একটি বানানভুলসর্বস্ব ব্লগ নজুকে চেনে না এমন মানুষ আমাদের এলাকাতে নেই বললেই চলে। আমাদের সাহিত্য সভার শুকতারা হিসেবে না চিনলেও ফর্সা, নাদুশ-নুদুশ নজু অনেকের কাছে আধা ফিরিঙ্গি ভাই হিসেবেই বেশী পরিচিত। আমাদের দেশে এখনো বিলিতি মেমরা হাঁটলে যেমন চারপাশে ভীড় জমে যায়, নজুর বেলাতেও তেমন একটা পার্থক্য হয়না। নজুর খ্যাতিতে ঈর্ষাকাতর দূর্জনেরা রটিয়ে বেড়ায় যে সে মেলানিনের অভাবে ভুগছে, তাই তার চামড়া ধবল রোগীর মত সাদা। অপরদিকে নজুর অনুরাগীরা তাকে চলন্ত আলোকিত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে।
তাদের মতে সন্ধ্যায় যখন আমাদের সাহিত্য সভায় বিদ্যুৎ চলে যায় তখন নজুর গা থেকে বিচ্ছুরিত আলোতে আমরা আমাদের সভার কার্যক্রম সম্পন্ন করি। তাদের কাছে নজু সাহিত্য জগতের অবতার হিসেবে মর্ত্যে অবতরণ করেছে, মুসা নবীর মত তার মোজেজা প্রদর্শন করে নজু আবার সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাবে; সক্রেটিসের মত সাহিত্য জগতে নতুন পথ দেখিয়ে সেই পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে।
নজু এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। বিশ্রামরত মেষপালকের মত আন্দালুসিয়ার কোন এক খেঁজুর গাছের নিচে বসে খেঁজুর পাতায় নলখাগড়া দিয়ে সাহিত্য রচনাতেই সে মগ্ন থাকে। এই কলুষিত পৃথিবীর কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না।
সে পড়ে থাকে কান্ট, হেগেল আর নিৎসে-এর দুনিয়ায়। বেদ থেকে বাইবেল, হোমার থেকে হার্ডি, ভার্জিল থেকে ভার্জিনিয়া, সফোক্লিস থেকে শেক্সপীয়ার, দান্তে থেকে দস্তয়ভস্কি- কোনো কিছুই তার আর পড়ার বাকি নেই। তার জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে সাহিত্য, আর তার চেয়ে বড় ফিজিক্যাল ও মেটাফিজিক্যাল অংশে রয়েছে তার ক্যালিওপী (নজু তার প্রেয়সীকে এই গ্রীক মিউজের নাম ধরেই ডাকে)।
আমাদের সাহিত্য সভার প্রধান মাঝে মাঝেই বলেন যে, আমাদের এই অভাগা দেশে একজন এসেছিলেন মুনীর চৌধুরী, আর তার পরে নজু, মাঝখানে শুধুই ধূঁ ধূঁ মরুভূমি। তার সাহিত্য জ্ঞান সাহিত্যে বড় বড় ডিগ্রীধারীকেও হার মানিয়ে যায়।
বাংলা তো বটেই, এমনকি গ্রীক, রোমান, ইংরেজি, ফরাসী, জার্মান ও লাতিন সাহিত্যের বড় বড় মহীরথীদের লেখা নজুর নখদর্পণে। আর শুধু সাহিত্য কেন হবে, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি- এসব বিষয়ের উপরও নজুর দখল আলেক্সজান্ডারের পৃথিবী জয়ের সীমানাতুল্য। জ্ঞানগরিমা, সাহিত্য বোধ, সফিসটিকেশনে নজুর স্থান আমাদের সভার যেকোন সদস্যের চেয়ে অনেক উপরে। এমনকি সভা প্রধানও তাকে তোয়াজ করে চলেন, পাছে নজুর জ্ঞানের কাছে তার নগন্যতা সবার সামনে নগ্নভাবে উম্মোচিত হয়। নজুর উপস্থিতিতে আমরা সব তুচ্ছ সাহিত্যবোধিরা নিচু গলায় কথা বলি, যেন ভুল কিছু বলে ফেললে এখনি গর্দানটা যেতে পারে।
কথাটা শুনে উদ্ভট মনে হলেও তা রূপক অর্থে সত্য। কোনো বিষয়ে আমাদের ভুল বক্তব্য, সেটাকে নজু বিরোধী বক্তব্যও বলা চলে, নজু এমনভাবে সংশোধন করে দেয় যাতে আমাদের মাথা সত্যি সত্যিই লজ্জায় কাটা পড়ে। তার সাথে যোগ হয় গণতন্ত্রের অভিশাপ। নজুর সমর্থনে নজুবাদীরা নাৎসী সমর্থকে পরিণত হয়, এমতবস্থায় গ্যাস চেম্বার এড়িয়ে যাওয়াই আমাদের কাছে শ্রেয় বলে মনে হয়।
আমাদের সাহিত্য সভা নিছক শখের বশেই বানানো।
টাকা তুলে বই কিনে সেগুলো পড়া, আলোচনা করা ইত্যাদি- খুব বড় কোনো উদ্দেশ্য নয়। বিদ্যাসাগরীয় যুগের মত সমালোচনার ঝড়ে বাংলা সাহিত্যকে চাঙ্গা করে তোলা কখনোই আমাদের এজেন্ডা ছিলো না। যারা শখের বশে একটু-আধটু লেখালেখি করে তাদেরকে উৎসাহ প্রদানই ছিলো মূখ্য বিষয়। কিন্তু নজু ব্যতিক্রম, তার নীতি হল উৎসাহ তখনই সৃজনশীল যখন তা সমালোচনার রূপে আসে। ভালো মানের লেখক তখনই তৈরী হবে যখন লেখককে কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেয়ার ব্যাবস্থা থাকবে।
আমাদের মধ্যে সমালোচনা করার যোগ্যতা কেবল নজুই রাখে। সমালোচনা তার পারিবারিক সম্পদ। সুতরাং সেই বিভাগটা আমরা তার হাতেই হস্তান্তর করি। তার যোগ্যতাকে সুবিচার করা হয়েছে ভেবে নজু খুশি মনেই সে পদ গ্রহণ করে।
এই ব্যবস্থার পরও যে আমাদের সভায় চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে তা কিন্তু নয়।
পরিবর্তন যা হয়েছে তা হল কষ্টিপাথরে খাঁদ ধরা পড়তে পড়তে শখের লেখকের সংখ্যা প্রায় শূন্যে যেয়ে ঠেকেছে। পরীক্ষার খাতায় ভুল লেখে শ্রেণীকক্ষে অপমানিত হবার অভিজ্ঞতা কম-বেশী সকলেরই আছে। কিন্তু সাবালক হয়ে ছোট, বড় ও বন্ধুদের সামনে অপমানিত হবার ঝুঁকি কয়জনই বা নিতে রাজি হবে। যারা লোক-লজ্জার মাথা খেয়ে বেহায়ার মত এখনো সমালোচিত হওয়া জারি রেখেছে তাদের সংখ্যাও হারাধনের ছেলেদের মত, সাথে কমেছে সভায় সদস্য উপস্থিতি সংখ্যা। এরূপ পরিস্থিতিতে সভা প্রধান নজুকে মিনমিন করে সমালোচনার তীব্রতা কমানোর অনুরোধ করলে নজু প্রবল আপত্তি জানায়।
সে জানায় যে সে নিজের লেখাও সমালোচনার জন্য সবার সামনে পেশ করে। শুধু পার্থক্য হল তার আকাশছোঁয়া সাহিত্য আমাদের মত অপাড় মূর্খদের বোধগম্য হয়না। মাতৃভাষা যে ল্যাটিন আর হিব্রুর মত দূর্বোধ্য হতে পারে তা আগে জানা ছিল না। ফলে কেউ সমালোচনা করতে রাজি হয়না। আর কেউ সাহস করে সমালোচনা করলে নজু এমনভাবে তার দিকে তাকায় যেন সমালোচক অদ্ভুত কিছু বলছে।
আর তার ফ্যাসিবাদী ভক্তরা সমালোচকের অশিক্ষিত পূর্বপুরুষকে শেষ দিবসের কাঠগড়াতে দাঁড় করাতে দেরী করে না। নজু শিল্পের সাথে আপোস করতে নারাজ, নতুবা সে সভা ত্যাগ করতে বাধ্য হবে, আর তার সাথে ত্যাগী হবে যীশুর দ্বাদশ সঙ্গী শিষ্য।
প্রতিটি মহান লেখকের জীবনে এমন একটি সময় আসে যখন তার মনে হয় বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠী তার লেখার স্বাদ উপভোগ করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। লেখক তার সমস্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি ছাঁচে ঢেলে মানুষে জন্য সৃষ্টি করেন তার মাস্টারপিস। তার প্রতিটি বাক্য মানুষের অন্তরে সঙ্গীতের মত নাড়া দেয়, পপির গন্ধের মত মস্তিষ্কে ঝিম ধরিয়ে দেয়, বুদ্ধ ও যীশুর বাণীর মত পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে সত্যের পথ দেখায়।
লেখক কোনো নির্দিষ্ট জাতি, গোত্র বা ধর্মের নয়। তিনি সকল মানব জাতির। এই ভাবনাই নজুকে গন্ডী পেরিয়ে বিশ্বজনীন হবার প্রেরণা দেয়। লেখকের সৃষ্টির মূল উপাদান হল ভাষা। এই ভাষা ব্যবহার করেই নজু সমগ্র বিশ্বের সাথে এক হবার সিদ্ধান্ত নেয়।
মান্দারিন পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যবহৃত ভাষা হলেও তা সার্বজনীন নয়। এমন নয় যে নজু চাইলে মান্দারিন শিখে সে ভাষায় লিখতে পারবে না। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যদি আঠারোটা ভাষা জানতে পারেন তাহলে নজু পারবে না কেন? নজু পৃথিবীর সকল পাঠকদের কাছে পৌছাতে চায় বলেই সে বেছে নেয় ইংরেজিকে।
প্রতিটি ডাক্তারের চেম্বারেই একটা করে কম্পাউন্ডার থাকে। বছরের পর বছর ডাক্তারের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে সে আপনা-আপনি কিছু ডাক্তারি শিখে যায়।
ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে জরুরী চিকিৎসা সেবা প্রদান তার কাছে এমন আহামরি কিছু নয়। মাঝে মাঝে তো দেখা যায় কিছুদিন পর সে নিজেই একটা চেম্বার খুলে বসে আছে এবং রোগীও বেশ ভালোই আসে । বাইরের সাইন বোর্ডে নামের সাথে এ থেকে জেড পর্যন্ত কতগুলো অক্ষর লেখা থাকলেই লোকে বুঝে যায় এটা একজন ভালো ডাক্তার। খোঁজ-খবর নিতে যেয়ে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করতে কেউই চায়না। এভাবে একজন কম্পাউন্ডার একজন ডাক্তারে ভূমিকায় বেশ ভালভাবেই উতরে যায়।
কাক ময়ূরপুচ্ছ পড়লে ময়ুর হতে পারে না সত্য তাই বলে কাকের যে সৌন্দর্যবোধ থাকতে পারে না এমন কথা কি কোথাও বলা আছে? জন্ম দেয়ার চেয়ে লালন-পালনই যদি মূখ্য হবে তাহলে সুকন্ঠী কোকিলের ডিমে তা দেয়া থেকে শুরু করে উড়তে শেখা পর্যন্ত ভরণ-পোষণ যে কাকই করে তা নিশ্চয় কারো অজানা নেই।
তাহলে যদি গাইতে গাইতে গায়েন হওয়া যায় তাহলে নজুর ইংরেজিতে লিখতে সমস্যা কোথায়? বিনা দোষে সাজাপ্রাপ্ত সক্রেটিস সমাজ ব্যবস্থার প্রতি সম্মান দেখানো জন্য হেমলক মুখে তুলে নিলে গুরুর মহান ত্যাগ যেমন শিষ্যেদের চোখে গুরুর স্থান আরো উপরে নিয়ে যায়, তেমনি সাহিত্যের খাতিরে নজুর ইংরিজি ভাষা হাতে তুলে নেয়া শিষ্যদের চোখে গুরুর সম্মান পরের ধাপে উন্নীত করে। আমরা ইংরিজি পড়েছি বটে, কিন্তু ইংরিজিতে লিখবো এমন বোধ আমাদের মনে কখনো উদয় হয়নি। হয়তোবা লিখতে পারবো না জানি বলেই সেই সুবুদ্ধি হয়নি। কিন্তু নজু তো আমাদের মত সাধারণ নয়।
তার আপাদমস্তক ইংরিজি। বাবা-মা ইংরিজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন বলে ছোট থেকেই নজুর ইংরিজি চর্চা ছিলো। বাংলা শেখার আগেই নাকি নজু ইংরিজিতে কথা বলা শিখেছে। তার শেখা প্রথম ছড়া নাকি রাইম অফ দি এনসিয়েন্ট ম্যারিনার । তাদের বাসায় কেউ বাংলায় কথা বলেনা।
এমনকি ওদের বাসার কাজের লোকও শুনেছি ইংরিজিতে কথা বলে। সুতরাং নজুর ইংরিজির দখল তর্কের অতীত। তার চেহারা, চাল চলন, কথাবার্তা, পোশাক সব কিছুতেই বিলিতি ছাপ খুবই স্পষ্ট। এদেশে নজুর জন্মগ্রহণ শুধুই একটা অনিচ্ছাকৃত দূর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু দূর্জন মাত্রই ত্রুটি খুঁজে ফেরে।
সভার কর্মকান্ডে এই পরিবর্তন অনেকেই ভালভাবে নিতে পারে না। বিশেষ করে নজুর কষ্টিপাথরে ধরা পড়া খাঁদগুলো নজুর অ্যাংলো সাহিত্যচর্চার তীব্র নিন্দা জানায়। হায়রে পোড়া দেশ! গুণীর কদর করতে জানে না যে জাতি, কিভাবে হবে তার উন্নতি? কুয়োর ব্যাঙের মত সাহিত্যকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আটকে রাখলে তা যে সূর্যরশ্মি বঞ্চিত হবে সে কথা কেউ বোঝে না। সৃষ্টির শুরু থেকেই যুগ তার পথ প্রদর্শকদের কদর করেনি। এটা যেমন সক্রেটিসের জন্য সত্য, যীশুর জন্য সত্য, ঠিক সেভাবে তা নজুর জন্যও সত্য।
আমাদের সহ সভা প্রধান যুগের স্টেরিওটিপিক্যাল প্রতিনিধি। তার পরদাদা নাকি স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার আরেক পূর্বপুরুষ নাকি নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের সাথে ইংরেজ হঠাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র যে বিভ্রান্তি নয় সেটা তাকে দেখলে বেশ বোঝা যায়। তার পারতপক্ষে ইংরেজি শব্দ না ব্যবহার করার প্রবণতা আধুনিক অ্যাংলো-বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে কৌতুকের বিষয়।
গুরুগম্ভির আবৃত্তির গলা থাকা সত্ত্বেও তার শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ তাকে ভালো বাংলা রেডিওতে আর.জে. হবার যোগ্যতা থেকে খারিজ করে দেয়। বিলিতি জিনিষের প্রতি নাক সিটকানোর প্রবণতা তার বংশ পরম্পরায় পাওয়া। ইংরিজির প্রতি তার বিদ্বেষ এক প্রকার মোনোম্যানিয়ায় পরিণত হয়েছে। ধর্মের কারণে মরুভূমি পাড়ি দেওয়া ইহুদিরা যেমন যীশুর বাণীকে মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, ইহুদি ধর্মের অবমাননা বলে আখ্যায়িত করেছিল, ঠিক সেভাবে সহ সভাপতি নজুর এই মহান উদ্যোগকেও প্রহসন ও মাতৃভাষার প্রতি চরম অপমান ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। আর তার সাথে এই উদ্যোগ মেনে নিতে পারেনি নজু কর্তৃক অপমানিত কিছু শখের লেখক।
অবশেষে এলো সে কাঙ্ক্ষিত দিন। নজু তার প্রথম বিলিতি সাহিত্যকর্ম লেখা শেষ করেছে। সেই লেখা নজু শিষ্যদের কাছে আসমানী ওহীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গুরুর অ্যাংলো প্রতিভার প্রচারে তারা যদি একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকতো তাহলে নজু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। কিন্তু নজু দম্ভ প্রচারে বিশ্বাস করে না।
বরং সে তা আমাদের সভার মধ্যে রাখতেই বেশী পছন্দ করে। চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট হোম- আগে ঘরের অভাগাদের আলো দেখিয়ে পরে সে পুরো দুনিয়ার সাহিত্য পিপাসুদের মনের চাহিদা পূরণ করবে। তার ইংরিজি এপিকের এক কপি সে সভা প্রধানের কাছে জমা দেয় সকল সদস্যের সুবিধার জন্য, যাতে করে তারা এই অনন্য লেখা উপভোগ করে নিজেদের মানব জীবন ধন্য হয়েছে মনে করার একটা দূর্লভ সুযোগ পায়। কিন্তু উলুবন কখনো কি তার মাঝে ছড়ানো মুক্তোর খোঁজ রেখেছে? অন্ধ কি দেখেছে মোনালিসার হাসি? বধির কি শুনেছে বেটোফেন? কেউ কি কখনো খোঁড়া রিকশাওয়ালা দেখেছে? না। আমাদের সাহিত্য সভার ছুঁচোর দৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্যবোধিরা নজুর মহাকাব্য ছুঁয়েও দেখে না, পাছে গোবর ছূঁয়ে গঙ্গাস্নান করতে হয়।
বিশ্বের অনেক বাঘা সাহিত্যিকের প্রথম লেখাই মূর্খ প্রকাশকরা ছাঁইপাশ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। বিখ্যাত হবার পর তাদের প্রকাশনা থেকে সেই লেখা প্রকাশের জন্য সেই প্রকাশকরা লেখকের হাত-পা ধরতেও বাদ রাখেনি। নজু চায় না আমরা তার চরণতলে ঠাঁই নেই। সে তার লেখা সদস্য সংখ্যা প্রতি কপি করে তার শিষ্যদের হাত দিয়ে সবার বাড়ি বাড়ি পৌছে দেয়। সাথে একটা নিমন্ত্রণ পত্র, তাতে এক সপ্তাহ পর তার মহাকাব্যের উপর আলোচনা ও সমালোচনা সভা ও চা পানের আমন্ত্রণ (সুদূরদৃষ্টিসম্পন্ন নজু অনুধাবন করতে পেরেছিল যে আমাদের এ বি সি ডি দৌড়ে তার মহাকাব্য পড়তে আমাদের সপ্তাহখানেকের কম লাগা সম্ভব নয়)।
চায়ের আদিনিবাস সুদূর চীনে হলেও তা বাঙ্গালির চেয়ে বেশী বোধহয় আর কোনো জাতি খায় না। বাসায়, অফিসে, আড্ডায়, অপেক্ষায় চায়ের কোনো জুড়ি নেই। আর আমাদের সংস্কৃতি বলে চায়ের সাথে টা অবশ্যম্ভাবী। সবাই সিদ্ধান্ত নেয় অন্তত চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য হলেও আমাদের নজুর ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত। কিন্তু তার জন্য চাই আড্ডার মাল-মশলা।
ঠিক করা হল নজুর মহাকাব্য পড়ে দেখা হবে।
ইংরিজিতে আমার দখল বরাবরই কম। সরল, সাদা বাংলা বাক্য গঠন পড়ে অভ্যস্ত আমার কাছে ইংরিজির জটিল বাক্য গঠন সব সময়ই খুব কঠিন ঠেকে। আমাদের ভাষায় মহাকাব্য খুব একটা লেখা হয়নি। আর যেটা লেখা হয়েছে তা পড়ার বিদ্যাও আমার পেটে নেই।
সুতরাং এই দু’ইয়ে মিলে নজুর সৃষ্টিকর্ম হজম করা আমার জন্য পেটের রোগীর জন্য ঈদুল আয্হা হয়ে দাঁড়ায়। দু-তিনটা ডিকশনারী ঘেটে ভাষাটা মোটামুটি উদ্ধার করতে পারলেও তার মর্মাথ করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। বাকিদের কাছে বুঝতে যেয়ে টের পেলাম হাঁড়ির কোনো ভাতই গলেনি। এ বস্তু গলাধঃকরণ করতে গেলে যে পেটে গোট বেঁধে পাক খেতে থাকবে তার কোন সন্দেহ নেই। এতদিন শুনেছি বিমূর্ত আর্ট বলে যে আধুনিক বস্তুটা আছে তা চিত্রকর্মের জন্যই প্রযোজ্য।
আমার একবার একটি বিমূর্ত আর্টের প্রদর্শনীতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে একটি ছবিতে আমার চক্ষুজোড়া স্থির হয়- সাদা ক্যানভাসে বিভিন্ন আকারের কালো ছোপ। মনের চোখ অন্ধ বলেই হয়ত ছবিটা দেখে আমার মনে হয়েছিল ডালমেশিয়ান জাতের কুকুরের চামড়ার মাইক্রোস্কোপিক চিত্র। ছবির চিত্রকরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে সাদা ক্যানভাস হল মানুষের চরিত্র ও কালো ছোপগুলো হল কলঙ্ক। কৃতকর্মের মাত্রা অনুযায়ী ছোপগুলোর আকার হেরফের করছে।
তাই যদি আঁকতে হবে তাহলে একটা চাঁদ আঁকলেই তো হয় রে বাবা। যা বলছিলাম, মন শৈল্পিক না বলেই হয়ত এরকম মনে হচ্ছিলো। নজুর মহাকাব্যও যেন একটি বিমূর্ত শিল্প। কিছু বোঝার উপায় নেই, যা বুঝবো তা ঠিক, আবার যেটা বুঝবো না তাও ভুল নয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উপমার অলংকারে সজ্জিত রমণীর দেহে সভ্যতার আদি আমল থকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত যত দর্শন মানুষের জীবনকে পথ দেখিয়েছে তার সম্মিলিত সুবাসে নজুর মহাকাব্য ঐশ্বরিক হয়ে উঠেছে।
কলিযুগে দেবতারা মানুষকে দর্শন দেন না, কিন্তু নজু বাঘা বাঘা সব দেব-দেবীদের মর্ত্যে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। দেবতারা যে এখনো মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক তা সাধারণ মানুষ ভুলে যেতে বসেছিল, নজু তা স্মরণ করিয়ে দিতে সফল হয়েছে।
সবাই মিলে নজুর নিমন্ত্রণে হাজির হই। অন্ধ জাতিকে পথ দেখাতে পেরেছে এই আনন্দে নজু তার প্রেয়সী সমেত হাজির হয়েছে, যেন পাতালপুরীর দেবতা প্লুটোর পাশে প্রোসারপাইন। শিষ্যবেষ্টিত নজুকে দেখে যীশুর লাস্ট সাপার চিত্রকর্মটি মনে পড়ে যায়।
আমরা যার যার আসনে অভীষ্ট হলে নজুশিষ্য হাসু শিষ্যের দল থেকে বের হয়ে এসে আমাদের সাথে বসে। এটা দেখে আমার মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। জুডাসও লাস্ট সাপারের সময় খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়েছিল। পরে সে রোম কতৃপক্ষের কাছে টাকা খেয়ে যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ঘরের কোণায় টেবিলে টায়ের বহর দেখে এই তুচ্ছ সন্দেহ আর আমলে আনি না।
এ কথা সে কথার পর সবাই কাজের কথা পাড়ে। তার মহাকাব্য সম্পর্কে নজু জানতে চাইলে সহ সভাপতি তাকে আচমকা প্রশ্ন করেন, “বাঁদর নাচ কখনো দেখেছেন?”
নজু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, “হ্যাঁ, দেখেছি”।
“জানেন তো মানুষের আদি পূর্বপুরুষ ছিল বাঁদর?’
“জানবো না কেন!”
এরপর সহ সভাপতি সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক প্রশ্নটা করেন, “ বাঁদর নাচতে পারলেই তাকে মানুষের খেতাব দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? অথবা যে বাঁদরটা নাচ পারে সে পরের জন্মে মানুষ হয়ে জন্মাবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?”
সহ সভাপতির এরুপ আচরণে নজু শিষ্যরা গুরুর অপমান বরদাস্ত করতে পারে না। তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাইলে নজু তাদের থামিয়ে দেয়, “আপনি কি বলতে চান?”
“ আমি যা বলতে চাই তা খুবই পরিষ্কার। আপনার এত বোধশক্তি দিয়ে কি সেটা বুঝতে পারছেন না?”
শুনেছি যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার সময় তার মা মেরী, তার শিষ্য ও জেরুজালেমের মহিলারদের বাধ্য করা হয়েছিল তার যন্ত্রণা অবলোকন করার জন্য।
প্রেয়সী ও ভক্তদের সামনে এই অপমান নজু মেনে নিতে পারে না। সে তা রুখে দাড়ানোর জন্য বলে, “আমার লেখা কি আপনার ভাল লাগে নি? আপনি সাহিত্যের কি বোঝেন? বুঝলে আমাকে এই কথাগুলো বলতেন না”।
সহ সভাপতি বাঁকা হেসে বললেন, “আমি কতটুকু বুঝি সেটা কোনো বড় ব্যাপার না। যে সাহিত্য সাধারণ পাঠক বুঝতে পারে না সেটা আবার কি সাহিত্য? আর আপনি যদি এটাই চান যে কেউ বুঝবে না তাহলে পাঠকদের যন্ত্রণা দেয়ার মানেটা কি? তাও আবার ইংরেজিতে?”
“আপনি বুঝেন নি সেটা আপনা ব্যর্থতা। কেউ না কেউ তো ঠিকই বুঝেছে।
সবাই তো আর আপনার মত শিল্পান্ধ নয়”।
সহ সভাপতির হাসি স্ফীত হয়। তিনি বলেন, “আপনিই জিজ্ঞেস করে দেখুন না কে কে আপনার অমর পদ্য বুঝেছে”।
গণতন্ত্র নাকি নাকি সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা, কিন্তু এর কোন বিকল্প নেই বলেই তা এত সার্বজনীন। কে কে বুঝছে ভোটে নজুর এগারো শিষ্য তাদের বাইশটি হাত আকাশে উত্তোলন করে।
এরপর বুঝেনি দলে হাত তুলতে বলা বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়। এমনকি নজুশিষ্য হাসুও তার দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করার কষ্ট করতে রাজি হয় নি। হাসুকে দেখে নজু যা বললো তা জুডাসের প্রতি যীশুর ক্ষমাসুলভ আচরণের কথাই মনে করিয়ে দেয়, “হাসু, বাইরে আমাকে ওভাবে আলিঙ্গন করে ভেতরে এসে এভাবে প্রতারণা করলে?”
হাসু কোন উত্তর দেয় না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। পরে শুনেছি সে সহ সভাপতির কাছে টাকা ধার করেছিল তাই বাধ্য হয়েই তাকে গুরুর সঙ্গ ছাড়তে হয়।
এরপর সহ সভাপতি নজুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনার মত পণ্ডিত ব্যাক্তিকে আমাদের মাঝে রাখা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আপনি সভা ত্যাগ করলেই আমরা খুশি হই”।
“কোন অপরাধে?”
“তেমন কোন অপরাধে নয়। বন্ধুদের আড্ডায় জ্যেঠামশায় কেউই চায় না। আপনার জ্যেঠামি সহ্যের বাইরে চলে গেছে।
উপরন্তু আপনার অ্যাংলো সাহিত্য চর্চা আমাদের এখানে শোভনীয় নয়। মধুসূদন যেটা পারেন নি আপনি কি মনে করেন আপনি সেটা পারবেন?”
“কোন মধুসূদন? আমাদের পাড়ার ডোমার মধুসূদন?”
“না, মাইকেল মধুসূদন”।
“মধুসূদন পারেনি বলে কি আমি পারবো না? মধুসূদন তো বিদেশে যেয়ে থাকতেও পারে নি, তাই বলে কি আর কেউ বছরের পর বছর থাকছে না?”
অত্যন্ত অকাট্য যুক্তি। কিন্তু যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার সময়ও রোম কর্তৃপক্ষ তার কোন অপরাধ প্রমাণ করতে পারে নি। ইহুদিদের সম্মিলিত দাবির মুখে যীশুর অপরাধ না করাটাও অপরাধে পরিণত হয়।
সভার অন্যান্য সদস্যদের চাপের মুখে সভাপতি নিজে নজুকে সভা ত্যাগ করতে বলতে বাধ্য হন, “আপনি যদি মধুসূদনকে ছাড়িয়ে যেতে চান সেটা অন্য কোথাও করেন, এখানে নয়”।
“আপনারা জানেন না যে কি ভুলটাই না করছেন”।
“আমরা খুব ভাল করেই জানি। আমরা আপনাকে বের করে দিচ্ছি”।
এ কথার পর নজু উঠে দাঁড়ায়।
সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমি আপনাদের সবার ভাল চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এখান থেকে ভাল সাহিত্যিক তৈরী করবো। আপনারা অবুঝ, বুঝতে পারছে না যে কি ভুল করছেন। যেদিন আপনারা আপনাদের ভুল বুঝতে পারবেন সেদিন আমি আবার ফিরে আসব”, এই বলে নজু তার সহচরদের সাথে করে বিদায় নেয়।
নজু চলে যাওয়াতে আমাদের সভার হারাধনের ছেলেরা আবার ফিরে আসতে শুরু করে।
সভার কার্যক্রম আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সভার কেউ তাদের ভুল বোঝে না, নজুরও আর ফিরে আসা হয় না। সেদিন ছিলো শুক্রবার, তারপর শনিবার। রবিবারে আমাদের সভার উল্টোদিকে আরেকটি সংঘ মাথা তুলে দাঁড়ায়, ছাদে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা- অ্যাংলো সাহিত্য গোষ্ঠী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।