জীবনটা একটা লাইফ..... তখন আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। আমার বড় চাচা ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়ে আমাদের সাথে থাকা শুরু করলেন। আমার চাচা সরকারী বড় চাকুরী করতেন। চাচীও সরকারী চাকুরী করতেন বিয়ের পর তা অবশ্য ছেড়ে দেন। তাদের একটি ফুটফুটে ছেলে ছিল।
আমাদের চাইতেও সুন্দর পরিষ্কার ও আদরের।
যদিও একসাথে ছিলাম তবে ঘর বা রান্নাঘর ছিল আলাদা।
খাওয়া দাওয়া নিয়ে মাকে অনেক জ্বালাতাম। উনাকে আঘাত করার জন্য প্রায়ই বলতাম, "খেতে দিতে না পারলে জন্ম দিয়েছেন কেন?" যখন বলতাম তখন কিছুই বুঝতাম না। এটা কখনো খেয়াল করা হয়নি উনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন।
তবে উনি চরম বিরক্ত হতেন। এমন দিন কমই ছিল যেদিন মায়ের হাতের মার খাইনি।
পরিবারে অভাবের থেকেও বেশি ছিল মিস ম্যনেজমেন্ট। আমি আমাদের থেকেও অর্থনৈতিকভাবে কম স্বচ্ছল পরিবারকে দেখেছি অনেক সুন্দর ভাবে বাঁচতে। পথ শিশুরাও অনেক সুখে জীবনযাপন করত।
অর মে না ইধারকা না উধারকা। না গরীব না বড়লোক।
আমার চাচাতো ভাই শুভ্র (ছদ্মনাম)। সে খেতে চাইতনা। আমার চাচী অনেক মজা করে সুজির মত বানিয়ে দিতেন।
এত মজার খাবার সে কেন যে খেতে চাইতনা কে জানে? তবে আমার একটু উপকার হয়েছিল। আমার চাচী আমাকে ডাকে আনতেন। আমাদের দুজনকেই পাশে বসাতেন।
এবং চামুচ আমার মুখের সামনে এনে শুভ্রের উদ্দেশ্যে বলতেন। এই যে দেখ বাবা , "মানুষ" (আমার ছদ্মনাম) খাচ্ছে।
আমি হা করতাম। তখন আমার ভাইয়ো হা করত। আমার চাচী তখন তার মুখের মথ্য চামুটা ঢুকিয়ে দিতেন। আমি প্রায়ই মনে করতাম যে, এতগুলা ধোকার মধ্যে একবার অন্তত আমার মূখে আসবে। হয়তবা আসত, কিন্তু শুভ্রেকে যখন আর খায়ানো যেতনা তখন বাকীগুলো আমি খেতাম।
অনেক মজা করে খেতাম।
আমি দিনে কয়েকবার খেতে চাইতাম। কতবার মনে নেই। আমাদের বাসায় প্রায়ই একধরনের বিস্কুট আনত। ওগুলো স্থানীয়ভাবে বেলাবিস্কুট (আসল নাম) নাম ছিল।
এক প্যাকেটে ৫০ টা বিস্কুট থাকত। আমাদের পরিবারের সদস্য ছিল মা+বাবা+বোন+ভাই+আমি=৫ জন। প্রায়ই বিস্কুট চুরি করে খেতাম। এবং হিসাব করতাম ১০ টার বেশি আমার পেটে গেল কিনা।
আমার দাদার সাথে প্রয়ই দুধ ভাত খেতাম।
প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু আমার মা পছন্দ করতেন না।
পরে যখন একটু বড় হই কৈশর বলা যায়। তখন প্রায়ই মায়ের সাথে ঝগড়া করে খেতাম না। বা দাদুর কাছে চাইতাম।
মাঝে মধ্যে ফুপুর বাসা (পাশেই) চলে যেতেমা। তাদের ভাত খাওয়ার সময় বা তারা যদি বুঝতে পারত আমি খাইনি তবে প্রায়ই .... তাদের সাথে খেতাম। কৈশরে খাওয়ার ব্যাপরে আমার অনেক লজ্জা কাজ করত। কিন্তু আমার মা পছন্দ করতেন না এভাবে অন্য কোথাও খাওয়া প্রয়াই ফুপুর সাথে দাদুর সাথে ঝগরা করতেন।
অনেক সময় এমন হত।
আমি দুপুরে না খেয়েই ফুপুর বাসায় ঘুমিয়ে পরেছি। বিকাল হয়ে গেছে। এদিকে আমার মা মনে করেছেন আমি ফুপুর বাসায় খেয়ে ফেলেছি। এভাবে আমার কৈশরের অনেকটা সময়ই উপোস কেটেছে।
আমাদের বাসা শহরে হলেও আমাদের অনেকগুলি গাছ ছিল।
আম, জামা, কাঠাল, চালতা, পেয়ারা। (চালতাফুল অনেক সুন্দর)। আমাদের দুইটা আমগাছও ছিল। একটার আমা গুলি ছিল খুবই মজা সাইজ মধ্যম অসাধারণ স্বাদ। আরেকটার আম অনেক বড় হত কিন্তু সংখ্যায় খুবই কম মাত্র ১৫/২০টা আম ধরত প্রকান্ড ঐ গছটাতে উঠা যেতনা।
আমের সময় প্রায় প্রতিদিনই গাছে উঠে আম খেতাম। আমগাছটা আমার খুবই প্রিয় ছিল। ঐ আম গাছটা এখন আর নেই। ঐখানে বিল্ডিং বানানো হইছে। কিন্তু ঐ আম গাছটার জন্য আমার অনেক ভালবাসা আজও আছে।
ইস আমি যদি কোন এক গ্রামে জন্মাতাম যেখানে অনেক আমগাছ আছে। এবং সব সময় অনেক আম ধরে।
পরে অবশ্য আমার যে কোন অভিমানর স্বাস্তি ছিল না খাওয়া। এমন হয়েছে, আমার মায়ের সাথে ঝগরা করে প্রায় ৩/৪ দিন ভাত না খেয়ে নাস্তা করেই ছিলাম। পরিবারের কারো সাথে আমার ঝগরা হলেই আমি ভাত খেতাম না।
আমার স্বাস্থ্য একদম খারাপ ছিল। কংকালসার। মাঝে মাঝে বিনা কারনেই ঝগরা করতাম। আমি কখনোই ভাত নীজে নিয়ে খেতাম না। সব কিছুই সামনে চাইতাম।
পছন্দের তরকারী না হলে খেতাম না। আমাদের কমন মেন্যু ছিল আলু ভর্তা ডাল। মাঝে মাঝে তেলাপুয়া মাছ। সপ্তাহে ১/দুবার অর্ধেক ডিম। এই জীবনে কতকেজি আলু যে খেয়েছি।
আল্লহ জানেন। (আমাদেরদেশে তো এক আলু মন্ত্রিও আছেন, তিনি সম্ভবত আমদের মত আলু খেয়েছিলেন। যিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন ভাতের বিকল্প আলু খাওয়ার জন্য। )
বাসার কাছাকাছি আমার বাবার দুইটা দোকান ছিল। আমার বাবার ব্যবসা কখনোই ভাল হতনা।
(একটা দিক অন্তত ভাল হয়েছে কুলিং কর্নার থেকে মাঝে মধ্যে আমরা কিছু খেতাম। ) একটা সময় ছিল আমি তখন আমাদের দোকানেই থাকতাম। বাবার দুইটা দোকান ছিল। তার পেছেনে থাকার ব্যবস্থা ছিল। বাসা থেকে খাবার আসত।
অথবা হোটেলে খেতাম। একবার আমার মা আমাকে দেখে কান্নাকটি করে অস্থির, কারন কি ছিল? হয়ত তিনি নীজেকে অপরাধী মনে করেছেন আমার স্বাস্থ্য এত খারপ দেখে। অদ্ভুত। কিন্তু আমার লজ্জা+ভাল লাগছিল, অন্তত আমার মা আমাকে নিয়ে একটু হলেও ভেবেছেন। কিন্তু না খাওয়া আমার একটা বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
আমি প্রতিদিন ১২/১৩ কাপ চা খেতাম, মুরি বিস্কুট ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের ২/৩ টা ভাড়াবাসা ছিল (দাদার তত্বাবধানে)। চাচী, ফুপু, ফুপাতোবোন, ভাড়াটিয়া সবাই কোন কাজ করাতে হলে আমাকে এক কাপ চা অবশ্যই খাওয়াতেন অথবা প্রায়ই এমনিতেই খাওয়াতেন। তাদের বাজার সদায় ঔষধ এই ধরনের কাজ আমি চায়ের বিনিময়ে করে দিতাম।
যেকোন জায়গায় খেতে বসলে আমার লজ্জা লাগত সবাই হাসাহাসি করত।
কারন আমি তিন লোকমার বেশি ভাত খেতেই পারতাম না।
আমাদের দোকানের পেছনে একজন ছাত্র ভাড়া থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরতেন। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন তুমি যদি ঠিকভাবে না খাও তবে তোমার স্বার্থ্য খারাপ হয়ে যাবে। এবং তোমার স্বন্তানরাও রোগা পাতলা হবে।
আমি তখন তাকে বলতাম, আমি বিয়েই করবইনা।
(এখন মোটামুটি অনেক কিছুই চাইলেই খেতে পারি কিন্তু ইচ্ছে হয়না। বেচে থাকার জন্য যতটুকু না খেলেই নয় ততটুকু .....। এখানের হাইপারমার্কেট গুলিতে প্রায় সকল ধরনের ফলমুল, সবজী, সবই আছে। মাঝে মাঝে নীজেই রান্না করি।
আলসেমীর কারনে, বেশিরভাগ সময়ই রেষ্টুরেন্টে খাওয়া হয়। একেকদিন এক এক রেষ্টুরেন্ট। ইন্ডিয়ান/ইরানী/বাংলাদেশি/পাকিস্তানী/আরবী। তবে আস্তে আস্তে খাওয়ার পরিমান বাড়ানোর চেষ্টা করছি। )
নকুল কুমার বিশ্বাসের একটা গান দিয়ে আজকের মত শেষ করছি।
দেখ কেউ রাতে চুরি করে
দেখ কেউ রাতে চুরি করে
কেউ হাতে ছুরি ধরে
কেউ করে রাজনীতি
কেউ দেখ গায়গীতি
কেউ দেখ ভিক্ষ মাঙ্গে
কেউ দেখ ইট ভাঙ্গে
কেউ বেচে শরীরর রক্ত
কেউ বেচে রক্ত কেউ বেচে ঘাম
পেটের কারনে দুই নাম্বার কাম
চারিদিকে খাই খাই লাভটা কি বল তাই?
খালি পেটে বসে দিন গুনিয়া....
খাওয়ার জন্যই এই দুনিয়া
খারে খা খাওয়ার জন্যই এই দুনিয়া।
পোষ্টের উদ্যেশ্য। শিশুদের খাওয়ার ব্যাপারে অনেক যত্নশীল হতে হয়। অবশ্য আমার মনে হয়না এমন কেউ এই পোস্ট পড়বেন যারা এই কথাটা প্রয়োগ করার জায়গা/ক্ষেত্র পাবেন। কারণ আমার ঐ পরিবারের মত পিক্যুলিয়ার এন্ড প্যথেটিক পরিবার এখন আর নাই।
এটা আমার বিশ্বাস।
আমার সমস্যাময় ইতিহাস শৈশব থেকে.......এখন পর্যন্ত । (১) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।