পূর্ব ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডে ক্রমেই মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে। এদের মধ্যে অধিকাংশ অভিবাসী হলেও আদিবাসীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ১৮৭০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রথম সৈনিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে ফিনল্যান্ডে আগমন করে। পরে উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও সাবেক যুগোশ্লাভিয়া থেকে মুসলমানরা এখানে এসে আলাদা কমিউনিটি গড়ে তোলেন। সংখ্যায় কম হলেও মুসলমানদের শিকড় এ দেশের গভীরে প্রোথিত।
মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনাচার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে বহু ফিনস ইসলাম কবুল করেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাম্প্রতিককালে প্রতি বছর ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা গড়ে এক হাজার, যাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা বেশি। পরে তারা মুসলমান ছেলেদের বিয়ে করে সংসার পাতেন। মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি তত্পরতা পরিচালিত হয় ফিনল্যান্ডে। বড় বড় মসজিদের সঙ্গে পাঠাগার, কমিউনিটি হল, পবিত্র কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র সংযুক্ত।
আল-ঈমান মসজিদ ও দাওয়াহ সেন্টারে মহিলাদের নামাজ আদায়ের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে মুসলমানদের অবদান ব্যাপক। কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের শ্রমবাজারে মুসলমান শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার স্বীকৃত।
ফিনল্যান্ড পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংসদীয় গণতন্ত্র এ দেশের সুস্থ রাজনীতির মূল চাবিকাঠি।
এর পশ্চিমে রয়েছে সুইডেন, উত্তরে নরওয়ে, পূর্বে রাশিয়া ও দক্ষিণে এস্তোনিয়া। ফিনল্যান্ডকে বলা হয় হ্রদের দেশ। ছোট-বড় প্রায় ১,৮৭,৮৮৮টি হ্রদ নিয়ে ফিনল্যান্ড গঠিত। দেশের ৮৬ শতাংশ ভূভাগ বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়েও ফিনল্যান্ডের অবস্থান বেশ উঁচুতে।
হুপার হাঁসসহ ২৪৮ প্রজাতির পাখি রয়েছে এখানে। প্রায় ৫৪ লাখ জনঅধ্যুষিত এ ভূখণ্ডটি আয়তনের দিক দিয়ে রয়েছে ইউরোপ মহাদেশে অষ্টম স্থানে। হেলসিঙ্কি এর রাজধানী। ট্যামপেরে, টুর্কু, অউলু, জাইভাসকিলা, লাহতি ও কুউপিও ফিনল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য শহর। ৩৩৬টি পৌরসভা নিয়ে স্থানীয় সরকার গঠিত।
কৃষিনির্ভরশীল হলেও এদেশ ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বের ধনী দেশের মধ্যে ফিনল্যান্ড অন্যতম। ১৮০৯ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এ দেশ ছিল রাশিয়ার অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। অবশেষে ১৯১৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। বৈশ্বিক আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মেলবন্ধনরূপে ফিনল্যান্ডের ভূমিকা ব্যাপক।
সাম্প্রতিক সময়ে ফিনল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপূর্ণ ও বাসযোগ্য দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ফিনিস ও সুইডিশ হচ্ছে সরকারি ভাষা। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ফিনিশ ভাষায় কথা বলে। ৬৩ শতাংশ ইংরেজি ভাষা জানে ও বুঝে।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মচর্চা, ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ ও ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে এদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ লুথেরান গির্জার অনুসারী। পৃথিবীর সর্ববৃহত্ এভানজেলিক্যাল লুথেরান গির্জা এখানে অবস্থিত। এদেশে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। ধর্মচর্চা অব্যাহত রাখার স্বার্থে মুসলমানরা ফিনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ করেন। বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গঠিত হয় ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন ইন ফিনল্যান্ড’।
সোমালি, আরবি, আলবেনি, কুর্দি, বসনীয়, তুর্কি ও ফার্সি ভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী এখানে ইংরেজি ও ফিনিশীয় ভাষায় কথা বলেন। অবশ্য মসজিদে ধর্মীয় আলোচনা আরবিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হেলসিঙ্কি ইসলামিক সেন্টার সর্ববৃহত্ সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। ইসলামিক সোসাইটি অব ফিনল্যান্ড আরব বংশোদ্ভূত মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন। ১৯৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফিনিশ ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন এদেশের সবচেয়ে পুরনো সংগঠন। ১৯৫৫ সালে এর যাত্রা শুরু, সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭শ’। এ সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় হেলসিঙ্কি, ট্যামপেরে, টুর্কু, অউলু, জাইভাসকিলা, লাহতি প্রভৃতি অঞ্চলে রয়েছে বহু মসজিদ। হিজাব পরিধানের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হেলসিঙ্কির বিদ্যালয়ে, রাস্তা-ঘাটে ও শপিংমলে ইসলামী পোশাক পরা মেয়েদের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করার মতো।
মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হালাল খাদ্যের দোকান গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক চমত্কার। ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন পৌর নগরীর মসজিদে কর্মরত ৫০ জন ইমামকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ইসলামিক সোসাইটি অব ফিনল্যান্ড। ইমামরা নিজ নিজ দেশে স্বীয় কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ শেষে এদেশে আসার কারণে ফিনিশ সোসাইটির সঙ্গে অনেকে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হন। সোসাইটি মনে করে, ফিনল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিলে ইমামদের চিন্তা-চেতনা ও সামাজিক আচরণে এক ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ ঐক্য গড়ে উঠবে।
ফিনল্যান্ডের কোথাও কোনো মাদরাসা নেই। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের সন্তান-সন্ততিদের পারিবারিক পরিসরে অথবা মসজিদকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় ধর্ম শিক্ষা প্রদান করে থাকেন। স্কুল পর্যায়েও ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
কোনো অঞ্চল বিশেষে যদি মুসলমান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তাহলে সরকারি অনুমতিক্রমে স্থানীয় বিদ্যালয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। ১১টি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদের ধর্মশিক্ষার জন্য সরকার অনুমোদিত পৃথক সিলেবাস রয়েছে।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবদীক্ষিত ফিনিশ মেয়েরা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকায় ইসলাম ধর্ম শিক্ষা প্রদান সহজতর হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারি স্কুলে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে টেক্সট বই বের করে প্রতি বছর। হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। এ বিভাগ থেকে কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
মিডিয়ার বৈরী প্রচারণা যে নেই, এমন নয়।
‘ইসলাম আতঙ্ক’ ছড়ানোর প্রয়াসও লক্ষণীয়। কিন্তু সত্যের জয় অবধারিত। ৯/১১ এর পর থেকে ফিনল্যান্ডের সাধারণ জনগণের মাঝে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু মানুষ ইসলামিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে লাইব্রেরি থেকে ধর্মীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করছেন। আরবি টেক্সটসহ ফিনিশ ভাষায় রচিত পবিত্র কোরআনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
বিশ্বের মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে ফিনল্যান্ডে মুবাল্লিগ, শিক্ষক ও ধর্মীয় স্কলার প্রেরণ করে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে সুনিশ্চিত করা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।