আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোলকিপার থেকে কিলার

নূরুজ্জামান: ফুটবল মাঠের চৌকস গোলকিপার থেকে ভয়ঙ্কর কিলার। সে মিরপুরের ত্রাস ব্যাঙ্গা বাবু। নিজের জবানিতেই বর্ণনা করেছে অন্তত আটটি খুনের ঘটনা। দায়ও স্বীকার করেছে। তবে নিজে থেকে নয়।

অন্য একটি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদে। অস্ত্র মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিজের জীবন ভিক্ষা চেয়ে বাবু স্বীকার করেছে খুনের মতো জঘন্য অপরাধের। বাবু প্রথম খুনের ঘটনার জবানবন্দিতে জানায়, ২০০১ সালের জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। দুপুরের দিকে শীর্ষ সন্ত্রাসী নান্টুর বড় ভাইয়ের বাসার সামনে যাই। উদ্দেশ্য ছিল নান্টু ও তার ছোট ভাইদের বিরুদ্ধে নালিশ করবো।

আমার ছোট ভাইদের মারধরের বিচার চাইব। কিন্তু বাড়ির গেটের সামনে যাওয়ার পরপরই নান্টুর দেখা পাই। সে আমাকে দেখেই তার কোমরে হাত দেয়। তখন বুঝতে দেরি হয় না যে, নান্টু গুলি করার জন্যই কোমরে হাত দিয়েছে। আমিও ভুল করিনি।

সঙ্গে সঙ্গে আমি ও নজরুল মিলে দুই পিস্তলের ৪ গুলি দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করি। শীর্ষ সন্ত্রাসী নান্টু বাহিনীর প্রধান নান্টুকে খুনের বর্ণনা সে দেয় এভাবেই। বাবুর পুরো নাম নাজমুল হাসান ওরফে ব্যাঙ্গা বাবু (৩৪)। গত রোববার আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সে। বর্ণনা করেছে নান্টু ছাড়াও কিভাবে তার বাহিনীর অন্য সদস্যদের সে হত্যা করেছে, কার কার নির্দেশে কোন কোন গার্মেন্টে গুলি চালিয়েছে, জখম করেছে কতজনকে।

ওই স্বীকারোক্তিমূলক জবানিতে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার নেপথ্য কারণও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যাঙ্গা বাবু মিরপুরের ত্রাস। তার বিরুদ্ধে অন্তত ৮টি হত্যা ও অসংখ্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং অস্ত্র মামলা রয়েছে। সূত্রমতে, দীর্ঘদিন ভারতে পালিয়ে থাকার পর সমপ্রতি বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্যাঙ্গা বাবু। পরে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানাধীন একটি গ্রামে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির সময় জনতার হাতে গণপিটুনি খায়।

পরে পুলিশে সোপর্দ করার পর তার আসল পরিচয় জানাজানি হয়। তা সত্ত্বেও গোয়ালন্দ থানা পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে হাজির করে। এতে সহজেই সে জামিন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। তবে গোয়েন্দা নজরাধীনে থাকা ব্যাঙ্গা সমপ্রতি ফের ধরা পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। একটি হত্যা ও অস্ত্র মামলায় ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে গোয়েন্দারা।

জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়। বিনিময়ে সন্ত্রাসী জীবনের সকল অপকর্মের কথা অকপটে স্বীকার করে। একই সঙ্গে তার দেয়া তথ্য মোতাবেক দিয়াবাড়ি বিআইডব্লিউটিসি’র নিমগাছ তলার মাটির নিচ থেকে দু’টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। পরে আদালতে একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা ও গুলি করার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয় ব্যাঙ্গা। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলে, ২০০১ সালের জানুয়ারি/ ফেব্রুয়ারি মাসে নান্টুকে গুলি করে হত্যা করে।

জুলাই মাসে মিরপুর পাইকপাড়ায় শওকত আলী হত্যাকাণ্ডের সফল মিশন পরিচালনা করে। এর ৪ মাস পর ডিসেম্বরে নান্টুর আরেক সহযোগী আলীকে গুলি করে হত্যা করে। ২০০২ সালে সেগুনবাগিচায় হত্যা করে নান্টুর আরেক সহযোগী মুন্সী বাবুকে। ২০০২ সালে হত্যা করে আরেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী ঘোড়া মাসুদকে। এরপর অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে সে।

মিরপুরের একচ্ছত্র চাঁদাবাজ হিসেবে দেখা হয়। চাঁদার দাবিতে মিরপুরে ২ নম্বর এলাকার গার্মেন্টের ম্যানেজারকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করে। ওই গুলিতে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ২০০২ সালের শেষের দিকে ৫ লাখ টাকা চাঁদার জন্য আরেক গার্মেন্ট মালিককে গুলি করে আহত করে। গোয়েন্দাদের কাছে জানায়, সন্ত্রাসীদের কারণেই সে সন্ত্রাসী হয়েছে।

গুলি করেই গুলির বদলা নিয়েছে। তার নামের সঙ্গে ‘ব্যাঙ্গা’ যুক্ত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে বলে, কিশোর বয়সে আমি গোলবারে দাঁড়ালে গোল হতো না। বল ধরতাম জাম্প দিয়ে। অনেকই সেই জাম্প নিয়ে হাসাহাসি করতো। বলতো ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে গোল বাঁচিয়েছি।

সেই থেকে আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ব্যাঙ্গা’। এরপর থেকে ‘ব্যাঙ্গা বাবু’ হিসেবে পরিচিতি পাই। তদন্ত সূত্র জানায়, তার আসল নাম নাজমুল হাসান ওরফে বাবু (৩৪)। মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার পয়সা পশ্চিম পাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাতেম আলীর ছেলে। ছোট বেলা থেকেই বেড়ে উঠেছে রাজধানীর মিরপুর এলাকায়।

থাকতো শাহ আলী থানাধীন সি ব্লকের ৬ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৯৩ সালে তার পিতা মারা যান। তখন থেকে সংসারের হাল ধরে ব্যাঙ্গা বাবু ও তার বড় ভাই। কয়েকটি সেলাই মেশিন কিনে বাসায় বসে জামা তৈরি করে মার্কেটে ও দোকানে বিক্রি করতো। ধীরে ধীরে কারখানা গড়ে তোলে।

কারখানার ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে গিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকেই মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রপের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয়। আড্ডা দিতে থাকে সন্ত্রাসী বাহিনী আলী গ্রুপ, নান্টু গ্রুপ, ইকবাল গ্রুপ, বাঙ্গু-সুজন গ্রুপসহ আরও একাধিক দলের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ বিভিন্ন গার্মেন্ট মালিক, কর্মী ও বস্তিবাসীর ওপর অন্যায়-জুুলুম-নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই কর্মকাণ্ড চালাতো। ব্যাঙ্গা বাবুর দাবি, সে ওইসব কর্মকাণ্ডে রাগ করতো। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়।

এরই একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালে ব্যাঙ্গা বাবুর ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত বাপ্পী ও আক্রামের কাছে চাঁদা দাবি করে বসে নান্টু গ্রপের সন্ত্রাসীরা। না দিলে মারধর করে। জবানবন্দিতে বাবু আরও বলে, মারধরের ঘটনায় নান্টু ও তার সহযোগী শাহাদাত, মামুন ও খায়রুলের কাছে ৪-৫ বার বিচার প্রার্থনা করি। বিচার না পেয়ে আমার ছোট ভাইদের পাঠিয়ে নান্টুর ছোট ভাইদের ডেকে আনতে বলি। আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে উল্টো নান্টু গ্রুপের সন্ত্রাসীরা ক্ষুর দিয়ে পোজ মারে আমার ছোট ভাইদের।

স্ট্যাব (ছুরিকাঘাত) করে আমাকেও। এতে প্রচণ্ড জেদ হয় নান্টু ও তার সহযোগী শাহাদাতের ওপর। আমিও শাহাদাতকে ধরে মারধর করি। পরে ওই এলাকা ছেড়ে মিরপুর ১৪ নম্বর যাই। এর কিছুদিন পর ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসের এক রাতে ইকবাল নামে এক বন্ধু হঠাৎ ফোন করে।

ডেকে নিয়ে যায় মিরপুর ১ নম্বর কাশেম মোল্লা ক্লাবের সামনে। সেখানে বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকার ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি নান্টু বাহিনীর নান্টু, মামুন, আলী, খায়রুল, মুন্সি বাবু, মিঠু, শাহাদাত, সালাউদ্দিনসহ আরও অনেকে হাজির। তারা সবাই পিস্তল ও রিভলবার বের করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। হাতে ও রানে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।

এ সময় কাশেম মোল্লা ওই নান্টু বাহিনীকে দৌড়ানি দেয়। তারা চলে যাওয়ার পর আমার আরেক বড় ভাই মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৫ দিন পর অনেকটা সুস্থ হই। এর প্রায় ৪ মাস পর নান্টু ও তার বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরে আসতে থাকে। চেষ্টা চালায় আধিপত্য বিস্তারের।

আমিও তাদের খতম করার প্রস্তুতি নিতে থাকি। গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়ার পর আরও একটি অস্ত্র মামলায় দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ হচ্ছে ব্যাঙ্গা বাবুকে। তার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে মিরপুর এলাকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। Source: Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।