আমি আব্বুকে নিয়ে কিভাবে শুরু করবো ঠিক বুঝতে পারছিনা। আমার আব্বুকে আমি খুব ভালোবাসি যখন আমি তাকে ICU তে ৭২ ঘন্টা জীবন-মরণের সাথে লড়তে দেখেছি তখন উপলদ্ধি করেছি। আব্বু আমাদের মাঝে আছে ঠিকই কিন্তু তার কণ্ঠ দিয়ে তিনি আর গান করেন না। আনমনে বাসায় শুয়ে টিভি দেখেন। আমাকে গান গাইতে দিতে চান না।
কোথায় জানি কষ্ট জমে আছে। আব্বুকে আমি ছোটবেলায় টিভিতে দেখে দেখে বড় হয়েছি। বিটিভি তে যে কয়বার "অনির্বান" ( সেনাবাহিনীর অফিসারদের পরিবেশনায় বিশেষ অনুষ্ঠান ) অনুষ্ঠান টি প্রচারিত হত , আমার জন্য রেকর্ড করে রাখা হত । তখন সারা দেশে একমাত্র বিটিভি -ই ছিল । আব্বু তখন মিশনে দেশের বাইরে ।
আমি আকাশে প্লেন দেখলেই হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকতাম আর বলতাম আমার আব্বুকে নিয়ে এসো । এই হল আমার শৈশবের বাবার সাথে স্মৃতি । একবার জন্মদিনের দিন আমার জ্বর হলো । আমাকে সিএমএইচ এ ভর্তি করা হল , তখন আমার বয়স ২ , বাবাকে ছাড়া আমার প্রথম জন্মদিন আব্বু মোজাম্বিক থেকে ফোন দিলেন আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দেওয়ার জন্য । তখন এত মোবাইলের ছড়াছড়ি ছিলনা ।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা লাগতো দেশে কল করতে । আমার আম্মু বাবাকে কিছুই জানান নি যে আমি অসুস্থ , কারন ততক্ষণে সব মেহমানদের দাওয়াত দেয়া হে গেছে , কেক কাটার অপেক্ষা । আমাদের বাসায় সবাই এসে জানতে পারলো আমি হাসপাতালে । আব্বু এই ঘটনা জানলে আম্মুকে অনুষ্ঠান করতে দিতেন না। সকলেই কষ্ট পেত ।
আব্বু ফোন রাখার পরও সারাদিন খুব অস্থির ছিলেন । আব্বু কিছুদিন আগে আমাকে পুরোনো কথাগুলো বলছিলেন । " তোমার আম্মুকে জিজ্ঞাস করলাম সব ঠিক মত উত্তর দিলেন । কিন্তু something is missing & fishing sounds there !!!!! আমি সারাদিন তোমাকে নিয়েই চিন্তায় ছিলাম। আম্মু আমাকে হাসপাতাল থেকে শুধু এক ঘন্টার জন্য ছুটি নিয়ে বাসায় এসে কেক কাটিয়ে ফেরত নিয়ে যান ।
এটি ছিল আমার এ যাবৎ কালের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর জন্মদিন । সেই নব্বই এর যুগে ঘন ঘন মোবাইলে কথা না বলেই সন্তানের ( আমার ) প্রতি আব্বুর যে টান আমি দেখতে পেয়েছি , তা আমি গত কয়েকদিন আগে জেনেছি ।
আমার আব্বুর এর গান যখন থেমে গেছে , আমার গানের সূচনা সেখান থেকেই । অসমাপ্ত কিছু সুর আমাকে দিয়েই আল্লাহ পূরণ করাবেন সেই বিশ্বাস আজো বুকে নিয়ে পথ চলছি । আমি কিছুদিন আগে NTV তে আমার প্রথম টিভি শো "আমারো গাইতে ইচ্ছে হলো" তে অংশ নিয়েছি ।
NTV অফিসে ডুকছি সে সময় শ্রদ্ধেয় " ফকির আলমগীর" স্যার ও গাড়ি থেকে নামছেন । আমি সালাম দিয়ে আমার পরিচয় দিলাম , আমার আম্মুকে উনি চিনেন । উনার "সখিনা " অ্যলবামে " একটা চিঠি দিলাম তোমার কাছে" গানটিতে আম্মু দ্বৈত কণ্ঠে গান গয়েছেন । আমার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলেন । আমি বললাম ভালো আছেন ।
শ্রদ্ধেয় " ফকির আলমগীর স্যার বলেন ," তোমার মায়ের চেয়ে তোমার বাবা ভালো গায় " এই কথাটি বলে আমরা লিফটের দিকে এগিয়ে গেলাম ।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । উনার মত Legend আমার আব্বুর গানের কণ্ঠ মনে রেখেছেন । আমার চোখে পানি চলে আসলো । বাসায় এসে মাকে বললাম ঘটনাটি।
আমার পল্লীগীতির প্রতি ভালোবাসা বাবার কাছ থেকে পাওয়া । আব্বু খিলগাঁও গভ: বয়েস হাই স্কুলে থাকার সময় স্কুল কম্পিটিশনে 1st হয় আবদুল আলিমের পল্লীগীতি গেয়ে , ঐ কম্পিটিশনে স্বয়ং আবদুল আলিমের বড় পুত্র জহির আলিম ( খিলগাঁও গভ: স্কুলে আব্বুর সিনিয়র ব্যাচ ছিলেন )অংশগ্রহন করেন । আব্বু তাকে পরাজিত করেন , সবাই ভেবেছিল পল্লীগীতিতে আবদুল আলিমের পুত্রই 1st হবেন। পরবর্তিতে স্বয়ং আবদুল আলিম খুবই অবাক হয়েছিলেন তারই গান কেউ এতো ভালো করে পারে যে তার আপন ছেলেকে হার মানিয়েছে , আবদুল আলিম আব্বুকে ডেকে পাঠান , আব্বু এই খবরটি আজো গর্ব সহকারে বলেন । তখন আব্বু ক্লাস নাইনের ছাত্র মাত্র।
আবদুল আলিমের জীবনের শেষ দিককার ঘটনা ,আব্বুর আর সৌভাগ্য হননি উনাকে গান শোনানোর , উনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তখন।
আমার বাবা কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসলেন । সাল ১৯৭৬ , বাবা কাজী নজরুল ইসলামে তার মৃত্যশয্যায় গান শুনিয়েছিলেন । কবি বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর আব্বু নজরুল সঙ্গীতে মন দেন তালিম নেন স্যার আহম্মদ আবদুল্লাহ স্যারের কাছে ।
পরবর্তীতে আবদুল মান্নান স্যারের " রঙধনু " সঙ্গীত একাডেমিতে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন । আমার আম্মুর সাথে তার ওখানেই পরিচয় ।
আমার বাবা মেজর আতাউর রহমান একজন সৎ আর্মি অফিসার , দরদী কণ্ঠে হাজারো জনতাকে মুগ্ধ করেছেন তার গায়কীতে । আমি তার মতো কখনোই গাইতে পারবোনা । আমার অনুষঠান আমি আব্বুকে শুনতে বা দেখতে মানা করি।
আমি ভয় পাই , উনার সমালোচনা গুলোকে নিজের জন্য শ্রেষ্ঠ সমালোচনা আমি মনে করি। আমি কক্ষনো জিজ্ঞাস করি নি বাবা আমার গান কেমন লাগলো , কোনো ভালো উত্তর পাইনি , তবে নিরাশ হয়নি । বাবা আজ তোমার জন্মদিন তোমাকে কোন গানটি উপহার দেবো ?? বলোতো !!
http://www.youtube.com/watch?v=VWC1-BJQw7U
এই লিংকে বাবার গাওয়া একটি দেশাত্ববোদ্বক গান আছে , শুনবেন সকলে। আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন।
- রুবাইয়া রহমান উপমা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।