আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মের জল্লাদদের আচরণের প্রতিবাদে মুসলমানেরা ধর্ম বিসর্জন দিয়ে মানুষ হয়ে উঠুক

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা সংখ্যালঘুদের উপরে নিয়মতান্ত্রিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাই। গতকাল রাত থেকে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে আগুণ দেওয়া হয়েছে, চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধমন্দির জ্বালানো হয়েছে, উখিয়ায় বৌদ্ধমন্দির জ্বালানো হয়েছে এবং আহত শতাধিক, উখিয়ার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ জন। ধর্মের তরবারী হাতে ধর্ম রক্ষার মিশনে নামা এইসব জল্লাদদের পরিচয় না কি মুসলমান নয়। কিন্তু তারা যেহেতু মুসলিম হিসেবেই নিজেকে পরিচিত করছেন তাই প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের এদের কাফের মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে নিজেদের বিবেক পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে নইলে নিজের মুসলমানিত্ব খারিজ করে মানুষ হয়ে উঠতে হবে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো কোরআন অবমাননাকারী সংবাদ ফেসবুকে শেয়ার করা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ভীষণ ধরনের অপরাধ করেছেন যে কারণে এইসব সংখ্যালঘু নির্যাতন বৈধ।

প্রথম আলোর এই ঘটনা এবং ঘটনার প্রতিক্রিয়া ধাঁচের রিপোর্টিং এ আমাদের সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক মানসিকতা প্রকাশিত হয় না, আমাদের জাতিগত সহিংসতার সংবাদগুলোও রেশমী কাপড়ে জড়িয়ে উপস্থাপন করে তারা, কোনো কোনো সময় একেবারেই উধাও করে দেয়। তাদের বিভিন্ন বিবেচনা আছে, তারা চায় দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকুক, তাদের পাঠকেরা কোরআনের বানীর পরে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের রিপোর্টের শব্দকে পবিত্র মনে করে। এই একটা গণ অন্ধত্ব তৈরিতে প্রথম আলো সফল, কিন্তু অপরাপর গণমানুষেরা, যারা সংখ্যাগুরু হওয়ায় কখনই আতংকিত বোধ করেন নি তাদের প্রতিক্রিয়া কি এ ঘটনায়। একজনের নিন্দা জানানোর প্রতিক্রিয়ায় দেখলাম কয়েকজন এসে বলছে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীরা এইসব আচরণ করতে পারে না। যারা এইসব আচরণ করেছে তারা নামসর্বস্ব মুসলমান।

আমি সরল মনে জানতে চাইলাম আপনি এমন ১০ জন প্রকৃত মুসলমানের নাম বলেন যারা এ মুহূর্তে ইসলামের সকল বিধিনিষেধ মেনে চলে এবং যারা মানবিকতায় বিশ্বাস করে এবং পৌত্তলিকদের ধর্ম পালনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রয়োজনে এই ন্যায্য দাবীর পক্ষে লড়াই করতে প্রস্তুত প্রকৃত মুসলিমের গল্প শোনানো মানুষটা আমাকে ১৪০০ বছর আগের গল্প শোনালেন, সেসময় সাহাবারা কি করেছেন, সেটাই প্রকৃত ইসলাম, সেসব পড়ে জানলে আমার ইসলাম বিদ্বেষটা কমে যাবে। আমি তখন আর এইসব গল্প- প্রকৃত ইসলামের মীথ নিয়ে রসিকতা করবো না। পৌত্তলিকতা বিষয়ে ইসলামের মীমাংসা হয়েছে মুহাম্মদের কা'বা প্রবেশের সাথে সাথেই, যে সময় কা'বায় স্থাপিত ৩৬০টা মুর্তি ভেঙে কা'বাকে পৌত্তলিকতা মুক্ত করা হয়েছিলো এবং সকল পৌত্তলিকদের পৌত্তলিকতা পরিত্যাগ কিংবা পবিত্র আরব ভূখন্ড ত্যাগের হুকুম দেওয়া হয়েছিলো। এ নিয়ম না মানলে তাদের কতল করা হবে এমন হুমকিও দেওয়া হয়েছিলো। বুদ্ধ আসলে ইশ্বরের প্রেরিত পুরুষ, সেও নবী, এমনটা শুনেছিলাম একজনের কাছে, কিন্তু তার মুর্তি বানিয়ে সেখানে ধ্যান করা নিশ্চিতভাবেই পৌত্তলিকতাই, সেটা প্রকৃত মুসলমান কিভাবে মেনে নিবে? সময়ের প্রেক্ষাপটে রাষ্টের চাপে এখনকার মুসলমানদের মডারেট মুসলমানের জীবনযাপন করতে হয়।

তারা প্রকৃত ঈমানদারিত্বের সাথে প্রকৃত ইসলামের চর্চা করতে পারে না, সে জন্য এ দেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যাই হোক প্রকৃত ইসলামের চর্চার অনুশীলন যারা করছে রামুতে, উখিয়া পটিয়ায় তাদের এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক আচরণ ও নির্যাতনের নিন্দা জানাই আমি। আমি বিশ্বাস করি রাজনৈতিক কারণে উপমহাদেশে কিংবা অন্যান্য দেশে পৌত্তলিকতাকে মেনে নিলেও প্রকৃত ইসলাম কোনো সময়ই পৌত্তলিকতার সাথে আপোষ করে নি, এদেশে কিংবা অন্যান্য দেশে যা ঘটেছে সেটা রাজনৈতিক, রাজতন্ত্রী ইসলামের প্রসারের ফলে ঘটেছে। যেকোনো কারণেই হোক পারিবারিকভাবে মুসলমান হওয়ায় আমার ধর্ম পালন করা না করায় সামাজিক ভাবে তেমন বিরুদ্ধ বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মুখোমুখি হতে হয় নি। পারিবারিক পর্যায়ে যা প্রতিক্রিয়া সেটা হজম করতে হয়েছে।

কিন্তু সম্পূর্ণ অকারণ এ নির্যাতনে আমি উপলব্ধি করলাম সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হিসেব আমি কখনওই এইসব বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো না। আমার পেছনে বিশাল একটা দেয়াল আছে সে দেয়ালটা আমাকে নিরাপদে রাখছে অপরাপর সংখ্যালঘু মানুষের জন্য এই দেয়ালের পুরুত্ব একেবারেই কম, তাদের নিরাপত্তাবেষ্ঠনী আমাদের সংখ্যাগুরুর সুবিধালোভী মানুষদের চাপে ভেঙে গেছে অনেক আগেই। তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র উপস্থিত থাকে না সব সময়, উপস্থিত হলেও তারা নিরাপত্তা প্রদানে তেমন উৎসাহী হয়ে উঠে না, ক্ষেত্র বিশেষে নির্যাতন উপভোগ করে। সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা ছাইয়ের গাদায় স্বর্ণ খুঁজতে যায়। আমরা লজ্জিত হই প্রতিবাদ করি, কিংবা মৌন ও সরব সমর্থন দিয়ে যাই।

যারা এই মুহুর্তে ব্লগটা পড়ছেন এবং যারা আগামী বছরে এই ব্লগটা পড়বেন বাংলাদেশের জনসংখ্যা শুমারী মেনে নিয়ে বলা যায় আপনি যেকোনো বিবেচনায় সংখ্যালঘু নন, তবে আপনার আমার পাশে অসংখ্য সংখ্যালঘু বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব নিয়ে জীবনযাপন করছেন। গণের জোয়ারে গণতন্ত্রের চাপে পিষ্ট নাগরিক জীবনে গণের একজন হয়ে না উঠতে পারার ভয়াবহ অভিশাপটুকু আপনি আমি কখনও উপলব্ধি করি না, যদিও ধর্মাচারণে আমাদের অধিকাংশই অনেক বেশী অনিয়মিত, যদিও আমাদের ধর্মের সুক্ষাতিসুক্ষ্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে ততটা অবগতি নেই এবং আমাদের এই আপাতধর্মউদাসীনতা আমাদের ভেতরে এক ধরণের জায়মান অপরাধবোধের জন্ম দিয়েছে এবং সেই অপরাধবোধের প্রতিক্রিয়ায় আপনার আমার ভেতরে ধর্মবিষয়ে এক ধরণের অহেতুক সংরক্ষণশীলতা বিদ্যমান। এই অপরাধবোধের কারণে আমরা প্রকাশ্য ধার্মিকদের অহেতুক উন্মত্ততাকেও সমর্থন করি ,যারা ধর্মচিহ্ন ধারণ করে আছে তাদের প্রতি আমাদের এক ধরণের অন্ধ শ্রদ্ধাবোধ এক ধরণের সচেতন প্রশ্রয় রয়েছে। এই একই ধর্মবিষয়ক স্পর্শ্বকাতরতা আমাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মপালনের অধিকার বিষয়ে উদাসীন করেছে। বাংলাদেশের আদমশুমারী অনুসারে এদেশের প্রতি ১০ জনের ৯ জন মুসলমান আর প্রতি ১০০ জনের ৯৯ জন বাঙালী।

সেই আদমশুমারী অনুসারে এদেশে সনাতন ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যালঘু, আপনি ব্যক্তিগত বিশ্বাসে হয়তো মুসলিম নন, আপনি ব্যক্তিগত জীবনাচরণে হয়তো কখনও ধর্মসংশ্লিষ্ঠতা প্রকাশ করেন নি কিন্তু এদেশে এখনো সামষ্টিক বিবেচনায় আপনি আক্রান্ত নন। আমি গত ৮ মাসে ঘটে যাওয়া কয়েকটা সাম্প্রদায়িক বর্বরতার ঘটনা জানাতে চাই লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রাজশাহী, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, চাপাইনওয়াবগঞ্জ এবং নেত্রকোণায় ঘটে যাওয়া এইসব সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদ তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয় নি। কয়েকজন আদিবাসী তরুণী ধর্ষিত হয়েছেন, থানায় মামলা নেওয়া হয় নি। একজন হিন্দু যুবক ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো এক মুসলমান মেয়েকে, তাকে সালিশ ডেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে- প্রায় একই রকম অভিযোগে অন্য একটি হিন্দু পরিবারের বসতভিটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরেকজনকে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছে। রামুর ঘটনা ঘটমান বর্তমান, সেটাতে কত রক্ত ঝরবে সেটা আগামী কয়েক দিনে পরিস্কার হবে আমি নানাবিধ যন্ত্রনায় পাসপোর্টে নিজের পরিচয় বাংলাদেশী লিখেছি, বাংলাদেশী আসলে এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে, অপরাপর উণমানুষেরা বাংলাদেশের নাগরিক নন।

আমি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এই বর্বরতার প্রতিবাদে নিজের বাংলাদেশী পরিচয় মুছে ফেলতে পারি না কিন্তু নিজেকে চাইলেই সংখ্যালঘু শ্রেণীতে পরিণত করতে পারি। আমি চাইলেই বৌদ্ধ হতে পারবো না, জানি প্রকাশ্যে নিজের ধর্মত্যাগের হ্যাপা আছে বাংলাদেশে, আমি চাইলেই হিন্দু হতে পারবো না, কিন্তু আমি আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাতে পারি। আমি বলতে চাই আমি মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত লজ্জিত হই স্বজাতির নির্যাতন প্রবনতায়। আমি যদি সুযোগ থাকে স্বেচ্ছাশ্রমে বৌদ্ধমন্দির গড়ে তুলতে পারি, যদি সামর্থ্যে কুলায় এদের প্রতেকের পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ী পুনঃনির্মান করতে সহযোগিতা করতে পারি কিন্তু তাদের ভেতরের বিশ্বাস ও আস্থার ভেঙে যাওয়া ভিত্তি নির্মাণ করতে পারবো না। তাদের ভেতরের সংখ্যালঘুত্বের ভীতি ও নির্যাতিত হুয়ার সাম্ভাব্য উদ্বেগ মুছে দিতে পারবো না।

আমার সামর্থে যতটুকু আছে তাই করতে পারি- আমি ব্যক্তিগত লজ্জায় নিজের পাসপোর্টে লিখে রাখা মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলতে পারি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.