তন কোন দেশ, কোন রাষ্ট্র, কোন শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমগ্র মানবজাতি, প্রাণীকুল ও বৃক্ষ জগৎকে ধ্বংস করবে। কাজেই এর বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বের সব স্তরের, সব শ্রেণীর মানুষকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

গড়ে তুলতে হবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এমনকি নিজেদের শারীরিকভাবে রক্ষার জন্য পুঁজিবাদীদেরও দাঁড়াতে হবে পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত মুনাফার বিরুদ্ধে। এই সত্য উপলব্ধির সময় এখন এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণেরও। তাদের এখন বুঝতে হবে যে, প্রকৃতিকে রক্ষা করা প্রয়োজন প্রকৃতির স্বার্থে নয়, মানবজাতির অর্থাৎ তাদের নিজেদের স্বার্থেই। তাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, প্রকৃতিকে রক্ষার এই সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে বিশ্বের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম।

এই সংগ্রামের মাধ্যমে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করতে মানবজাতি যদি সক্ষম না হয় তাহলে তার ফলে তারা নিজেদের ধ্বংসই ডেকে আনবে, নিজেদের শারীরিক অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলুপ্ত করবে। ৩.১১.২০১২ বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল (যুগান্তর, ০৪/১১/২০১২) Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.