আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাবি ছাত্রের দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম্য

শান্তির জন্য সংগ্রামী শাহবাগ মোড়ে বিকালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদ উজ জামান। ডাকনাম জামানের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানায়। সে ছাত্রলীগ কর্মী এবং বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। বিকালে আগারগাও এর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে শাহবাগে রাস্তা পারাপারের সময় রাজধানী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যু বরন করেন। উল্লেখ্য যে, ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগ আসার জন্য হেঁটে রাস্তা পার হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।

কয়েক বছর আগেও একই স্থানে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান হ্যাপী নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্রী। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। হ্যাপী কোন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী ছিলনা। কিন্তু সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনই প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। পাশাপাশি সাধারন ছাত্রীরা তো ছিলই।

তবে সে সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন আমাদের আন্দোলনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। যাহোক সেই আলোচনা আজ নয়। আজকে জামানের মৃত্যুবরন এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী অপ্রত্যাশিত ঘটনাসমুহ একজন ভুক্তভোগী হিসেবে লিখতে চাই। ভুক্তভোগী এই অর্থে যে, শাহবাগ মোড়ের ঘটনার ব্যপ্তি চারদিকে ছড়িয়ে যখন কাঁটাবন মোড় হয়ে হাতিরপুল পেরিয়ে সেন্ট্রাল রোড ধরে অজানা স্থান পর্যন্ত এগিয়ে যায় তখন বিষয়টিকে নিছক ছাত্রদের আবেগের স্ফুরন বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নাই এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি হাতিরপুলে বাজার করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু লাঠিসোটা সমেত একদল তরুনের ভাঙচুরের শিকার হয়ে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।

মানুষ জন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। চলে নির্বিচারে ভাংচুর। গাড়ির গ্লাস থেকে শুরু করে দোকানের শাটার কিছুই ভাঙচুরের বাইরে থাকেনি। হাতিরপুল মোড়ে যখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি তখনই দেখা হলো ক্যাম্পাসের দুই জুনিয়র স্কলারের সঙ্গে। তাদের একজন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক যে আবার সম্প্রতি বিসিএস পুলিশ ক্যাডার সিলেক্ট হয়েছে।

আরেকজনও বিসিএস ট্যাক্স ক্যাডার সিলেক্ট হয়েছে। তাদের সঙ্গে এটা সেটা কথা বলা শুরু করলাম আর খেয়াল করছিলাম ঘটনা কী থেকে কী হচ্ছে। কথা বলতে বলতেই তিনজনে মোবাইলে ফোন করে খুজ নিলাম শাহবাগ থেকে প্রায় এক কিমি দূরে যেখানে সচরাচর কোন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনা সেখানে ভাঙচুরের কারন অনুসন্ধানে। এসব ক্ষেত্রে সাধারনত দেখা যায়, ঘটনা যাই ঘটুক বিভিন্ন শ্রেনী তাদের নিজস্ব স্বার্থে ঘটনাকে কাজে লাগায়। সেটা মাথায় রেখেই খোঁজখবর করলাম।

এরমধ্যেই কয়েকবার বিভিন্ন দোকানের ভিতরে প্রবেশ করেছি আবার বের হয়েছি। একটা ঘুমোট পরিবেশ। চারদিক যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ক্যাম্পাসের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ২০০৭সালে পড়ালেখা শেষ হলেও বিভিন্ন কারনে ২০১১ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট থাকতে হয়েছে নিয়মিতই। সেজন্য প্রায় একযুগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি কিভাবে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়।

রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সরকারী প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, মিডিয়া ইত্যাদির কল্যাণে এরুপ ঘটনা অহরহ। ২০০১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। কারনটা স্বাভাবিকভাবেই কয়েকজন স্বার্থান্বেষীর নীলক্ষেতে মার্কেটের একজন দোকান মালিককে খুন সংক্রান্ত। যেখানে স্পষ্টতই যেকোন কিছুর ভাগভাটোয়ারার বিষয় জড়িত ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার হাইকোর্টের রায় দেওয়ার দিন।

ঢাকা শহরে ছিল বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের আবেগ প্রকাশের দিন। অথচ একটি মহল সেই আবেগকে পুজি করে নিজেদের স্বার্থে নীলক্ষেতে হত্যাকান্ড ঘটিয়ে জনতার আবেগকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আজও দেখলাম এরকম একটি ব্যাপার। ক্যাম্পাসের যেকোন অনাকাংকিত ঘটনার প্রতিবাদে সবসময়েই সবাই সোচ্চার হয়।

সরকার সংশ্লিষ্ট না হলে সরকারী দলের অনুসারীরাও যোগ দেয় এমনো হয়। কিন্তু আজকের জামানের মৃত্যুবরনের বিষয়টিতে সরকারী দলের অনুসারীদেরও আবেগাক্রান্ত করে তুলেছে। তারাও আবেগ প্রকাশ করতে রাস্তায় নেমেছে। পাশাপাশি দলীয় ব্যানারে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও জোটসমুহও মিছিল সমাবেশ প্রতিবাদ করেছে। এর মধ্যে অতি উৎসাহী কিছু ছাত্রের বাড়াবাড়ি আচরন হিসেবে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

এগুলো বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার ঘটনা। কিন্তু রাত ৯টার সময়ে আবার ভাংচুর কেনো ও কিভাবে এবং কারা ঘটালো? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে জানলাম চমকপ্রদ ঘটনা। রাত ৯টার কিছু আগে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের একটি মিছিল সমাবেশ বা এজাতীয় বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছিল শাহবাগ মোড়ে। ক্যাম্পাসে যেকোন ছাত্র বা সংগঠনের উপর নির্যাতন অথবা ক্ষতিগ্রস্ত যেকোন পক্ষের জন্যই বাম সংগঠন সমুহ প্রতিবাদ করে এটা তাদের দলীয় স্বিদ্ধান্ত। ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্র অধিকারের দাবী এবং অধিকার ক্ষুন্নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া বাম সংগঠনের রাজনৈতিক স্বিদ্ধান্ত।

আজও সেটার অংশ হিসেবেই তারা বিক্ষোভ করছিল। এর মধ্যেই জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একজন ছাত্রী কর্মীর পায়ের উপর দিয়ে একটি গাড়ি চলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদীর উপরে পুনরায় আঘাত হানায় গাড়ির উপর সকলের রাগ হামলে পড়ে। শুরু হয় আরেকদফা ভাঙচুর। আশেপাশে থাকা সাধারন প্রতিবাদী ছাত্ররাও বেপোরোয়া ভাংচুরে লিপ্ত হয়।

কিন্তু শাহবাগের ভাঙচুর কাঁটাবন মোড়ে এলো কিভাবে? এটা সকলেই জানে কাঁটাবন মসজিদকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রশিবির-জামায়াতের একটি চক্র গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিবিরের কর্মীরা ঢাকায় চাকুরীসুত্রে এসে কাঁটাবনের আশেপাশেই তাদের নিজস্ব কিছু মেসে অবস্থান করে। জামায়াতের চাকুরীজিবি কর্মীরাও অফিস শেষে বিকাল-সন্ধ্যা হতেই কাঁটাবন মসজিদে নামাজের উসিলায় একত্র হয়ে আড্ডা দেয়। যারা এই রাস্তায় সন্ধ্যায় চলাফেরা করেন নিয়মিত তারা হয়ত খেয়াল করে থাকবেন যে, কিছু ছাত্র উত্তীর্ণ বা ছাত্র বয়সী তরুন নিয়মিতই আড্ডা দেয়। এই আড্ডার বিস্তৃতি শাহবাগেও প্রসারিত হয়।

আজও এমনি বিষয়। শাহবাগের ভাঙচুরের বিষয়টি তারা রাজনৈতিক বিবেচনায় কাঁটাবনে শুরু করে। সেটার ধারাবাহিকতায় হাতিরপুল এলাকায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একটি গ্রুপ ভাংচুরে লিপ্ত হয়। হাতিপুলের মোতালিব প্লাজার সামনে ছাত্রদলের একটু গ্রুপ নিয়মিত আড্ডা দেয়। আরেকটি গ্রুপ আড্ডা দেয় এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগনাল সংলগ্ন স্থানে।

এইসব এলাকায় আজকের ভাঙচুর এরাই সংগঠিত করেছে। ছাত্র ফেডারেশনের একটি অফিস হাতিরপুল শর্মা হাউজ বা এর আশেপাশে কোথাও থাকলেও তাদের কর্মীরা বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনে শাহবাগ ও ক্যম্পাস এলাকায় থাকায় কাঁটাবন ও হাতিরপুল এলাকায় তাদের ভাঙচুরের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। কারন হাতিরপুল মোড়ে সোয়া নয়টার দিকের ভাংচুরের সময়ে এবং এর একটু আগে কাঁটাবন মোড়ের ভাঙচুরের সময়ে ভাঙচুরকারী কোন গ্রুপ শাহবাগ থেকে কাঁটাবনের দিকে আসেনি। তাহলে এখানের ভাঙচুর অবশিষ্ট দুই পক্ষ ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের কর্মীরা ছাড়া ঘটা অসম্ভব। অবশ্য নয়টা চল্লিশের দিকে কাঁটাবন মোড় এলাকায় পুনরায় শুরু হওয়া ভাঙচুর কারা করেছে সেটার খোঁজ নিতে পারিনি।

কারন বাজার-সওদা নিয়ে বাসায় ফেরাটা জরুরী। তাই তিনজনই আলাদা হয়ে গেলাম। তবে আবারও বলে রাখছি ঘটনা আমরা যেভাবে উধঘাটন করতে পেরেছি আমি সেভাবেই লিখেছি। যেটুকু উল্লেখ করেছি এটুকু হয়ত মুল ঘটনার খুবই নগণ্য অংশ। এর আগে ও পরে হয়ত আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনার প্রেক্ষিতে সুবিধাবাদী যেকোন শ্রেণী গোষ্ঠীই যেকোন নতুন ঘটনা অথবা ঘটনার মোর ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য যেকোন ঘটনা ঘটাতে পারেন। সেটাও পাঠককে বিবেচনায় রাখার অনুরোধ রইল। মৃত্যুবরন করেছে তৌহিদ উজ জামান। তার পরিবার হারিয়েছে তাদের সোনার টুকরো জামানকে। বন্ধুরা হারিয়েছে তাদের প্রিয় বন্ধুকে।

আমরা দেশবাসী হারিয়েছি একটি মেধাবী মুখ। যিনি হয়ত আমাদের অনেক কিছু দিতে পারতেন। ছাত্রলীগ হারিয়েছে তাদের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও সংগঠককে। কষ্টটা জামানের নিকটবর্তীদের নিশ্চয়ই আমার মতোদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু এটা নিয়ে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সম্ভাবনা কেবলই দূরবর্তীদের এটাই নির্মম বাস্তবতা।

তৌহিদ উজ জামানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে দুর্ঘটনা ঘটানো বাস ও সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবী জানাই। সিটি কর্পোরেশনের নিকট আবেদন করছি শাহবাগে দুটি ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণের। একটি জাতীয় জাদুঘরের কোণা থেকে পুবালী ব্যাংক কোণা পর্যন্ত। আরেকটি ফুলের দোকানগুলোর সামনে থেকে বারডেমের কোণায় স্থাপিত বিদ্রোহী কবির ম্যুরল পর্যন্ত। যদিও এর পূর্ব পার্শ্বেই একটি ওভার ব্রিজ রয়েছে।

কিন্তু সেটা একটু অধিক দুরত্বে যেকারনে সেটা প্রায় অব্যবহৃতই থাকে। আবেগ প্রবন ছাত্রদের মনে রাখা উচিত একটি অন্যায়ের প্রতিবাদে আরো বড় অন্যায় সংগঠিত করার কোনো অধিকার ও যৌক্তিকতা তাদের নাই। সকল অন্যায়ের অবসান হোক। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.