আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন কবিয়াল রমেশ শীল

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ১৯৬৭ সালের আশ্বিন মাসের এক পরিপূর্ণ পূর্ণিমার সন্ধ্যায় কর্ণফুলি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কবিয়াল রমেশ শীল তাঁর শিষ্য রাইগোপাল কে শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠে বললেন, আমার জইন্যে কবর খুঁইড়া রাখিয়ো রাইগোপাল । আমার যাওনের সময় হইছে। রাইগোপাল গুরুর হাত ধরে ছিল।

এখন হাত ছেড়ে সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠতেই রমেশ শীল টলে উঠলেন। নদীপাড়ের দমকা বাতাসে বৃদ্ধের নব্বুই বছরের পলকা শরীরখানি একবার ধাক্কা খেল। কোনওমতে সামলে নিলেন বৃদ্ধ। দূরন্ত বাতাসে তাঁর পরনের খয়েরি রঙের বার্মিজ লুঙ্গি-আর ঘিয়ে রঙের সিলকের পাঞ্জাবি পতপত করে উঠছে। বৃদ্ধের মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা পাকা চুল, ভাঙা চোয়ালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি।

তবে চোখের জ্যোতি এই বয়েসেও ম্লান হয়ে যায়নি। নদীর বাতাসের আশটে গন্ধ ভাসছিল। আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। আকাশে রূপার থালার মতন একটি চাঁদ। ঝলমলে আকাশ থেকে রূপালি-সফেদ আলো কচুরীপানাহীন টলটলে পানির ওপর ঝরে ঝরে পড়ছিল।

নদী এখানে ভারি নির্জন। উঁচু দু-পাড়ে অন্ধকার-অন্ধকার ঝোপঝার। নদীতে একটি বাঁশের ভেলা ভাসছিল। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা একজন বৃদ্ধ লগি হাতে দাঁড়িয়ে। এই সন্ধ্যায় দৃশ্যটি বড় মায়াময়।

রাইগোপাল শব্দ করে কাঁদছিল। কর্ণফুলি নদীতে বাঁশের ভেলার পাশে একটি সাম্পান ভাসছিল। সন্ধ্যার নির্জনতায় কান্নার শব্দ ছড়িয়ে গেলে সাম্পানওয়ালা দ্রুত দাঁড় বেয়ে পাড়ের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। রমেশ শীল দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ... আইজকাল আমার বিছানায় শুইয়া দিন কাটে।

চলাফিরায় কষ্ঠ হয়। আইজ আমার মরণের আগে একবার এক নজর কর্ণফুলি নদী দেখার সাধ হইল। আমি যেই গেরামে থাকি, সেই গেরামের নাম গোমদন্ডী। এই নদী গোমদন্ডী থেইকা আতি কাছে বইলা অতি কষ্ঠ হইলেও আইতে পারলাম। রাইগোপাল আমারে ধইরা ধইরা আনছে।

আমার পুত্র যজ্ঞেশ্বর; সে আসতে দিতে চায় নাই। তবে বোয়ালিয়ার শাকপুরার হারুন মল্লিক-এর বাড়িত গানের আসর বসছে। তার ডাক আসছিল বইলা সে তাড়াতাড়ি চইলা গেল। মাশাল্লা! গান গাইয়া বোয়ালখালি থানায় (বর্তমানে উপজেলা) যজ্ঞেশ্বর ভালো নামডাক করছে। ... কর্ণফুলি নদীর পাড়ে আসতে পারলাম ঠিকই, তয় আমার ইচ্ছা ছিল মরণের আগে একবার ফটিকছড়ি যাই।

ফটিকছড়ি থানার (বর্তমানে উপজেলা ) মাইজভান্ডার গ্রামে আমার পীরজান সৈয়দ গোলামুর রহমান- এর মোকাম। বহু বৎসর হইল আমি তাঁহার তরিকায় দীক্ষা নিছি। তারপর হক মওলার ইশারায় মাইজভান্ডারি তরিকার সাধনসঙ্গীত রচনা করছি। "নুরে দুনিয়া", "এস্কে সিরাজিয়া", "ভান্ডারে মওলা"-এই পুস্তকাগুলি মাইজভান্ডারি গানের সঙ্কলন। দুঃখের কথা কী বলব-আমি পীরজান সৈয়দ গোলামুর রহমান -এর তরিকায় দীক্ষা নিছিলাম বলিয়া আমি আমার সমাজে নিন্দিত ধিকৃত হইছিলাম।

আমারে একঘরে করা হইছিল। আমার এখন পৃথিবী ছাইড়া যাওনের সময় হইছে। আমি জানি তারা আমার দাহ করব না। তাই রাইগোপাল রে কবর খুঁইড়া রাখার কথা বললাম। বোয়ালিয়ার হিন্দুসমাজ আমার ওপর ক্রন্ধ হইয়া আছে।

কারণ আমি বলছিলাম-‘হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকল ধর্মের এককথা’। আর বলছিলাম: ‘মাটির মূর্তির পূজা ছেড়ে মানুষ পূজা কর। ’ বোয়ালিয়ার হিন্দুসমাজ যে আমার ওপর ক্রন্ধ হইয়া আছে তাহার আরও কারণ আরও আছে। ১৯৪৪ সালে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করি। অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট শব্দের মানে লোকে বুঝিত ‘নাস্তিক’! ইহার যে অন্য মানে হইতে পারে, কূপমুন্ডকেরা তাহা ভাবিতে পারে নাই।

কাজেই ১৯৪৮ সালে কলিকাতার বিদগ্ধজন আমারে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ‘বঙ্গের শ্রেষ্টতম কবিয়াল’ উপাধি দিলে কী হইব- আমি আমার আপন সমাজে অন্ত্যজই থাকিয়া গেলাম । পাকিস্তান সরকারও আমারে নির্যাতন করছিল। ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হইয়া জেল খাটছি। কারণ ... কারণ আমি লিখছিলাম: দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে / এখনও লোকে জাগিল না কেনে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি সরকার আমার সরকারি মাসোহারা বন্ধ কইরা দিল।

পাকিস্তানি সরকারের মতন আমার আপন সমাজও আমারে কম ভোগায় নাই। জানি, এখন আমার যাওনের সময় হইছে। আমি জানি তারা আমার মৃতদেহ দাহ করব না। তাই রাইগোপাল রে কবর খুঁইড়া রাখার কথা বললাম। আমার মুখে এই মর্মান্তিক কথা শুইনা না রাইগোপাল এখন কান্দতেছে।

যেন ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’- এই কথা সে জানে না! রাইগোপাল কাঁদছে। তবে এই মুহূর্তে শব্দ করে কাঁদছে সে। নীরবে কাঁদছে। বৃদ্ধ কবিয়াল রমেশ শীল পরম স্নেহে তাঁর প্রিয় শিষ্যকে জড়িয়ে ধরে পূর্ণিমা-প্লাবিত নির্জন নদীটির দিকে তাকিয়ে আছেন। মুহূর্তেই কী এক অজানা কারণে তাঁর পূর্বস্মৃতি জেগে ওঠে।

তাঁর প্রথম স্ত্রী অপূর্ববালার কথা মনে পড়ে। অপূর্বর সঙ্গে আজ থেইকা ৬৭ আগে আমার বিবাহ হইয়াছিল। এর এক বছর আগে (১৮৯৯ সালে) বাংলার কয়েকজন শ্রেষ্ঠ কবিয়ালকে পরাজিত করে তেরো টাকা পাই। তারপর আমি কবিগান কে পেশা হিসাবে নেওয়ার কথা ভাবলাম। অপূর্ব কে ঘরে তুলি।

অপূর্ব রাউজানের মেয়ে। ( বোয়ালখালীর উত্তরে রাউজান, আর রাউজানের উত্তরে ফটিকছড়ি... যেখানে মাইজভান্ডার গ্রাম। যে গ্রামে আমার পীরজাম মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান এর মোকাম), ... অপূর্ব জ্যোস্না বড় ভালোবাসিত , বিশেষ করিয়া আশ্বিন মাসের কোজাগরী জ্যোস্না ভালোবাসিত। আমরা চট্টগ্রামের মানুষেরা বড় প্রকৃতিপ্রেমিক। তখন আমি ২৩ বছরের যুবক; কোজাগরী পূর্ণিমায় আমি আর অপূর্ব একটি সাম্পান করিয়া কর্ণফুলি নদীতে রাত্রিভর ভাসিয়া বেড়াইতাম।

বৈঠা বাইতে বাইতে আমি অপূর্বকে চাটগাঁইয়া ভাষায় বলিতাম: একখানি গান কর অপূর্ব । অপূর্ববালা বলিত যে- সে গান করিতে জানে না। এই কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতাম, তাহা হইলে তুমি কী জান? অপূর্ব বলিত, আমি কী ভাবে বলি যে আমি কী জানি। আমি বলিলাম, তুমি বলিবে না তুমি কী জান? সে বলিল, বলিলাম তো আমি কী ভাবে বলি যে আমি কী জানি। এইভাবে আবোলতাবোল বকিয়া সময় কাটিয়া যাইত।

আর নির্জন পূর্ণিমালোকে বাতাসের তোরে একখানি সাম্পান ভাসিয়া যাইত ... এই সব কথার স্মরণ হওয়ায় এই মুহর্তে নব্বুই বছরের বৃদ্ধর চোখে জল আসে ... সেই সাম্পানটি এসে তীরে ভিড়েছে। দু’দিকে দুটি দাঁড় ধরে ফণী বড়ুয়া সাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে । ফণী বড়ুয়া কবিয়াল রমেশ শীল- এর আরেক প্রিয় শিষ্য। ফণী বড়ুয়ার পরনে লুঙ্গি আর নীল রঙের হাফশার্ট। গোলপানা মুখখানি হলদেটে।

বৃদ্ধ রমেশ শীল বললেন, আমারে ধর রে রাইগোপাল। আমারে ধইরা নৌকায় তুল। চোখ মুছে নিয়ে রাইগোপাল গুরুকে নৌকায় তুলে। এতে নৌকা দুলে ওঠে। রাইগোপাল তার গুরুকে পরম যত্নে গলুইয়ের ওপর বসিয়ে দেয়।

এতে বৃদ্ধের হাড় মটমট করে ওঠে। গুরুন অনুমতি নিয়ে ফণী বড়ুয়া ধীরে ধীরে সাম্পান ঘুরিয়ে নেয়। জ্যোস্নার তুফানে ফণী বড়ুয়ার মন নেচে উঠেছে। সে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল: ‘বাংলার জন্য জীবন গেলে হব স্বর্গবাসী/ আমার বাংলার দাবি ঠিক থাকিবে/ যদিও হয় ফাঁসী। ’ গান শেষ হলে খনখনে কন্ঠে বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে, ও ফণী? এইটা কার গান রে ? দ্যাহ ওস্তাদে কয় কী? বলে ফণী হাসে।

এইটা আপনের গান গুরু। আপনের গান। বলে রাইগোপাল হাসে। আমার গান? কও কী। জ্যোস্নার আলোয় বৃদ্ধের মুখে গভীর বিস্ময়চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখা গেল।

ফণী বলল, আপনের বয়স হইছে না গুরু। জীবনে কত গান লিখছেন। সব কী আর মনে থাকে? কথা সত্য বটে। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেস, ও ফণী, তুমি নাকি ঢাকা শহরে গেছিলা শুনলাম? হ, গুরু। ঢাকার কমলাপুরে বৌদ্ধ বিহার দেখতে গেছিলাম।

শিষ্যের কথায় বৃদ্ধ অবাক হলেন মনে হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কমলাপুরে বৌদ্ধ বিহার? কও কী? কবে হইল? আজ থিকা তিন বছর আগে। বুঝছি। তয় ঢাকার কি খবর? ফণী বলল, ছয় দফা দাবি-দাওয়া নিয়া ঢাকা শহর গরম হইয়া আছে। রাস্তায় রাস্তায় ছাত্রজনতা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু কইরা দিসে।

কমলাপুর থেইকা গেছিলাম তোপখানা রোডে। ক্যান গেছিলা? গেছিলাম বিরানি খাইতে। ঢাকায় গেছি আর বিরানি খামু না? খাইবা না ক্যান? হ। বিরানি খাইয়া নি হোডেলতুন বাইর হইছি মাত্র। পল্টনে ছাত্রজনতার মিছিল পন্ড করতে পুলিশে ধাওয়া দিছিল।

সেগুনবাগিচার গলির ভিতর দিলাম দৌড় । দৌড় দিলে কী হইব-আইয়ুব খানের পোষা পুলিশের লাডির বাড়ি ঠিকই খাইতে হইল। ঘ্যাসও খাইছি। পাকিস্তানিরার ভয় পাইছে গুরু। পাইব না- ছয় দফা কি সহজ কথা।

মানীগুণী লোকেরা লিখছেন। রমেশ শীল বললেন, ছয় দফার কথা শুনছি তোতা মিঞার কাছে। মানীগুণী লোকেরা লিখছে কইলা। কারা লিখছে? লিখছেন মুনির চৌধুরী, রেহমান সোবহান, গোবিন্দ চন্দ্র দেব আর কামাল হোসেন। অ।

এদের মধ্যে গোবিন্দ চন্দ্র দেব আর মুনির চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় আছে রমেশ শীল- এর। গোবিন্দ চন্দ্র দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাড়ি সিলেট। সিলেটের বিয়ানীবাজারে এক গানের জলসায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রমেশ শীল এর মুখে মাইজভান্ডারি গান শুনে মুগ্ধ।

জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি আমি সমন্বয়ী দর্শন নিয়ে ভাবছি। তাহলে সমন্বয় সম্ভব কি বলেন? রমেশ শীল বলেছিলেন। জ্বী, সম্ভব। মুনির চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৫৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাজীবনের স্মৃতি স্মরণ হতেই রমেশ শীল কেঁপে উঠলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কম্পন অনুভব করলেন। ... পূর্ব পাকিস্তানেপূর্ব পাকিস্তানে অখন আইয়ুবশাহী শাসন চলতেছে। গতবছর থেইকা (১৯৬৬) বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব কারাগারে। মুজিবের দুঃখে প্রান কান্দে বৃদ্ধের। আমাগো যৌবনে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন -সংগ্রাম করছি।

পাক সরকার আমার ‘ভোট রহস্য’ পুস্তকখানা নিষিদ্ধ করছিল, আমারে জেলে ভরছিল। মুজিবের যৌবনে মুজিব অখন পাকিস্তানি শাসনশোষনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। হে হক মওলা! তুমি তারে দেইখো। তাঁর দ্বারা বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইবে। হায়! আমি তখন বাঁচিয়া থাকিব না।

মুজিব নেতা বলিয়াই একাকী গহীন গাঙে নাও বাহিতেছে। তাঁর গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব আজ বাঁইচা নাই। তিষট্টি সালের ডিসেম্বর মাসে তারে লেবাননের বৈরুত শহরের হোটেল রুমে মৃত পাওয়া গেছে। তারে বিষ দিয়া মারছে কিনা কে জানে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বড় ভালো লোক আছিলেন।

উনিশ ’শ তেত্রিশ সনে তাঁহার কইলকাতার সদর স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়া দেখা করছিলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। দেশ-বিভাগের প্রাক্কালে যে দাঙ্গা হইল- সেই দাঙ্গার সময় আমি ছিলাম কইলকাতায় । দাঙ্গা বাঁধায় হিন্দু আর মুসলমানে। আমি হিন্দুও না মুসলমানও না।

আমি হইলাম মানুষ। এই ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে বৃদ্ধ শিষ্যদের খোঁচা মেরে বললেন, ফণী বড়ুয়ায় হইল বুদ্ধ। আর তুমি রাইগোপাল হইলা হিন্দু। আর আপনে? রাইগোপাল জিজ্ঞেস করে। আমি হইলাম মানুষ।

বৃদ্ধ বললেন। বলে হাসলেন। এই কথা শুনে রাইগোপাল গেয়ে উঠল: ‘হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ/ সকল ধর্মের এককথা’। নিজের লেখা গান শুনে বৃদ্ধ লজ্জ্বা পেলেন বোধ হয়। মুখ ফিরিয়ে জ্যোস্নাময় কর্ণফুলির দিকে তাকালেন।

অপূর্ববালা এমন করিয়া আমাকে লজ্জ্বায় ফেলিয়া দিত। হায়! অপূর্ব সন্তানহীনা অবস্থায় মরিয়াছিল। তাঁহার শোক বুকে চাপিয়া দ্বিতীয় স্ত্রী অবলাবালা কে ঘরে তুলিলাম। অবলাবালার গর্ভে হক মওলায় আমারে চারপুত্র এবং এক কন্যা উপহার দিয়েছেন। গান করে বলিয়া পুত্রদের মধ্যে যজ্ঞেশ্বর শীল হইল আমার যাদুধন।

বোয়ালিয়া থানার (বর্তমানে উপজেলা) সে এক সংগীতরত্ন বিশেষ। আসলে এসবই মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান এর দুআ। তিনি আজ থেইকা তিরিশ বছর আগে বলেছিলেন, তোমার জন্য দুআ করি রমেশ। এই সব ভেবে বৃদ্ধ আবেগতাড়িত হয়ে উঠলেন । দূরে কর্ণফুলি নদীর ওপর রেলব্রিজ।

কুউউ ঝিক ঝিক শব্দে রেলব্রিজের ওপর দিয়ে একটি ট্রেন চলে যায়। সেই শব্দে বৃদ্ধের হৃদয়ে কী এক তোলপাড় হয়ে যায়। যে কথা শিষ্যদের বহুবার বলেছেন রমেশ শীল, আজও শেষবারের মতো সে কথাই বলতে লাগলেন। বললেন, শুন তুমরা দুইজন। ১৯৩৭ সালের কথা।

আমার বয়স তখন ষাইট। আমি মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান- এর তরিকায় দীক্ষা নিলাম। দীক্ষা নিয়া হক মওলারে লইয়া গান বান্ধলাম। বলে গেয়ে উঠলেন বৃদ্ধ- স্কুল খুইলাছে রে মওলা, স্কুল খুইলাছে হই হই ... গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে এই গান মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান- এর কানে গেল। তিনি বলেন, এই গান কার? তাঁহার এক মুরিদ বলে, হৌজুর, এই গান বোয়ালিয়া থানার গোমদন্ডী গ্রামের রমেশচন্দ্র শীলের ।

পীর ছাহেব তখন জানতে চান, বোয়ালিয়া থানার গোমদন্ডী গ্রাম তো পূর্ব এবং পশ্চিমে বিভক্ত। পূর্ব গোমদন্ডীর কাছে রেললাইন; আর পশ্চিম গোমদন্ডীর কাছে কর্ণফুলি নদী। রমেশ শীলের বাড়ি গোমদন্ডী গ্রামের পূর্ব না পশ্চিম? নালায়েক সাগরিদ সে কথা বলতে পারে না। পীর ছাহেব তখন বলেন, যাও তারে আমার কাছে নিয়া আস। রমেশের গান শুনে আমার চোখে কান্দন আসে।

আমি তারে দুই চোখ ভরে দেখতে চাই। আমি তখন হাটহাজারী ছিলাম। হাটহাজারীর নয়ন তালুকদার-এর বাড়িতে গানের আসর বসছিল। পীরের এত্তেলা পাইয়া তড়িঘড়ি ফটিকছড়ি গেলাম। আমাকে দেইখা পীর ছাহেব বললেন, স্কুল খুইলাছে রে মওলা, স্কুল খুইলাছে ।

এই গান কার? তুমার? আমি বললাম, জ্বী হুজুর, আমার। পীর সাহেব আমারে খুঁটায় খুঁটায় দেখলেন। তারপর আমারে তার খাস কামড়ায় লইয়া গেলেন। বড় একখানা কক্ষের দেয়ালে সবুজ রং। পবিত্র মক্কা শরীফের ছবি।

মেঝেতে কালো মার্বেল পাথর । বাতাসে মেশক আতরের গন্ধ। পীর সাহেব একখানা আরামদায়ক ইজি- চেয়ারে বসলেন। বসে আমারে বললেন, বস, রমেশ। আমি সুন্দর একখান বার্মিজ কাঠের চেয়ারে বসলাম।

পীর ছাহেব বললেন, যুগ যুগ ধইরা এই দেশের মানুষ এই গান শুনব। মাইজভান্ডারি গ্রামের আমরা ঠিক কী ছিলাম এই গান শুইয়া সেইটা তারা জানব। তারা জানব "আমরা সিনায় সিনায়" লেখাপড়া শিক্ষা দিতাম। তারা জানব আমরা "খাতাকলম ছাড়াই" শিক্ষা দিতাম। বলিয়া পীর ছাহেব হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

আমার বুকে মোচড় দিয়া উঠিল। আমি বুঝিলাম আমার সংগীতশিক্ষা আজ পূর্ণতা পাইল। পীর ছাহেব কান্না সামলাইয়া বলিলেন, আল্লাহর অশেষ রহমত তুমি আমার মুরীদ হইছ। তোমার জন্য আমি আল্লাহর দরবারে খাস কইরা দুআ করি। এই কথা শুইনা না আমি চুপ কইরা রইলাম।

আমার সারা অঙ্গ কাঁপতেছিল। পায়ের তলায় সাদাকালো মার্বেল পাথরের মেঝে কাঁপতে ছিল মনে হইল। আতরের গন্ধ ঘন হইয়া উঠিল। পীর সাহেব বলিলেন, তোমার বাবার নাম কি? আমি বলিলাম, চন্ডিচরণ শীল। পেশা? কবিরাজি।

হুমম। বুঝিলাম পীর ছাহেব আরও কিছু জানিতে চাহেন। বলিলাম, আমি তখন ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। আমার বাবার মৃত্যু হইল। আমার বয়স তখন এগারো।

আমি ছাড়া সংসার দেখিবার কেউ নাই। মনের দুঃখে গান বান্ধলাম: আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ নাই/ মায়ের অলংকার সম্বল আমার বিক্রি করে খাই। ... স্কুলে আর পড়া হইল না। কুড়ি বছর বয়েস (১৮৯৭ সালে) প্রথম মঞ্চে গান গাইলাম। গান সবার পছন্দ হইল।

ভরসা পাইলাম। সেই শুরু হুজুর। এর দুই বছর পরে আমি নদীয়ার ওসমান কবিয়ালকে পরাজিত করে তেরো টাকা পাই। এর পর আমি কবিয়াল বলে পরিচিত হইলাম। আগে কবি গান ছিল অশ্লীল হুজুর।

জীবনবিচ্ছিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে ভরপুর । আমি কবিগানকে মাটিতে নামাইয়া আনি। সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার করিয়া তুলি। গাইলাম: ব্যবসার ছলে বণিক এল/ডাকাত সেজে লুট করিল মালকোঠার ধন হরে নিল/আমারে সাজায়ে বোকা/কৃষক মজদুর একযোগেতে/হাত মেলালে হাতে হাতে/ শ্বেতাঙ্গ দুষমনের হতে/যাবে জীবন রাখা। পীর ছাহেব উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া বলিলেন, বাহ্ ।

বেশ। বেশ। এই রকম গান আরও একখান গাও। আমি গাইলাম- দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে / এখনও লোকে জাগিল না কেনে। হুমম।

বলিয়া পীর ছাহেব চুপ করিয়া গেলেন। আমি বলিলাম। হুজুর আমি কবিয়াল সমিতি গঠন করব ভাবতেছি । কর, কর । তোমার জন্য আমি দুআ করি রমেশ।

বলে চুপ করে রইলেন বৃদ্ধ কবিয়াল। রাইগোপাল ও ফণী বড়ুয়া কে বলতে হল না । তারা গুরুর পীরের সম্মানে গাইতে শুরু করিল- স্কুল খুইলাছে রে মওলা, স্কুল খুইলাছে হই হই ... গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে বৃদ্ধ রমেশ শীল ওদের সঙ্গে গলা মেলালেন- স্কুল খুইলাছে রে মওলা, স্কুল খুইলাছে হই হই ... স্কুল খুইলাছে রে মওলা, স্কুল খুইলাছে গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে সেই স্কুলের এমনি ধারা মাইনে ছাড়া পড়ায় তারা আরে খাতা কলম ছাড়াই তারা শিক্ষা দিতাছে গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে ... হই হই গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে হই হই সেই স্কুলের এমনি ধারা নাইকো হিসাব জুয়ানবুড়া আরে সিনায় সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে স্কুল খুইলাছে রে মওলা স্কুল খুইলাছে হই হই ...গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী খুইলাছে গানের সুর বোয়ালখালির আশ্বিনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। কোজাগরী পূর্ণিমায় কর্ণফুলি নদীতে একটি সাম্পান ভেসে যায় ... মরমি-সমাজতন্ত্রী কবিয়াল রমেশ শীল (জন্ম: ১৮৭৭) ১৯৬৭ সালে মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল ... তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়ায় ওয়াকিল আহমেদ এর লেখা কবিয়াল রমেশ শীল এর ওপর নিবদ্ধ; http://www.banglapedia.org/HT/S_0341.HTM ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.