আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্য রাতের আমি (গল্প)

রাত বাড়ার সাথে সাথে এই জায়গায়টায় আমাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, রীতিমত ভীড় লেগে যায়। এই খানে যেই ডাস্টবিনটা আছে ওইটাতে কয়েকটা ওয়ার্ডের ময়লা ফেলা হয়। আর ময়লা বেশি মানেই খাবারও বেশি। অনেক দিন আগে যখন প্রথম মায়ের সাথে এই জায়গাটাতে এসেছিলাম ওইদিন থেকেই জায়গাটা আমার পছন্দ। আমি আর আমার বন্ধুরা রাত ৯টা থেকেই এই জায়গাটাতে ঘুড়াঘুড়ি করি।

বেশ ভালই লাগে। সামনের মোড়ের চায়ের দোকানটায় রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে হরেক রকম মানুষের সমাগম। কেউ মায়ার টানে, আর কেউ ধূয়ার টানে। রাতভর বাজতে থাকে পুরোনো দিনের হিন্দী গান। আর তারই সাথে চলতে থাকে খিস্তি খেউড়।

অন্ধকারে কালো টানে রাতের বুক চিড়ে ভেসে উঠে নতুন চিত্র। নিরন্তর অবহেলায় জীবন্ত হয় জীবন। ডাস্টবিনের পাশের পুরোনো ল্যাম্পপোস্টটাকে ঘিরে প্রাণ পায় আদিম কামনা। এই ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাড়িঁয়ে থাকে কোন অষ্টাদশী অথবা যৌবনের দ্বারপ্রান্তে থাকা কোন মধ্যবয়স্কা। তাকে ঘিরে উঠতি বয়সি, মধ্যবয়সীদের সিটি, আদিম আহ্বান, খিস্তি খেউড়।

চায়ের দোকানটাতে কিছু ছেলে আড্ডা দেয়, প্রতিদিন। অনেক অনেক চা খায়, সাথে থাকে সিগারেট। এদের মধ্যে একজন আবার খুব দামী একটা লাইটার ব্যবহার করে, জিপ্পো। আমি অবশ্য বুঝিনি কেন এটার দাম এত বেশি। ওর বন্ধুরা বলাবলি করেছে।

যাইহোক, জিপ্পোটা যার তাকে আমার খুব পছন্দ, আমাকে প্রতিদিন চা আর বন রূটি খেতে দেয়। আমার চা-বন খেতে খুব ভাল লাগে। এই জন্য এই দোকানের আশপাশটাও আমার খুব পছন্দ। আমার এই জায়গাটা এখন আরো ভাল লাগে কারণ এখান থেকে একটু দূরেই ওই মেয়েটা থাকে। অপূর্ব সুন্দর।

দেখলেই মনে হয় বিদেশি। অসাধারণ গায়ের রঙ, তীক্ষ্ণ চোখ, সরু কটি , চলনে-বলনে ঠমক। এক ফোঁটা মেদ নেই কোথাও। ধুলি ধূসরিত। কিন্তু আকর্ষনীয়।

আজ এই জায়গাটায় কোন ভীড় নেই। ডাস্টবিন ময়লায় সয়লাব। জাপান সরকারের বন্ধুত্বের নিদর্শন ময়লার গাড়িটাও দুইদিন হল আসে নি। হলদে শুকনো তালগাছের মত ল্যাম্পপোস্টের মৃতপ্রায় বাতিটাই কেবল মানুষের অস্তিত্বের প্রতিনিধি হয়ে আছে। অন্যদিনের মত এই ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাড়িঁয়ে নেই কোন অষ্টাদশী অথবা যৌবনের দ্বারপ্রান্তে থাকা কোন মধ্যবয়স্কা।

তাকে ঘিরে নেই উঠতি বয়সি, মধ্যবয়সীদের সিটি, আদিম আহ্বান। মোড়ের চায়ের দোকানের ঝাপিটাও আজ ফেলা। সকল আদিম কামনা চাপা পড়েছে আদিম ভয়ের আড়ালে। আজকের রাতটা খুব সাদামাটা ভাবে শুরু হয়েছিল। আকাশের এক কোণায় একটা দরিদ্র চাঁদ, তাকে ঘিরে কিছু তারা, আর দুরন্ত কিছু মেঘ।

আমিও এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আশে পাশে কেউ নেই। একা। শুধু ডাস্টবিনটার কাছে একটা মানুষ। কপালে ছোট্ট একটা গর্ত।

গর্তের চারপাশটা কিছুটা কালচে, কিছুটা হলদে। মাছি উড়ছে। নিথর শরীর। তার নীল রঙের জিন্সটা হাঁটুর কাছে ছেঁড়া। জিন্সের পকেটে এখনো একটা প্যাকেটে কয়েকটা বেনসন লাইট আর একটা লাইটার, জিপ্পো।

গায়ের সবুজ রঙের টি-শার্টটা ছেঁড়া। এক পায়ে জুতা। অন্য পায়ের জুতা বেশ খানিকটা দূরে পড়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে বেটোফেন এর সপ্তম সুরটা বেজে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত ওই ছেলেটার মোবাইলের রিংটোন।

হয়তো ছেলেটার মা অথবা তার কোন বন্ধু অথবা তার প্রেয়সী পাগলের মত খুঁজছে তাকে। যারা ছেলেটাকে গুলি করেছিল, তারা আবার ফিরে এসেছে। ছেলেটাকে একটা মাইক্রোতে তুলে হাজারীবাগের দিকে যেতে লাগল। আমিও গাড়িটার পেছনে দৌঁড়াতে থাকলাম। ট্যানারীর কাছটাতে এসে নিথর দেহটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পচা ডোবার মধ্যে।

তারপর আবার গাড়িতে উঠে বসল। হালকা চাঁদের আলোয় আমিও চিনতে পারলাম ঐ ছেলে গুলোকে। তারা সবাই আর যেই ছেলেটা গুলি খেল তারা একসাথে চায়ের দোকানটায় আড্ডা দিত, সিটি দিত। আর মেতে উঠত আদিম কামনায়। খুব ভাল বন্ধু ছিল তারা।

ছেলেটার লাশ চার দিন পর পুলিশ পেয়েছে চেনার কোন উপায় নেই। খুনি কারা তা অবশ্য বের করতে পারেনি। ছেলেটার মা আর ছোট্টবোনটা অনেক কেঁদেছে। তার ঐ বন্ধুরাও অনেক কেঁদেছে আর আমি অবাক হয়েছি। আমি বলতে পারিনি যে এরাই অপরাধী।

স্রষ্টা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন, দেখার ক্ষমতা দিয়েছেন শুধু দেননি বলার ক্ষমতা। আর, একটা কুকুর কেনই বা বলতে পারবে? স্রষ্টাই যে সব চেয়ে বড় অপরাধী। গল্পটায় অবজারভার একজন মানুষও হতে পারত। শুধু শেষ দুটো লাইন না থাকলেই হত। মানুষ সভ্য হয়েছে, মানুষের জীবনের মান নেমেছে, হারিয়েছে বিবেক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।