আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার: হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব ১০ )

সদ্য প্রয়াত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক এই সাক্ষাৎকার গুলো গ্রহন করেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। সেই সাক্ষাৎকার গুলো নিয়ে এই পোস্ট। ধারাবাহিক ভাবে দেয়া হচ্ছিল। আজকে দেয়া হল এর শেষপর্ব। আগের পর্বের লিঙ্ক - পর্ব ( ৮,৯ ) পর্ব ৭ , পর্ব ৫-৬ পর্ব ৪ , পর্ব ১-৩ দশম পর্ব হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ ইমদাদুল হক মিলন 'পদ্মা গোমতী' বেশ নামকরা সংগঠন।

বাংলাদেশ এবং আগরতলা মিলিয়ে কার্যক্রম চলে সংগঠনের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে 'পদ্মা গোমতী'র সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান আর আগরতলার হচ্ছেন অনিল ভট্টাচার্য। এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত 'ত্রিপুরা দর্পণ' পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দত্ত, কবি রাতুল দেববর্মণ প্রমুখ। রাতুল দেববর্মণ বিখ্যাত দেববর্মণ পরিবারের লোক। শচীন দেববর্মণ ও রাহুল দেববর্মণ আলোকিত করেছেন যে পরিবার।

শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণও কম বিখ্যাত নন। কী অসাধারণ সব গান লিখেছেন! আর শচীনকর্তার গানের কথা না-ই বা বললাম। বাংলা গানে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সুরের মায়ায় এবং কণ্ঠের জাদুতে শচীন কর্তা বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙাল মুলুক ছাড়িয়ে বোম্বেতে (আজকের মুম্বাই) পাড়ি জমালেন।

হিন্দি গানের জগতেও হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এমন সব বিখ্যাত ও হিট ছবির সুর করলেন, উপমহাদেশ মাতিয়ে দিলেন। লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, কিশোরকুমার_আরো কত কত গায়ক তাঁর সুর করা গান গেয়ে জগৎ জয় করলেন! শচীন দেববর্মণের সুর করা বহু হিন্দি ছবি থেকে দুটোর কথা বলি। একটি ছবির নাম 'অমর প্রেম'। অভিনয় করলেন রাজেশ খান্না ও শর্মীলা ঠাকুর।

কিশোরকুমার তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে গাইলেন হৃদয় তোলপাড় করা গান। মূল গল্প বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কী অসাধারণ প্রেমের গল্প, কী অসাধারণ প্রেমের ছবি! আরেকটি ছবির নাম 'গাইড'। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণের গল্প, অভিনয় করলেন দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রেহমান। গানগুলোর কোনো তুলনা হয় না।

দুটো ছবিতেই শচীনকর্তা নিজের কণ্ঠ সামান্য একটু ব্যবহার করলেন। 'অমর প্রেম'-এর গানটির একটি লাইন আমার মনে পড়ছে, 'ও মাইয়ারে...'। 'গাইড'-এ দু-তিন লাইনে তিনি গেয়েছিলেন গ্রামবাংলার বিখ্যাত সেই গান_ আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন_ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর। তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত)_ বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন_ বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলামায়ের কোল।

আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়। শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে।

২০০৪ সালে সেই সুযোগ হলো। 'পদ্মা গোমতী' সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্রকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে, অন্যপ্রকাশের কমল আর তাঁর স্ত্রী, মাজহারও সস্ত্রীক।

তখন তাঁর বড় ছেলে অমিয় খুব ছোট। শাওন তখনো মা হননি। বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে লাকসাম। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের।

তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই। তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পেঁৗছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে। শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত।

বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখা পড়েছি। বেশির ভাগই প্রবন্ধ। মুগ্ধ হলাম যে বই পড়ে, সেই বইয়ের নাম 'মুক্তো'। জন স্টাইনবেকের 'পার্ল'-এর অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি।

আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব। হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন 'কালো বুদ্ধিজীবী'।

আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি। সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তাঁর 'ফেরা' উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন 'আমাদের মানিকবাবুকে'।

আগরতলা কুমিল্লার মতো শহর। একেবারেই সাদামাটা, মফস্বল। শান্ত স্নিগ্ধ সরল টাইপের জীবন মানুষের। কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই, সন্ত্রাস মাস্তানি খুনখারাবি নেই। শান্তিময় পরিবেশ চারদিকে।

অন্যদের কী হলো জানি না, আগরতলায় ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। এই সেই আগরতলা, এখানকার জমিদার রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে। আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে।

বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা। আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে।

একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক। হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের দিনগুলো কাটছিল এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য।

গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি। প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে এক শ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক।

কিসের টাকা, দাদা? আপনি চা-টা খাবেন। না না, টাকা আমি নেব না। কেন? এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন? আমরা হতভম্ব! আগরতলার 'নীর মহল' খুব বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি।

সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়। একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা। আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম।

ঘটনা হলো কি, 'পদ্মা গোমতী' থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে। রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল।

মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই। চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে।

সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা 'পদ্মা গোমতী' বোঝে না। সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না।

হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটা কাজ করব নাকি? কী? অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি? (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না) আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই! তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ? আরে! ওই পর্যন্তই।

অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। শোনো মাজহার। একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না।

মাজহার তটস্থ। কী কথা স্যার? গোপন কথা। বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে... মানে আমি অমিয়র কথা বলছি।

কী হয়েছে স্যার? মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হায় হায়, বলে কী! নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব! আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো? দলের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে।

মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর। আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উল্টো। একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার! অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে।

এখনও অমিয়র দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে। সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দু তিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম 'শচীন দেববর্মণ সড়ক'।

এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, 'তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে। ' হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার ইমদাদুল হক মিলন : এ রকম হতেই পারে। কিন্তু আপনি বলছেন যে আপনি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখে, যেমন_'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন, আপনি দেশমাতৃকার ঋণ কিছুটা শোধ করলেন। দেশমাতৃকার ঋণ শোধ করার জন্য দেশমাতৃকার শত্রুদের মহৎভাবে দেখার অর্থ কী? হুমায়ূন আহমেদ : তাদের মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা তো আমি করিনি। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছি।

তাদের সত্যিকারের অংশটি_এই যে রাজাকারদের অত্যাচার, আলবদরদের অত্যাচার_এসব অংশ পুরোপুরিভাবে আছে। কিন্তু যেভাবে থাকলে তোমার ভালো লাগত সেভাবে হয়তো নেই। ইমদাদুল হক মিলন : 'জোছনা ও জননীর গল্প' নিয়ে একটু কথা বলে আমরা এ প্রসঙ্গটা শেষ করি। আপনি বহুদিন পরিকল্পনা করে লেখাটা লিখেছেন। আপনি যে মাপের লেখক_আপনি খুব সহজে তৃপ্ত হন না।

আপনি কি এ উপন্যাসটা লিখে খুশি হয়েছেন? হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, আমি খুশি। ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয়েছে, আপনি যেভাবে লিখতে চেয়েছেন সেভাবে লিখতে পেরেছেন? হুমায়ূন আহমেদ : এক শ ভাগ। আসলে প্রত্যেককে নিজের প্রতিভা দেওয়া হয়েছে। প্রতিভার বাইরে কেউ কাজ করবে না। যে প্রতিভা দিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, আমি কাজ করব তার ভেতরেই।

আমি যদি মনে করি, এটা দিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখব, সেটা হবে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', তা তো ঠিক হবে না। আমাকে যদি আল্লাহপাক 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' লেখার ক্ষমতা দিয়ে দেন, সেটা হবে ওয়ার অ্যান্ড পিসের মতো লেখা। আমাকে যেটুকু প্রতিভা আল্লাহ দিয়েছেন, সেই প্রতিভার পুরোটা আমি কাজে লাগিয়েছি। অনেক উপন্যাসে আমার ঘাটতি আছে, এ উপন্যাসে আমার কেনো ঘাটতি নেই। ইমদাদুল হক মিলন : আপনি এ উপন্যাসে নানা ধরনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের এ উপন্যাসে আপনি কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে দিয়েছেন, কখনো বা বেশ অভিনব পদ্ধতিতে লেখক ইনভলভড হয়েছেন লেখাটিতে। আপনি সব সময় বলেন আপনি স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। এই উপন্যাসে আপনার লেখা কি ওভাবেই এসেছে? নাকি আপনি আগে থেকেই আঙ্গিক ঠিক করেছিলেন? হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি আঙ্গিক আগে থেকেই ভেবেছিলাম। আমি দেখলাম জাতিসংঘে কী হলো, সাধারণ সভায় কী হলো_সেটা আমি সঠিক একটা লাইন দিয়ে দিতে চাইলাম। ভাবলাম মূল লেখার ভঙ্গি এসব একত্রে মিলিয়ে দেখি না, জিনিসটা কেমন হয়।

ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে, এ উপন্যাসটির সব কিছু আপনার পরিকল্পিত। হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ পরিকল্পিত। এ উপন্যাস লেখার কাজটি আমি অনেকবার শুরু করেছি, আবার বন্ধ করে দিয়েছি। ইমদাদুল হক মিলন : একেবারে প্রথম দিকেই কি আপনি এ আঙ্গিকটা মাথায় রেখে শুরু করেছিলেন? হুমায়ূন আহমেদ : না, যখন মূল লেখাটায় আসি, তখন মাথায় ছিল আমাকে এভাবে যেতে হবে, এই হবে আঙ্গিক, নয়তো এটা আমি পারব না। মিলন, মাফ করো।

আজ আর না। [পরের দিন আবার] ইমদাদুল হক মিলন : ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আপনি কি বড় লেখক মনে করেন? হুমায়ূন আহমেদ : অবশ্যই। ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে মনে করেন? হুমায়ূন আহমেদ : প্রথমত উনি একজন বড় কবি। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন কবিতাক্রান্ত গদ্য লেখেন। তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম দেখলাম একজন বড় কবি গদ্য লিখছেন, কবিতাক্রান্ত গদ্য না।

সহজ সরল। তারপর দেখলাম, তাঁর কাহিনী তৈরি করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধু কাহিনী তৈরি করা না, কাহিনীর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা_দুইটা-তিনটা-চারটা লাইন দিয়ে কাহিনীর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা বড় লেখক না হলে সম্ভব না। ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো এবং আপনি সব সময় তাঁর ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের বড় পণ্ডিতরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সে অর্থে বড় লেখক মনে করেন না_এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন? হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের পণ্ডিতরা বিভিন্ন সময়ে অনেককেই বড় লেখক মনে করেননি।

রবীন্দ্রনাথকেও অনেকে বড় লেখক মনে করেননি। একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এমএ পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের গদ্য তুলে দিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল শুদ্ধ বাংলায় লেখো। মানে তাঁদের ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো অশুদ্ধ। ইমদাদুল হক মিলন : আপনার বিবেচনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব বড় লেখক। তাঁর কোন কোন দিক আপনার খুব বড় লেখকের মতো মনে হয়? এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলি, আপনি একদিন আমাদের বলছিলেন_সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি পৃথিবীর বড় ভাষাগুলোর দেশে জন্মাতেন, ফরাসি বা স্পেন বা ইংরেজি ভাষার কোনো দেশে, তাহলে নোবেল প্রাইজ পেতে পারতেন।

আপনার এটা মনে হয়? হুমায়ূন আহমেদ : আমার মনে হয়। আসলে মিলন, আমাদের বাংলা ভাষায় কিন্তু অতি উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষায় যেসব লেখক রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা। অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্করের পাওয়া উচিত ছিল। ইমদাদুল হক মিলন : এবং এঁদের পাশাপাশি সুনীলকেও মনে হয়? হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, আমার মনে হয়।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি আরেকজন লেখকের ব্যাপারে খুব বলতেন_সতীনাথ ভাদুড়ী। এই লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রিয় একজন লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সব সময় তাঁর প্রিয় লেখকদের তালিকায় তাঁর নাম রাখেন। এবং তাঁর প্রিয় উপন্যাসের নাম বলেন_'ঢোড়াই চরিত মানস'। আপনি একমত তাঁর সঙ্গে? হুমায়ূন আহমেদ : এই উপন্যাস আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করেনি।

এই উপন্যাসে তিনি এমন একটি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করেছেন, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত না। আমার মনে হয় সতীনাথ ভাদুড়ী 'ঢোড়াই চরিত মানস' উপন্যাসে টেকনিক্যাল দিকটাতে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন উপন্যাস লেখার সময়। কিন্তু উনি সহজ যেসব লেখা লিখেছেন, যেমন_অচিন রাগিণী, জাগরী খুবই শক্তিশালী লেখা। উনি খুবই বড়মাপের একজন লেখক, বিশেষ করে ছোটগল্পে। ইমদাদুল হক মিলন : যে এক শ্রেণীর লোকের মুখের ভাষা বইতে থাকে, ধরেন আমি যদি 'লীলাবতী' বইটার প্রসঙ্গে আবার আসি_আপনি এই বইটায় ওই এলাকার লোকজনের মুখের ভাষা এনেছেন এবং বর্ণনার সময় অবলীলাক্রমে ব্যবহার করে গেছেন।

এটা কেন করলেন? হুমায়ূন আহমেদ : আমি তা করেছি একটা সহজিয়া ভঙ্গিতে, যাতে যে পড়ে সে-ই বুঝতে পারে। যেমন_এখানে হয়তো তুমি একটা-দুটো শব্দ বুঝবে না, কিন্তু আবার অর্থটা সম্পূর্ণ বুঝবে। আমি কথ্য ভাষাটারই একটা আধুনিক ধরন দাঁড় করার চেষ্টা করেছি, যাতে পড়ে সবাই বুঝতে পারে। যেমন_তুমি যদি সিলেটি বা চিটাগাংয়ের ভাষায় বই লেখো তাহলে আমরা বাংলাভাষীরাও কিন্তু পড়ে কিছু বুঝব না। কাজেই সাহিত্য রচনার জন্য তো আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড ভাষা দরকার।

ইমদাদুল হক মিলন : মানে, যা সব পাঠক বুঝবে? কমিউনিকেট করবে সবাইকে? হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ। যেমন_সিলেটে দেখেছি, সিলেটি ভাষায় নাটক হচ্ছে। চট্টগ্রামের ভাষায়ও নাটক দেখেছি। কিন্তু ওই সব ভাষা শুনে আমার খটকা লাগে। কিছুই বুঝতে পারিনি।

সিলেট বা চট্টগ্রামের লোকরা অবশ্য বুঝেছে। এখন একটা হুবহু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে আমার সাহিত্যকে ছোট করে ফেলব কেন? ছড়িয়ে দেব। ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা, যাঁদের লেখা আপনি প্রায় সবই পড়েছেন? হুমায়ূন আহমেদ : একদম শুরু থেকে বলি_বঙ্কিমচন্দ্র। কেননা তাঁর গল্প তৈরির ক্ষমতা অসাধারণ। তারপর আমাদের শরৎচন্দ্র।

[আরেকদিন] ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে কথা বললাম অনেক বিষয়ে। আজকে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই সেটি হলো মৃত্যুচিন্তা। আমি জানি যে আপনি মৃত্যু নিয়ে ভাবেন। জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃত্যু-পরবর্তী জগৎ নিয়েও আপনি ভাবেন। আপনার মৃত্যুচিন্তাটা কী রকম? হুমায়ূন আহমেদ : আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে।

বর্ষা আসবে, জোছনা হবে; কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না, জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না। এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না। আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ওই দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই আর পারছি না। ইমদাদুল হক মিলন : মানে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি আপনার এই বোধটা তীব্র হচ্ছে যে আপনি আর নিতে পারছেন না? হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি তো মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। আমরা সবাই আছি।

আমি কিন্তু মৃত্যুকে দেখেছি। আমার মতো অনেকেই দেখেছেন। মৃত্যুকে দেখা ভয়াবহ ব্যাপার, নিজের মৃত্যুকে দেখা। ১৯৭১ সালে মিলিটারির হাতে যখন ধরা পড়েছিলাম, পাকিস্তানি মিলিটারি আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। আমি ফিরে আসি সেখান থেকে।

তখন আমি মৃত্যুকে দেখেছি একদম চোখের সামনে। বয়সও ছিল কম। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। তারপর কয়েকবার আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। একবার তো খুবই ভয়াবহ অবস্থা ছিল।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে মারা যাচ্ছি। আমার আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জোরে জোরে কালেমা পাঠ করছিলেন। কালেমার শব্দ শোনাতে শোনাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ডাক্তাররা বললেন, অবস্থা খুবই খারাপ। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন।

তখন আমার মা-ভাই-বোন সবাইকে খবর দেওয়া হলো। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। তারপর হলো আমার বাইপাস অপারেশন। বাইপাস অপারেশনের সময় যখন অ্যানেসথেশিয়ার কাজ শুরু হলো, যখন আমি তলিয়ে যাচ্ছি, সেই সময় হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, এই যে তলিয়ে যাচ্ছি, হয়তো বা আমি আর এখান থেকে উঠে আসতে পারব না। তখন আরেকবার খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখলাম।

বারবার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুচিন্তাটি মাথায় আসে। আমার মধ্যে যেটা হয়, আমি নেই অথচ সব কিছু আগের মতোই আছে_এই বোধটা আমাকে খুব কঠিনভাবে আক্রমণ করে। বেশির ভাগ মানুষকেই আমি দেখেছি, তাঁরা খুব সহজভাবে মৃত্যুকে নেন এবং বলেন, আমি নেই তো কী হয়েছে, আমার ছেলেমেয়েরা আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, পরবর্তী প্রজন্ম আছে। আমি থাকব না, তারা তো থাকবে। এভাবেই অনেকে বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেন।

আমি কেন জানি নিতে পারি না। আমার কাছে আমি থাকাটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ইমদাদুল হক মিলন : বড় লেখকদের ক্ষেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে। যাঁরা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে। আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন_এই ফিলিংসটা আপনার কেমন? হুমায়ূন আহমেদ : এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না।

আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায়-আসে? ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু এ রকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে? হুমায়ূন আহমেদ : না, সে রকম মনে হয় না। মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্ট...এই চিন্তাটা কখনো আমার হয় না যে ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারা জীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্য। হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ ইমদাদুল হক মিলন 'পদ্মা গোমতী' বেশ নামকরা সংগঠন। বাংলাদেশ এবং আগরতলা মিলিয়ে কার্যক্রম চলে সংগঠনের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে 'পদ্মা গোমতী'র সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান আর আগরতলার হচ্ছেন অনিল ভট্টাচার্য।

এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত 'ত্রিপুরা দর্পণ' পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দত্ত, কবি রাতুল দেববর্মণ প্রমুখ। রাতুল দেববর্মণ বিখ্যাত দেববর্মণ পরিবারের লোক। শচীন দেববর্মণ ও রাহুল দেববর্মণ আলোকিত করেছেন যে পরিবার। শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণও কম বিখ্যাত নন। কী অসাধারণ সব গান লিখেছেন! আর শচীনকর্তার গানের কথা না-ই বা বললাম।

বাংলা গানে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সুরের মায়ায় এবং কণ্ঠের জাদুতে শচীন কর্তা বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙাল মুলুক ছাড়িয়ে বোম্বেতে (আজকের মুম্বাই) পাড়ি জমালেন। হিন্দি গানের জগতেও হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এমন সব বিখ্যাত ও হিট ছবির সুর করলেন, উপমহাদেশ মাতিয়ে দিলেন।

লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, কিশোরকুমার_আরো কত কত গায়ক তাঁর সুর করা গান গেয়ে জগৎ জয় করলেন! শচীন দেববর্মণের সুর করা বহু হিন্দি ছবি থেকে দুটোর কথা বলি। একটি ছবির নাম 'অমর প্রেম'। অভিনয় করলেন রাজেশ খান্না ও শর্মীলা ঠাকুর। কিশোরকুমার তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে গাইলেন হৃদয় তোলপাড় করা গান। মূল গল্প বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

কী অসাধারণ প্রেমের গল্প, কী অসাধারণ প্রেমের ছবি! আরেকটি ছবির নাম 'গাইড'। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণের গল্প, অভিনয় করলেন দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রেহমান। গানগুলোর কোনো তুলনা হয় না। দুটো ছবিতেই শচীনকর্তা নিজের কণ্ঠ সামান্য একটু ব্যবহার করলেন। 'অমর প্রেম'-এর গানটির একটি লাইন আমার মনে পড়ছে, 'ও মাইয়ারে...'।

'গাইড'-এ দু-তিন লাইনে তিনি গেয়েছিলেন গ্রামবাংলার বিখ্যাত সেই গান_ আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন_ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর। তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত)_ বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন_ বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলামায়ের কোল। আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়।

শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে। ২০০৪ সালে সেই সুযোগ হলো। 'পদ্মা গোমতী' সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে।

তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্রকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে, অন্যপ্রকাশের কমল আর তাঁর স্ত্রী, মাজহারও সস্ত্রীক। তখন তাঁর বড় ছেলে অমিয় খুব ছোট। শাওন তখনো মা হননি।

বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে লাকসাম। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের। তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই।

তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পেঁৗছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে। শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখা পড়েছি। বেশির ভাগই প্রবন্ধ।

মুগ্ধ হলাম যে বই পড়ে, সেই বইয়ের নাম 'মুক্তো'। জন স্টাইনবেকের 'পার্ল'-এর অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি। আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব। হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন।

নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন 'কালো বুদ্ধিজীবী'। আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি।

সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তাঁর 'ফেরা' উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন 'আমাদের মানিকবাবুকে'। আগরতলা কুমিল্লার মতো শহর। একেবারেই সাদামাটা, মফস্বল।

শান্ত স্নিগ্ধ সরল টাইপের জীবন মানুষের। কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই, সন্ত্রাস মাস্তানি খুনখারাবি নেই। শান্তিময় পরিবেশ চারদিকে। অন্যদের কী হলো জানি না, আগরতলায় ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। এই সেই আগরতলা, এখানকার জমিদার রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন।

এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে। আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে। বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা।

আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে। একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক।

হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের দিনগুলো কাটছিল এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি।

দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি। প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে এক শ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক। কিসের টাকা, দাদা? আপনি চা-টা খাবেন। না না, টাকা আমি নেব না।

কেন? এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন? আমরা হতভম্ব! আগরতলার 'নীর মহল' খুব বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি। সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়।

একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা। আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম। ঘটনা হলো কি, 'পদ্মা গোমতী' থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে।

রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল। মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই।

চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা 'পদ্মা গোমতী' বোঝে না। সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না। হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি।

আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটা কাজ করব নাকি? কী? অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি? (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না) আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই! তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ? আরে! ওই পর্যন্তই। অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলো।

আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। শোনো মাজহার। একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না। মাজহার তটস্থ। কী কথা স্যার? গোপন কথা।

বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে... মানে আমি অমিয়র কথা বলছি। কী হয়েছে স্যার? মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

হায় হায়, বলে কী! নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব! আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো? দলের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে। মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর। আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উল্টো।

একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার! অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে। এখনও অমিয়র দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে।

সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দু তিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম 'শচীন দেববর্মণ সড়ক'। এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, 'তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে। ' হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার ইমদাদুল হক মিলন : এ রকম হতেই পারে।

কিন্তু আপনি বলছেন যে আপনি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখে, যেমন_'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন, আপনি দেশমাতৃকার ঋণ কিছুটা শোধ করলেন। দেশমাতৃকার ঋণ শোধ করার জন্য দেশমাতৃকার শত্রুদের মহৎভাবে দেখার অর্থ কী? হুমায়ূন আহমেদ : তাদের মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা তো আমি করিনি। মানুষকে মানুষ হিসেবে দে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.