আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রখ্যাত শিল্পপতি ও মানবসেবী জহুরুল ইসলাম

বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম ভাগলপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের জন্ম। তার বাবা আফতাব উদ্দিন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ছিলেন বাজিতপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। এলাকার জনহিতকর কর্মকাণ্ডে তার ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। আর মা রহিমা আক্তারের পুণ্যতা, দানশীলতা, বদান্যতা আজো এলাকায় মুখে মুখে আলোচিত ও প্রশংসিত। সেই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সুসন্তান জহিরুল ইসলাম।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে তিনি তার ব্যবসায়ের বিস্তার ঘটিয়েছেন সেই আমলেই। আজকের যুগে যাকে বলা হয় করপোরেট সিস্টেম। লন্ডন, বাংলাদেশ বা যেকোনো দেশের একটি অফিসে বসে তিনি বিভিন্ন দেশের অফিসগুলো পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন দক্ষতার সাথে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও শহরে সেবামূলক কোনো পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া দেখে তা দেশে বাস্তবায়নের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করতেন। যোগাযোগ করতেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সাথে।

সেই পরিকল্পনা থেকেই ইস্টার্ন হাউজিং প্রতিষ্ঠা। এ উদ্যোগে ঢাকার আবাসন সমৃদ্ধির পাশাপাশি ছিল কর্মসংস্থানের বিশাল আয়োজন। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের দুয়ারও খোলে তার মাধ্যমেই। দেশের অর্থনীতির ভিত্তিতে রক্ত সঞ্চালক হিসেবে আজো দেশ-বিদেশে দৃষ্টান্ত হিসেবে উচ্চারিত হয় নামটি। তার জনহিতকর হাত প্রসারিত হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, ব্যাংক, কৃষি, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন খাতে।

মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদার প্রতিটিতেই তিনি ও তার প্রতিষ্ঠানের অবদান দৃষ্টান্তমূলক। ধনী আদমজী, ইস্পাহানি দাউদদের অসহযোগিতা মোকাবেলা করে তিনি এ দেশীয় ব্যবসায় ও ব্যবসায়ীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সফলও হয়েছেন। মোগল আমলের মধ্যভাগে তিন ভাই বাজেত খাঁ, ভাগল খাঁ ও দেলোয়ার খাঁ মোগল শাহের দরবারি প্রতিনিধি হয়ে এই এলাকায় আসেন। বাজেত খাঁর নামানুসারে হয় বাজিতপুর। ভাগল খাঁর নামানুসারে ভাগলপুর ও দেলোয়ার খাঁর নামানুসারে নামকরণ হয়েছে বর্তমান দিলালপুর।

জহুরুল ইসলাম ভাগল খাঁর পরিবারের ত্রয়োদশ বংশধর। শৈশবে জহুরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল ‘সোনা’। কর্মফলের মাধ্যমে ছোট থেকে বড় হওয়ার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে গেছেন জহুরুল ইসলাম। ভাগ্যান্বেষণে সততা-পরিশ্রম-আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে মানুষ কত সফল হতে পারেন, সেই উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। ব্যস্ত মহানগরী থেকে দূরে গ্রামীণ মনোরম পরিবেশে জহুরুল ইসলামের শিক্ষা প্রকল্প ঘুরে এলে যেকোনো মানুষই বিস্মিত হবেন।

বাজিতপুর থানার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল বরাবরই দুর্বল। উচ্চশিক্ষা ও উন্নত চিকিৎসা সেখানকার মানুষের ভাবনায়ও ছিল না। এখন দেশের বিভিন্ন এলাকা এমনকি রাজধানী থেকেও মানুষ উচ্চশিক্ষা ও সুচিকিৎসার্থে যাচ্ছেন বাজিতপুরে। জহুরুল ইসলামের কর্মজীবন শুরু ১৯৪৮ সালে। মাত্র ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সিঅ্যান্ডবির ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

তিন বছর পর ইস্তফা দিয়ে শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসায়। সরকারি অফিসে স্টেশনারি সরবরাহের ব্যবসায়ও করেছেন। তখন সীমিত পুঁজিতে কোনো বাঙালির ঠিকাদারি বা ব্যবসায়ের কথা ভাবা যেত না। শুরুতে তিনি কিশোরগঞ্জ পোস্ট অফিস নির্মাণের কাজ পান। পরে পেলেন গুলিস্তান থেকে টিকাটুলী সড়কের কাজ।

সততা ও কাজের গুণ-মানে মাত্র দুই বছরের মাথায় নিজেকে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে ১৩ সদস্যের পরিবারকে নিয়ে আসেন রাজধানী ঢাকায়। ভাই-বোন সবাইকে উচ্চশিক্ষার পথে চালিত করেন। একান্নবর্তী পরিবার এক সময় রূপ নেয় বিশাল পরিবারে, যা তিনি ধরে রেখেছিলেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এ ঘটনা আমাদের পারিবারিক ও সমাজ বাস্তবতায় এক ব্যতিক্রমী বিস্ময়কর ঘটনা।

স্ত্রী সুরাইয়া বেগম ছিলেন তার জীবনের অগ্রযাত্রার সহযাত্রী তথা অনুপ্রেরণা। ১৯৫৬ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজারের এক স্বনামধন্য পরিবারে অধ্যাপক মোশাহেদ আলী চৌধুরীর মেয়ে সুরাইয়া বেগমের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা তাকে ব্যবসায়বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সমাজসেবা ইত্যাদিতে উদ্ভাবনী শক্তি জুগিয়েছে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে জহুরুল ইসলামের অবদান আমাদের ইতিহাসের অংশ। তিনি ফলাও করে কখনো ওই অবদানের কথা উল্লেখ করতেন না।

দান-অনুদানের মতো মহৎকাজে গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। তার সেই বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর লেখা প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি নামক গ্রন্থে কিছু উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেÑ জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ জুন ঢাকা ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি সুবেদ আলী ছদ্মনাম ধারণ করে স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম চালাতে থাকেন। এর অংশ হিসেবে মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ প্রদান করেন।

বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের লেখা স্বৈরাচারের দশ বছর গ্রন্থেও উল্লেখ আছে। জহুরুল ইসলাম ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক নেতাকর্মীদের মোকদ্দমার খরচ, আহতদের চিকিৎসার খরচ জোগাতেন। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার খরচও ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন তিনি। এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ও স্বাধীনতাযুদ্ধে নীরবে-নিভৃতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জহুরুল ইসলামের ছিল ব্যক্তিগত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক।

বঙ্গবন্ধু তাকে ‘হাজী সাহেব’ ডাকতেন। বিনয়, উদারতা, আতিথেয়তা, পরোপকার প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। কর্মজীবনে এসব বৈশিষ্ট্যের আরো বেশি প্রকাশ ঘটেছে। কখনো তিনি একা খেয়েছেনÑ এমন নজির খুব কম। খাবার টেবিলে মানুষ কম থাকলে তিনি খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করতেন না।

দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবীসহ সৃষ্টিশীলদের সাথে ছিল তার আত্মার সেতুবন্ধ। সংস্কৃতির বিকাশ ও সৃষ্টিশীল কাজে তিনি সহযোগিতা করেছেন উদারভাবে। তিনি ছিলেন মোহামেডান ক্লাবের অন্যতম সদস্য। এর উন্নয়নে তার বরাদ্দ তথা অবদান ছিল বিস্তর। ‘নাভানা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’ ক্রীড়াঙ্গনে তার এক স্মারক।

জহুরুল ইসলামের ধর্মকর্ম চর্চায় ছিল ব্যতিক্রমী ধারা। দ্বীন-দুনিয়াকে তিনি খুব আলাদাভাবে দেখতেন না। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত জহুরুল ইসলাম নিকটজনদের বলতেন, জীবনের সব কিছু দ্বীনের আওতায়। সেই চেতনা থেকেই তিনি নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, মসজিদ-মাদরাসা-এতিমখানা নির্মাণের পাশাপাশি সমাজ ও দেশ গঠনে সচেষ্ট ছিলেন। তাকে কখনো নামাজ কাজা করতে দেখা যায়নি।

’৭১-এর আগে-পরে সারাক্ষণ দেশ গঠন ও সমৃদ্ধকরণে তিনি ছিলেন সাধকের ভূমিকায়। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.