আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার বিরুদ্ধে নারী মহাসমাবেশের যুক্তি কি?

বাংলাদেশ পৃথিবীতে একটিই। আর আমি একজন বাংলাদেশী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর ১৩ দফার বিরুদ্ধে ২৭ এপ্রিল নারী মহাসমাবেশ করবে কিছু নারী সংগঠন। কিন্তু তাদের যুক্তি কি? হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায় কি নারীদের জন্য ক্ষতিকর কোন দফা আছে? নাকি এটা স্রেফ ইসলাম বিরোধিতা ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পথ? হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর ১৩ দফার ২টি দফা নারী সংক্রান্ত। কি আছে তাতে? নিম্নে উক্ত দফা দুটির হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা এবং দৈনিক ইত্তিফাকে নারীনেত্রী ও সংগঠক "ফরিদা আখতার" এর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হল - দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী জাতির সার্বিক উন্নতির বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে তাদের নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থল, সম্মানজনক জীবিকা এবং কর্মজীবি নারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘরে-বাইরে ও কর্মস্থলে নারীদের ইজ্জত-আব্র“ ও যৌন হয়রানী থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক হিসেবে পোষাক ও বেশভূষায় শালীনতা প্রকাশ ও হিজাব পালনে উদ্বুব্ধকরণসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং একই লক্ষ্যে নারী-পুরুষের সকল প্রকার বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে অবাধ ও অশালীন মেলামেশা, নারী-নির্যাতন, যৌন হয়রানী, নারীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহিংসতা, যৌতুকপ্রথাসহ যাবতীয় নারী নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। ব্যাখ্যা: তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাস্তিক্যবাদি ব্লগাররা শুধু আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেই থামেনি। সাথে সাথে আবহমান বাংলার রক্ষণশীল সামাজিক অনুশাসন এবং সংস্কৃতির উপরও আঘাত করে অনেক কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে। বিয়ে বহির্ভুত ও ঘনিষ্ঠ অনাত্মীয় নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটু বিচরণ ও রাস্তায় একঙ্গে; এমনকি একই তাবুতে অবস্থান করে রাত্রি যাপনের মত অনৈসলামিক, অনৈতিক, অসামাজিক ও এদেশের আবহমান কৃষ্টিকালচার সংস্কৃতি বিরোধী কাজ প্রকাশ্যে ঘটছে শাহবাগে।

ধর্মীয় অনুভূতি ছাড়াও যা পারিবারিক, সামজিক এবং জাতীয় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিতেও কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শাহবাগে যে কালচারের চর্চা চলেছে ও চলছে, তা দেশে চালু হলে নারীদের নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রেই বিঘœ হবে। দেশের নারী সমাজকে ইভটিজিং, ধর্ষণ ও যৌনহয়রানী থেকে বাঁচিয়ে রেখে সর্বোপরি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই উপরোক্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ইসলাম নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং যৌনহয়নারী থেকে বেঁচে থাকার জন্য হিজাব প্রথা বাধ্যতামূলক করেছে এবং পুরুষদেরকেও বৈধ সম্পর্কের বাইরে নারীদের সাথে দৃষ্টি অবনত রেখে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে বলে চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা করেছে। কাজেই হিজাব পালন করে, অথবা যৌন উদ্দীপনা তৈরী করে না- এমন শোভনীয় পোষাক পরে নারীরা নিরাপদ কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে বা ঘর থেকে বের হতে তো কোন বাধা নেই।

ইসলাম নারীর নিরাপত্তার দিকটা কঠোরভাবে দেখে। কেবল সুযোগসন্ধানীরাই এটাকে নারী অবদমন বলে অপপ্রচার চালায়। আমাদের কথা পরিস্কার যে, হিজাব বা শালীনতার সাথে নারীদের নিরাপদ পথ চলাচল, শিক্ষার্জন ও কর্মক্ষেত্রে যেতে কোন বাধা নেই। উদাহরণতঃ নারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য আলাদা বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ থাকতে পারলে আলাদা কর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে আপত্তি তোলার যুক্তি থাকতে পারে না। নারীনীতি ও শিক্ষানীতির ইসলাম বিরোধী ধারা ও বিষয়সমূহ বিলুপ্ত করতে হবে এবং শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলামের মৌলিক শিক্ষা মুসলিম ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে।

ব্যাখ্যা: ত্যাজ্য সম্পত্তিতে সমঅধিকারের আইনসহ নারী নীতির পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ধারাগুলোই আমরা সংশোধনের দাবী করছি। এছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক বিতর্কিত সিডো সনদ বাতিলের দাবী জানাচ্ছি। এই সিডো সনদের বিরুদ্ধে খ্রীস্টানদের ধর্মীয় নেতা পোপ ও ভ্যটিকানসহ অনেক মুসলিম ও খ্রীস্টান দেশ আপত্তি জানিয়েছে। এই সিডো সনদ কার্যকর হলে পারিবারিক ব্যবস্থা বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এই বিতর্কিত সনদে বিয়ে বহির্ভুত অবাধ যৌনাচারের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে সন্তানের পিতৃ পরিচয় বিলীন হয়ে যাবে।

আমরা নারী সমাজকে স্পষ্ট করে জানাতে চাই, ইসলাম সর্বোত্তম উপায়েই নারীদের মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার পক্ষে। আর বর্তমানের নাস্তিক্যবাদিরা নারীদেরকে কেবল অলংকারিক ও ভোগ্যপণ্য রূপেই বিবেচনা করে। অন্যদিকে সরকার ঘোষিত শিক্ষা নীতিতে ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকোচিত করা হয়েছে। এখানে ধর্ম শিক্ষা রাখা হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মন ও মননে ধর্মহীন করার জন্য কুটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। চলতি ২০১৩ সালের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য বইসমূহে ইসলামের যে অপব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে, তা চরম অগ্রহণযোগ্য।

তাছাড়া কোমলমতি ছেলে-মেয়ে শিশুদেরকে কাছে একসাথে বসিয়ে যেভাবে যৌন শিক্ষা চালু করা হয়েছে, তা এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিকতা ও সুস্থ সামাজিক অনুশাসনকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। মানুষকে যাবতীয় পশুপ্রবৃত্তি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যায়-অপরাধ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে ধর্মশিক্ষা বা ধর্মীয় অনুভূতির বিকল্প নেই। এ কারণে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ থেকেই আমরা দাবী জানিয়ে আসছি যে, শিক্ষার সকল স্তরে সঠিক ধর্ম শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইসলাম সবসময় অন্যায়, অবিচার, ঘুষ-দূর্নীতি, মদ-জুয়া, মিথ্যা, খুন, ধর্ষণ, মারামরি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখে। সুতরাং সুস্থ মানসিকতাপূর্ণ আদর্শ নাগরিক গঠনে ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প কিছু হতে পারে না।

হেফাজতের ১৩ দফা ও 'নারী নীতি' নিয়ে বিভ্রান্তি - ফরিদা আখতার আমি যতদূর জানি হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইছে; কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চকেও তারা গ্রহণ করতে পারছে না। হেফাজতে ইসলাম 'নাস্তিক' ব্লগারদের, বিশেষ করে যারা ধর্মের ও রাসুলেরও অবমাননা করেছে, তাদের শাস্তির দাবি নিয়ে এসেছে। শাহবাগ শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে। কিন্তু এই একটি দাবির পর এখন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা, এরপর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা, শেষে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করাসহ শাহবাগের ৬ দফা নানাদিকে বিস্তারিত হয়েছে।

হেফাজতে ইসলামও ব্লগারদের শাস্তির দাবি থেকে এখন নিয়ে এসেছে ১৩ দফা। ১৩ দফার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি। শাহবাগের ৬ দফা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। কারণ ধরে নেয়া হয়েছে এসব দাবি নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। সরকারের মেনে নেয়ার ব্যাপার মাত্র, যা সরকার একের পর এক তাদের জন্য করে যাচ্ছে।

যদিও ৬ দফা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। আমি হেফাজতের ১৩ দফা নিয়েই লিখছি; কিন্তু সব দফা নিয়ে নয়। শুধু নারী অধিকারের প্রশ্নের সাথে জড়িত দুটি দাবির (দাবি নং ৪ ও ৫) বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোর ঢালাও বিরোধিতা করার কারণ আমি দেখি না। ব্যাপারটার বিরোধিতা বা পক্ষে দাঁড়িয়ে যাবার বিষয় নয়।

গ্রামীণ গণমানুষের বিশাল একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের জায়গাগুলো আমাদের বুঝতে হবে। তারা তাদের ক্ষোভ- বিক্ষোভের কথাগুলো জানিয়েছে। এখন দরকার সেগুলো নিয়ে সমাজের অন্যান্য অংশের সাথে একটা ব্যাপক আলোচনার আয়োজন করা। সেদিক থেকে নারী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে যে সকল দাবি নারীর জন্য প্রাসঙ্গিক আমি শুধু সেই দাবিগুলো নিয়ে কিছু কথা তুলব। কিন্তু আমার ভয় হয় এই ডায়লগ, ব্যাপক কথাবার্তা বা আলোচনার জন্য যে সময় প্রয়োজন তা আমরা দিতে চাই কিনা।

একটি পক্ষ মনে করে দাবি আদায়ের সময় নির্ধারণ করে দিয়ে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই বল প্রয়োগে সমাধান করতে হবে। অন্যদিকে এই দাবিগুলো ধর্মের মোড়কে ইসলামপন্থিদের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে বলেই নারীদের প্রথম প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক হয়ে গেছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে এর বিরোধী হতে হবে, এটা কোন যুক্তি হতে পারে না। যে মোড়কেই আসুক মোড়ক খুলে মূল বিষয় নিয়ে আমাদের পরস্পর কথা বলতেই হবে। এখন সে সময় এসেছে।

ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন নতুন কোন গল্প নয় যে, নারীদের তা বোঝাতে হবে। বেগম রোকেয়া তা অনেক আগেই বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু মুশকিল হয় যখন এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী মুক্তির নামে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা পুরুষতান্ত্রিক অবাধ বাজারব্যবস্থা ও নারীকে পণ্যে রূপান্তরের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি। আবার ধর্মীয় জায়গা থেকে তোলা দাবি-দাওয়া বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রাবারের মতো ক্রমাগত টানতে গেলে বাংলাদেশকে আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দল, নারী সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের কাছ থেকে অনেক প্রতিক্রিয়া এসেছে।

তাদের একটি সাধারণ বক্তব্য হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা মানলে আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাবো। কেমন করে? সেটা কিন্তু কেউ পরিষ্কার বলছেন না। প্রথমত মধ্যযুগ বর্তমান যুগের চেয়ে মন্দ ছিল কিনা সেটা একটা তর্কের বিষয়। দ্বিতীয়ত কেউ মধ্যযুগে যেতে চাইলেই কি যেতে পারবেন? আমার মনে হয় না। তৃতীয়ত আমরা একটি বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি, হেফাজতে ইসলাম বা আমরা কেউই এর বাইরে নই।

ফলে হেফাজতে ইসলাম আমাদের কোন এক 'মধ্যযুগে' ফিরিয়ে নিতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনা দেখছি না। বরং সমাজের গণমানুষের বিশাল একটি অংশ বিদ্যমান ব্যবস্থাকে কিভাবে দেখছে, কিভাবে সমালোচনা করছে এবং কিভাবে তার প্রতিকার খুঁজছে সেটা বুঝতে পারাই আমাদের প্রধান কাজ হতে পারে। আমাদের দরকার ধর্মীয় ভাষায় তোলা তাদের মূল বক্তব্যগুলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব এবং কতটুকু কেন সম্ভব নয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটা সুস্থ আলোচনার দিকে নেয়ার চেষ্টা করা। তাদের দাবিগুলো আদৌ সমর্থন করা যাবে কিনা, কিংবা কতটুকু করা যাবে তার তর্ক-বিতর্ক হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারাই একমাত্র গ্রামের গরিব নারী-পুরুষদের কাছে একটি প্লাটফর্ম হিসেবে হাজির হতে পেরেছে।

কাজেই একে উপেক্ষা করা আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি ধন্যবাদ জানাই হেফাজতে ইসলামকে। কারণ প্রথম ১৩ দফা হাজির করার পর সমাজের প্রতিক্রিয়ায় তারা সাড়া দিচ্ছেন। তারা পত্রিকায় ১৩ দফার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা থেকেও আমি দফা ৪ ও ৫ নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ করতে চাই।

দফা নং ৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। এই দাবিকে ভাগ করলে অন্তত তিনটি ভিন্ন দাবি তৈরি করা যেত। যেমন ১. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা, ২. বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ এবং ৩. মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। অর্থাত্ এই ৪ নং দাবিটি পুরোটাই নারীদের বিরুদ্ধে নয়। মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের অংশটি বাদ দিলে থাকে "বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ" অংশটি এবং এই অংশটি নিয়েই চলছে বিতর্ক।

আমার মনে হয় এই অংশটি হেফাজত বা কোন ইসলামী দলের কাছ থেকে না এসে যদি কোন রাজনৈতিক দল কিংবা নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আসতো, আমরা একে স্বাগতই জানাতাম হয়তো। পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক নারী এই ধরনের সমস্যার শিকার হচ্ছেন, যা নারীকে পণ্য আকারে হাজির করছে। কেউ কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় এমন পথ বেছে নিয়েছেন; কিন্তু তাদের কারণে অধিকাংশ নারীর ওপর অপবাদ আসছে। ফলে এই অবস্থা পরিবর্তন করা প্রগতিশীল নারীদেরও দাবি হতে পারে এবং হয়েছেও। এর সাথে নারীদের ঘর থেকে বের হবার বা না হবার কোন সম্পর্ক নেই।

হেফাজতে ইসলামের এই দাবি থেকে অনেকে ভেবে নিয়েছেন তারা নারীদের ঘর থেকেই বের হতে দিতে চান না। নারীদের কাজ করা বা শিক্ষার সুযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। দেখা যাক আল্লামা আহমদ শফি এই নিয়ে কি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন:"দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী জাতির সার্বিক উন্নতির বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে তাদের নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থল, সম্মানজনক জীবিকা এবং কর্মজীবী নারীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে নারীদের ইজ্জত-আব্রু, যৌন হয়রানি থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক হিসেবে পোশাক ও বেশভূষায় শালীনতা প্রকাশ এবং হিজাব পালনে উদ্বুব্ধকরণসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; এবং একই লক্ষ্যে নারী-পুরুষের সব ধরনের বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে অবাধ ও অশালীন মেলামেশা, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহিংসতা, যৌতুক প্রথাসহ যাবতীয় নারী নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কঠোর হাতে দমন করতে হবে"।

এই ব্যাখ্যায় আমি মৌলিকভাবে কোন সমস্যা দেখি না। তবে শুধু এটা যেন না হয় যে, শালীনতার একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকবে, তার বাইরে অন্য পোশাক থাকবে না। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কিছু বিষয় হেফাজতে ইসলাম তুলে এনেছে, যা আমি এখানে উল্লেখ করলাম না। এ অভিযোগ সত্যি কিনা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে; কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে কিছুটাও যদি সত্যি হয় তাহলে এমন প্রতিক্রিয়া আমরা ঠেকাতে পারবো না। আমরা কেউই কোন নারী-পুরুষের দৃষ্টিকটু বিচরণ চাই না, এমনকি উন্নত বিশ্বেও চায় না।

শাহবাগ নিয়ে অন্য প্রশ্ন তোলা হলেও যেসব নারী সামনের কাতারে আছে আমি মনে করি তাদের পোশাক নিয়ে আপত্তি তোলার কোন জায়গা আমি দেখি না। আল্লামা আহমদ শফি বলছেন:"আমাদের কথা পরিষ্কার যে, হিজাব বা শালীনতার সঙ্গে নারীদের নিরাপদ পথ চলাচল, শিক্ষার্জন ও কর্মক্ষেত্রে যেতে কোনো বাধা নেই। " তাদের আর একটি বক্তব্য "নারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য আলাদা বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ থাকতে পারলে আলাদা কর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আপত্তি তোলার যুক্তি থাকতে পারে না'' । এই দাবি কতখানি বাস্তবসম্মত হবে তা ভেবে দেখার বিষয়। আমরা নিজেরাও মনে করি প্রতিটি কর্মস্থলে নারীদের প্রয়োজনে কিছু আলাদা ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে পারে।

বেশিরভাগ কর্মস্থল নারী কর্মীদের উপযোগী করা নয় এবং সেটা হলে নারীরা কাজ করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। কিন্তু আলাদা কর্মস্থল সম্ভব হবে কিনা সেটা আমরা তাদের বিবেচনা করতে বলতে পারি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৪ নম্ব্বর দাবিতে নারীদের ঘরে ঢোকানো হচ্ছে না, বরং নারীদের সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছে ইসলামের বয়ানে। এই প্রস্তাবে ভীত না হয়ে আমাদের দেখতে হবে নারীদের বর্তমান অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখে নারীকে ভোগ্যপণ্য ভেবে যারা নির্যাতন করে, তাদের হাত থেকে আমরা কিভাবে মুক্ত হতে পারি। আমাদের সমস্যা হচ্ছে কেউ ধর্মের নামে নীতির কথা বললে ঘাবড়ে যাই যে, তাহলে বুঝি ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে পড়ে গেলাম।

'বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার' কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে প্রতিটি সংস্কৃতি ও সামষ্টিক মূল্যবোধ সামাজিকভাবেই এ সকল বিষয় নির্ধারণ করে। আমি আল্লামা আহমদ শফি এবং হেফাজতে ইসলামের অন্যান্য নেতা ও কর্মীকে অনুরোধ করবো এই বিষয়টি নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হোক, কোন আরোপিত নীতি হিসেবে নয়। শাসনের সুরে নয়। সমাজকে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আরও বিকশিত করে নেবার দায়িত্ব আছে সকলেরই।

সেদিক থেকে আলোচনা করলে তা ইতিবাচক হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন নারীরা কাজ করছেন। মুসলিম নারীরা হিজাব পরে কিংবা না পরেও শালীনভাবে কাজে যাচ্ছেন এবং নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন। তবে মনে রাখতে হবে, এ কথা কেউ হলফ করে এখনও বলতে পারবে না যে, নারীর পোশাক পরিবর্তন হলে আপনা থেকেই ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিষয়টির সাথে পুরুষদের মন- মানসিকতা ও নারীর প্রতি ব্যক্তি এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত।

এটা যতদিন সামাজিক আন্দোলন করে নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তন না করা যাবে ততদিন এই দুরবস্থা চলতে থাকবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.