আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিশন বাড়ী খোঁজাঃ It’s Too late for To-Let

অবসরে রিক্সায় ঘোরা ঢাকা শহরবাসীর প্রিয় একটি কাজ। আমিও স্ত্রীকে নিয়ে ঘন্টা হিসাবে রিক্সা ভাড়া নিচ্ছি। কখনো উঠছি সকালে, নামছি বিকালে; আবার কখনো উঠছি বিকাল তিনটার দিকে আর নামছি রাত সাড়ে আটটা-নয়টায়। বকশিশ সহ ভাড়া পরিশোধ করছি তিনিশ থেকে সাড়ে চারশ টাকা। একইরকম ভাবে কাটিয়ে দেয়া গত কয়েকটি ছুটির দিন যাচ্ছে এমন।

ঘন্টা হিসাবে এ ভ্রমণ ফুরফুরে আনন্দের জন্য নয়, এ ভ্রমণ বাসা খোঁজার অভিযানে। আমাদের বর্তমান ফ্ল্যাটে এর মালিক নিজেই এসে উঠবে। জানিয়েছিলো আরো চার মাস আগে জুনে। বাসা ছাড়তে হবে নভেম্বরের ১ তারিখের মধ্যে। আলসেমি করে ভেবেছি শেষ মাসে একটা খুঁজে নিয়ে উঠে পড়বো।

এমাসে এসে খুঁজতে গিয়ে মাথায় মহাকাশ ভেঙে পড়লো। ভালো বাসা পাবো বলে আশা ছিলো, সে আশা অতি দ্রুত আশংকায় পরিণত হলো- আদৌ বাসা পাওয়া যাবে কি? মিশন ইম্পসিবল না হলেও নিশ্চয়ই ‘মিশন হার্ডলি পসিবল’। মাঝারি আকারের বাসা দরকার আমার। দুই বেড, সাথে ড্রইং-ডাইনিং। বিয়ের পর দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যখন প্রথম বাসা নিয়েছি তখন কেবল এক রুম বা দুই রুমের বাসা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম।

তখন মনে হয়েছিলো ছোট বাসা খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে কষ্টকর, মাঝারী বা বড় বাসা পাওয়া সোজা। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে ছোট আর বড় বাসা পাওয়া সোজা, মাঝারীটা পাওয়া সবচে’ কঠিন। মানুষের আফসোস সত্যিই সময়ের সাথে বদলে যায়। কোন এক বিচিত্র কারণে পুরান ঢাকায় বাড়ি ভাড়া লাগামহীনভাবে বেশী। আপামর পুরান ঢাকাবাসীর সারাদিনের হৈ-হল্লা, রিক্সা-ঠ্যালা গাড়ির জিলাপির প্যাঁচের মতো জ্যাম, ছোট গলি-ঘুপচির নোংরা পরিবেশের পরও এখানকার ভাড়া ঢাকার অধিকাংশ এলাকা থেকে বেশী।

একটা উদাহরণ দেই। ওয়ারীতে একটা ফ্ল্যাট বাড়ীতে টু-লেট লাগানো দেখে ঢুকলাম। সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম ভাড়ার ব্যাপারে। তিন বেডের বাসা, সাথে ড্রইং-ডাইনিং। ভাড়া হলো সার্ভিস চার্জ বাদে চল্লিশ হাজার টাকা।

সার্ভিস চার্জ মাসে চার হাজার, ইউটিলিটি বিল আলাদা। অ্যাডভান্স হলো দুই লক্ষ টাকা। আমি আর আমার স্ত্রী পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছি। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন যারা আছে সবাই কি এই ভাড়াতে আর অ্যাডভান্সেই থাকে?” তারা বললো, “জ্বী”। আমরা আবার চেপে বসলাম ঘন্টা মাপা রিক্সায়, সাথে নিয়ে এলাম দীর্ঘশ্বাস।

এবার গেলাম লিফট বিহীন সাত তলার উপর একটা বাড়ীতে। দুই বেড, সাথে ড্রইং। ডাইনিং স্পেসটা খুব ছোট, যেখানে ডাইনিং টেবিল বসালে এরপর বাসায় হাঁটাচলা করা যাবে কিনা তা নিয়ে একটা রিসার্চ হতে পারে। কেয়ারটেকার বললো ভাড়া পনের হাজার টাকা। সাত তলার উপরে হলেও ডাইনিং স্পেস বাদ দিয়ে বাসাটা দেখে পছন্দ হলো।

কেয়ারটেকার বললো দুই মাসের ভেতর লিফট হয়ে যাবে। তবে দেখে মনে হলো না এখানে লিফটের আসলেই কোন কাজ চলছে। আরো সমস্যা হলো এই যে, হবু লিফটের যায়গাটা সিঁড়িঘরের ভেতর হা করে খোলা। কোন প্রোটেকশন দেয়া নেই। আমার মতো যে কেউ তাদের ছোট বাচ্চাদের কথা চিন্তা করলে আঁতকে উঠবে।

আমরা বর্তমান ভাড়াটিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম লিফটের ব্যাপারে। তারা জানালো, “আমরা দুই বছর হলো এখানে এসেছি। তখন থেকেই শুনছি দুই মাসের ভেতর লিফট হয়ে যাবে”। বলদা গার্ডেনের পাশে পুরানো ধাঁচের একটা বাড়ীতে টু-লেট দেখে আমরা খুশী হলাম। যাক, এর নিশ্চয়ই এতো ডিমান্ড হবে না।

বাড়ীওয়ালা বাড়িটি দেখালো। বাড়ীতে মোট চার রুম, খুব বড় নয়। আলাদা ড্রইং, লিভিং রুম এভাবে নেই, যে যেভাবে চায় সেভাবে ‘সাজিয়ে’ ব্যবহার করতে পারে। ভাড়া? “সব বাদে ত্রিশ হাজার টাকা”। অ্যাডভান্স? “দুই লক্ষ টাকা”।

ওয়ারী ছাড়িয়ে ঢুকে পড়লাম টিকাটুলিতে। বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের দিকে আর হাঁটছি না। ছোটগুলোতে দেখছি। বাসা ভাড়া কিছুটা কম দেখা গেলো, অ্যাডভান্সও কম। তবে অধিকাংশ অ্যাপার্টমেন্টেরই গ্যাস সংযোগ নেই।

এর মানে হচ্ছে সিলিন্ডারে বাড়তি খরচ হবে মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। টিকাটুলি শেষ করে বাসায় ফিরে আসি। নাহ, এবার অন্য দিকে খুঁজতে হবে। এবার গেলাম লক্ষ্মী বাজারে। গলি-ঘুপচি আর খানা-খন্দে ভরা একটি ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা।

স্কুল কলেজে বোঝাই। ঘন্টাওয়ারি রিক্সায় ঘুরে বেড়ালাম দীর্ঘ সময়। কানা গলি, অন্ধ গলি, ভালো গলি-বাদ গেলো না কিছুই। পুরো লক্ষ্মীবাজারে সাকুল্যে দুটি বাসা খালি পেলাম। একটি পাঁচতলার উপরে তিন রুমের বাসা, যেটির নীচ তলায় জুতার কারখানা আর পৃন্টিং প্রেসের মহা মিলন মেলা।

কে যে কোন কাজে আসছে আর যাচ্ছে বোঝার সাধ্য কারো নেই, আর কেউ সেজন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেসই করছে না-এই হলো বাসার সিকিউরিটির অবস্থা। আরেকটি পেলাম অচেনা এক গলির ভেতর যেখানে দুটি রিক্সা পাশাপাশি গেলে জ্যাম লাগা অবধারিত। বাসার জানালার এমন অবস্থা যেন কেউ একটু নক করলেই খুলে পড়ে আসবে। আমরা বেরিয়ে আসি আর ঘুরতে থাকে রিক্সার চাকা। আমরা ক্লান্ত হয়ে ড্রিংকস খাই, সাথে রিক্সাওয়ালাও সঙ্গী হয়।

তারাও যেন আমাদের ব্যথাতেই সমব্যথী। এভাবে করতে করতে দুই শুক্রবারের পুরোটাই গেলো। শনিবারগুলোতেও সকাল থেকে নিয়ে দিনের আলো ম্লান হওয়া পর্যন্ত ঘুরে চললাম। যেই বাসা পাই, সেটার এটা হয় তো ওটা হয়না। কারো ভাড়া কম তো বাসার সিকিউরিটি নেই, কারো সিকিউরিটি ভালো তো ভাড়া অ্যান্টেনার উপর দিয়ে যাচ্ছে, কারোটা সবদিক মিলিয়ে ভালো তো অ্যাডভান্স চাচ্ছে অবিশ্বাস্য-এভাবেই চলছে।

কোরবানির আগের এ সময়টাতে বাসা খালিও পাওয়া যাচ্ছে কম। আমাদের অবস্থা দেখে বাড়ীওয়ালা নিজের কষ্ট মেনে নিয়েও সময় বাড়িয়ে দিলেন আরো। পানির মাছ ডাঙায় তুলে রোদে পুড়িয়ে আবার পানিতে ছেড়ে দিলে যেমন বিদ্যুতবেগে প্রাণ ফিরে পায়, আমাদের অবস্থা হলো তেমনই। আহ, কি শান্তি। সে রাতের ঘুম হয়ে উঠলো গভীর ও স্বপ্নময়।

তবে কোন কোন অলস মুহূর্তে আবার বাড়ী খোঁজার কথা মনে হলেই আঁতকে উঠি। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়, তবে আমাদের যেতে হচ্ছে বার বার এবং একেবারে হেলমেট ছাড়া। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।