আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রপতির ক্ষমাপ্রাপ্তরা কে কোথায়॥ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

মুক্তমত প্রকাশের প্লাটফর্ম ব্লগ। তাই ব্লগে বসতে ভা্ল লাগে....। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় দণ্ড মাফ হয়েছে ৭১ আসামির। ক্ষমা পাওয়া সবাই জীবিত আছেন। ক্ষমা পাওয়ার পর এদের অনেকেই রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাফ করার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর প্রত্যেক সরকারের সময়েই রাষ্ট্রপতির এই সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারা শাখা সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় বিভিন্ন সময়ে ৭১ আসামির মধ্যে ৪৬ জনের মৃত্যুদণ্ড মাফ করে মুক্তি, একজনের কারাদণ্ড ও জরিমানা এবং ২৪ জনের মৃত্যুদণ্ড মাফ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং সর্বশেষ মো. জিল্লুর রহমান এসব আসামির সাজা মাফ করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তি পাওয়া এসব আসামি পরবর্তী জীবনেও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রয়েছেন।

এদের বেশিরভাগই বর্তমানে প্রত্যক্ষ রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা ছাড়া বাকি সব ক্ষমাই হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে দণ্ড মাফ বা হ্রাস করার কাজটি করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। বাংলাদেশের আইন ও রীতি অনুসারে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ক্ষমা প্রদর্শনের প্রাথমিক সম্মতি দিয়ে থাকে। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সেভেন মার্ডার সংঘটিত হয়।

এই সেভেন মার্ডারের অন্যতম ফাঁসির আসামি ছিলেন তখনকার ছাত্রলীগ নেতা বর্তমানে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি হয়ে শফিউল আলম প্রধানসহ অন্যদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাফ করেন। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে রাজনৈতিক উত্থান হলেও তিনি বর্তমানে বিএনপির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন। সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী আবদুল খালেক রানা ও ফিরোজ আল মামুনের জোড়া খুনের মামলায় নয় নম্বর বিশেষ সামরিক আদালতে ফাঁসির আদেশ হয় আবুল হাসনাত ওরফে গালকাটা কামাল, মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু, আবুল কাসেম মানিক, শহীদ হোসেনসহ ২৮ জনের। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৮২ সালে গালকাটা কামাল এবং অন্য সহযোগীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

আবার একই মামলার ১৯৮৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পলাতক অবস্থা থেকে আত্মসমর্পণ করে জেলখানায় যায় মানিক। রাষ্ট্রপতি এরশাদ মানিককে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেন । এ সময় অন্য ২৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। যদিও পরে তারা কিছুদিন কারাভোগ করেই মুক্তি পান। জানা গেছে, মানিক বর্তমানে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছেন।

রাজনীতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। একই মামলায় মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু ২২ বছর বিদেশে পলাতক থাকার পর ২০০৫ সালের ৩ জানুয়ারি দেশে এসে আত্মসমর্পণ করেন। মাত্র ১০ দিন কারাগারে থাকার পর বিএনপি আমলে ২০০৬ সালের ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের ক্ষমায় মুক্তি পান তিনি। ঝিন্টু মুক্তি পাওয়ার আগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপির সুইডেন শাখার সভাপতি হয়ে সেদেশে বসবাস করতেন। তখন থেকেই ঝিন্টু তারেক রহমানের মোটামুটি কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত।

তিনি এখনো তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরশাদ পুরনো ঢাকার দিলা ও মোখলেছ নামের দুই ফাঁসির আসামির মৃত্যুদণ্ড মাফ করেন। এরপর তারা জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর তারা যোগ দেন বিএনপিতে। বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০১০ সালে চারটি দুর্নীতির মামলায় ১৮ বছরের সাজা ও পাঁচ কোটি টাকার জরিমানার দণ্ড থেকে ক্ষমা পান সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর চৌধুরী।

তার সাজা মাফ করেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। প্রত্যক্ষভাবে দলীয় পদে না থাকলে শাহদাব এখনো রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। এ নিয়ে ওঠা বিতর্ক মিলিয়ে যেতে না যেতেই, ২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নাটোরের বিএনপিদলীয় সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহমেদ গামা হত্যা মামলায় ২০ আসামির ফাঁসির আদেশ স্থগিত করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি। ফাঁসির দণ্ড থেকে ক্ষমা পাওয়া আসামিরা হলেন, নলডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ফিরোজ, নাটোর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামানের বাবা আনিসুর রহমান আনসার, ফয়সাল হোসেন, সেন্টু শাহ, শাজাহান শাহ, বাদল শাহ, ফজলুল হক শাহ, জহুরুল শাহ, জাহেদুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন, ফারুক হোসেন, আব্দুল জলিল, সোহাগ, বাবলু, আবুল, ওহিদুর রহমান, আতাউর, আশরাফ, ফরমাজুল ও ফকরউদ্দিন। এর মধ্যে নিষিদ্ধ সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) লাল পতাকার দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীও মুক্তি পান।

আসামিদের মধ্যে নাটোর সদর উপজেলার রামশাকাজিপুর গ্রামের শাহ পরিবারের সদস্যই রয়েছেন ১৩ জন। দণ্ডপ্রাপ্তরা মুক্তি পেয়ে নাটোর পৌঁছলে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আবদুল আহাদ সরকার স্থানীয় সার্কিট হাউসে মুক্তিপ্রাপ্ত ১৪ আসামিকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন। পরে তাদের বিশাল সমাবেশে সংবর্ধনাও দেয়া হয়। এর কিছুদিন পর একই এলাকায় খুন হন গামারই রাজনৈতিক সহকর্মী কমিশনার সানাউল্লাহ নূর। সানাউল্লাহ হত্যা মামলার চার্জশিটে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামিদের কয়েকজনের নামও রয়েছে।

জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক মদতে উপজেলায় এখনো এই শাহ পরিবার আগের মতোই দাপট দেখিয়ে চলছেন। রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৯ মার্চ জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলার প্রধান আসামি স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আহসান হাবীব টিটুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাফ করেন। টিটুর গ্রামের বাড়িও একই থানার ঢালবাড়িতে। ১৯৯৯ সালের ১১ অক্টোবর ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী দিবসে বিএনপির মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক। এ সময় আবদুর রাজ্জাককে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় টিটুসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা হয়। মামলার রায়ে টিটুর মৃত্যুদণ্ড ও অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। হাইকোর্টে আপিল করার পর টিটুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে জামালপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টিটু। ঘটনার সময় আহসান হাবিব টিটু উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।

বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। গত বছর হজ করেছেন তিনি। ব্যবসা এবং রাজনৈতিকভাবে তিনি ব্যস্ত আছেন। আগামীতে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার জন্য তিনি বর্তমানে উচ্চমহলে লবিং করছেন বলে জানা গেছে। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা আবু তাহেরের ছেলে এএইচএম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাফ করেন রাষ্ট্রপতি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে লক্ষ্মীপুর শহরের বাসা থেকে নুরুল ইসলামকে অপহরণে করে হত্যা করে, টুকরো টুকরো করে মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার রায়ে ২০০৩ সালে আদালত বিপ্লবসহ পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় পলাতক থেকে বিপ্লব গত ৪ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর আবু তাহের ছেলে বিপ্লবের প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বিপ্লবের সাজা মাফ করেন।

আরো দুটি হত্যা মামলায় বিপ্লবের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তিনি বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগারে আটক আছেন। কিন্তু জানা গেছে, তিনি এখনো জেলার সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এ কাজে তাকে সহায়তা করেন তার ছোট ভাই জেলা যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক সালাউদ্দিন টিপু। গত জুলাইয়ে অসুস্থতার কথা বলে আদালতে আবেদন করে এক মাস জেলা হাসপাতালে ছিলেন তিনি।

এ সময় তিনি কেবিনে ছিলেন সারাদিন সব কর্মীকে সঙ্গে নিয়েই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, সংবিধানের চতুর্থ ভাগে (নির্বাহী বিভাগ) ৪৯ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে-কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে। ’ সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ মৃত্যুদণ্ড বা যে কোনো দণ্ড দিলেও রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে তা বন্ধ করতে পারেন। সর্বোচ্চ আদালত যদি কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান করে তাহলে আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা চেয়ে আবেদন করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্টের একজন প্রবীণ আইনবিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তাদের পরিবার বা স্বজনদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুকম্পা চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি অনুকম্পা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে যাকে অনুকম্পা করা প্রয়োজন তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাফ করেন। ’ তথ্যসূত্র: Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.