আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধ এবং জিয়া-প্রেক্ষিত ১৯৭১

তবে তাই হোক, ক্লান্তিহীন তিল তিল আরোহনে সত্য হোক বিক্খুব্ধ এই জীবন _____ স্বাধীন বাংলাদেশের পশ্চাতমুখী যাত্রা শুরু হয় মুলতঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নৃশংস হত্যাকান্ড এবং ১৯৭৫ সালের ৩ রা নভেম্বরে জেলখানায় পৈশাচিকভাবে খুন করা হয় আমাদের জাতীয় চার নেতা বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-ইতিহাসের এই ভয়ানক বাঁকে যদি আপাতঃ খলনায়ক হিসেবে খোন্দকার মোশতাক চিহ্নিত হলেও চুড়ান্ত বিচারে এই সমস্ত ঘটনাবলী’র বেনিফিসিয়ারী হলেন একজন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জেনারেল জিয়াউর রহমান। এটা খুব সত্য যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো ধাপে ধাপে এবং ১৯৪৭ সালের দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া ফাকিস্তান থেকে বিপরীতমুখী ধারায় গনতন্ত্র-অসাম্প্রদায়িকতা-বাংগালী জাতীয়তাবাদ-সমাজতন্ত্র। ঐতিহাসিক অধ্যাপক বোরহানউদ্দীন খাঁন জাহাঙ্গীর তাঁর মুক্তিযুদ্ধ এবং জিয়াউর রহমানের মৌলবাদ নিবন্ধে যথার্থই বলেছেনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে দুটি পরস্পরবিরোধী ধারা কাজ করেছে। প্রথম ধারাটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং সেক্যুলার সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস।

দ্বিতীয় ধারাটি মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং মৌলবাদী সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস। একটি নয়, বরং বহুস্তরের ইতিহাস চেতনা, আমাদের ইতিহাস বোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পর্যালোচনা ঘিরে আছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতি করেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে জিয়াউর রহমান প্রচ্ছন্নভাবে মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন এবং এই লেবাস প্রকাশ্য হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে, বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনীতির মধ্য দিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থন এসেছে সেনাবাহিনীর মৌলবাদী মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

রাজনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতাদর্শিক যোগাযোগ করিয়েছেন জিয়াউর রহমান। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : যে ইতিহাস শক্তিশালী হয়েছে বঙ্গবন্ধু-মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মোজাফ্ফর আহমদের রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্য দিয়ে এবং এই অবস্থানটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর সেক্যুলার মতাদর্শিক অবস্থান গ্রহণের ইতিহাস। জিয়াউর রহমান যেমন রাষ্ট্রক্ষেত্র থেকে সেক্যুলারিজমকে উৎখাত করেছেন, তেমনি তিনি সেনাবাহিনীর সেক্যুলার অবস্থানও উৎখাত করেছেন। দুই ক্ষেত্রেই তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করেছেন। সে জন্য জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক চরিত্র হচ্ছে প্রচ্ছন্ন মৌলবাদ থেকে প্রকাশ্য মৌলবাদে উত্তরণের ইতিহাস।

যে জন্য জিয়াউর রহমান থেকে গোলাম আযমের রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দূরত্ব কিছু নয়। জিয়াউর রহমান থেকেই স্বাধীনতার লড়াই কিংবা জাতীয় আন্দোলনের আখ্যান হয়ে ওঠে কলোনি-উত্তর জাতিরাষ্ট্রে রাজনৈতিক-সামরিক শাসক গ্রুপদের ক্ষমতা বৈধকরণের উপায়। এই প্রক্রিয়ায় জাতীয় বীরদেরও রূপান্তর ঘটতে থাকে, জিয়াউর রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন মুসলিম জনসমষ্টির স্বার্থরক্ষার সবচেয়ে প্রধান রাজনীতিবিদ; মণি সিংহ হয়ে ওঠেন হিন্দু রাজনীতিবিদ; শেখ মুজিব ও মোজাফ্ফর আহমদ হয়ে ওঠেন ভারত অনুগৃহীত রাজনীতিবিদ। এভাবে জিয়াউর রহমান ও গোলাম আযম সাম্প্রদায়িক ইতিহাস তৈরি করা শুরু করেন। সাম্প্রদায়িক ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এক নয়।

জিয়াউর রহমান সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভারতের হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে দেখেছেন, গোলাম আযমও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাকিস্তানের হেজিমনির বদলে ভারতের হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের কারণে দুজনই হত্যার রাজনীতি চালু করেছেন এবং ভেবেছেন হত্যাই তাঁদের রাজনীতিকে বৈধতা দেবে। মুক্তিযুদ্ধ যে কলোনিবিরোধী রাজনীতি, এই বোধকে নষ্ট করেছেন জিয়াউর রহমান এবং একটি কলোনিয়াল সমাজে মুক্তিযুদ্ধ যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, এই বোধকে জিয়াউর রহমান ও গোলাম আযম সাম্প্রদায়িকতা আরোপ করে ছিন্নভিন্ন করেছেন। (বঙ্গবন্ধু এবং মেজর রফিক বীর উত্তম) এখানে ফিরে যেতে হয় ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে। ৭ ই মার্চের সেই স্বাধীনতার ঘোষনার পরে কি হচ্ছিলো চট্টগ্রামে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে চট্টগ্রামকে ১নংসেক্টরের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামবাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামকে ৪টি অংশে ভাগ করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন এলাকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শহর এলাকার দায়িত্ব নেন জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, জনাব এম. এ. মান্নান ও জনাব আক্তারুজ্জামান চৌধুরী।

কালুরঘাট এলাকার দায়িত্ব নেন জনাব এম. এ. হান্নান, জনাব আতাউর রহমান খান কায়সার, ডাঃ এম এ মান্নান ও ডাঃ আবু জাফর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দায়িত্ব নেন জনাব এম এ ওহাব। শুভপুর এলাকার দায়িত্ব নেন ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন এবং তাঁর সহকর্মীরা। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রামে একটি প্রশাসনিক জোন ছিল, যার প্রধান ছিলেন জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী (প্রাক্তন মন্ত্রী)। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন জনাব এম. আর. ছিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব এম. এ. হান্নান।

২৬ শে মার্চে চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ বিস্তারিত আলোচনার পর বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। ইতোপূর্বে শহরের বিভিন্ন স্থানে বাংলা ও ইংরেজীতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিলি করা হয়। ২৬ শে মার্চ দুপুর ২টা থেকে ২:৩০টার মধ্যে কোন এক সময়ে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জনাব এম. এ. হান্নান কালুরঘাটস্থ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাটি সর্বপ্রথম পাঠ করেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে বেতারের কালুরঘাটস্থ সম্প্রচার কেন্দ্র ‘‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’’ হিসেবে কাজ শুরু করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ২৬ শে মার্চ তারিখে তিনটি অধিবেশন হয়।

১ম অধিবেশনটি হয় আনুমানিক দুপুর ১২ টা হতে ১টা পর্যন্ত। অধিবেশনটি ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং এতে উপস্থিত ছিলেন জনাব এম. এ. হান্নান, ডাঃ এম এ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন, জনাব রাখাল চন্দ্র বণিক, জনাব শাহ্-ই-জাহান চৌধুরীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ২য় এবং ৩য় অধিবেশন ছিল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের। জনাব বঙ্গলাল দেব চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এতে উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন দুটি যথাক্রমে বিকেলে এবং রাতে অনুষ্ঠিত হয়।

২৭ শে মার্চ তারিখ সকালে মেডিকেল কলেজের ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য ছাত্র নেতৃত্বের সমন্বয়ে আরেকটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বিকালের অধিবেশন পরিচালিত হয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে। জাতির পিতার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠসসহ এভাবেই স্বাধীনতার পরবর্তী সম্প্রচার কার্যক্রম চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে সূচিত হয়। এতো গেলো মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত ধাপে অগ্রসর হবার গল্প। তার আগে দেখে নেই চট্টগ্রাম সামরিক অঞ্চলগুলোতে কি চলছিলো? ধারনা নেওয়ার চেষ্টা করি ঠিক সে সময়ের সামরিক অবস্থানগুলিঃ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারঃ প্রায় দুই হাজার পাঁচশ সৈনিক ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলো।

যাদের অধিকাংশ ছিলো নতুনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। এই সেন্টারের অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন বাঙ্গালী অফিসার ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম আর মজুমদার এবং অন্যান্য দায়িত্ব প্রাপ্তরা হলেন- ডেপুটি কমান্ডেন্ট কর্নেল এইচ এস সিগ্রি (অবাঙ্গালী) চীফ ইন্সট্রাকটর লেঃ কঃ এম আর চৌধুরী(বাঙ্গালী) এ কিউ লেঃ কঃ জেড এম ওসমানী (অবাঙ্গালী), এডজুডেন্ট ক্যাপ্টেন মহসিনউদ্দীন আহমেদ (বাঙ্গালী) কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন এনামুল হক চৌধুরী (বাঙ্গালী) ট্রেনিং এডজুডেন্ট ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী (বাঙ্গালী) অধিনায়ক ট্রেনিং কোম্পানী ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ (বাঙ্গালী) অধিনায়ক হোল্ডিং কোম্পানী ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া(বাঙ্গালী) রেকর্ড অফিসার মেজর এম আর বেগ (অবাঙ্গালী) রেকর্ড অফিসার মেজর কামাল (অবাঙ্গালী) মেজর সিরাজুল ইসলাম (বাঙ্গালী)। উপরোক্ত বাঙ্গালী অফিসারদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী (বর্তমানে জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী অবঃ বীর বিক্রম) ক্যাপ্টেন মহসিনউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া ব্যতিত অন্যরা যুদ্ধে যোগদান করেন নাই। লেঃ কঃ এম আর চৌধুরী ২৫ শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হন। সে গল্পে আমরা পরে আবারো আসবো।

ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টঃ ষোলশহর বায়েজিদ বোস্তামী রোডে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষের খালি টিনশেডে অবস্থান করছিলো অষ্টম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। এ রেজিমেন্টে অধিনায়ক লেঃ কঃ রশিদ জানজুয়া(অবাঙ্গালী) সহ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (সহ অধিনায়ক) এ্যাডজুডেন্ট লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী (বাঙ্গালী) কোয়ার্টার মাষ্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ (বাঙ্গালী) কোম্পানী অধিনায়ক মেজর মীর শওকত আলী (বাঙ্গালী) কোম্পানী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী (বাঙ্গালী) কোম্পানী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আহমেদ দীন(অবাঙ্গালী) কোম্পানী অধিনায়ক লেঃ মাহফুজুর রহমান (বাঙ্গালী) কোম্পানী অফিসার লেঃ আজিমউদ্দিন (অবাঙ্গালী) কোম্পানী লেঃ হুমায়ুন আহমেদ (অবাঙ্গালী)। মেজর জিয়া সহ উপরিউক্ত প্রতিটি বাঙ্গালী অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। নবম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টঃ এছাড়া নবম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে আরো একটি নতুন ইউনিট গঠনের পর্যায়ে ছিলো। এই ব্যাটেলিয়ানের সৈনিকরাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে প্রশিক্ষনরত ছিলেন।

নবগঠিত এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন মেজর মুশতাক আহমেদ এবং ব্যাটেলিয়ান এডজুডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন। মেজর মুশতাক এই ইউনিটে যোগদানের পুর্বেই ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন এবং ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ব্রাহ্মনবাড়িয়ার চতুর্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ই পি আর হেডকোয়ার্টার, হালিশহরঃ হালিশহরের ই পি আরের একটি সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিলো। যার অধীনে চট্টগ্রামে দুইটি উইং হেড কোয়ার্টার ছিলো। এই সব সেক্টর এবং উইঙ্গে যেসব অফিসার নিয়োজিত ছিলেন তারা হলেন- সেক্টর হেড কোয়ার্টার অধিনায়ক লেঃ কঃ আব্দুল আজিজ শেখ (অবাঙ্গালী) সহ-অধিনায়ক মেজর আব্দুল হামিদ (অবাঙ্গালী) এ্যাডজুডেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (বাঙ্গালী) মেডিকযাল অফিসার মেজর আমিরুল ইসলাম (বাঙ্গালী)।

এখানে একটা নোট দেওয়া ভালো এই ক্যাপ্টেন রফিক মুক্তিযুদ্ধে পালন করেন ঐতিহাসিক ভুমিকা। ১১ নাম্বার উইঙ্গঃ হালিশহরে ১১ নাম্বার উইঙ্গে অধিনায়ক মেজর মোঃ ইকবাল (অবাঙ্গালী) সহ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আবুল হায়াত (অবাঙ্গালী)। ১৪ নাম্বার উইঙ্গঃ ১৪ নাম্বার উইঙ্গ হালিশহরে অধিনায়ক মেজর শামসুদ্দিন আহমেদ (বাঙ্গালী) সহ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মমতাজ আহমেদ (বাঙ্গালী) এই অফিসারদের মধ্যে মেজর শামসুদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ১৭ নাম্বার উইঙ্গঃ চট্টগ্রাম সেক্টরের অধীনে ১৭ নাম্বার উইং হেডকোয়ার্টার ছিলো কাপ্তাইতে। যার অধিনায়ক ছিলেন মেজর পীর মোহাম্মদ (অবাঙ্গালী) ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী (বাঙ্গালী)।

ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। এম ভি সোয়াত-শহীদ লেঃ কঃ এম আর চৌধুরী -ক্যাপ্টেন রফিক এবং মেজর জিয়াউর রহমানঃ ২৮ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ বিপুল গোলাবারুদ এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এম ভি সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান নেওয়ার সংবাদে চট্টগ্রামের জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং স্থানীয় জনগন-রাজনৈতিক কর্মীরা এইসব অস্ত্র খালাস করার বিরুদ্ধে ব্যাপক গনপ্রতিরোধ গড়ে তুলেন। বাঙ্গালী ব্রিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে স্থানীয় প্রশাসক নিয়োগ করে সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ব্রিগ্রেডিয়ার মজুমদার প্রতিরোধাকারীদের প্রতি নমনীয় থাকায় সুকৌশলে তাঁকে ঢাকায় বদলি করা হয় এবং ব্রিগ্রেডিয়ার আনসারী (ফাকিস্তানী) কে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু জনতার প্রতিরোধের মুখে ফাকিস্তানীদের সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়! ততকালীন ই পি আরের সেক্টর এ্যাডজুডেন্ট ক্যাপ্টেন রফিক লিখিত ‘লক্ষ প্রানের বিনিময়ে’ এবং মেজর জিয়া কতৃক লিখিত ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে দেখা যায়-ক্যাপ্টেন রফিক-মেজর জিয়া এবং লেঃকঃ এম আর চৌধুরী কয়েকবারই মতবিনিময় করেন।

পাকিস্তানী বাহিনী বাঙ্গালীদের উপর আক্রমন করলে বাঙ্গালী সেনাবাহিনী এবং ই পি আর দের ভুমিকা কি হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন সেখানে ক্যাপ্টেন রফিক সুষ্পষ্টভাবে ‘আক্রান্ত হবার পুর্বেই আক্রমনের মতামত দেন-অবশ্যই বিদ্রোহ ঘোষনা’। কিন্তু লেঃ কঃ এম আর চৌধুরী এবং মেজর জিয়া এটা বিশ্বাস করতে পারেননি যে অবাঙ্গালী সৈনিকরা বাঙ্গালী সৈনিকদের আক্রমন করতে পারে। সুতরাং মেজর জিয়া এবং লেঃকঃ এম আর চৌধুরী বিদ্রোহ ঘোষনার বিপক্ষে মতামত দেন। লেঃ কঃ এম আর চৌধুরী শহীদ এবং বিদ্রোহ ঘোষনাঃ ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ রাত ১১ টায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ২০ তম বেলুচ রেজিমেন্ট এক ঝটিকা আক্রমনের মাধ্যমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার দখল করে নেয় এবং বাঙ্গালী সৈনিকদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পাশবিকভাবে হত্যা করে এবং তখনি শহীদ হন লেঃকঃ এম আর চৌধুরী। হয়তো কিছুটা দোনোমোনা কিংবা পাকিস্তানীদের বিশ্বাস করার পরিনাম।

ঠিক সেই সময় মেজর জিয়া লেঃ কঃ জানজুয়ার নির্দেশে ষোলশহর থেকে ব্যারিকেড সরাতে সরাতে রাত সাড়ে ১১ টায় আগ্রাবাদ অবস্থান করছিলেন। এদিকে ই বি আর সি তে বেলুচ রেজিমেন্ট কতৃক আক্রমন এবং নির্বিচারে সৈনিক হত্যার খবর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পৌঁছালে সেখানে অবস্থানরত বাঙ্গালী সৈনিকরা বিদ্রোহ ঘোষনার জন্য বাঙ্গালী অফিসারদের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী ত্বরিত আগ্রাবাদ গিয়ে লেঃকঃ এম আর চৌধুরী হত্যা এবং ই বি আর সি তে হামলার খবর দিলে তিনি ব্যাটেলিয়নে ফেরত আসেন এবং সৈনিকদের নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। এসময় তারা ব্যাটালিয়ানে অবস্থানরত অবাঙ্গালী অফিসারদের লেঃ কঃ জানজুয়াসহ হত্যা করেন অথবা বন্দী করেন। এবং তাঁরা সমস্ত ব্যাটেলিয়ান সহ কালুরঘাট হয়ে পটিয়ায় অবস্থান নেন। ঠিক সেই সময়ে ই পি আর এর সেক্টর এ্যাডজুডেন্ট ক্যাপ্টেন রফিক পুর্ব পরিকল্পনা ও নির্দেশ মতে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়া এবং ক্যাপ্টেন রফিক ই পি আর এবং ই পি আর এবং ই বি আর সি র বেঁচে যাওয়া সৈন্য নিয়ে কুমিরায় কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আগত পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতিরোধ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং স্বাধীনতার ঘোষনাঃ ২৭শে মার্চ মেজর জিয়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাড়ে তিনশ সৈন্য এবং প্রায় দুইশত ই পি আর সৈনিক পটিয়ায় একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ গড়ার জন্য অবস্থান নেয়। এই দিনে মেজর জিয়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেনঃ আই মেজর জিয়া, অন বিহাফ অব দা লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ডিক্লেয়ার্ড দা ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ……………………………… (কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচারযন্ত্র) তোমরা কান খুলকে শুনো ৩১ শে জুলাই ধানুয়া-কামালপুরের যুদ্ধ এবং ৩ রা আগষ্ট নক্সী বি ও পি আক্রমনে যথাক্রমে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হন আহত হন ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। তিনজন চৌকস অফিসার হারিয়ে ১১ নাম্বার সেক্টর তখন খুব খারাপ অবস্থায় পড়ে যায়। এই প্রথম বিগ্রেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান বাঙ্গাল্য বক্তব্য রাখেন।

তাঁর এই বক্তব্য প্রদানকালে বুঝতে পারি আমরা সকল অফিসার ও ফোর্স বুঝতে পারি জিয়াউর রহমান বাঙ্গালী হয়েও ভালোভাবে বাংলা বলতে পারেননা। তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলা-উর্দু অথবা ইংরেজী-উর্দু মিশিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর বক্তৃতায় একটা উক্তি ছিলো এমন- ‘তোমরা কান খুলে শুনো’। এভাবে তিনি আরো অনেক কথা বাংলা-উর্দু মিলিয়েই বলছিলেন। তাঁর এমন বক্তৃতা শুনে অফিসার এবং ফোর্স একে অপরের মুখের দিয়ে চাইতে থাকেন।

সুত্রঃ আপন আয়নায় একাত্তর, পৃষ্ঠাঃ ১৪৯ লেখকঃ শফিকউল্লাহ সাব সেক্টর কমান্ডার ১১ নম্বর সেক্টর জেনারেল ওসমানী এই আক্রমনে ব্যর্থতার জন্য যতেষ্ট ক্ষুব্দ হয়েছিলেন সে বিষয়ে যুদ্ধে আহত মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ তাঁর ‘রক্তে ভেজা একাত্তর’ গ্রন্থে ৮৩ পৃষ্ঠায় লিখেনঃ ‘১৩ই আগষ্ট সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওস্মানীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সকল এপোয়েন্টমেন্ট বাতিল করে জেনারেল ওসমানী আমাকে নিয়ে ম্যাপ এনে কামালপুর আক্রমনের বিশদ বিবরন শুনলেন। উস্মা প্রকাশ করলেন মেজর জিয়া সম্পর্কে, তাকে কে বলেছে এই ধরনের আক্রমন করতে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিশেষে বিদায় নেবার সময় কাঁধে হাত রেখে বল্লেনঃ থ্যাঙ্ক গড-ইউ আর এলাইভ’। সবাইকে ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

আবারো লেখার ইচ্ছে আছে-হ্যাপি ব্লগিং!! সুত্রঃ ০১। আপন আয়নায় একাত্তর লেখকঃ শফিকউল্লাহ, সাব সেক্টর কমান্ডার, ১১ নাম্বার সেক্টর। ০২। লক্ষ প্রানের বিনিময়ে- মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম ০৩। দৈনিক জনকন্ঠ ০৪।

চট্টগ্রাম জেলা তথ্য বাতায়ন ছবিঃ অন্তর্জাল নোটঃ এই লেখায় আমার তেমন কিছু লেখার ছিলোনা শুধু বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে সন্নিবেশিত করলাম।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.