আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাচীন বাবু ইংলিশ কিংবা হালের বাংলিশ এবং আমাদের ইংরেজী শিক্ষা

হাউকাউ পার্টি ৬ শব্দের একটা বাংলা বাক্যের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে চারাট ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করাই বর্তমানের কথা বলার ফ্যাশান। এখন আমরা যেমন অনেকেই এই ধরনের ইংরেজী বাংলা জগাখিচুরী বাক্যকে যেমন বাংলিশ বলি, অনেক কাল আগে ইংরেজী শিক্ষার শুরুর যুগে কিছুটা এই ধরনের ভাষা প্রচলিত হয়েছিল 'বাবু ইংলিশ' নামে, খোদ ইংরেজীরাই তামাশা করে দিয়েছিল এ নাম। এই বিচিত্র ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হতো দরখাস্ত লেখা, কোর্ট-কাচারির আরজি বা সভা-সমিতির বক্তৃতায় কিংবা সংবর্ধনা তৈরিতে এবং অবশ্যই ইংরেজ প্রভুদের ভুয়সী প্রশস্তি করা হতো তাতে। সে সময়ে অনেক বড় বড় ইংরেজ সাহেব 'বাবু ইংলিশের রসে মজেছিলেন নিছক বিনোদনের জন্য, এমন কি লর্ড কার্জনের মতো প্রতাপশালী শাসকও। তিনি তাঁর 'এ্য ভাইসরয়'স ডায়েরী: লিভস ফ্রম এ্য ভাইসয়'স নোটবুক" বইতে উল্লেখ করেছেন তাঁর দপ্তরে যে সব বিপুল সংখ্যক 'বাবু ইংলিশে' লেখা চিঠিপত্র, আরজি ইত্যাদি জমা পরতো সেখান থেকে তিনি রীতমত বাছাই করে 'বাবু ইংলিশ' সংকলন তৈরি করেছিলেন! তবে যতই হাসাহাসি করা হোক না কেন ভাব প্রকাশে এই 'বাবু ইংলিশ' তেমন বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারেনি।

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক..... ১৮৯১ সালের আগে উপমহাদেশে যে রেলগাড়ি গুলো চলতো তাতে কোন টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না। তো একবার এমনই এক গ্রীষ্ম কালে এক বাঙালি বাবু ভরপেট কাঁঠাল খেয়ে ট্রেনে চাপলেন। একসময়ে এই কাঁঠাল তার পেটে গুরুচাপের সৃষ্টি করলো, কিন্তু ট্রেনের ভেতরে কোন টয়লেট না থাকায় সে দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষায় রইলো কখন পরের স্টেশন আসে। কিছু সময় পরে ট্রেন থামতেই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কিন্তু কপালে দূর্ভোগ থাকলে যা হয়.....আনুষাঙ্গিক কাজটা শেষ করার আগেই বদ গার্ড বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে দিল। বেচারা চমকে গিয়ে ফিরে চেয়ে দেখে হায়রে ট্রেন তো চলে যাচ্ছে, তখন বদনা হাতে বাবু দৌড়ে ট্রেন ধরতে গিয়ে অশেষ নাকাল হয়ে রেগেমেগে ট্রেন কতৃপক্ষকে একটা চিঠি লিখেছিলেন।

চিঠিটা ছিল এমন....... "I am arrive by passenger train at Ahmedpur Station and my belly is too much swelling with jackfruit. I am therefore went to privy. Just i doing the nuisance the guard making the whistle blow for the train to go-off and i am running with bodna in one hand and dhoti in the next when i am fell over and exposed all my shocking to man and female women in the platform. This is too much but if passenger go to make dung the dam guard not wait for five minutes for him." তবে তার এই এক সচিত্র চিঠিতেই কিন্তু কেল্লাফতে হয়েছিল। এই চিঠি পাবার পরই রেল কতৃপক্ষ ট্রেনের কামরায় টয়লেটের শুভ সূচনা করে। আরেকবার এক ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালির গায়ে একটা 'ফোড়াঁ' হলো, ফোঁড়ার ব্যাথায় কাতর হয়ে বেচারার অফিস করাটাই কষ্টকর হয়ে দাড়ালো। তখন সে বাধ্য হয়ে একটা ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন। দরখাস্তটি ছিল এমন......... "সিন্স লাস্ট টু ডেজ আর মোর আই এ্যম মাচ ট্রাবল উইথ দি লারজেস্ট সাইজ বয়েল, এ্যজ পার মার্জিন".......উল্লেখ্য মার্জিনে একটা ফোঁড়ার ছবি আঁকা ছিল! আরেকটা ঘটনার কথা না বললেই নয়।

শিক্ষিত বাঙালির ইংরেজি ভাষা এবং তার অপপ্রয়োগ যে কি হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করে সেটা এই ঘটনাটা পড়লে কিছুটা আঁচ করা যাবে। জন বিমস নামের এক ভাষাবিদ জেলা অফিসার তার 'মেময়ার্স অব এ্য বেঙ্গল সিভিলিয়ান' বইতে লিখেছেন......"তিনি তখন চট্রগ্রামের কমিশানর হিসেবে কর্মরত, এই সময়ে ছোট লাট স্যার এসলি ইডেন আসবেন চট্রগ্রাম পরিদর্শনে। ছোট লাঠের আগমন বলে কথা, সেই উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারী অফিস, আদালত, রাস্তার মোড়ে মোড়ে তোরন বানিয়ে লাঠের শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন টানানো হয়েছে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন চট্রগ্রাম সরকারী হাসপাতালের এক কর্মকর্তা। তিনি হাসপাতালের ঢোকার পথে মহাকবি দান্তের 'ডিভাইন কমেডি'র কিছু লাইন লিখে টানিয়েছিলেন যা আক্ষরিক ভাবেই কমেডি হয়ে গিয়েছিল।

তিনি লিখেছিলেন.. "এ্যাবনডন হোপ, অল ইউ হু এন্টার হিয়ার" মানে কি দাড়ালো বলুন তো? .....যারা এখানে প্রবেশ করবে, তাদের বেরুবার আশা ছেড়ে দিয়েই ঢুকতে হবে!! যাই হোক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় ১৮৩৫ সালের পর থেকে উপমহাদেশে ইংরেজির দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে এবং এই বিষয়ে ইংরেজ শাসকদের চাইতে এদেশীয়দের একান্ত আগ্রহই ছিল বেশি। উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষাকে উচ্চ শিক্ষার বাহন করেছিলেন মেকলে-বেনটিক। একটি প্রচলিত জনপ্রিয় ধারনা রয়েছে যে মেকলে সাহেব জোড় করে বাঙালিদের ইংরেজি শিখিয়েছিলেন, আসলে ধারনাটি কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। বাঙালি ইংরেজি শিখেছিল নিজের গরজে, চেষ্টায়, প্রায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে। ইংরেজির অনুকূলে প্রশাসনের শিক্ষানীতি ঘোষনার বহু আগে থেকেই।

এই দেশে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের জন্য যে মানুষটির অবদান সব চাইতে বেশি তিনি হলেন ডেভিড হেয়ার। শোনা যায় সে সময়ে ইংরেজি শেখার জন্য মানুষের এত আগ্রহ জন্মছিল তিনি যখন রাস্তায় পালকি করে বের হতেন তখন দলে দলে ছেলেপিলে পাল্কী ধরে ধরে দৌড়াতো আর বলতো........"Me poor boy, me take in your school"!! উল্লেখ্য হেয়ার সাহেব স্কুলে গরিব মেধাবী ছাত্রদের বিনা বেতনে পড়াতেন। রাজানারায়ন বসু বলেছেন সে সময়ে ইংরেজী শিখতে মানুষ এত আগ্রহী ছিল যে রীতিমত ডিকশনারী মুখস্ত করে ফেলতো। এ প্রসঙ্গে শিবনাথা শাস্ত্রী লিখেছিলেন...... "যে যত অধিক সংখ্যক ইংরেজি শব্দ ও তাহার অর্থ কন্ঠস্থ করিত, ইংরেজি ভাষায় সুশিক্ষিত বলিয়া তাহার তত খ্যাতি প্রতিপত্তি হইতো। এরূপ শোনা যায় শ্রীরামপুরের মিশানরীফন সে সময়ে এই বলিয়া তাহাদের আশ্রিত ব্যাক্তিদিগকে সার্টিফিকেট দিতেন যে, এই ব্যাক্তি দুইশত বা তিনশত ইংরেজি শিখিয়াছে বাবু ইংলিশ নামের বাক্য রচনাহীন, ব্যাকরণহীন এই ইংরেজির প্ররচলন হয়েছিল মূলত: বিদেশী শাসকদের কৃপা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য, জাগতিক সুবিধা লাভের উদ্দ্যেশ্য সাহেবভজনাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

ইংরেজরা চলে গেছে বহুদিন হলো, সেই ইংরেজিতে অর্ধশিক্ষিত 'বাবু'রাও আজ আর তেমন নেই! সেই বাঙালিরা তারপরে বাংলায় কথা বলার জন্য, লেখার জন্য, গান গাওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে,প্রাণ দিয়েছে কিন্তু দিন শেষে তাদের সেই ইংরেজি প্রেম কিন্তু এক বিন্দুও কমেনি! মাঝে মাঝে যখন টিভিতে দেখি 'ডিয়ার ভিউয়ার্স এখন শুনবেন ওমুকের গান' কিংবা রেডিওতে 'ডিয়ার লিসনার্স শুনতে থাকুন অবিরাম অমুক তমুক" কিংবা কেউ বলছে "তুমি এমন করে কথা বলো, আমি একদম 'লাইক' করি না".......তখন মনে হয় এই ভাষাটা আসলে কাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হচ্ছে? কোন ভিন্নভাষী মানুষ কি এই কথা গুলো শুনে বুঝবে যে কি বলা হচ্ছে, না বুঝবে না কারণ অর্ধেক তো বাংলা। তাহলে? এটা কি ভাষার কোন অলংকারিক সৈন্দর্য্য বাড়াচ্ছে, তাও না..তাহলে? সেদিন অতীশ দীপঙ্করের জন্মদিন উপলক্ষে চীনা এ্যম্বাসডের ও সাথে একদল চৈনিক এসেছিলেন বিক্রমপুরে। সেখান থেকে তারা আসলেন আমাদের নব আবিষ্কৃত বৌদ্ধ বিহারটা দেখতে....দেখি চ্যাঙ চুঙ করে নিজেরাই নিজেদের বোঝাচ্ছে কি জানি! আমাদের এখান থেকে একজন গেলো ইংরেজিতে বুঝাতে যে কি কি পাওয়া গেছে.....তারা পুরো সময়টা হাসি হাসি মুখ করে শুনলো সব কিছু! পরে যাবার সময়ে শুনি এরা একজনও ইংরেজি জানে না। অথচ সেটা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। আর আমাদের বাংলা ভাষা নিয়ে এত এত ঐতিহ্য ও গর্বের ইতিহাস থাকলেও বাংলায় কথা বলতে অনীহা কেন জানি না।

"আমি ভাল বাংলা জানি না' বা "আমার বাচ্চা তো বাংলায় ভাল করে কথাই বলতে পারে না" এটা অনেকেই প্রচ্ছন্ন গর্বের সাথে প্রায়ই বলে থাকেন। কিছু দিন একটা বড় কর্পোরেট হাউজে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, আমাদের কাজটা বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়ে এবং দলের সকল সদস্য বাঙালি হলেও আমাদের মিটিং গুলো সব সময়েই হতো ইংরেজীতে .....জানি না কেন! আর খুব বেশি রেগে গিয়ে ভাব গম্ভীর আধুনিক ভাষায় গালি দিতে কিংবা অনেক ভালবাসার কথা বলতে গেলে ইদানিং ইংরেজি ছাড়া কোন গত্যান্তর দেখি না। সেদিন আমার মেয়ের স্কুলে গিয়েছি টিফিন টাইমে, শুনি এক মা তার বাচ্চাকে বেশ ধমকাচ্ছেন তার বাচ্চা খায় না তাই। বাচ্চার সাথে তার সংলাপটি ছিল এমন....."বেবী ওখানে যাচ্ছো কেন, যেও না জামায় 'ডার্টি' লেগে যাবে। আর তুমি তো কিছুই খাও নি, এই 'ম্যাঙ্গোটা' খাও আর 'এগ'টা শেষ করো।

কোন কথা শোন না, তুমি একদম 'নটি' হয়ে গেছো"!! যেখানে ভিনভাষীর কেউ নেই সেখানে ইংরেজীতে কথা বলার যৌক্তিকতা আমি আসলেই খুঁজে পাই না, এই জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে কিছুটা ক্ষ্যাত বলে মনে হয়! যাই হোক থাকবো আমি ক্ষ্যাত তবুও বাংলাই আমার কাছে সেরা। তথ্যসূত্র: মাহবুব আলম...গুপ্তধরনের খোঁজে১  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।