উত্তরাঞ্চল বলতে বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত জেলাসমুহ বিশেষত রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়,গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, (+বগুড়া) অঞ্চলের বসবাসকারী লোকজনকেই সচরাচর বোঝানো হয়ে থাকে(বৃহত্তর রংপুর-লাল নীল রংদিয়ে কুড়িটা গাই)। এই অঞ্চলের মানুষ সাধারণত অনগ্রসর/অবহেলিত অঞ্চলের মানুষ বলেই পরিচিত। ক্ষুধা দারিদ্র আর 'মঙ্গা' এই শব্দ-ত্রয় যেন চট করে মনে আসে এ অঞ্চলের কথা মনে আসাতেই। চোখেমুখে ফুটে ওঠা নেতিবাচক অ-সহিষ্ণু একটা ভাব প্রবলভাবে লক্ষণীয় এ এলাকার কথা বলাতেই । আসলেই কি তাই।
আমরা খালি চোখে যা দেখি তাই কি ঠিক? কেনই বা ঠিক?
'মফিজ' ডাকটা এ এলাকারই একটা তাচ্ছিল্যের ডাক। '**লা উত্তরাঞ্চলের মফিজ' এটা হজম করতে করতে এখন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে বলে। আমরা এখন আর ওসব গায়ে মাখি না, পরোয়া করি না। কারণ আমরা নিজেই জানিনা কেন আমরা এই পশ্চাৎপদটায় আঁকড়ে আছি জীবনভর। আমরা এমএ বিএ পাশ করে ঘরে বসে চাকরি করার চিন্তা ছাড়তে পারিনা।
আমরা পাশ করার পর এসে বাড়িতে বসে আবাদি দেখাশোনা করি আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকি স্থানীয় একটা স্কুলে অথবা কলেজে জয়েন করে ঘরে বৌ এনে সংসার দেখাশোনা করব- ঘরে বসেই। 'ওপার' অঞ্চলের জল হাওয়া আমাদের সহ্য হয় না বেশি একটা। আমরা বুক ভরে শ্বাস নিই, প্রাণ ভরে তেষ্টা মিটাই আর শীতল হাওয়ায় বসে আমাদের পিঠের ঘামাচি মেরে নিই চোখ মুদে, পরম তৃপ্তিতে।
কিছুদিন আগে একটা লেখা পড়েছিলাম, "উত্তারঞ্চলের বড়লোকেরা কে কেমন !!! আপনাদের মন্তব্য চাই"-শিরোনামে। একটা কমেন্ট আমাকে বেশ নাড়া দেয়।
কমেন্টে লেখা ছিল-
"উত্তরাঞলের মানুষরা আসলেই তাই। কারো কোন উপকার করবে না ( ক্ষতিও করবে না)। এবং এদের মধ্যে মানসিক শক্তি অনেক কম। অল্পতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে, সাহসী কোন পদক্ষেপ নেবার আগে হাজার বার চিন্তা করে। তবে মূলত পারস্পরিক সম্প্রীতির অভাবেই উত্তরাঞ্জলের মানূষের আজ এ দশা।
নোয়াখালি বা বরিশালের লোকজনকে দেখেন, বংশে একজন দাঁড়িয়ে গেলে সেই বাকি সবাই কে টেনে তুলে। আর উত্তরাঞলে উলটা। কেউ দাঁড়িয়ে গেলে হয় তাকে সবাই টেনে নামানোর চেস্টা করে, অথবা তার কান্ধে উঠে বসে থাকার চেস্টা করে, নিজ চেস্টা বা গরজে কিছু করার মন মানসিকতা নাই। "
Click This Link
কথাগুলো যদিও অনেকাংশে ঠিক, কিন্তু এর নেতিবাচক দিকটা আমাকে দ্বিধান্বিত করেছে। আমি ফিজিক্স নিয়ে পড়েছি।
অর্থনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না। শুধু এটুকু বুঝি- আমরা বাংলাদেশী/বাঙ্গালী যাই হই না কেন, হৃদয় জুড়ে দেশের প্রতি মমত্ববোধ কমবেশি আমাদের সবারই আছে। সেটা যে যেই এলাকায়'ই থাকি না কেন। প্রত্যেকেরই দেশকে দেয়ার আছে অনেক। সেটা যেকোনো প্রান্ত থেকেই হোক না কেন।
এক্ষেত্রে আমি বারবার দেশ দেশ বলাতে অনেকেই ক্ষেপে উঠতে পারেন। আসলে ধনতন্ত্র কিংবা পুঁজিবাদে অর্থনীতির মুলে আছে ব্যক্তিবাদ। কোনও একক ব্যক্তি এগিয়ে যাওয়া আর সেই সাথে সমাজ এগিয়ে যাওয়া একই ব্যাপার(যদি না এক্ষেত্রে এগুতে থাকা ব্যক্তি- সমাজের অপরাপর সাধারণ লোকগুলোকে শোষণ না করে 'উৎপাদনশীল পুঁজি-গঠন' প্রচেষ্টায় এগিয়ে যায়)। কিছু ব্যক্তির এরকম এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এগিয়ে যায় সমাজ-সেই সাথে দেশ। আর আমাদের দেশে যে কালচারটা চলছে তা হল, শোষণ নীতি।
এক্ষেত্রে কিছু লোক আর সব লোককে ঠকিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে চলছে। এতে করে ধনী গরীব বৈষম্য বাড়ছে শুধু। সত্যিকারের এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। উত্তর জনপদে এই জিনিসটা আরও বেশি প্রকট।
আর আমাদের এই জনপদে উপরে ওঠা লোকের সংখ্যা খুবই কম।
একটা পরিবার থেকে যদি কেউ একটু নিজ পায়ে দাঁড়াতে শেখে, গাছের উপরের ডালটার দিকে তাকায়, উঠতে চায়- তাহলে তার গোষ্ঠীর আর সবাই তার পা টেনে ধরে। একসাথে ওপরে উঠতে চাওয়ার ব্যপারটা উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। আর তক্ষুনি ঘটে বিপর্যয়। হয় লাথি মেরে সবাইকে ভাগিয়ে পা ছাড়িয়ে নিতে হয়, নতুবা একসাথে ধরণিপ্রপাৎ! তবে একটা কথা. গাছে ওঠার সময় এই লোকগুলো যদি একটু নিচ থেকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করত, তবে সে গাছে উঠে আর সকলকে টেনে তোলার চেষ্টা করার একটা সম্ভাবনা থাকত বৈকি! আর সবচে বড় কথা, গাছে উঠতে যেমন নিচ থেকে ঠেলা দিলে সহজ হয়- উপর থেকে একটা হাত টেনে তুললে কাজটা আরও সহজ হয়ে যায়। আমাদের উত্তরাঞ্চলে এই ওপর থেকে টেনে তোলার হাতটা খুব একটা নেই।
যারা উপরে আছে, তারা ব্যস্ত হয়ে আছে নিজেকে নিয়ে। নিচের দিকে তাকাবার সময় কিংবা মানসিকতা তাদের খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।
উত্তরাঞ্চলের মানুষ কেন এমন? এই প্রশ্নটার সাথে জড়িয়ে আছে এখানকার ইতিহাস অথবা নৃতাত্ত্বিক গঠনবৈচিত্র। এই উত্তরাঞ্চল বললে শুধু বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরকেই নয়, বরং বরেন্দ্র সংস্কৃতি-সভ্যতাটাকেও আমলে নিতে হবে। আর সেই সাথে আমাদের জানতে হবে আমাদের পাশাপাশি অঞ্চলের ইতিহাসটাকেও।
এই ইতিহাসের মধ্যে পার্শ্বদেশ ভারতের জলপাইগুড়ি আর কুচবিহারের ইতিহাসটা আমাদের সাহায্য করতে পারে অনেকাংশে। কারণ, এই এলাকাটার অনেক অংশই দেশ বিভাগের আগে জলপাইগুড়ি আর কুচবিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল কোনও না কোনও সময়ে। 'রঙ্গপুর জেলার ইতিহাস' বইয়ে এ অঞ্চলের একটি বৃহৎ অংশ কৌরব রাজ্যের অংশ ছিল বলে ধারণা করা হয়। (মোঃ লুৎফর রহমান) বর্ণনামতে, খৃষ্ট জন্মের প্রায় ২০০০ বৎসর আগে রাজত্ব করতেন মহাভারত যুগের বিখ্যাত বীর রাজা নানক ও তাঁর পুত্র ভগদত্ত। রাজা নানকের বোন কৌরবরাজ দুর্যোধনের অন্যতম মহিষী ছিলেন।
রাজা ভগদত্ত কৌরবদের পক্ষে পান্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন । এই যুদ্ধে রাজা অর্জুনের বাহিনীকে তাড়িয়ে দেন। নিম্ন আসাম, কুচবিহার, রঙ্গপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি -সহ একটি বিরাট অঞ্চল তাঁর দখলে ছিল(আর তখন রঙ্গপুর বলতে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলাও এর অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হত))।
(সুলতানী যুগে) ১২'শ শতকে খেন বংশীয় রাজা নীলধ্বজ কর্তৃক কুচবিহার, নিম্ন আসাম, রঙ্গপুর এসব এলাকায় কামতাপুর রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিবরণ পাওয়া যায়(রঙ্গপুর জেলার ইতিহাস-পৃষ্ঠা৬)। কিন্তু মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান সম্পাদিত 'রঙ্গপুরের প্রাচীন ইতিহাস' বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, এ সময় কোচ(কুচবিহার) রাজা বিশ্বসিংহ এই অঞ্চলের সীমারেখার ব্যাপক রদবদল করেন।
অর্থাৎ এসময়ে রংপুরের কিছু অংশ কুচবিহার রাজ্যে ঢুকে পড়ে। এতে লালমনিরহাট জেলার কিছু অংশকে কামরূপ(আসাম) রাজ্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়(১৫১৫খৃঃ মতান্তরে ১৫৩০খৃঃ)।
(মুঘল শাসনামলে) ১৫৮২ সালে রাজা টোডারমল্লের প্রশাসনিক শ্রেণীবিন্যাসের ফলে প্রাচীন ত্রিসোতা(বর্তমানে তিস্তা) নদী ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে ৮৪ টি পরগনা নিয়ে গঠিত হয় ঘোড়াঘাট সরকার। পরবর্তীতে ১৬৫৮ সালে সুবাদার শাহ সুজার নতুন প্রশাসনিক বিন্যাসের ফলে সৃষ্টি হয় ২৪৬ পরগনা বিশিষ্ট কোচবিহার সরকার (কোচবিহারের ইতিহাস-খান বাহাদুর চৌধুরী আমানত উল্লাহ, পৃ-২৬১) উত্তরে ভুটান, দক্ষিণে ভবানীগঞ্জ(বর্তমানে গাইবান্ধা), পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ ও পশ্চিমে করতোয়া নদী পর্যন্ত কোচবিহার সরকার বিস্তৃত ছিল।
এ থেকে দেখা যায় উত্তর কখনোই একটি একক অংশ হিসেবে বেশিদিন টিকে থাকেনি।
বারবার এর বিভাজ্যতা এসেছে। হয় প্রশাসনিক-ভাবে একে সম্পৃক্ত করা হয়েছে একেক অঞ্চলের সাথে একেকবার, নতুবা রাজ্যদখলে এর অখন্ডতা নষ্ট হয়েছে বিভিন্ন রাজরাজড়ার আমলে। এর ফলে এখানকার মানুষ বিভিন্ন এলাকার মানুষের মিশ্রতায় এসেছে বহুবার। উপজাতিদের মত স্বকীয়তায় থাকতে পারেনি কখনোই।
এছাড়াও, আর্যরা এদেশে এলে তারা একসময় অনার্যদের বিয়ে থা করে এদেশেই যে বসতি স্থাপন করে একটি মিশ্র জাতি গড়ে তোলে- এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দ্রাবিড়, কোল আর কৌরব এই তিন জাতির মিশ্রতা এসে পড়েছে আমাদের চেহারায়। যার ফলে আমাদের গায়ের রং তামাটে, চোখ পিঙ্গল অথবা কালো, নাক ঋজু, মানসিকতা এরূপ।
কিরূপ?
আপাতত এই প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে আমি অন্য একটা ব্যপারে আপনাদের দৃষ্টি নিয়ে যাচ্ছি। আমরা বাঙালী জাতটা যে একটা মৌলিক জাত নই এ ব্যপারে সচেতনভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন সময়ে আমাদের এ দেশ শাসন করেছে বিভিন্ন রাজা কিংবা দেশ কিংবা জাতি। পাঠান, মুঘল (-তথা মুসলিম), ডাচ-পর্তুগিজ, ইংরেজ, সর্বশেষ পাকিস্তান এসে আমাদের বাঙ্গালী জাতের সংকরায়নে ভূমিকা রেখেছে অসামান্য।
আর আমরা যা করছি, যা ভাবছি, তাতে এ জাতিগুলোর চিন্তা-চেতনার অংশ আমাদের মননে গেঁথে আছে একান্ত অবচেতনেই, তা সেটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যা'ই হোক না কেন। ইতিবাচক হলে প্রবলভাবে ইতিবাচক, আর নেতিবাচক হলে প্রবলভাবে নেতিবাচক। আর এ কারণেই আমরা জাতিগত-ভাবেই সবাই আর সবার থেকে বেশ একটু ভিন্ন। পাশাপাশি থেকেও আমাদের মন মানসিকতায় বৈপরীত্য আকাশপাতাল হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। আর এ কারণেই হয়তবা এই বাংলাদেশের একেক অঞ্চলের সংস্কৃতি ও মানসিকতায়(খুব সহজেই) বিস্তর ব্যবধান সবিশেষ লক্ষণীয়।
উত্তরাঞ্চলের সব মানুষের মানসিকতাও এক(প্রায় একইরকম) নয় এটাও বলে দেয়ার দরকার হয় না।
তদুপরি কিছু মিল থেকেই যায়।
স্বার্থকেন্দ্রীকতা কিংবা আত্মকেন্দ্রীকতা কার না আছে?
উত্তরাঞ্চলের মানুষ সহজ সরল।
মোটেই নয়। বরং এটাকে অতিথিবৎসল বলাটাই বেশি যৌক্তিক।
আতিথথ্যেয়তায় এদের মেলা ভার। বিদেশ বিভূঁইয়ের কেউ বিপদে পড়ে এলে এরা জাত পাত এর ধার ধারে না। অযাচিত উপকার করায় এরা কৃপণতা করে না এতটুকু। কুটুম্বিতায় এরা নিঃস্ব হতেও ভয় পায় না। এরা বিশ্বাস করে মানুষকে সহজেই।
এই বিশ্বাসের মর্যাদা অনেকেই হয়ত রাখেনা। চতুরতায় ঠকিয়ে নেয় সহজেই। তারপরও এরা বারবার বিশ্বাস করে 'মানুষ'কে। 'মানুষ'কে ছাড়া আর কাকেই বা বিশ্বাস করবে মানুষ? আর একারণেই বলা হয় 'সহজ সরল'।
এই এলাকায় মানুষেরা গল্প করতে ভালবাসে বরাবরই।
বেশিরভাগ গৃহস্থালিতে তাকালে দেখা যাবে বাড়ির বাইরে ছাউনি দেয়া একটা ঘর তুলে রাখা সবসময়ের ঐতিহ্য। এটাকে 'ডাড়িয়া ঘর' বলে। আর এই ঘরে মাচা পেতে করা হয় বসার ব্যবস্থা। এটাকে বলে 'ডাড়িয়া চাংড়া"। সারাদিনের ব্যাস্ততার অবসর এই দাড়িয়া ঘর।
নানা রকম আলোচনা সমালোচনা জমে ওঠে এ ঘরেই। ভিলেজ পলিটিক্স থেকে শুরু করে স-ব।
কাজ যেখানে অপ্রতুল,ব্যস্ততা যেখানে কম, সেখানে একে অন্যের পিছনে লাগাটা স্বাভাবিক। তাই এ অঞ্চলের মানুষেরা ক্রিটিক্যাল। বিশেষত কথা চালাচালিতে।
এখানে বিবিসি সিএনএন কিছুই লাগে না।
মিথ আর উপাখ্যান তৈরী হয় তাই অনায়াসেই। তবে দুঃখজনক সত্যি, এই এলাকার মূলধারার সাহিত্যগুলো আর আগের মত নেই। সংরক্ষণের অভাব আর বেড়ে ওঠা ব্যস্ততায় আজ আর এইসব সৃষ্টিশীলতা ডানা মেলে না। তৈরী হয় না বিয়েবাড়ির জন্য নতুন নতুন 'গীত' অথবা ভুলে যায় মেয়েরা কথায় কথায় 'সিল্কা'র উপমা।
ঘরকুনো স্বভাবটা এদের মজ্জায়(ইদানীং অবশ্য এরা একটু আধটু বের হতে শিখেছে)। তবে নিঃস্পৃহ নয় কোনমতেই। প্রতিবাদের ভাষাটা শিখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়েনা কখনোই। অন্যায়কে সোজা 'না' করে দেয়ার মানসিক শক্তির ঘাটতি কোনওকালেই যে ছিল না, তার সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বেশিরভাগ প্রজা-বিদ্রোহের ঘটনাই (/সূত্রপাত) ঘটেছে এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের মাঝে।
এর কিছু নমুনা দিলে ভাল হবে মনে হয়-
নুরুদ্দিনের ''জাগো বাহে, কোনটে সবাই"-ঃ জমিদার তথা ব্রিটিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের প্রথম ডাক। আর এই ডাকটির উৎপত্তি কিন্তু আমাদের এই জনপদেই। এ অঞ্চলের সাহসী মানুষ অন্যায় জুলুম আর বর্বরতার কাছে নতি স্বীকার করেনি কোন কালেই। উইলিয়াম হান্টারের ভাষ্যমতে- ১৭৮৩ সালে জানুয়ারি মাসে রঙ্গপুরের কৃষকদল হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং রাজস্ব আদায়কারীদের বিতাড়িত করে। তারা তাদের নেতা নুরুদ্দিনকে নবাব হিসেবে ঘোষণা করে এবং খাজনা প্রদান বন্ধ করে।
তারা তাদের দাবী দাওয়া স্থানীয় কালেক্টরের নিকট পেশ করে। কিন্তু বিষয়টি মীমাংসিত না হলে তা ভয়ংকর আকার ধারণ করে। সেনাপতি ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যদল নবাব নুরুদ্দিনের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে। এ সময় নুরুদ্দিন মোগলহাটে(লালমনিরহাটের একটি জায়গা) অবস্থান করছিলেন। মোগলহাট যুদ্ধে নবাব আহত আর সেনাপতি দয়াল নিহত হন।
এ সময় অবশিষ্ট বিদ্রোহী-দল পাটগ্রামে অবস্থান নেয়('রঙ্গপুর জেলার ইতিহাস')।
ফকির বিদ্রোহ-মজনু শাহঃ ফকির মজনু শাহ, সন্ন্যাস নেতা ভবানী, এবং সর্ব হিন্দু মুসলিম জননেতা নুরুদ্দিনের নেতৃত্বে রঙ্গপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের প্রজারা যে বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করে, তার বহ্নিশিখা কাজীরহাট, কাকীনা, টেপা,ফতেহপুর, পাটগ্রাম প্রভৃতি চাকলায়(ঐ সময়ে একক প্রশাসনিক ইউনিটকে চাকলা বলা হত) বিস্তৃতি লাভ করে। বিদ্রোহীরা ইংরেজ কোম্পানির অনুরক্তদের এমনকি গোমস্তাদেরও হতাহত করে। ফলে টেপা ও অন্যান্য বেশ কয়েকটি স্থানে নায়েব-গোমস্তারা প্রাণ ত্যাগ করে।
২২ ফেব্রুয়ারি (১৭৭৩) ইংরেজ সিপাহী-দল পাটগ্রাম আক্রমণ করলে অতর্কিত আক্রমণে সম্পূর্ণ বিদ্রোহী দল বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।
এ যুদ্ধে ৬০ জন বিদ্রোহী নিহত ও বহু সংখ্যক আহত ও বন্দী হয়। মজনু শাহকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তিনি অন্য কোথাও সরে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
এরপর দীর্ঘকাল এ অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা আর বিদ্রোহ টিদ্রোহ করেনি। ভাষা আন্দোলনের সময় একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে শুধু।
আর এরপরের ইতিহাস ত সবারই কমবেশি জানা। তবু এটুকু অন্তত বলা যেতেই পারে যে,৭১'এ -এ অঞ্চলের দুঃসাহসী মানুষ'ই তীর ধনুক আর দা কুড়াল নিয়েই রংপুর ক্যান্টনমেন্ট অ্যাটাক করেছিল- যেটা এক অর্থে আত্মহত্যারই শামিল।
আত্মহত্যা?
না, এ উপমাটা এখানে আদৌ মানায় না।
তাহলে কী?
আবেগ?
উত্তরাঞ্চলের মানুষের আবেগ আছে সীমাহীন বৈকি। কিন্তু...
না।
এটাকে বরং দেশের প্রতি অতিমানবিক ভালবাসা তথা দেশাত্মবোধ বলাটাই বোধ করি যৌক্তিক।
অথবা উদ্বুদ্ধকরণ, উদাহরণ এঁকে দেয়া মানুষের মনে- অসম সাহসের, অদম্য দেশাত্মবোধের।
মুক্তিযুদ্ধের ৬ নং হেড-কোয়াটার বুড়িমারী। এটি অবস্থানগত কারণেই হোক আর কৌশলী সিদ্ধান্তেই হোক(বিস্তীর্ণ এলাকায় রেললাইন উঠিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল ঐ সময়, তিস্তা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ঐ সময়)একমাত্র সেক্টর যেটা কীনা সবসময়ই মুক্তাঞ্চল হিসেবে রক্ষা করতে পারার গৌরব আমাদের। আমরাই সেই হতাশ সময়ে সাহস যুগিয়েছিলাম সারা দেশে।
আমাদের এই ট্রানজিট দিয়েই যোগাযোগ করা হয়েছিল ভারত আর রাশিয়ার সাথে। সাহায্যের আবেদন নিয়ে আমরাই গিয়েছিলাম ওদের কাছে এই পথেই। আর এতে অসামান্য অবদান ছিল আমাদের পাটগ্রামের তৎকালীন এম পি আবিদ আলী সাহেবের।
প্রথম দিকে আমরাত যুদ্ধ করেছিলাম ইন্ডিয়ার দলীয় (কংগ্রেস)অস্ত্র দিয়ে(এখন যেমন আওয়ামী বিএন পির কাছে আছে)।
জুন জুলাই মাসের দিকে যখন এই অস্ত্রের টান শুরু হল, গ্রেনেড ফুরিয়ে এলো,ইন্ডিয়া বলল- আমরা রাজনৈতিক সাহায্য করব তখনি যখন বাংলাদেশের অধিকাংশ এম পি (পার্লামেন্টারি সদস্য)এসে আমাদের কাছে লিখিত আবেদন করবে।
নয়ত এই যুদ্ধ কেবল একটা 'গন্ডগোল' হিসেবেই স্বীকৃত হয়ে থাকবে আমাদের কাছে।
তারপরই আমরা তাজউদ্দীন আহমেদ সহ ৩৭ জনের একটা টিম পাঠানোর সিদ্ধান্তে পৌছাই। সেখানে ইন্দিরা গান্ধী বলে দেন আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু করতে পারব কী না সন্দেহ আছে। তখন তাকে কনভেন্স করার জন্য আবিদ আলী (পাটগ্রামের এমপি)শুধু একটা কথাই বলেছিলেন,"দেখুন এই অবস্থায় আমাদের দেশে গণহত্যা চলছে, মা বোনের ইজ্জত নিয়ে লুটোপুটি খেলছে ওরা। এখন যদি আপনারা আমাদের প্রতিবেশী হয়ে কিছু না করেন, নির্বিকার থাকেন তবে আমরা হয়ত আর কোনদিনই স্বাধীনভাবে বাচার স্বপ্ন দেখতে পারব না।
আপনাদের সিদ্ধান্তে একটু দেরী হয়ে গেলে আমরা হয়ত হারিয়ে ফেলব একটা জেনারেশনকেই। "
না।
ইন্ডিয়া সেদিন আর দেরী করেনি।
রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দুই জাহাজ অস্ত্রের চালান নিশ্চিত করে সুন্দরবন উপকুলে। আর ওদিকে এই খবর পেয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য পাঠায় আমেরিকা।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা অসম সাহসিকতায় আর জীবন বাজি রেখে উড়িয়ে দেয় আমেরিকার জাহাজ আর নিশ্চিত করে রাশিয়ার চালান(প্রয়াত এম পি আবিদ আলীর লেখা থেকে)।
আমি নিঃসন্দেহ আমাদের এই উত্তরাঞ্চল না হলে মুক্তি অধরাই থেকে যেত আমাদের কাছে।
উত্তরের মানুষদের প্রসঙ্গে একজন কমেন্টে লিখেছিলেন, তাঁর বাড়ি উত্তরে না হয়ে কেন বরিশাল কিংবা নোয়াখালীতে হল না! বরিশাল আর নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের অদম্য নিষ্ঠা, সাহসিকতা আর খেঁটে পড়ে দিনযাপন করা মানুষদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ আমার সবসময়ের জন্যই। কিন্তু প্রসঙ্গটা যখন আমাদের উত্তরাঞ্চলের কিছু মানুষের হাপিত্যেশের, তখন আমাকে বলতেই হয়,
আসলে আমরা সঠিক ইতিহাস জানিনা কিংবা নিজেদের সঠিক চিনিনা বলেই আমাদের এই অন্তর্দহণ!
আমরা সবার আগে নিজেদের জানলেই জাত্যভিমানটা আমাদের এসে যাবে ঠিকই। বরিশাল কিংবা নোয়াখালীতে জন্মাবার সাধ হবে না(এই লেখাটা কাউকে বিশেষ উদ্দেশ্য করে লেখা নয়, তদুপরি কমেন্ট, উদ্ধৃতির খাতিরে যারা এসে গেলেন, তাঁদের নেগেটিভ-লি না নেয়ার অনুরোধ করছি)।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, এরশাদ সরকার ক্ষমতায় এসে দেশের বিভিন্ন অংশে অনেক কাজ করে গেছেন অবলীলায়। বিশেষত সিলেট আর চট্টগ্রাম-বাসীরা তার অবদান ভোলার কথা নয়। কিন্তু আমরা পারিনি।
কারণ?
ঐ জাত্যভিমান, আমরা সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম, কোনো স্বৈরশাসকের অনুগ্রহ আমরা চাইনা বলে।
এরশাদ এসেছিলেন।
কারমাইকেলকে সেই সেদিনই ভার্সিটি ঘোষণা দিতে। হয়ত রংপুরকে বিভাগও ঘোষণা করতেন আগে পরে।
এরশাদ সেদিন মডার্ন মোড় পর্যন্ত এসেও রংপুর ঢুকতে পারেনি। আমরা জুতার মালা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম বলে!
এটাকে কী বলবেন আপনারা? নিছক বোকামি? হয়তবা। তবে আমরা এই বোকাই থাকতে চাই, অন্যায় যেন আমাদের সাদা মনে প্রশ্রয় না পায় কোনোভাবেই।
পরিশেষে, দেশের আর সব অংশের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও এগিয়ে যেতে চাই। আমরা এগিয়ে যেতে চাই এমনভাবেই, ঠিক যেমনভাবে আমরা আছি। আপোষহীন-একগুঁয়ে-জেদী অথবা বোকা, শান্তিপ্রিয়-অতিথিবৎসল-আবেগ ভরপুর অথবা সরল।
টলমল জল থেকে উঠে আসে সবুজ বাতাস। সেই বাতাস ছোঁয়া সবুজ অনুভূতিতে আমরা জিরিয়ে নিই আমাদের শ্রান্ত দেহ।
কাজের ফাঁকে গল্প আমাদের নির্মল আনন্দ দেয়, আমরা হাসি- আমরা দুঃখে ভাসি। খোঁচা খাই, খুঁচে দেই। তারপর আবার এক হই সব ভুলে। নগরায়ন আর শিল্পের প্রভাব খুব একটা নেই বলে আমরা যান্ত্রিক দিনযাপনে অভ্যস্ত নই কখনোই। আমরা একটু অন্য মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি।
সহজ মানুষ।
আমাদের এভাবে মেনে নিতে কি আপনার আপত্তি আছে??
(আমাদের তিস্তা। শুকনো মৌসুমে শুকনো গাছের মতই-
অথবা হঠাৎ প্লাবন তোলা ছলছল জল-
ইন্ডিয়ার 'ফারাক্কা বাধ' একে করে রেখেছে 'উত্তরের দুঃখ'-)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।