আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্য রাতের ধাঁধা

২৯ আগষ্ট,২০০১। রাত তিনটা। ক্রিং ক্রিং শব্দে ফোন বেজে উঠলো। রামজি বিনালশিবেনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। হামবুর্গের অ্যাপার্টমেন্টে রিসিভার তুলে ঘুমকাতুরে চোখে রামজি বললেন- ‘হ্যালো’।

অপর প্রান্ত থেকে পাল্টা জবাব- ‘হ্যালো। ’ গলাটা খুব চেনা। বন্ধু মানুষ। এক সময় একই ঘরে থাকত। নাম মোহাম্মদ আতা।

‘কী ব্যাপার?’ আতার জবাব: ‘আমার এক বন্ধু আমাকে যে ধাঁধাঁটা বলেছে সেটা সমাধান করতে পারছি না, তাই তোমায় ফোন করলাম। ’ বিনালশিব: কি ধাঁধা ? আতা : ‘দু’টো লাঠি, একটা ড্যাশ, আর একটা কেক লাঠির সঙ্গে উল্টো করে জোড়া। ’ ‘শুধু এই ধাঁধাঁটা শোনানোর জন্য আমাকে গভীর ঘুম থেকে জাগালে !’ ও প্রান্তে আতা নিশ্চুপ। সে জানে, এই কোড তার বন্ধু ঠিক ঠিক বুঝে নেবে। আগেও তারা দু’জনে নিয়মিত এ ভাবেই কথা বলেছে।

নীরবতায় কাটলো কিছুক্ষন। তার পর রামজি জানান, ‘তোমার বন্ধুকে বল সে যেন চিন্তা না করে। ধাঁধাটা খুব মিষ্টি। গুড বাই। ’ বিনালশিব পাকিস্তানে পৌঁছান ৫ সেপ্টেম্বর।

সেখান থেকে বিশস্ত বার্তাবাহক মারফত আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের কাছে তিনি খবর পাঠান, ‘আমেরিকার উপর বিরাট হামলা হবে মঙ্গলবার, ১১ সেপ্টেম্বর। ’ এটাই ছিল মহম্মদ আতা-র সেই মিষ্টি ধাঁধা। দু’টি লাঠির অর্থ : ১১, লাঠির মাথায় উল্টো করে একটি কেক মানে ৯। আর ড্যাশ হল মাঝের স্পেস। সব মিলিয়ে ১১-৯, অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর।

তারিখ লেখার মার্কিন ষ্টাইলে : ৯-১১। কতটা গভীর সেই ষড়যন্ত্র ? প্রায় নিঃশব্দে বুনে চলা সেই চক্রান্তের জাল কতটা ঘিরে ফেলেছে এই বিশ্বকে ? পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে মেরে ফেলার পরেও কি সেই চক্রান্তের অবসান ঘটেছে ? আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশনের (এফ বি আই) প্রাক্তন স্পেশাল এজেন্ট আলি এইচ সওফান যে কাহিনি শুনিয়েছেন, তা হলিউডের স্পাই থ্রিলারকেও হার মানাবে ! সওফানের মতে, সি আই এ তাঁদের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করলে হয়তো ৯/১১-র হামলা রোধ করা যেত ! ‘নিউ ইয়র্ক-ওয়াশিংটন ভাল লোক ’ ফেব্রুয়ারী, ২০০২। কিউবার গুয়ানতানামো বে-র কয়েদখানা। ৯/১১-র ঘটনার পরে আফগানিস্তান থেকে ধরে আনা এক বয়ষ্ক মানুষকে প্রশ্ন করেছিলেন সওফান : ‘নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সম্পর্কে কী জানেন?’ উত্তর এসেছিল, ‘আমি জানি না ওরা ঠিক কী করেছে। তবে আমি নিশ্চিত, ওরা ভাল লোক।

’ জিজ্ঞাসাবাদের পর সওফান জানান, ‘এই মানুষটি আল কায়দা অথবা ৯/১১ সর্ম্পকে কিছুই জানেন না। আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল, যে নিরীহ লোকগুলোকে ধরে আনা হয়েছে, আল কায়দা ও তালেবানদের থেকে তাঁদের আলাদা করা। ’ নিরীহ মানুষরা কী ভাবে এফবিআইয়ের জালে ধরা পড়তো ? তার একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক সওফানের বিবরণ থেকে। আমেরিকার ‘ভাল বন্ধু’ নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের যোদ্ধারা ট্রাকে চেপে আফগানিস্তানের পশতুন এলাকা দিয়ে যেত। গ্রামবাসিদের ট্রাকে চড়ার অনুরোধ করত তারা।

এদের অনেকেই কখনও গাড়িতে চড়েনি। লাফিয়ে তারা ট্রাকে চড়ে বসত । অ্যালায়েন্সের যোদ্ধারা বেশির ভাগই ছিল জাতিতে তাজিক। পশতুনদের তারা ঘৃণা করত। নিরীহ গ্রামবাসীদের তারা সোজা নিয়ে যেত কাছাকাছি মার্কিন সেনা ছাউনিতে।

অফিসারদের জানিয়ে দিত, লোকগুলো তালেবান অথবা আল কায়দার। বন্দিপিছু মিলত পঞ্চাশ ডলার! গুয়ানতানামো বে-তে কয়েদিদের ওপর অত্যাচার নিয়ে অনেক সত্য-মিথ্যাই চালু আছে। মানবতা ও মানবাধিকারের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে যে দেশ নিজেদের দাবি করে, এ ব্যাপারে সেই মার্কিনিদের অন্যায় কার্যত্রক্রমকে বেআব্রু করে দিয়েছেন সওফান। বলেছেন, গুয়ানতানামোয় বন্দিদের হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে রাখার জন্য রক্ষীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কোনও বন্দিকে তার সেল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘরে আনার প্রয়োজন হলে দু’জন রক্ষী তাকে বয়ে নিয়ে আসতেন।

কখনও চাকা লাগানো স্ট্রেচারে করে তাদের আনা হতো। আলি বলছেন, বন্দিদের সঙ্গে এই ব্যবহার করে আল কায়দাকে কার্যত বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, ওরা নয়, আসলে আমরাই ওদের দেখে আতঙ্কে রয়েছি। গোটা পদ্ধতিটাই ভুল ছিল। আনুগত্যের মুল্য আল কায়দা নেতা শেখ সইদ অল-মাসরি-র অফিসে অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় ঢুকে পড়লো এল হুসেন খার্শতাও। নাইরোবির এভিয়েশন স্কুলে প্রশিক্ষন নিতে গিয়েছিলেন খার্শতাও।

ফিরে এসেছেন সুদানে। খার্শতাও জানেন, তার গর্ভবতী স্ত্রী কপর্দকশুন্য অবস্থায় সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের খরচ জোগাতে খার্তুমের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। অথচ, আল কায়দার কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থ্যা খার্শতাওকে তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি দিচ্ছে না। তত দিনে আল কায়দা নেতৃত্ব খার্শতাওকে ওসামা বিন লাদেনের ব্যক্তিগত পাইলট হিসেবে বেছে নিয়েছে। আল কায়দার অর্থনৈতিক দিকটি দেখতেন অল-মাসরি।

খার্শতাও তাঁকে বলে, ‘আমার স্ত্রীর সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য পাঁচশো ডলার চাই। ’ প্রায় মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে মাসরি বলেন : ‘দুঃখিত, আমরা তোমায় কোনও সাহায্য করতে পারছি না। ওকে মুসলিম হাসপাতালে নিয়ে যাও। ’ খার্শতাও জানে, সে হাসপাতালের কী নিদারুণ দশা। উত্তেজিত খার্শতাও বলতে থাকে, ‘এটা যদি আপনার স্ত্রী বা মেয়ে হত, পারতেন ওখানে পাঠাতে? আমি ’৯১ সাল থেকে আল কায়দার সঙ্গে রয়েছি।

এ ভাবেই কি আপনারা আমার আনুগত্যের মুল্য চোকালেন?’ ছিটকে বেরিয়ে আসেন খার্শতাও। ’১৯৯৮-এর ৭ আগষ্ট। পুর্ব আফ্রিকার দার-উস-সালাম, তানজানিয়া, কেনিয়ায় আমেরিকার বিভিন্ন দূতাবাসে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় কেনিয়া থেকে আরও অনেকের সঙ্গে গ্রেফতার হন আল কায়দার নাইরোবি সেলের খার্শতাও। ওই হামলায় প্রাণ হারান প্রায় ২২৩ জন। আহতের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে যায়।

তারপরও একটি পশ্চিমি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে ছাড়া পান খার্শতাও। ওই গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্য ছিল-‌‌খার্শতাওকে তাদের এজেন্ট হিসেবে আল কায়দার অন্দরে চালান করে দেয়া। এবার আসরে দেখা দেয় এফ বি আই। কিন্তু খার্তুমে ফিরে যাওয়া সওফানকে কী ভাবে নিজেদের হেফাজতে নেয়া যাবে? তাকে প্রত্যপর্ণে কোনও ভাবেই রাজি হবে না সুদান। তা ছাড়া, খার্শতাও জেনে যাবে, তাকে এফ বি আই খুঁজছে।

এতে ভয়ও পেতে পারে সে। মাঝখান থেকে তাকে নিজেদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে এফ বি আইয়ের। অতএব, মরক্কোর গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে দেশটির অভিবাসন দফতর তাকে ডেকে পাঠায়। তাকে বলা হয়, তার বাচ্চাদের অভিবাসন নিয়ে একটা সমস্যা আছে। সে যেন মরক্কোয় ফেরে।

খার্শতাও মরক্কোয় নামা মাত্রই এফ বি আই তাকে ‘নিরাপদ আস্তানা’য় নিয়ে যায়। সহকর্মীদের নিয়ে খার্শতাওকে জেরা শুরু করেন আলি সওফান। তাকে বলেন, ‘আমরা সবই জানি। যে ব্যবহার তোমার পাওয়া উচিত ছিল, আল কায়দা তোমার সঙ্গে সেই ব্যবহার করেনি। তোমারই স্বার্থে আমাদের সঙ্গে পুরোপুরি সহযোগিতা করো, আমরাও তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করব।

মনে রেখ, তোমার স্ত্রীর যখন সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন, সে সময় তিনি দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষা করছেন। তোমাকে সাহায্য করেনি ওরা। সব থেকে অনুগত এক সদস্যের সঙ্গে কী ব্যবহার করেছে আল কায়দা !’ সওফানের এই কৌশলে কাজ হয়। ভাল ব্যবহার পেয়ে ধীরে ধীরে মুখ খুলতে থাকে খার্শতাও। এফ বি আই-ও দু হাত ভরে সাহায্য পেতে থাকে তার কাছ থেকে।

আবু জুবেইদা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গী আবু জুবেইদা ২০০২-এর মার্চে ধরা পড়ে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ থেকে। আবু জুবেইদাকে জেরা করার পদ্ধতি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় আমেরিকার প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা মহলে। প্রকাশ্যে চলে আসে সিআইয়ের ‘এনহান্সড ইন্টারোগেশন টেকনিকস’। জুবেইদাকে জেরা করতে মার্কিনি প্রশাসনের কাছে বারো রকমের পদ্ধতি প্রয়োগের অনুমতি চায় সিআইএ। তার মধ্যে ছিল লাগাতার ঘুমাতে না দেয়া, কালো রঙের ছোট বাক্সে ঠাস দিয়ে অভিযুক্তকে পুরে রাখা, বন্দিকে শৌচাগারে যেতে না দিয়ে স্রেফ ডায়াপার পরিয়ে রাখা, তাকে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে সেই কাপড়ে লাগাতার পানি ঢেলে যাওয়া যাতে তার করে অনুভূতি একেবারে পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো হয় (পরে জানা যায়, জুবেইদাকে জেরার সময় সি আই এ মোট ৮৩ বার এই পদ্ধতির আশ্রয় নেয়) প্রভৃতি।

২০০২-এর পহেলা আগষ্ট রাত ১০টা নাগাদ আমেরিকার বিচার বিভাগ ওই বারোটির মধ্যে দশটি পদ্ধতি প্রয়োগের লিখিত অনুমতি দেয় সি আই এ-কে। কারণ হিসেবে বলা হয়, সেগুলি বন্দিদের উপর অত্যাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জেনেভা চুক্তি লংঘন করবে না। সওফান জানাচ্ছেন, গোপন ডেরায় আবু জুবেইদার সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল, তা সি আই এ টেপে ধরে রাখে। কিন্তু, তদন্তকারীরা তা দেখার আগেই সি আই এ সেগুলি নষ্ট করে ফেলে। পরে সি আই এ-র অভ্যন্তরীন যে সব ই-মেল প্রকাশ্যে আনা হয় (ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস) তা থেকে জানা যায় সি আই এ-র উচ্চ পদাধিকারীরা ওই সব টেপ তড়ি-ঘরি করে নষ্ট করে ফেলার কথা বলছেন! তোরা-বোরা থেকে অ্যাবোটাবাদ আমেরিকার প্রতিরক্ষা দফতর সুত্রে মেলা তথ্য জানাচ্ছে, ২০০১-এর ১৭ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের তোরা-বোরা পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন।

চারিদিকে শুধুই বরফ আর বরফ। মার্কিনিদের বোমারু বিমানের লাগাতার হামলা থেকে তখন কোনওত্রক্রমে প্রাণ বাঁচেন লাদেন। ওসামা বোঝেন, পালাতে হবে সেখান থেকে! অতএব, ঘোড়ার পিঠে চড়ে আরো উত্তরে আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশ। পাহাড় আর ঘন অরণ্যের আড়ালে, যাতে আকাশ থেকে মার্কিন ড্রোনের নজরদারিতে অসুবিধা হয়। সেখান থেকে অ্যাবটাবাদের উচু প্রাচীর ঘেরা আশ্রয়ে ঠাঁই নেয়ার ফাঁকে কেটে গেছে দীর্ঘ এক দশক।

শেষের দিনটি আসে ২রা মে,২০১১। ঘটনাটা সকলেরই জানা। কিন্তু, সন্ত্রাসবাদ খতম করতে গিয়ে বন্দিদের মধ্যে পাল্টা সন্ত্রাস ছড়ানোর নীতির প্রতিবাদ করছেন এফ বি আইয়ের এক স্পেশাল এজেন্ট-এমনটা কেউ ধারণা করেছে কখনো! অন্য লড়াই ‘দ্য ব্লাক ব্যানারস’ বইটির পাতায় পাতায় বিভিন্ন লাইন কালো মোটা দাগ দিয়ে কাটা। কোনও কোনও পাতায় আবার প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত কালো দাগের জন্য পড়ার কোনও উপায় নেই! এফ বি আই অনুমতি দিলেও সি আই এ সেগুলি ছাপার অনুমতি দেয়নি! মধ্য রাতের ধাঁধাঁর সমাধান কি তাহলে সত্যই মিলল? (দ্য ব্লাক ব্যানারস/ ইনসাইড দ্য হান্ট ফর আল কায়দা, আলি এইচ সওফান) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।