আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভেতো বাঙ্গালীর অ্যাডভেঞ্চার ( সত্যি ঘটনা )

হঠাৎ ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছিল। আমি কোথায় এটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। মবাইল ফন টি বের করে সময় দেখি রাত পোনে তিন টা। আমি বসে আছি টুঙ্গি পাড়া এক্সপ্রেস নামের বাসে।

প্রায় ৪৫ মিনিট সময় ঘুমিয়েছি। কাওরাকান্দি ঘাটে বাস ফেরি থেকে নামার পর গোপালগঞ্জ পর্যন্ত জাগ্নাই ছিলাম। আগের দিনের ছুটাছুটি আর রাতের জার্নিতে শরির ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই শুধু মনে আছে গোপালগঞ্জ এ যখন বাস থেমেছিল তখন তখন রাত ২ টা। আমার গন্তব্য এতক্ষনে এসে পরার কথা।

, হেল্পার সুপারভাইজার কে বলে রেখেছিলাম ঘোনাপাড়া আসলে যেন আমাকে দেকে দেয়। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গায় না বিপদের কোন গন্ধে আমার বুক্টা ধুকপুক করছিল। পাশের যাত্রীটি গোপালগঞ্জেই নেমে গেছে। আমি বাসের সাম্নের দিকে বসেছিলাম। পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি শুধু এক জোড়া তরুন দরিদ্র দম্পত্তি তাদের কোলের বাচ্চা সহ আর শ্রমিক টাইপ এক মানুষ ছাড়া যাত্রী কেউ নেই।

এতক্ষনে বাস্টি থেমেছে। আসে পাশে দোকান পাট কিছুই নেই। ফেরি তে আসার সময় আকাশে চাঁদ দেখেছিলাম। এখন সেটাও নেই চার পাশ গাঁড় অন্ধকার। আশেপাশে বাড়িঘর আছে কি না তাও বুঝতে পারছিলাম না।

শুধু বাসের হেড লাইটের আলোয় সামনে একটি পাকা ঘর দেখতে পাচ্ছিলাম মনে হচ্ছে সামেন আর রাস্তা নেই। হেল্পার ড্রাইভার বাস থেকে নেমে কাকে যেন ডাকাডাকি করছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে সন্দেহ ঘনীভূত হল যে খুব সম্ভবত আমার যেখানে নামার কথা সে যায়গা পার হয়ে এসেছি। কেন এমন টা মনে হচ্ছিল তাও বুঝতে পারছিলাম না।

এরকম মুহুর্তে আমাদের মন সাধারনত খারাপ কিছুই চিন্তা করতে শুরু করে আমরা না চাইলেও। রাত অ অনেক কতদুর এসেছি কে জানে? একবার ভাব্লাম রাত টা বাসেই কেটেদিয়ে সকাল বেলা দেখা যাবে কি করা যায়। কিন্তু তারপরও এখন কথায় সেটা জানা দরকার। বাস থেকে নেমে দেখি এটা এব্রথেবড়ো কাঁচা রাস্তা। মাঝে মাঝে কথাও একটু ভাঙ্গা ইট বিছানো।

একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম এটা একটা নদীর ঘাট। সামনে যেটা পাকা ঘর মনে হয়েছিল সেটা ফেরি ঘাটের ঘর। সামনেই ছোট্ট একটা ফেরি একটা বাস এটে যায়। নদী টা বেশি প্রসস্ত মনে হল না কিন্তু পানি বেশ ভালই আছে। হেড লাইটের আলোয় ওপারের ঘাট টিও আবছা দেখা যাচ্ছিল।

এ রাস্তায় আমি এবারি প্রথম কিন্তু আমাকে যেভাবে বলা হয়েছিল তাতে মাওয়া কাওরাকান্দির পর আর কোন ফেরি ঘাটের থাকার কথা না। নিশ্চিত হলাম আমার গন্তব্য ছেড়ে এসেছি। হেলপার কে বললাম ঘোনা পাড়া কখন পার হয়েছি? সে বলল যে সে ডেকেছে অনেক যাত্রীও নেমেছে। আসলে আমি ঘুমিয়ে থাকায় বুঝতে পারিনি। আমি ধন্দে পরে যাই এখন কি করা উচিৎ সেটা ভেবে।

ড্রাইভার টি আমার দিকে এগিয়ে আসল। মধ্য বয়স্ক হবে টেনশনে র কারনে আন্দাজ করতে পারছিলাম না। তবে বেশ শক্ত পোক্ত চেহারা, মুখে সাদা কাচা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সে এসে বলল “ ভাইজান এই রাস্তা ধরি উল্টা দিক হাতটতি থাকেন এক দেড় কি। মি।

পর টুঙ্গিপাড়া বাজার পেয়ি যাবেন , সেখানে সারা রাত দোকান পাট কিছু খোলা থাকে। সেখানে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি সকালে বাস বা অটো পেয়ি যাবেন। “ আমি তার সাথে আর কিছু টুকটাক কথা বলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার ট্রাভেল ব্যাগ টা বাস থেকে নামিয়ে ঘাড়ে নিয়ে হাটতে শুরু করলাম। এক দেড় কি। মি।

এমন কোন দূর নয়। বাসের তিন জন যাত্রী আমার নেমে যাওয়া দেখে কেমন করে তাকাচ্ছিল। এ রাস্তায় সর্বহারা দের দউরাত্ত আছে শুনেছিলাম। আমার কাছেও বিশেষ কিছু নাই মাত্র তিন হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছি তার মাঝে ইতোমধ্যে পাচশত টাকা বাসের ভাড়া আর খাওয়াদাওয়া বাবদ শেষ হয়েছে। যেহেতু পথ হারিয়েছি তাতে আমাকেও সর্ব হারার মাঝেও ফেলা যায়।

হঠাত বেড়াতে এসে একটা অ্যাডভেঞ্চার মধ্যে পরে এসব চিন্তা গায়ে মাখলাম না। বাস থেকে একটু দূরে এসে একা হয়ে গেলাম। চাঁদ ডুবে যাওয়ায় বেশ অন্ধকার। কিছুক্ষইনের মধ্যেই অন্ধকার চোখ সয়ে নিল। খুব ভাল দেখানাগেলেও হাটতে অসুবিধা হচ্ছে না।

রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ। তার পাশে ছোট খালের মত। খালের ওপারে বাড়ী গুল কেমন অপার্থিব ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মার্চ মাস আমি চব্বিশ তারিখ রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি এখন পঁচিশ তারিখ। দিনের বেলা বেশ গরম থাকলেও রাতে ঝিরি ঝিরি বাতাসে বেশ শীত করছিল।

আমার হাতে ছোট্ট একটি LED টর্চ, টর্চ এর সাথেই ছোট্ট একটা চাকু আর কিছু প্রয়োজনীয় কিটস আছে। একটা বাইনোকুলার গলায় ৭.৫ কিমি রেঞ্জ এর। একটা লাইটার আছে পকেটে। ঘুরতে বের হলে এগুল আমার সাথেই থাকে। স্কুলে পড়ার সময় স্কাউট করতাম তখন কম্পাস ধরে কিভাবে পথ চলতে হেয় সেটা শিখেছি।

একটা কম্পাসও আছে পকেটে। ছোট হলেও বেশ কাজের। পকেট থেকে কম্পাস বের করে প্রথমে দেখে নিলাম কন দিকে যাচ্ছি। যদি কোন কারনে রাস্তা ভুল করে অন্য কোন রাস্তায় বা অন্ধ রাস্তায় ঢুকে পরি তাহলে বুঝতে শুবিধা হবে কোন দিকে আমাকে যেতে হবে। টর্চ মাঝে মাঝে যালাচ্ছিলাম।

কোন জনমানুষ নেই আশেপাশে। মাঝে মাঝে শুধু রাত জাগা পাখি গুল এক গাছ থেকে আর এক গাছে উড়ে যাচ্ছিল। রাতের নিঃশব্দের মাঝে এদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ গুল পরিবেশ কে ভৌতিক করে তোলে। আমি গ্রামেরই ছেলে। রাতের গ্রাম এর এসব আধ ভৌতিক শব্দ গুলর সাথে আমি পরিচিত।

কিন্তু অজানা একটা যায়গায় এ পরিবেশ অন্যরকম লাগছিল। হাটছিত হাঁটছই। সময় যেন থেমে গেছে। পাচ মিনিট সময় কে মনে হচ্ছে ৫ ঘন্টা। যেন মহাকালের পথে আমি এক সঙ্গিহীন যাত্রী।

যার গন্তব্য দূর দিগন্ত রেখায়। যায়গাটা টুঙ্গিপড়ার খুব কাছে। তার মানে হাজার বছর এর শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা এ গ্রামেই। আমাদের কাদা ছোড়াছুড়ির নোংরা রাজনিতী আমার কাছে ঘেন্না লাগে। কিন্তু এ মানুষটি ত আমাদের এক নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

সারা দেশে স্বাধিনতা প্রিয় বাঙ্গালীর কাছে অধিকার আদায়ের এক অবিসাংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিল। তার সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ ত হয়নি। কিন্তু এ অন্ধকার একাকি রাতে মনে হচ্ছিল আমি যেন তার পাশাপাশি হাঁটছি। কিছুটা আনমনেই হেটে যাচ্ছিলাম। হঠাত কথা থেকে যেন তিনটা কুকুর এর দল উপস্থিত হল।

এমন অন্ধকারে ব্যাগ হাতে আগন্তুক দেখে আমার পাশে প্রথমে কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। এরপর অন্ধকার বিদির্ন করে গা হিম করা স্বরে ডাকতে শুরু করল। রাতের বেলা অন্ধকারে সামনে দিয়ে একটা ছুঁচো গেলেও মনে হয় শেয়াল গেল সেখানে তিন টা হৃষ্ট পুষ্ট কুকুর এমন করে চেচাচ্ছে যেন এখনি আমাকে কামড়ে জমের বাড়ি পাঠাবে। ছোট বেলায় এমন এক পরিস্থিতিতে পরার পর থেকে আমি জানি এমন সময় কি করতে হয়। ভয়ে দৌর দিলে খবর আছে এরা আরও বিপুল উৎসাহে পিছু ধাওয়া করে।

মনে মনে যে একেবারেই ভয় পাই নি এটা বললে মিথ্যা বলা হবে। তার পরও নিজেকে জথা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে LED টর্চ এর তীক্ষ্ণ আলো একটা কুকুর এর চোখে ফেললাম। আলোতে চোখগুলো কেমন ভৌতিক লাগছিল। আল ফেলে আমি স্বাভাবিক ভাবে হাটতে থাকলাম। যেন কোন তাড়াহুড়ো নেই।

কিন্তু মন এর একটা অংশ বলছে একটা একশ মিটার দৌড় লাগাতে কিন্তু আমি জানি সেটা হবে খুবি ভয়ঙ্কর। আমার কৌশলটাতে কাজ হল। যেটার চোখে আলো ফেলেছিলাম সেটা মিয়ে গেল। সাথে সাথে অন্য দুটিও যেন আমার উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। দুটো চলে গেলেও যেটার চোখে আলো ফেলেছিলাম সেটা আমার পিছু পিছু আসতে লাগলো।

কিন্তু এবার বেশ শান্ত ভাবে। আমি ওটার সাথে গল্প করার মত করে কথা বলতে বলতে হাটছিলাম। অন্ধকার এমন রাতে একটা সঙ্গী খারাপ না, হোক না সেটা কুকুর। ব্যাগে চিপ্স এর প্যাকেট ছিল, ওটা বের করে কয়েকটা কুকুর টার দিকে ছুড়ে দিলাম। আমি একটা চিপ্স মুখে দিয়েই বুঝতে পারলাম আমি প্রচন্ড ক্ষুধার্ত।

শেষ ভাত খেয়েছি ফেরির ক্যান্টিনে। নদীর পানির মত ডাল, ভাত আর একটা মুরগীর ঠ্যাং। ২০ টাকায় অতি উপাদেয় খাবার ছিল। দুশ্চিন্তা ক্লান্তি আর উত্তেজনায় মনে হয় তারাতারি হজম হয়ে গেছে, এতক্ষন এক্তা ঘোরের মাঝে বুঝতে পারিনি। কিন্তু পেটে খাবার এর কনা ঢুকতেই ক্ষুধাটা মাথা চারা দিচ্ছে।

ক্ষুধার কথা মাথায় আসার পর পা টাও যেন চলতে চাইছে না। দেড় কিমি পথ এত দির্ঘ হয় জানা ছিল না। মোবাইল বের করে সময় দেখি প্রায় ৩০ মিনিট ধরে আমি হাঁটছি। সামনে কিছু দূরে হাল্কা একটা আলো চোখে পরলো রাস্তার পাশে। প্রথমে ভাবলাম হয়ত টুঙ্গি পাড়া বাজার এসে গেছে।

কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা চা স্টল। সাধারন স্টল গুলর মতই। এক পাশে কোনায় একটা ১৪” সাদা কালো টিভি তে কি যেন একটা বাংলা ছিনেমা চলছে। ভেতরে কেউ নেই। একপাশে কোনায় একটা পর্দা টাঙ্গানো দেখলাম মনে হয় ভেতরের কোন ঘর কে দোকান থেকে আলাদা করার জন্য এই ব্যাবস্থা।

আমি গলাটা পরিষ্কার করে ডাকলাম কেউ কি আছেন? প্রথমে কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম কোন সাড়া পেলাম না আবার ডাকলাম এবার কাজ হল। পর্দা ঠেলে প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া চুলের এক লক বের হয়ে এল। মধ্য বয়স্ক । বুড় নয়। গায়ে কোচকানো শার্ট, পরনে লুঙ্গি।

সুচাল মুখে কন দারি নেই, খোচা খোচাও না। চখ বেশ উজ্জ্বল। চখ দেখে মনে হল না যে সে ঘুম থেকে উঠছে। আর এ অজ পাড়া গায়ে এত রাতে দোকান খোলা দেখে একটু অবেক না হয়ে পারা গেল না। সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাআকিয়ে আন্তরিক ভাবেই বলল কি ব্যাপার কোথাথেকে আসছেন? তাকে বললাম আমার দূর্গতির কথা।

সে বলল অ আচ্ছা তা ঘোনাপাড়া নেমে কোথায় যাবেন? আমি বললাম ঘুরতে বেরিয়েছি, ঘোনাপারা নেমে মোল্লারহাট যাব। সেখানে আমার মামাত বোন দুলাভাই থাকেন। দুলাভাই সেখান কার টিএনও অফিস এ পি আই ও না কি জানি অফিসার। থাকেন উপজেলা পরিষদ কয়ার্টার এ। এখানে বলে রাখা ভাল যে বোনের বাড়ি দর্শন আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার ইচ্ছা ওখানে এক রাত থেকে আসপাশ এলাকাটা একটু ঘুরে দেখা ।

এরপর সেখান থেকে ষাট গম্বুজ মসজিদ হয়ে খান জাহান আলীর মাজার দেখে বাগেরহাট শহরটা এক চক্কর দিয়ে খুলনা যাওয়া। সেখানেও একটু ঘুরে যশোর হয়ে ঢাকা ফিরে আসা। দর্শনিয় স্থান গুলো সবাই যে ভাবে আয়োজন করে দেখতে যায় সেভাবে ঘুরতে আমার ভাল লাগে না। রাস্তায় বেরিয়ে আশপাশের মানুষ এর সাথে মেশা, সস্তার দোকানে বসে চা খেতে খেতে সাধারন মানুষ এর সাথে কথা বলা বা উদেশ্যহীন ভাবে হেটে বেরানো এভাবে ভবঘুরে হয়ে ঘুরতে আমার বেশ লাগে। একা হয়ার সুবিধা হল এখানে নিজের ইচ্ছায় সব কিসছু করা যায়।

কার কথা চিন্তাও করতে হয় না বা কারকথা শুনতেও হয় না। আর এভাবে মানুষ এর সাথে মিশ্লে সেই এলাকা সহ ঐ এলাকার মানুষ গুলো সম্পরকে একটা ধারনা পাওয়া যায়। যাহোক লোকটিকে বললাম ভাই আমি ক্ষুধার্ত আমাকে কিছু খেতে দিন। বলাটা এমন ছিল যে আমি দোকানদার কে বলছি না আবদার করছি। সে বলল বাহিরে বাল্টিতে পানি আছে হাত মুখ ধুয়ে নিন আমি ব্যাবস্থা করছি।

ব্যাগটা রেখে হাত মুখ এ পানি দিয়ে বেশ ঝরঝরে লাগছিল। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে ভেতরে এসে দেখি সে মাঝারি এক গ্লাস ভর্তি দুধের সড় আর দুট পাউরুটি আগুনে সেকে টেবিলে রেখেছে। পেটে ক্ষুধা থাকলেও সত্যি আমি কল্পনাতেও এত ভাল খাবার আশা করিনি। ছোট বেলায় আমাদের বাড়ির সামনে চা র স্টল টাতে এমন সড় পাওয়া যেত। উপর দুই চামুচ চিনি দিয়ে খেতে বেশ লাগত।

চমক বেশিক্ষন থাকল না, ক্ষুধা জানান দিচ্ছে পেটে। এক রকম হাপুহুপুর করেই খাবার টি খেলাম। রাত শেষ হয়ে আসছে ঘুম ঘুম ভাবো কেটে গেছে। আমি দোকানের ঢাকায় সদর ঘাট এ লঞ্চ এ চাকরি করেছে। লঞ্চ গুল সাধারনত রাতেই ছাড়ে তাই এ দীর্ঘ সময়ে সে খুবি কম রাত রাতে ঘুমিয়েছে।

আর সে অভ্যাসটিই রয়ে গেছে। কোন কাজ নেই তাই দোকান খুলে বসে থাকে, মাঝে মাঝে আমার মত কিছু মানুষ হয়ত আসে। ২ট ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার পরিবার। আমি জিজ্ঞেস করলাম কখন রওনা হওয়া যায়? সে বলল, ফর্সা হক তার পর। একটু পর আজানের শব্দ ভেসে আসল।

ধীরে ধীরে পুব আকাশে আলোর রেখা ফুটে উঠছে। দূর অন্ধকার গামের পেছন্টা দেখতে দেখতে লাল হয়ে উঠল। পাখি গুল নানা সুরে গাইতে গাইতে সকাল টাকে মুখর করে তুলছে। যেন তারা নতুন আর একটি দিন কে স্বাগত যানাচ্ছে। কত সুন্দর কত পবিত্র সে দৃশ্য।

মন টা ভালোলাগায় ভরে ওঠে। অল্প সময় এর মাঝেই দোকান মালিকটির সাথে বেশ ভাব হয়ে যায়। আমি ব্যাগ ঘারে নিয়ে বিদায় নিতে চাইলে সে বলে আর একটু বসেন পরিবার ভাত রানতেছে খেয়ে তারপর যাবেন। আমি বলি নানা এত কষ্ট করার দরকার নেই। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা।

মানুষ এখন কত সরল আছে তা ঢাকা শহরে থেকে বুঝা যায় না। এ মানুষ গুল দেখার লোভেই আমি মাঝে মাঝে বের হই। খাবার আয়োজন দেখে সত্যি আমার জিভে জল এসে গেছে। ধোয়া ওঠা গরম ভাত, লাল শাক, আলু গোল করে কেটে মোলায়েম করে ভাজি করা। পাশে একটা ঘী এর বয়াম।

কিছুটা জমে নিচে পরেছে। বাঙ্গালীর এর থেকে ভাল ব্রেকফাস্ট আর কি হতে পারে? খুবি তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। তার বৌ কে ধন্যবাদ দিতেই সে যেন লজ্জা পেল। বয়স এ তার বৌ টি তার থেকে বেস ছোট কিন্তু কত সেটা বোঝা মুশকিল। তাদের দুইটি ছেলে রনি আর রায়হান।

রন পড়ে ৫ম শ্রেনীতে আর রায়হান ৮ম শ্রেনীতে। তাদের বাড়িটি তে দুটি ঘর। টিনের বেড়া টিনের চাল। মাঝে মাঝে খোপ খোপ কয়েকটি জানালা। পাশেই ছনের চালার রান্না ঘর।

সকালের মিষ্টি রোদে উঠনে মাদুর পেতে খেতে দিয়েছে। অতিথি র জন্য কড়ির প্লেট কাচের গ্লাসের ও ব্যাবস্থা করেছে। আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র এক মানুষ। তাদের এ অকৃত্তিম ভালোবাসায় নিজেকে ধন্য মনে করি। মানুষ গুলোর মুখি বলে দেয় কতটা সুখী তারা।

তাদের চাহিদা খুবি অল্প কিন্তু সন্তুষ্টি আকাশ ছোয়া। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটতে শুরু করলাম। হয়ত তার সাথে আর দেখা হবে না কিন্তু এ কথা কি আমি কোন দিন ভুলতে পারব? ১০ মিনিট হাটার পর একটা মোড় ঘুরে টুঙ্গি পাড়া বাজার এ চোলে আসলাম। একটা বাস দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে শুনলাম এটি ঘোনাপাড়া, মোল্লারহাট হয়ে বাগেরহাট যাবে। যেনে নিয়েছিলাম মোল্লারহাট ৬ কিমি এর মত।

বাসে যেতে ইচ্ছা করছিলনা। ঘোনাপাড়া পর্যন্ত অটো যায় তিন চাকার ইলেক্ট্রিক গাড়ি। সাধারনত শেয়ার এ যায় আমি একাই একটা নিলাম। ৩০ টাকা মাত্র। ইচ্ছা একটু আশপাশ দেখতে দেখতে যাওয়া।

কিছুদুর যেতেই সাদা ধব্ধবে দাড়িওয়ালা এক লোক অটো কে থামা র ইঙ্গিত করল। দ্রাইভার বলতে যাচ্ছিল রিজার্ভ নেয়া যাবে না কিন্তু আমি বললাম, না থামাও। মনে হচ্ছিল না থাম্লে বেয়াদবি করা হবে। উনি উঠে আমার পাশে বসলো। আমি সালাম দিলাম।

উনি জাবেন বাগেরহাট এ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বাড়ি কোথায় কই যাচ্ছি এইসব। ঘুরতে বের হয়েছি সুনে বেশ খুশি হলেন। ঘোনাপাড়া নেমে দেখলাম ভ্যান রিকশা আছে আবার বাস ও আছে। অল্প রাস্তা তাই ভ্যান এ যাওয়াটাই আমার কাছে উত্তম মনে হল। আমাদের বগুড়া এলাকায় যাত্রী বাহী ভ্যান গুলোতে সরু গদি থাকে বসার জন্য কিন্তু এখানকার গুল শুধু কাঠের পাটাতন।

চার দিকেই যাত্রী রা পা ছড়িয়ে বস্তে পারে। মুরুব্বিই তার পরিচিত এক ভ্যান ঠিক করে দিল। যদিও তার দরকার ছিল না কিন্তু এটাই আমাদের বাঙ্গালী আন্তরিকতা। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভ্যানে উঠে বস্লাম। এ রাস্তা টি বাগেরহাট শহর এর পাশ দিয়ে খুলানা পর্যন্ত গেছে।

বেশ শুন্দর ঝকঝকে রাস্তা। গাড়ি টারি নেই বললেই চলে। সকালের বিশুধ্য ঝিরি ঝিরি বাতাসে মনটা ভাল হয়ে যায়। ভ্যানয়ালা টি মৃদুভাষী , আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু জমলনা। মোল্লারহাট উপজেলা কমপ্লেক্স এ ঢুকে চোখে কেমন জানি লাগল।

বিল্ডিং গুল কেমন যেন খুবি জীর্ন ভাব, দেয়ালে নোনা ধরার দাগ। অফিস বিল্ডিং টার সামনে দিয়ে মসজিদটাকে হাতের ডানে রেখে সামনে এগিয়ে গিয়েকোয়ার্টার গুলো দেখতে পেলাম। পুরোন বাড়ির মত দোতলা দালান। উপরে অঠার সিড়ি বাইরে প্রত্যেক্টা বাড়ির সামনে একচিলতে আগাছা সমৃধ্য বাগান। ফোনে আপুর সাথে কথা বলেছি একটু আগে দেখি ভাইয়া আপু দাঁড়িয়ে আছেন।

আমাকে দেখে এগিয়ে এল রাস্তায় কোন কষ্ট হয়েছে কি না এসব কথা জিজ্ঞেস করছিল। আমি ভাড়া মিটিয়ে তাদের সাথে বাসার দিকে হাটতে লাগলাম। কালকে রাতের ঘটনা আমি পুরোটাই চেপে গেলাম। শিড়ি দেইয়ে উপরে উঠে আসলাম। বাসাটা বেশ পছোন্দ হল।

কেমন যেন এক রহস্য রহস্য ভাব আছে বাসাটির মাঝে। তখন বাজে সকাল সাড়ে সাতটা। সীদর দুর্গত এলাকা এ টি। ত্রান কাজ তখন চলছে। ভাইয়া বেশ ব্যাস্ত।

উনি ঐ সকালেই বেরিয়ে গেলেন। আপু বললেন এখানে সাধারনত পুকুরেই গোসল করতে হয়, পানিতে আর্সেনিক আয়রন এর কারনে টিউবয়েল এর পানি ব্যাবহার করা যায় না। খাবার পানি আসে বেশ দূর থেকে। এক জনের সাথে মাস কাবারি চুক্তি করা আছে। আপু বলল কাপড় চেঞ্জ করে গোসল করে এস আমি নাস্তা বানাচ্ছি।

আমি গেলাম পুকুরে গোসল করতে, শান বাধানো পুকুর ঘাট। পুকুরে গোসলে মজাই আলাদা। কিন্তু আরোকয়েক জন থাকলে আরো ভাল হত। আমি সাত্রে পুকুর এর মাঝখানে গিয়ে আবার ফিরে আসলাম। গা মুছে বাসায় এসে একটা গেঞ্জি গায়ে দিতেই বিছানার দিকে চোখ গেল।

মনে হল নাস্তা হতে হতে একটু গড়িয়ে নেই। গড়াতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই আপুও আর ডাকেন নি। ঘুম ভেঙ্গেছে বেলা ১২ টায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি আপু দুলুর এর খাবার বানাতে ব্যাস্ত। আমি রান্না ঘরে গিয়ে আপু র সাথে গল্প করছি আর সকালের নাস্তা গুল এটা অয়াটা মুখে দিচ্ছি।

দুপুরে ভাইয়া এলে একসাথে খেয়ে নিলাম। ভাইয়া ব্যাস্ত থাকায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে পারছেন না তাই একজন কে সাথে দিতে চাচ্ছিলেন আমি না করে দিলাম। ভাইয়া বললেন যেখানেই যাও সন্ধার আগে ফিরে এস যায়গাটা ভাল না। আমি মাথা নাড়লাম। বিকাল ৩ টা নাগাদ বাসা থেকে বের হলাম।

কাল ২৬ মার্চ অবশ্যি কোন স্কুল বা কলেজ মাঠে কালকের অনুষ্ঠান আয়োজন চলছে। এগুল দেখতে আমার ভাল লাগে তাই খুজে খুজে স্কুল বের করলাম কিন্তু আমাকে হতাশ হতে হল। ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ইয়ান ঠিক করলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরার জন্য। ভাড়া নিয়ে একটু ভয়ে ছিলাম। কিন্তু ভ্যান ওয়ালা টি আমার ভয় ভাঙ্গিয়ে ১০০ টাকায় রাজি হয়ে গেল।

তাকে বললাম তমার ইচ্ছা মত ঘুরতে। সে মহা উৎসাহ নিয়ে আমাকে বাজার টি এক চক্কর দিল। বেশ মিশুক মানুষ। হাল্কা পাতলা গড়নের। বয়স ৩০ এর কোঠায়।

মুখে চে র মত দাড়ি। বাজার ঘুরে সে জিজ্ঞে করল যে মেলা দেখতে যাব কি না। বাজার থেকেবেশি দূরে হবে না সেটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম কিসের মেলা। সে তার সদুত্তর দিতে পারল না শুধু এটুকু বুঝলাম যে হিন্দুদের কোন পুউজ উপলক্ষে মেলা।

মেলা টি না কি বেশ বিক্ষাত এ অঞ্চলে। বললাম চল দেখে আসি। বেশিদূর নয় মানে যে কত দূর তা বুঝিনি। আর রাস্তার অবস্থাও যাচ্ছেতাই। মাঝে মাঝেই ধূলার সাগরে পরতে হয়।

আমর যখন মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকছি তখন শন্ধ্যা হয় হয় করছে। সপ্তডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে মেলা বসেছে। কিন্তু মাঠের কোথাওকোন মন্দির দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভ্যান ওয়ালা টি ভ্যান টি নিরাপদ যায়গায় রেখে এসে বলল চলেন আগে পুউজা দেখে আসি। আমি বললাম চলেন।

তার পিছে পিছে একটা বাড়ির উঠনে উপস্থিত হলাম। দেখি উঠনের একপাশে মন্ডপ ধূপের গন্ধ আসছে, ঢাকের শব্দ আসছে মাইকে পুজর গান বাজছে। মন্ডপের কাছে গিয়ে দেখি দুর্গা পূজা। তখন চৈত্র মাস দূর্গা পূজা ত আশ্বিন এর দিকে হওয়ার কথা। আমি কিছু বিঝতে পারছিলাম না।

শুধু এক বাড়িতে পূজা না এমন সাত টা বাড়িতে পূজা হচ্ছে। এ জন্যই না কি এ এলাকার নাম সপ্ত ডাঙ্গা। , এখন জানি না তারা ঐ সময় কেন পূজা করছিল শুধু কোথায় যেন শুনেছিলাম এটাকে অকাল বোধোন বলে। বাংলাদেশের আর কোথাও এ পূজ হয় কি না আমার জানা নাই। ভ্যান ওয়ালাটি খুবই উৎসাহে আমাকে সব কিছু ঘুরে দেখাচ্ছে।

পূজ দেখা শেষ করে মেলা প্রাঙ্গনে এসে সে বলল চলেন মিষ্টি খাই। মেলার মিষ্টি সাধারনত ভাল হয় না। কেমন আটা আটা লাগে। কিন্তু সে যে ভাবে বলছিল মনে হল আমি না খেলাম সে খেতে পেলে খুশি হবে। তাই গেলাম তার সাথে।

সে বেছে বেছে একাটা দোকানে বসলো। দোকানদার তি তার পরিচিত। সে আধা কেজি মিষ্টীর কথা বলল আমি ত আতকে উঠলাম বললাম কে খাবে এত গুলো সে হেসে বলল আরে আসুক আগে তার পর দেখা যাবে। একটু রাগ হচ্ছিল লোকটার উপর। চুপচাপ বসে আছি।

একটু পর মিষ্টি আসল মাটির সরাতে করে। মিষ্টির চেহারা খারাপ না। ভদ্রতা করে একটা মুখে দিলাম। মুখে দিয়েই আমি থ। আমি বাজি ধরে বলতে পারি বাংলাদেশের যত নাম করা মিষ্টির দোকান আছে সে সব দোকানে যত মিষ্টি তৈরি হয় এ মিষ্টী তার বাবা।

কিভাবে যে পেটে আধা কেজি চালান করেছি বুঝতেই পারিনি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাগ্রিবের আজান ভেসে আসছে, পাশ থেকে ঢাকের আওয়াজও। সংখ্যা লঘু আর ধর্মের কথা বলে যারা বড় বড় চিৎকার করেন তাদের কানে অজ পাড়া গায়ের এ সাম্যের ঐকতান পৌঁছাবে না। আমরা বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি কত নিবিড় ভাবে থাকতে পারি সেটা তারা জানে না।

মেলাকে পেছনে ফেলে ফিরে যাচ্ছি। ঢাকের আওয়াজ স্তিমিত হয়ে আসছে। গধূলীর আলোয় আকাশ রাঙ্গা। কাল স্বাধীনতা দিবস। দূর কোথা থেকে ভেসে আসছে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।