আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ টেলিভিশন যার সৌরভ এখনও অম্লান

ও রে যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে । ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেবরে লুট ক'রে- যাব না আর ঘরে। ১৯৬৪ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার ডিআইটি ভবনের ছোট্ট একটি অংশজুড়ে একটি টেলিভিশন কেন্দ্র তার গৌরবময় যাত্রা শুরু করেছিল। সেই ছোট্ট টেলিভিশন কেন্দ্রটির নাম বাংলাদেশ টেলিভিশন। শুরুতে এর নাম পাকিস্তান টেলিভিশন থাকলেও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর এর নাম বাংলাদেশ টেলিভিশন'' রাখা হয়।

বাংলাদেশ টেলিভিশন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল। এটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি সারাদেশে টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার করে থাকে। এ কারনে দেশের সবচেয়ে বেশী মানুষ (৯৩%) এই টেলিভিশন এর নেটওয়ার্ক এর আওতার অন্তর্ভুক্ত। দেশের সাধারন মানুষ এই চ্যানেলের প্রধান দর্শক। ''ওই যে আকাশ নীল হল আজ সে শুধু তোমার প্রেমে'' - ফেরদৌসি রহমানের গাওয়া এ গানটিই ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গান।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে প্রচারিত প্রথম নাটক ছিল ''একতলা দোতালা'' টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার সাড়ে ছয় বছর পর ১৯৭১ সালে শোষণ ও বঞ্চনার অচলায়তন ভাঙার বিদ্রোহে অগ্নিগর্ভ হয়ে দেশ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তৎকালীন ঢাকা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালায় বিদ্রোহের আবহ ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ‘আবার আসিব ফিরে’ নামের একটি নাটক। সৈয়দ মাহমুদ আহমেদের কাহিনীকে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুন। এ নাটকে সরাসরি দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে টেলিভিশনের অনেক কর্মীই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করেন তাদের মধ্যে জামিল চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার, মুস্তাফিজুর রহমান অন্যতম। টেলিভিশনের প্রায় ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। লাহোর টেলিভিশন থেকে কর্মী এনে টিভি সম্প্রচার চালু রাখা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা একসময় টিভিতে ছোটদের অনুষ্ঠান বা নাটকে অংশ নিয়েছেন, সেইসব গেরিলারা ডিআইটি ভবনের টিভি টাওয়ারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান।

গেরিলাদের মধ্যে ছিলেন মাহবুব আলী, নজিবুল্লাহ , আহসান নেওয়াজ বাবু প্রমুখ। টিভি ভবনে এত নিরাপত্তার পরও বোমা বিস্ফোরণে স্তম্ভিত হয়ে যায় পাকিস্তানি শাসকরা। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পরপরই একদল মুক্তিযোদ্ধা টিভি ভবনে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা ক্র্যাকপ্ল্যাটুনে ছিলেত প্রয়াত শাহাদাত চৌধুরী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদসহ আরো অনেকে। ১৭ ডিসেম্বর টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নতুন টেলপ ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হওয়া প্রথম নাটকটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। ‘বাংলা আমার বাংলা’ নামের এ নাটকটির রচনায় ছিলেন ড. ইনামুল হক এবং প্রযোজনায় ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। একাত্তরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রদর্শিত এ নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল আসার আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনই ছিল বাংলাদেশের একমাত্র চ্যানেল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই মানুষকে এই চ্যানেলটি দেখতে হত এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনও মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচার করত।

অনেক সময় অনেক গুণী শিল্পী ও ব্যাক্তিত্তদের আগমন ঘটেছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভুপেন হাজারিকা, শাবানা আজমির, প্রতিমা ব্যানারজী উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন রজত জয়ন্তি অর্থাৎ ২৫ বছর উদযাপন করে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন ৪০ বছরে পদার্পণ করে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় কিছু অনুষ্ঠান হলঃ - যদি কিছু মনে না করেন - ইত্যাদি - শুভেচ্ছা - মাটি ও মানুষ - সময়ের কথা - সিসিমপুর - নতুন কুরি (জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ) - বিটিভি জাতীয় বিতর্ক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত কিছু জনপ্রিয় নাটকঃ - সংশপ্তক - কোথাও কেউ নেই - নক্ষত্রের রাত - বহুব্রীহি - আজ রবিবার - অয়োময় - এইসব দিনরাত্রি - সময় অসময় - সকাল সন্ধ্যা এছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী মেগাসিরিয়াল যেমনঃ ম্যাকগাইভার, আলিফ লায়লা, নাইট রাইডার, দ্যা এক্স-ফাইলস, রোবোকপ, সিন্দাবাদ ইত্যাদিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশন শুক্রবারে বাংলা সিনেমা প্রচার করত যা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং এখনও করছে। এছাড়াও শিশুতোষ বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমনঃ মনের কথা, সিসিমপুর, বিভিন্ন কার্টুনও জনপ্রিয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন সবসময়েই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খেলাধুলা সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে, এদের মাঝে বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ফুটবল বিশ্বকাপ, অলিম্পিক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনের হাত ধরেই অনেক গুণী অভিনেতা, শিল্পীর উত্থান হয়েছে।

বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি আজও সেই আগের মতই জনপ্রিয়। মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানটি আজও কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়। যেকোনো ভালোর সাথেই খারাপ কিছু থাকে। এখানেও রয়েছে। বর্তমান এ স্যাটেলাইট চ্যানেলের যুগে বাংলাদেশ টেলিভিশন তার বহু পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে, তাদের স্টুডিও-র ও কোন উন্নতি দেখা যায় না।

তাদের অনুষ্ঠানের মান অত্যন্ত হতাশাজনক। দিন দিন তাদের অনুষ্ঠানের মান নিচে নামছে। মূলত অব্যবস্থাপনা, দলীয়করণ, অদক্ষ লোক নিয়োগ প্রভৃতি কারনে এ চ্যানেলটির মান নিম্নগামী হচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলীয়করণ এই চ্যানেলের সবথেকে বড় সমস্যা। সরকারি হস্তক্ষেপের কালো থাবায় এই চ্যানেলটি জর্জরিত।

প্রতিটি সরকারই তাদের নিজেদের স্বার্থে নির্লজ্জভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটিকে ব্যবহার করেছে এবং এখনও করছে। রাত ৮টার বাংলা সংবাদ দেখলেই বোঝা যায় এ চ্যানেলটি কিভাবে সরকারের তোষামোদ করে। সরকার শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে এই চ্যানেলটিকে স্বায়ত্তশাসিত করছে না। প্রতিটি সরকারই তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য এই চ্যানেলটিকে ব্যবহার করছে। তাই বাংলাদেশ টেলিভিশন এর জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে।

বলতে গেলে, শহরের মানুষ এই চ্যানেল দেখা ছেড়েই দিয়েছে। সরকারী হস্তক্ষেপ, নিম্নমানের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরও বাংলাদেশ টেলিভিশন একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এত কিছুর পরও প্রতিবছর বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রচুর লাভ করে। এই চ্যানেল আমাদের সাধারন মানুষের টাকায় চলে, এটা আমাদের সম্পদ। বাংলাদেশ টেলিভিশন সেই আগের মত আবারো জনপ্রিয় হবে এটাই আমাদের আশা, এটাই প্রত্যাশা।

কিছু লিঙ্কঃ বাংলাদেশ টেলিভিশন ছবি ব্লগ Click This Link বাংলাদেশ টেলিভিশন আইনঃ Click This Link কিছু পুরনো বিজ্ঞাপনঃ Click This Link Click This Link  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.