Don't Ever Be Lonely (A Poor Little Fool Like Me) সান্দাকফু - ফালুট ট্রেকিং :
সান্দাকফু নামটি সর্বপ্রথম শুনেছিলাম আমার ট্রেকিং গুরু ‘আনোয়ার ভাইএর মুখে, উনি বিভিন্ন সময় উনার পোর্টেবল হার্ডডিস্ক থেকে আমাকে ছবি বের করে দেখাতেন এবং প্রায়শঃই গুগল এ ছবি সার্চ করে দেখিয়ে বলতেন উনি এইসব জায়গা দিয়ে গিয়েছেন এবং এখানে এটা ওখানে ওটা। এসব শুনে শুনে আর অবসর সময়ে গুগলে ম্যাপ দেখে কিছু কিছু জায়গার নাম ও প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার একটিগোপন ইচ্ছা ছিল আধিক উচ্চতা আরোহণের এবং তখন মাত্র বাংলাদেশের সবোর্চ্চ পাহাড়টি আরোহণ করে ফেলেছি (মদক/ সাকা হাপং), আর তাই আনোয়ার ভাই যখন বলল সান্দাকফু'র কথা তখন মনে মনে টার্গেট করে রেখেছিলাম ২০১২তেই সান্দাকফু ভ্রমণ করবো ইনশাআল্লাহ। যদিও মালেশিয়ার মাউন্ট কিনাবালুতে যাবার কথা ছিল কিন্ত এত টাকা ($700) যোগার করার চাইতে ২০০০ ফিট কম উচ্চতায় সান্দাকফুকে'ই নেক্সট টার্গেটে রাখলাম।
সান্দাকফু'র ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় যেই আবেগ'টি কাজ করছিল সেটা হচ্ছে ১১৯২৯ফিট আরোহন এবং নিজ চোখে কাঞ্চনঝঙ্গা এবং এভারেস্টের চূঁড়া দেখা।
যেহেতু আনোয়ার ভাইর এর সাথে আর ব্যাটে-বলে হয়ে উঠেনি তাই আমার আর এক ট্র্যকিং পার্টনার 'মাহবুব রুবেল' কে রাজী করালাম যদিও সে মাউন্ট কিনাবালু'র প্ল্যানে ছিল। যথাস্তু আমরা দুজন ইন্ডিয়ান ভিসা - পাসপোর্ট এন্ডোর্সমেনট - শ্যামলী'র শিলিগুড়ী'র বাসের টিকেট কেটে ফেল্লাম। বাসের টিকিটের ক্ষেত্রে আমরা রাউন্ড ট্রিপ না করে ওয়ানওয়ে'র কেটেছিলাম যাতে বাসের টিকিটের জন্য আমাদের কোন তৎক্ষণিক প্ল্যান আটকে না যায়।
ভিসা আর শ্যামলীর ব্যাপারে কিছু বলে নেই যদি ব্যাপারটা জেনে কারও উপকার হয়। ইন্ডিয়ান ভিসা ফি ৪০০/- টাকা ছিল এবং আপনার কগজ-পত্র ঠিক থাকলে এমনিতেই ভিসা দিয়ে দেয়।
আমি এক মাসের জন্য ভিসা চেয়েছিলাম কিন্ত সাবইকে নাকি ৩ মাসেরই দেয় এবং আমাকেও তাই দিল। আর বাসের ব্যাপারটা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যায় শুধু শ্যামলী'ই, অন্যান্য গুলো আপানকে বুরিমারি বর্ডারে নামিয়ে দিবে। বর্ডার পর্যন্ত ভাড়া তখন ছিল ৬০০/- টাকা এবং বর্ডারের ঝামেলা শেষ করে ওপাড়ে চ্যাংড়াবান্ধা থেকে আবার শিলিগুড়ী পর্যন্ত লোকাল বাস ছাড়ে এক ঘন্টা পর পর। কিন্ত সমস্যাটা হচ্ছে চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ী পর্যন্ত রাস্তাটার কিছু কিছু জায়গার চান্দের গিরিখাত রয়েছে এবং সাদা ধুলা খেয়ে কিঞ্চিৎ ফর্সা হয়ে যাবার সুযোগ রয়েছে। আমি মনেকরি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাবার চেয়ে ১৫০০/-টাকা দিয়ে সরাসরি চলে যাওয়াই ভাল আর চ্যাংড়াবান্ধার পরে শ্যামলীর একটা ভলভো গাড়িতে করে নিয়ে যায় যেটা খুবই আরামদায়ক, আর বুড়িমাড়ি বর্ডার পর্যন্ত একটা হিনো গাড়িকে জোড় করে এসি বানিয়ে সা্রভিস দেয়া হয়।
আর মতিঝিল সোনালী ব্যাংক প্রত্যকের জন্য ৩০০/-টাকা দিয়ে ট্রাভেল ট্যাক্সে'র একটা রশিদ কেটে নিবেন - সেটা অবশ্য বাসেও দেয়া যায়, শুধু টাকাটা পে করলেই হয়।
ঢাকা থেকে রাত ৮:৩০ এ ছেড়ে গাড়ি লালমনিরহাট-বুড়িমাড়ি বর্ডারে পৌছুবে সকাল ৬:৩০ এর দিকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সকাল ৯টার আগে বর্ডার অফিস খোলে না আর বর্ডার অফিস খুল্লেও চেকিং করে আপনি ১১টার আগে বাসে উঠতে পারবেন নাহ। সুতরাং বর্ডারে নেমে একটা ভাল রকম নাস্তা করে নিতে পারেন আর আশেপাশে ঘুরে সময়টা পার করে দিতে পারেন। মনেরাখবেন চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডারেই যেখানে আপনাকে ইন্ডিয়ান কাস্টমস পাসপোর্ট প্রোসেস করবে সেখানে থেকেই ডলার ভাঙ্গিয়ে নিবেন কারন ওখানেই রেট সর্বোচ্চ পাবেন।
অবশ্য শ্যামলীর লোকরাই আপনাকে তাদের রেস্টিং কাউন্টার - মানিচেঞ্চারে নিয়ে যাবে যেখানে আপনি নিশ্চিন্তে আপনার ডলার গুলো ভাঙ্গিয়ে নিতে পারেন। মনরে রাখবেন - সবগুলো ডলারই রুপি তে ভাঙ্গাবেন কারন শিলিগুড়িতে ১টাকা কম আর দার্জিলিং এ প্রায় ২টাকা কমে আপনাকে ভাঙ্গাতে হবে যদি পরে ভাঙ্গাবেন মনেকরেন। সান্দাকফু ট্র্যাকিং এ শিলিগুড়ি আর দার্জিলিং ছাড়া আর কোথাও মানিচেঞ্চার নেই এবং এই দুটি যায়গাই ট্র্যাকিং রাউট থেকে বহুদূর, সুতরাং আমার পুরাতন উপদেশ - সাথে যা আছে সব ভাঙ্গিয়ে নিন বর্ডার থেকেই - আর ফিরবার সময় বাড়তিগুলো আবার টাকায় কনভার্ট করে নিবেন।
কিছু টিপস - বর্ডারে আপনার ব্যাগ ওরা কেউ খুলেও দেখে না - কিন্ত এর অর্থ এই নয় যে আপনি অবৈধ কিছু নিয়ে যাবেন - যেমন ৬ ইঞ্চির উপরে ফলার ছুরি অথবা লং রেঞ্জের ওয়াকি-টকি ইত্যাদি। ধরা না পড়ার চেষ্টার চাইতে ধরা পড়ার উপাদান না রাখাই ভাল।
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশানের কেউ জিজ্ঞাস করলে বলবেন - দার্জিলিং এ যাচ্ছেন – যখন যেই আপনাকে জিজ্ঞাস করুক বলবেন দার্জিলিং যাচ্ছেন - কোন হোটেল জিজ্ঞেস করলে বলবেন সোনার বাংলা হোটেল। টাকা আর পাসপোর্ট সবসময় - সবসময় - সবসময় সতর্ক ভাবে কোমোড়ের ব্যাগে (থাইল্যান্ডের কতগুলো সুন্দর ওইস্ট ব্যাগ পাওয়া যায় - আমি কিনেছিলাম মোতালিব প্লাজার নিচতলা থেকে - দাম ৪০০/-টাকা ) রাখবেন ।
ট্রেকিং এর জন্য প্রয়োজনীয় কিট :
ট্রেকিং বুট - এটা ভাড়ি সোলের আরামদায়ক যেকোন বুট হলেই চলবে – এলিফ্যান্ট রোডের ওভার ব্রীজের উত্তর কোনায় নিচে দুটো হকার বসে পুরোনো জুতো নিয়ে - ওখান থেকেও কিনতে পারেন অথবা সার্ক ফোয়ারা ( কাওরান বাজার ) মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার ইদানিং কিছু হকার বসছে - মতিঝিলেও পাবেন- দাম কিন্ত মোটেও ৬০০+ এর বেশী নয় ( আমারটা কিনেছিলাম ৪৫০ দিয়ে ২০১১ তে )। বুট'টা অবশ্যই এক/দুই সাইজ বড় কিনবেন, যাতে ট্রেকিং এ পায়ের পাতা নড়াচড়া করতে পারেন এবং আরামে ট্রেকিং করতে পারেন।
ট্রেকিং ব্যাগ :- ভালো ট্রেকিং ব্যাগ পাবেন ভ্রমণ-সঙ্গী'তে (কাঁটাবন), খুব ভালোটা নিবে ১৪০০০টাকা , আমি সাজেস্ট করি ক্যামেল মাউন্টেইন এর ৪০ থেকে ৬০ লিটারের ব্যাগ - আর আমি কিনেছিলাম গুলশান হকার্স মার্কেট থেতাকা ২৮০০/- টাকা দিয়ে একটি চাইনিজ ব্যাগ - ওজন একটু বেশী হলেও পিছনে দুটো লোহার পাত ছিল যা দীর্ঘ - লম্বা হাইকিংএ ও পিঠে কোন পেইন দ্যায়নি।
গরম কাপড় - খুবই চিন্তার বিষয় আপনার জন্য কারন সান্দাকফু'র অপর নাম ঠান্ডাকফু, বরফ পড়ার শীতের কথা চিন্তা করেই আপনার প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনি যদি একটি ফুল থার্মাল জ্যাকেট কিনেন ( বঙ্গবাজার / নিউমার্কেট -> ৮০০ - ১৫০০) তাহলে সেটার ওজন কভার করার জন্য আপনাকে অনেক আজাইররা জিনিস বাদ দিতে হবে। দুটো ফুল স্লিভ মোটা T-shirt - দুটো ট্রাউসার - স্পেয়ার আন্ডার ওয়ার - স্পেয়ার মোজা - একটা গামছা - থার্মাল গ্লাভস (হাত মোজা) - একটা নরম-অল-উলের মাফলার ব্যাস। এগুলো নিয়ে কিছু দিন বাসায় বা বাসার আসে পাশে ব্যাগে করে নিয়ে ডেমো ট্র্যাকিং করবেন যাতে ঘাড়ের উপরে প্রেশারটা সহ্য হয়ে যায়।
যাত্রা শুরুঃ- প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিয়ে আমরা ২৫শে মার্চ রাত সাড়ে আঁটটায় কল্যাণপুর থেকে শ্যামলীর বাসে চেপে বসলাম।
রাতে বগুড়া স্টপেজে কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সকাল সাতটায় বুড়িমাড়ি বর্ডারে পৌছালাম। বর্ডার চেকপোস্ট আর কাস্টমস অফিস খোলে সকাল নয়টায় এবং এর আগেয় অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাই ভাবলাম এলাকাটা একটু ঘুরে দেখি। শ্যামলীর রেস্টহাউসের পিছনেই একটি পাথর ভাঙ্গার মেশিন আর তারপরে অবারিত ধানক্ষেত দিগন্ত অবধি। বাস থেকে নামার সময় একজন জাপানিকে দেখলাম লুঙ্গিপড়ে ঘাড়ে রশি দিয়ে বাধা বুট আর পায়ে স্যান্ডেল, জিজ্ঞেস করলাম কোথায় বাড়ি কোথায় যাবেন, বলল দেশ-বিদেশ ভ্রমন করাই তার কাজ এবং ভারত হয়ে সে যাবে নেপাল এবং সেখান থেকে পাকিস্তান, জাপানিরা সত্যিই অদ্ভুত। শ্যামলীর রেস্ট হাউসে কিছু উন্মুক্ত প্লাগ পয়েন্ট আছে যাতে আমাদের মোবাইল গুলো চার্জ করে নিলাম।
@বুড়িমাড়ি বর্ডার হানিফ-শ্যামলি রেস্ট হাউস
মাইলস্টোন
@বিভিন্ন জেলার দূরত্ব
এটা ওটা করে সাড়ে নয়টায় ডাক পড়ল সীমান্ত পার হবার, বিজিবি’র চেকপোস্ট পার হয়ে ভারতীয় ইমিগ্রেশানের হাতে পড়লাম, অবশ্য এদের আথিথেয়তা খুবই ভাল। এখানে প্রায় তিনঘণ্টা লেগে গেল সব কিছু শেষ করতে। এগারটার দিকে শ্যামলীর আর একটি ভলভো এসে দাঁড়ালো যাতে করে আমরা রওনা দিলাম শিলিগুড়ি’র উদ্দেশে। পথে পথে দেখলাম ধনী-গরিব সবার বাড়িতেই একটি করে পুজার মণ্ডপ রয়েছে।
@সেন্ট্রাল প্লাজা
@এখানেই বাস থামে
প্রায় দুটের দিকে শিলিগুড়ি পৌছুলাম, পৌছেই আমরা মানেভাঞ্জান যাবার উপায় খুজতে থাকলাম, একটা ছেলে এসে আমাদের দিলিপ দা'র সাথে পরিচয় করিয়েদিল, দিলিপ দা আমাদের বললেন মানেভাঞ্জানের উদ্দেশ্যে শেষ গাড়ি ছাড়ে ১২টায় এবং ভাড়া প্রায় ২০০রুপি প্রতি জন।
আমাদের কোন ইচ্ছা ছিলনা শিলিগুড়িতে থাকার, তাই দিলিপ'দা একটি টাটা সুমো গাড়ি রিজার্ভ করে দিল যার ভাড়া ২৫০০রুপি। দিলিপ’দা আমাদের পরামর্শ দিয়েছিল যে সেন্ট্রাল প্লাজার বিপরীতে ঢাকা হোটেল নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে যাতে খুব সস্তায় সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। কিন্ত আমাদের সাথে বিশেষ একজন থাকার কারনে সেন্ট্রাল প্লাজাতেই খেয়ে নিলাম, সুস্বাদু বলছি এজন্য যে ফিরে আসার সময় খেয়েছিলাম। আমরা খেয়েদেয়ে এসে দেখলাম আমাদের জন্য একটি টয়োটা সেন্ট্রিনো দাড়িয়ে আছে এবং কায়দা করে দিলিপ'দা এটার জন্য আরো অতিরিক্ত ২০০ রুপি বাগিয়ে নিল।
আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার - মিরিক থেকে তোলা
অবশেষে আমরা দুপুর আড়াইটার দিকে রওনা দিলাম মানেভাঞ্জানের উদ্দেশ্যে, সেদিন ছিল ২৬শে মার্চ।
শিলিগুড়ি'র রাস্তা ধরে কিছুদুর যাবার পরে আমরা একটি মিলিটারী এলাকার ভিতর রাস্তা ধরে চল্লাম, প্রথমে আমরা যাব মিরিক তারপরে শুকিয়া-পোখারী এর পর মানেভাঞ্জান। এখানে দেখলাম পাথুরে নদী থেকে ট্রাকের পর ট্রাক পাথর সংগ্রহ করছে, বাংলাদেশে যেমন বালু সংগ্রহ করে। আমরা একটু একটু করে উচ্চতায় আরোহণ করছি এবং আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের অস্বস্তিবোধের উপলব্ধি করছি - কিছুটা বমি বমি, এখানে বলে রাখা ভাল যে উচ্চতা আরোহণের ক্ষেত্রে কারো যদি একবার বমি হয় তাহলে সেটা তার জন্য 'রেড কার্ড' অর্থাৎ এর পর থেকে তাকে নেমে যেতে হবে। আমাদের নেপালী ড্রাইভার বেশ জোড়েই গাড়ি চালাচ্ছে এবং পাহাড়ী বাঁক গুলো ঘোরার সময় একটা রোমাঞ্চকর অনিভুতি হচ্ছিল।
@মিরিক লেক
@মিরিক পার্ক - এই মাঠে ইচ্ছেমত ঘোড়া চরতে পারবেন (ভাড়ায়)
@একটি স্কুল - ঠাণ্ডায় হাত কাঁপছিল তাই ভাল করে তুলতে পারিনি
@ কাঠের উপরে এমন সুন্দর করে রঙ দিয়ে লিখা যেন মনে হয় ফটশপ করা।
আমরা মিরিকে ১৫/২০ মিনিট থেমেছিলাম এবং আমার মনে হল মিরিকে আমার আর একবার আসতেই হবে কারন জায়গাটা খুব খুবই সুন্দর। মিরিকে আসার কিছু আগে থেকেই ঠাণ্ডাটা খুব জাঁকিয়ে বসা শুরু করেছিল, তাই মিনিকে নেমেই থারমাল গিয়ার পড়ে নিলাম। মিরিকে দেখার অনেক কিছু আছে কিন্তু সময় সল্পতা ছিল আর আমাদের নেপালি ড্রাইভার বার আব্র তাড়া দিচ্ছিল যে মানেভাঞ্জান থেকে তার একা একা আসতে হবে তাই তিনি বেশী রাত করতে চাচ্ছিলেন নাহ। মিরিকের মাঠ ঘুরে ঘুরে কিছু ছবি তুল্লাম, এক কোনায় দেখলাম কিছু বৌদ্ধ পুরহিত জড়ো হয়ে বসে বসে কি যেন করছে, আমি ছবি তুলতে গিয়েও বুঝতে পারলাম তোলা ঠিক না। মিরিকে একটি খুব সুন্দর লেক আছে তার ওপারে একটা বনভুমি, অনেকেই দেখলাম গাড়ি রিজার্ভ করে বেরাতে এসেছে এখানে – দেখে অধিকাংশই কলকাতার অধিবাসী মনে হল।
এখানে আমরা প্রায় ৬/৭ রকমের মস্ললা দিয়ে বানানো চা খেলাম, আমি আবার ঝালমুড়ি ও নিলাম, এখানকার ঝালমুড়ি ১০রুপি আর এর ভিতরে কি কি যে দিবে কিন্ত খেতে খুবই সুস্বাদু।
এখান থেকে আমরা ধীরে ধীরে আরো উপরে উঠে চা বাগানের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি এবং শীত'টাও তীব্র হচ্ছে। অবশেষে সন্ধার নামার সাথেই আমরা মানেভাঞ্জান পৌছুলাম, বলাবাহুল্য মানেভাঞ্জানের উচ্চতা ২১৫০ মিটার বা ৭০৫৪ ফিট আর শিলিগুড়ি'র উচ্চতা ছিল ১২২মিটার / ৪০০ ফিট - অর্থাৎ প্রথম দফাতেই আমরা প্রায় ২০২৮মিটার বা ৬৬৫৪ ফিট উঠে এসেছি 'সেন্টরিনো'তে করে এবং পথে আমার বমি্বমি আসাটাই স্বাভাবিক ছিল কারন এর আগে আমি কখনও এত উচ্চতায় উঠিনি।
যাহোক আমরা মানেভাঞ্জানের 'জীবন চিত্রে'র হোটেল এক্সোটিকা খুঁজে ওখানে গিয়ে উঠলাম। এখানে 'জীবন চিত্রে'র ব্যাপারে কিছু না বল্লেই নয়, সান্দাকফু ট্রেকিং এর আগে ইন্টারনেট সার্চ করে যত ব্লগ আর ফোরাম দেখলাম সবাই এই লোকটার কাছে যাবার পরামর্শ দিয়েছে, কারণটা একটু পরেই বুঝতে পারলাম।
একে উচ্চতা'র বমিবমি আর প্রচন্ড ঠান্ডা কিন্ত জীবন দাদা'র আন্তরিকতায় সবকিছু ভুলে গেলাম, শুধু জীবন দাদা না তার সহধর্মিনী আমাদের এমন আতিথেয়তা দিল যেন মনেহল আমার কোন খালা'র বাসায় এসেছি বেড়াতে।
জীবন চিত্রে
উনি বল্লেন উনিই আমাদের সব কিছু আয়োজন করে দিবেন, গাইড ম্যাপ ট্র্যাকিং রাউট ইত্যাদি। জিজ্ঞেস করলাম এত ঠান্ডা কেন, উনি বল্লেন এটা তো আমাদের সামার সিজন, শুনে হতহম্ব হয়ে আর কিছু বল্লাম না, মানেভাঞ্জানের রাস্তায় একটু ঘুড়াঘুড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম। একটা ফার্মেসিতে গিয়ে বমির ঔষধ চাইলাম, বমি শব্দটা উচ্চারণ করা মাত্রই ফার্মেসীওয়ালার চেহারার পরিবর্তনটা লক্ষ করলাম, সাথে সাথে বল্লাম যে আমার ডিজেলের ধুয়ার এলার্জি আছে, শিলিগুড়ি থেকে আসার সময় খারাপ লেগেছিল তাই একটা খেয়ে দেখি ভালো লাগে কিনা, মনে মনে ভয়ই পেয়ে গেলাম; কিনা-কি সন্দেহ করে আমাকে যদি আর উপরে উঠতে না দেয় ।
দিদি আমাদের খেতে ডাকলেন, গিয়ে একটা মজার জিনিস দেখলাম, খাবার শুরুতেই দুটো করে ডাল-কালোজিরা দিয়ে ভাজা পাপড় (আমার খুবই খুবই পছন্দের) এবং এটাই এই এলাকার খাবার রীতি, এর পরে সান্দাকফু হয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত যত জায়গা্য খেয়েছি সব জায়গায় খাবার আগে দুটো পাপড় ছিল।
সকালের মানেভাঞ্জান
খুব ভোরেই ঘুম ভাংলো, মজার বিষয় হচ্ছে এখানকার কাছের একটি প্রধান মন্দির থেকে ধর্মীয় গান মাইক দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়, গান গুলো শুনতে অনেকটা গজলের মত, শুনতে ভালই লাগে। বিছানা থেকে উঠে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করে ঠাণ্ডা টা এডজাস্ট করার চেষ্টায় পায়চারি শুরু করলাম।
জীবন দাদা এসে বল্লেন গরম পানি আছে গোসল করব কিনা, গোসল খানায় গিয়ে বুঝলাম গরম পানিটা আসলে নরমাল কারন যেখানে স্বাভাবিক টেম্পারেচার ১২ ডিগ্রি সেখানে ২৬ডিগ্রি’ই গরম পানি, অবশ্য শীত বেশী হবার কারনে পানি তারাতারিই ঠান্ডা হয়ে যায়।
আমাদের জন্য যে গাইড নির্ধারণ করেছেন জিবন’দা তার নাম 'নিমাহ' বয়স ৪২ এবং সান্দাকফু ফালুট ট্রেকিং এর ৬বার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সকালে জীবন দাদা'র ম্যাজিক দেখলাম, উনি হাতে হাতে একটি ম্যাপ একে দিলেন আমাদের সেখানে প্রতিটি শর্টকাটের চিহ্নিত করা এবং সঠিক দূরত্ব পরিমাপ করে দেয়া, একটা নিখুত মাষ্টার ম্যাপ, কোন সম্ভাব্য নয়, একদম অস্তিত্ব আছে সবগুলো ট্রেক উনি একে দিলেন দুরত্ব সহকারে।
আমাদের ট্রেকিং প্ল্যান ছিল মানেভাঞ্জান -> চিত্রে -> মেঘমা -> তংলু -> তুমলিং ->গাইরিবাস -> কালাপোখারী -> সান্দাকফু -> ফালুট ->রামাম -> রিম্বিক -> দার্জিলিং // উনি আমাদের মেঘমা থেকে গুরাসাই হয়ে তুমলিং যাবার পরামর্শ দিলেন কারন আকাশে পর্বতে অনেক কুয়াশা তাই তংলু থেকে কোনকিছু দেখার আশা নেই এবং রিম্বিক থেকে দারজিলিং যাবার রাস্তায় একটি ব্রিজ ভেঙ্গে গিয়েছে তাই ফিরে যাবার সময় এই মানেভাঞ্জান হয়েই যেতে হবে। উনাকে একটি লিভিং ব্রিদিং ট্রেকিং এনসাইক্লোপিডিয়া মেনে নিয়ে আমরা এস.এস.বি চেকপোস্টে আমাদের পাসপোর্ট নাম ইত্যাদি লিখে অনুমতি নিয়ে রওনা দিলাম আমাদের প্রথম ডেসটিনেশান ‘চিত্রে’র উদ্দেশ্যে।
চিত্রে:-
২৫০০মিটার / ৮২০২ ফিট - মানেভাঞ্জান থেকে প্রায় ৪০০মিটার / ১৩১২ ফিট উপরে এবং পুরোটাই পিচঢালা গাড়ির রাস্তা এঁকে-বেঁকে উপরে উঠে গিয়েছে। হাটিহাটি পাপা করে উথা শুরু করলাম, এক জায়গায় একটা মাইলস্টোনে লিখা আছে সান্দাকফু ৩১ কিলোমিটার, রাস্তাটা সমতল হলে কিছু বলার ছিল না কিন্ত এখান থেকে ঠিক যেমন ৩১ কিলো ঠিক তেমনি প্রায় আরো ১৬০০ মিটার উঁচুতেও। যাহক সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আসে পাশের পাহাড়ি প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে হাটা দিলাম।
চিত্রে যাবার রাস্তাটা অসম্ভব সুন্দর, পিচে ঢালা রাস্তা উঠে গিয়েছে পাইন বনের মাঝখান দিয়ে, একদম হলিউডের কোন ছবির মতো। হাঁটছি ছবি তুলছি আর ডানে বামে তাকিয়ে সুবাহানল্লাহ পড়ে পড়ে উঠে যাচ্ছি। ধিরে ধিরে কিছুদুর উঠার পরে নিচের দিকে একটু তাকিইয়ে দেখলাম মানেভাঞ্জান কে কত নিচে ফেলে উপরে উঠে এসেছি ( এটা এক প্রকার প্রশান্তি )।
@ বৌদ্ধ মনেস্ট্রি থেকে লজের দিকে হেঁটে যাচ্ছি
@ দোলমা দিদির লজে সেই অসাধারণ কফি
@ সেই জার্মান টিম
চিত্রে পৌছে দেখলাম এখানে একটি বিড়াট বৌদ্ধ মনেস্ট্রি রয়েছে - মনেস্ট্রির ভিতর দিয়ে আমরা একটা ট্রেকার্স লজে গিয়ে উঠলাম, এখানকার ট্রেকার্স লজ গুলো একাধারে রেস্ট হাউজ, ট্রেকার্স লজ এবং রেস্টুরেন্ট - এখানকার মজার বিষয়টা হচ্ছে আমরা যখন খাবার অর্ডার দিব ঠিক তখনই রান্না শুরু হবে এবং একদম ফ্রেশ খাবার পাওয়া যায়। এখানে দোলমা দিদি'র লজে আমরা কফি খেলাম, এখানেই পরিচয় হল দুই জার্মান ভদ্রলোকের সাথে, দুজনের বয়স আনুমানিক আমি ধরেছিলাম ৭০ এর কাছাকাছি - পরবর্তিতে ‘মেঘমা’তে গিয়ে পাসপোর্ট দেখানোর সময় একজন বলল তার জন্ম ১৯৩৩সালে - শুনে এস.এস.বি.'র দায়ীত্বরত কর্মকর্তারও চোখ কপালে।
লামেধুরা:-
চিত্রে থেকে আমি আমার পার্টনার রুবেল ভাই আর সেই দুই জার্মান মিলে আমাদের পরবর্তি ডেসটিনাশান লামেধুরা'র দিকে চল্লাম, যাবার পথে আমরা একটি শর্টকাট ফলো করলাম এবং এখানেই আমার একটু কষ্ট শুরু হল, ২৬০০মিটারের বেশি উপরে বাতাসের অক্সিজেন পরিমান হয়ত একটু কম, বুক ভরে শ্বাষ নিচ্ছি কিন্ত ফুসফুস ভরছেনা, একটু বমিবমি আর দুর্বলও লাগছিল - একদম পার্ফেক্ট অলটিচিউড সিকনেস এর লক্ষণ - মনদিয়ে শরীরের উপরে জোড় খাটালাম, প্রিয় গান গুলো মোবাইলে লাউড স্পিকারে দিয়ে ছেড়ে দিলাম আর আস্তে আস্তে একটু একটু করে উঠতে থাকলাম, লামেধুরার একটু আগে গিয়ে রুবেলভাই আর জার্মান দের পেলাম, ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এর পর অবশ্য সিকনেসটা চলেগিয়েছিল এবং সাবলীল ভাবেই ট্রেকিং করেছি।
লামেধুরা যাবার রাস্তাতে অনেক গুলো শর্টকাট দেখলাম, গুগল ম্যাপে এই রাস্তাগুলোকে বিপদজনক আখ্যায়িত করা হয়েছে লাল দাগ দিয়ে, কিন্ত হাঁটতে গিয়ে দেখলাম রাস্তার ব্যাস প্রায় ৩ফিট আর রাস্তার উপরিভাগ পাথর দিয়ে বাঁধানো।
@ এই সেই ক্যান্টিন / লজ যেখানে প্রথম চিয়মিন খেয়েছিলাম আর এর বাইরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন হার্ড ড্রিঙ্কস - ভুলেও ট্রেকিং এর সময় এগুলো খাবেন না, কোথায় কোন চিপায় ১০০০ফিট নিচে পড়ে মরে থাকবেন কে জানে।
@ আমাদের গাইড নিমাহ * পিছনে লাল জামা - সামনের জন জার্মানদের গাইড - এখানে ব্যাগ থেকে থার্মাল গিয়ার পরে নিচ্ছি কারন থামলেই ঠাণ্ডা।
লামেধুরা পৌছে দেখলাম আরো এক বিশাল জার্মান ট্রেকিং টিম এবং একটা সুইডিশ টিমও রয়েছে, এবং এখানেই আমরা চিয়মিং দিয়ে লাঞ্চ করলাম।
এখানেই প্রথম টের পেলাম যে হাঁটতে থাকলে একটা গরম ফুল স্লিভ করে থাকলেই হয়, ঘামে - শরীরের গরমে চলার পথে ঠাণ্ডাটা এততুকু অনুভব হয় না, কিন্ত যেই মাত্র লামেধুরার ক্যান্টিন লজের সামনে ব্যাকপ্যাক খুলে দাড়ালাম অমনি কনকনে ডিপ ফ্রিজের ঠাণ্ডা জেঁকে ধরল। লজের ভিতরে আমাদের থারমাল গিয়ার পরে কাঁপতে কাঁপতে ‘চিয়মিন’ আর কফি খেয়ে রওনা দিলাম মেঘমার উদ্দেশ্যে। হেঁটে কিছুদুর যাবারপর আবার থারমাল গিয়ার ব্যাগে ভরে আবার ফুল স্লিভ পরে হাঁটা।
মেঘমা:- ২৬০০ মিটার / ৮৫৩০ ফিট
মেঘমা যাবার রাস্তায় অনেক গুলো স্ট্যান্ডবাই শর্টকাট আছে, এই শর্টকাট গুলো প্রধান গাড়ি চলার রাস্তাকে ঘিরেই, কিন্ত জিক-স এর কৌণিক দূরত্বটাকে অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দেয় আর উচ্চতায় ও একটু খাড়া তাই দুরত্বটা কমলেও কষ্টটাদিয়ে পুষিয়ে যায়! মেঘমা নাম দেয়ার কারনটা মেঘমা এসে বুঝলাম, একেবারে মেঘের ভিতরে আমরা ট্রেকিং করছি এবং ১০ফিট দুরত্বের বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না, এখানে দ্বিতীয় এস.এস.বি. চেকপোস্ট এবং এখানেই ঐ জার্মান ট্রেকার দের বয়স জানতে পারলাম।
@ লজের বাইরে
@ লজের ভিতরে
মেঘমাতে একটি লজে আমরা কফির অর্ডার দিলাম, বলাবাহুল্য আমরা মানেভাঞ্জান থেকে অনেক চকলেট নিয়ে এসেছিলাম, আর আমি শ্রাদ্ধ শুরু করলাম, একটি কিটক্যাটের মোড়ক খোলার সাথে সাথেই এক আমেরিকান তরুন বলে উঠল, আমার মেয়ে যদি দেখে তোমার হাতের চকলেট তাহলে কেড়ে নিয়ে যেত', আমি বল্লাম আমার কাছে অনেক আছে, ওর মেয়ে আসল এবং রুবেল ভাই তাদের চোকোলেট দেয়া মাত্রই পিচ্চি মেয়েটা (বয়স আনুমানিক ১৩) আনন্দে লাফিয়ে উঠল। এর মাঝে ঐ দুই জার্মান আবার ম্যাপ নিয়ে বসেছে, আমি একটু উস্তাদির লোভ সামলাতে না পেরে ওদের এক আধটু গাইড দেয়া শুরু করলাম, এর মাঝে রুবেল ভাই জীবন দাদা'র হাতে আঁকা ম্যাপটা বের করল, আর যায় কোথায়, আশেপাশের সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল, কারন সবার কাছে গুগলের সার্চ করা ম্যাপ যেটায় কোন ডিটেইল নেই, কিন্ত এটায় সব শর্টকাট দেয়া দূরত্ব সহ।
তুমলিং:- ২৬০০ মিটার / ৮৫৩০ ফিট
মেঘমা থেকে তুমলিং যাবার দুটো রাস্তা আছে, একটা তংলু হয়ে তুমলিং আর একটা গুরাসাই হয়ে তুমলিং - তংলু'র উচ্চতা ৩০৭০ মিটার এবং কেউ কেউ বলে এখান থেকে কাঞ্চনঝঙ্গা আর এভারেস্ট সান্দাকফু'র চাইতেও নাকি ভালো আর স্পষ্ট দেখা যায়, কিন্ত যেখানে কুয়াশা আর মেঘে ঢাকা আবহাওয়াতে দশফিট দূরত্বে'র জিনিস দেখতে কষ্ট হয় সেখানে তংলু দিয়ে যাবার কোন মানে হয়না, সর্বোপরি গুরাসাই দিয়ে গেলে ৫/৭ কিলো রাস্তা সেইভ হয়। তবু প্ল্যান রেখেছি আবার যদি কখনো আসি তাহলে ভাল আবহাওয়াতে তংলু হয়েই যাব কারন ইউটিউবে দেখলাম কলকাতার কিছু ট্রেকারস এ রাস্তা দিয়ে গিয়ে খোদ সান্দাকফুর চাইতেও কিছু ভাল ছবি তুলেছে কাঞ্চনঝঙ্গার।
@ সেই বাবা আর মেয়ে - তার আগে রুবেল ভাই আর সবার আগে আমাদের গাইড নিমাহ - লাল জামা
@ এই লজেই কফি খেয়েছিলাম - এখানে হাই-কমোডও পাবেন
মেঘমা থেকে জৌবাড়ি যাবার পথে মেঘ এমনভাবে চেপে ধরল যে লেন্সে ফাংগাস পড়ে যাবার ভয়ে আর ক্যামেরা বের করা বন্ধ করে দিলাম, জৌবাড়ি পার হয়ে তুমলিং এর পথে সেই আমেরিকানের সাথে আবার দেখা, এইবার তার কাছে কিছু জানার চেষ্টা করলাম, তার বৌ হল কলকাতার অরিজিন কিন্ত জন্মসুত্রে আমেরিকান, তাই তার বৌ তার মেয়েকে আর স্বামীকে একপ্রকার নাড়ী'র টানেই এখানে ট্রেকিং করতে নিয়ে এসেছে।
মেয়েটা ওর বাপের হাত ধরে হাঁটছিল, আমি চিন্তা করলাম বাংলাদেশের বাপ গুলা কি করে, নিজেরা ত ভ্রমণ করবেই না উল্টা সন্তানদের করতেও দিবে নাহ, আর এদিকে ৮৩বছর বয়সীরাও ট্রেকিং করছে আর আমরা ৩০ পেরুলেই শেষ।
অবশেষে তুমলিং পৌছালাম, এখানে এসে দেখলাম ট্যুরিস্ট হসপিটালিটি কাকে বলে, বসা মাত্র পাপড় আর কফি, আর টয়লেটে তো হাই কমোডও পেলাম। সান্দাকফু আসার আগে প্ল্যান করে ছিলাম যে এখানেই আমরা রাত কাটাব অর্থাৎ ২৬শে মার্চ মানেভাঞ্জান ২৭শে মার্চ তুমলিং, কিন্ত দিনের অলো এখনও ৩/৪ ঘন্টা বাকি। বাংলাদেশ থেকে রওনা দেবার আগে **** ভাইকে একবার ফোন কোরে বল্লাম **** ভাই আমরা প্রথম দিনেই গাইরিবাস চলে যাতে পারবো কিনা, **** ভাই একটা রিতিমত তিরষ্কারের ফ্লেভারে অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বললেন হা: হা: হা: ফারুক . আগে যাও পরে বুঝবা - উনি ইতিপুর্বে ৩/৪ বার গিয়েছেন কিন্ত তাই বলে এভাবে অবজ্ঞা করাটা খুব লেগেছিল তাই তুমলিংএ যদি সন্ধাও হয়ে যেত তাহলেও আমারা গাইরিবাস গিয়েই ছাড়তাম। ধন্যবাদ মুনতাসির মামুন ভাইকে যিনি প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বলেছিলেন একদিনে গাইরিবাস কেন কালাপোখারিও যাওয়া যাবে, শুনে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
আমার অনুরোধ, ট্রেকিং এ কেউ কখনও কাউকে অবজ্ঞা না করে উৎসাহ দিবেন তাহলেই অসম্ভবটা সম্ভব হবে।
গাইরিবাস:-
২৯৭০মিটার থেকে নেমে ২৬২১ মিটারে অবস্থিত গাইরিবাস এ নেমে এলাম এবং এর পর ও প্রায় ২ ঘন্টা ট্রেকিং করার আলো ছিল। গাইরিবাস এ ট্রেকিং লজ খুব বেশী নেই আর এস.এস.বি.'র একটা ক্যাম্প আছে। আমরা পৌঁছাবার পর প্রায় ২ ঘণ্টা দিনের আলো ছিল এবং পরে ভেবেছি যে দ্বিতীয়বার আসলে এখানে না থেমে পরের ডেস্টিনেশান কাইয়াকাঠা কিংবা কালাপোখারি চলে যেতে পারব। পুরা একটা চারজনের ডরমেটরিতে দুজন লেপ কম্বল ডাবল রিডাবল করে ডিনারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
বলাবাহুল্য হাতমুখ ধুতে গিয়ে টের পেলাম পানি বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা। যথারীতি ডিনার করেই ঘুম, এখানে আমি ৪টা পাপড় খেয়েছিলাম।
@ এই লজেই আমরা ছিলাম এবং এই লজের ঠিক বিপরিত দিকেই এস এস বি ক্যাম্প
@ এই সেই ভয়াল দর্শন নেকড়ে টাইপ কুকুর - অথচ কি তার ভাবের আদর
পরদিন সকালে গাইরিবাস এ কতগুলো পাহাড়ি কুকুরের সাথে পরিচয় হল, এরা দেখতে পুরা ভয়ঙ্কর সাইবেরিয়ান নেকড়ের মত কিন্ত আন্তরিকতায় একদম ট্যুরিস্ট ভক্ত, আপনার সাথে সাথে হাঁটবে ভাব নিবে খেতে দিলে খাবে মনে হবে কতদিনের পরিচয়। এখান থেকেই আমরা সিংগারিলা ন্যাশনাল পার্কের টিকিট কেটেনিলাম এবং নাস্তা না খেয়েই রওনা দিলাম।
কাইয়াকাঠা:-
মানেভাঞ্জান থেকে যেমন খাড়া ৪০০ মিটার উঠে চিত্রে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনি গাইরিবাস ২৬২১ মিটার থেকে খাড়া ৪০০+মিটার উঠে কাইয়াকাঠা।
আগে জানলে রাত এখানেই কাটাতাম, এবং এই উঠার পথেই প্রথম দেখি রডোডেন্ড্রানের প্রাকৃতিক বাগান, ঝাকে ঝাকে রডোডেন্ড্রান ফুল। বলাহাহুল্য আমি যে এই লিখাটা লিখছি এভাবে তত্থ্য দিয়ে কোন লিখা আমি পাইনি বা আগে গিয়েছে কিন্ত তথ্য শেয়ার করেনি কি অজান্তে।
@ সাইনবোর্ড
@ এই লজের সামনে বসেই রোদ পোহানো
@ এই সেই সুস্বাদু স্যুপ
যাইহোক, সকালে না খেয়ে গাইরিবাস থেকে এসেছি, খুদা ছিল প্রচুর, তাই যখন একটা নুডুলসের স্যুপ বাটিতে করে দিল আমরা হাপুস - হুপুশ করে খেলাম আর স্বাদটা ছিল অসাধারণ - সত্যি সত্যিই অসাধারণ। এখানে বসে আমরা কিছুক্ষন বিশ্রাম করে আবার রওনা দিলাম কালাপোখারি’র উদ্দেশে।
কালাপোখারিঃ-
৩১৮৬ মিটার / ১০৪৫২ ফিট
কাইয়াকাঠা থেকে কালাপোখারি’র রাস্তাটাই বোধয় পুরো ট্যুর এ সবচাইতে ভাল রাস্তা কারন এটা পুরটাই সমতল এবং উঠানামা খুবই সামান্য।
কালাপোখারি পোঁছে আমরা প্রথমে এস এস বি ক্যাম্পে আমাদের পাসপোর্ট নাম চেকইন করে গাইডের পছন্দের একটি ট্রেকার্স লজে উঠলাম।
@ এই সেই পবিত্র পানির আধার বা কালা পোখারি - এটা এই এলাকার লোকদের পবিত্র স্থান এবং পূজনীয় এলাকা।
@ কি নাই এই সমস্ত লজে !
এখানে দেখলাম আরও বেশ কিছু ট্রেকারস লজ আছে – একটাতে ত টাটা স্কাই এর ডিস এন্টেনাও দেখলাম। রান্না হতে হতে এস এস বি থেকে একজন লক এসে আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলতে লাগলো – কলকাতার সবাই বুঝি সবাইকে তুমি করে বলে । সে তার এসএসবিতে জয়েন করার আগে পরে ২৪ পরগনা থেকে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে এসে যাত্রা পুজো ইত্যাদি অনুষ্ঠান দেখতে চলে আসার কাহিনী বলতে লাগলেন, এশিয়া কাপে ওরা নাকি বাংলাদেশ কে সাপোর্ট করে ছিল এবং আমাদের সাথে খেলার শেষে ওরাও নাকি কেঁদেছিল – ঠিক একই কথা অবশ্য বলেছিলেন মানেভাঞ্জানের এস এসবি তে যিনি প্রথম আমাদের নাম এন্ট্রি করেন – আমরা কি করি না করি এসব জানার সাথে সাথে তাদের অনুভুতি গুলোও তারা প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না।
এখানকার থাকার ব্যাবস্থা অসাধারন এবং সেই আবার প্ল্যান করলাম যে পরবর্তীতে গাইরিবাস না থেকে এখানেই চলে আসব। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে বিখেভাঞ্জানের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
বিখেভাঞ্জানঃ-
৩৩৫০ মিটার / ১০৯৯১ ফিট
কালাপোখারি থেকে বিখেভাঞ্জানে যাবার পথে আরো কতগুলো স্টপেজ পড়ে যেগুলর নাম মনে পড়ছেনা তবে বিখেভাঞ্জানের ঠিক আগের একটা পাড়া থেকে একটা মুরগি কিনে নিয়েছিলাম। বিখেভাঞ্জান থেকে সান্দাকফু’র তিনটি রাস্তা রয়েছে, একটি নেপাল হয়ে, একটি গাড়ির রাস্তা আর একটি হচ্ছে গাড়ীর রাস্তার মাঝে কৌণিক দূরত্বের শর্টকাট। আমরা গাড়ীর রাস্তা দিয়েই হাটা শুরু করলাম, কারন এই রাস্তাটা অনেকটা জায়গায় খাড়া উঠে গেলেও চওড়া অর্থাৎ গাড়ি চলার মত প্রসস্থ হয়ায় একটু মনস্তাত্ত্বিক ভাবে নিরাপদ।
সান্দাকফুঃ-
৩৬৩৬মিটার / ১১৯২৯ ফিট
বিখেভাঞ্জান থেকে খাড়া উঠতে উঠতে মাঝে মধ্যেই আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম আর ক্ষণে ক্ষণে দেখছিলাম সান্দাকফু দেখা যায় কি না। আমি যখন সান্দাকফুর ট্রেকার্স লজের মাথাতা দেখলাম তখন নিমাহ কে ডেকে বললাম ঠিক এটার জন্যই এত কষ্ট করে আসা। রাস্তাটা খুবই খাড়া এবং আমি আনোয়ার ভাই এর শেখানো সিস্টেমে ট্রেকিং করে যাচ্ছি, এবং ধিরে ধিরে সাবলীল ভাবেই উঠে যাচ্ছি। ঠিক সান্দাকফু’র মাথায় উঠে আমি কিছুক্ষণ হু-হা করে দেখি রুবেল ভাই এখনও পৌঁছায়নি। আমি গাইড কে পাঠালাম একটু নিচে নেমে দেখে আসতে কি হয়েছে, বেশ কিছুক্ষণ পরে রুবেল ভাই পৌঁছাল অনেকটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
জানতে পরলাম সান্দাকফু উঠার ঠিক আগের খাড়া ঢালে হাটার সময় ডান পায়ের’র পেশিতে টান পড়ে প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়ে ধিরে ধিরে উঠে এসেছেন।
এই সেই স্বপ্নের সান্দাকফু ...
সান্দাকফু উঠেই আমার প্রথম অনুভুতি হল – আমি মাত্র দিপ-ফ্রিজের দরজা খুললাম এবং ১৮০কিমি বেগে সেই ঠাণ্ডা বাতাস আমার উপরে ব্যে যাচ্ছে। ঠাণ্ডাটা স্থির থেকে কিছুটা মকাবিলা করা যায় কিন্ত ১৮০কিমি বেগে বাতাসের সাথে যদি আসে তাহলে এটা কি ভয়ঙ্কর হতেপারে তা বলে বোঝানো সম্ভব না। কিন্ত আশ্চর্য আমি সব কিছু আনুভুতি ছাপিয়ে সান্দাকফু’র চুড়ায় উথা শুরু করলাম এবং সান্দাকফু উঠার মুল উদ্দেশ্য ‘কাঞ্চনঝঙ্গা’ আর এভারেস্ট দৃষ্টি দিয়ে খুজতে থাকলাম, কিন্ত আবহাওয়া এতটাই খারাপ যে ৩০সেকেন্ড পর পর মেঘ আর কুয়াশা এসে দৃষ্টি সীমা ১০ফিটে এনে দিচ্ছ।
আমাদের গাইড নিমাহ আমাদের জন্য সস্তায় একটি সরকারি ক্লাস সি লজ ভাড়া করল এবং আমি আর রুবেল ভাই চেকিন না করেই লজের রুমে ঢুঁকে গেলাম।
রুমে ঢুঁকে বুঝতে পারলাম বাইরের চাইতে ভিতরে ঠাণ্ডা বেশি কেন জানি, হয়ত এটা মনের বাতুলতা। এখানে আমার পয়েন্ট এন্ড শুট কোডাকের কামেরাটা আর চালুই হলনা, কিন্ত আমার ডি ৫১০০ তা ঠিক কাজ করছে। এখানে কাপড় চেঞ্জ করে চেকিং করে আবার চুড়ার কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করতে থাকলাম যদি কাঞ্চনের দেখা মিলে। প্রায় ৩০ মিনিট সেই ১৮০কিমি বেগের ডিপ ফ্রিজের বাতাসে থেকে পরিশেষে আজ আর কাঞ্চন দেখা কপালে নেই মেনে নিয়ে আমাদের লজে ফিরে এলাম।
বিখের আগে কিনে নেয়া মুরগিটা এবার লজের কেয়ারটেকার কে দিয়ে রান্না করতে বললাম, শুনে সে বলে সে এটা কাটতে পারবে না, (বৌদ্ধ)।
আমি আর রুবেল ভাই জবাই করে রুবেল ভাই মুরগিটা পুরা টুকরো টুকরো করে দিল রান্নার জন্য। রাতে সেই মুরগী দিয়ে ডিনার করে ডাবল-রিডাবল কম্বল দিয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুম। প্ল্যান ছিল পরদিন সকালে খুব ভোরে উঠে দারিয়ে থাকব মনি-কাঞ্চনের প্রত্যাশায়।
পর্ব – ২
সান্দাকফুর সকালঃ-
রাতে ডাবল লেপ আর কম্বলে চেপে এমন যবুথবু প্যাক্ট হয়ে ঘুমিয়েছিলাম যে শোয়া অবস্থায় এপাশ অপাশ ও করিনি ঠিকমত পাছে যদি কোল্ড-প্রোটেকশান ভেঙ্গে যায়! একবার শুধু মনেপরে ‘পি’ করার জন্য বাধ্য হয়ে ছিলাম উঠতে, আল্লাহ - এত ঠাণ্ডা বরফ না পরেই বরফ পড়লে নাজানি ক্যামন হত, এই চিন্তা করতে করতে কাজ সেরে আবার লেপ-কম্বলের ক্রিমরোলে সেঁধিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙ্গা মাত্রই সচেতন হয়েই জানালার দিকে তাকালাম সূর্যের আলোর প্রত্যাশায়, সূর্যের আলো পাইনি কিন্ত পরিষ্কার আবহাওয়ার পরিস্কার আলোর দেখা পেলাম।
গাইড এসে আমাকে জাগা দেখে বলল এখনই সময় সান্দাকফুর উপর থেকে সূর্যদয় দেখার, আমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেলাম ১১৯২৯ ফিট থেকে সূর্যদয় দেখার জন্য। বলাবাহুল্য রুবেল ভ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।