আমি সুমাইয়া বরকতউল্লাহ। ছাত্রী। লেখালেখি করা আমার ভীষণ পছন্দ। আমি ছড়া, গল্প লিখি। পত্রিকায় নিয়মিত লিখি।
লেখালেখি করে বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছি। শিশু অধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ (প্রিণ্ট মিডিয়া) পর পর ৩ বার জাতিসংঘ-ইউন আমাদের বাড়ির তিনটা বাড়ির পরেই তিন্নিদের বাড়ি। তিন্নি খুব ছোট একটা মেয়ে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা বলতে পারে। তার বাবা থাকে বিদেশে।
ঈদের দুদিন আগের রাতে তার বাবা ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার কথা। সবারই আনন্দ। কিন্তু তিন্নির আনন্দ ছিল অন্যরকম। আমরা বাড়ি গিয়েছি শুনেই তিন্নি এক দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে। তার হাতে তার বাবার একটা পুরনো ছবি।
সে আমার সামনে এসেই আমার মুখটা টেনে নিয়ে বলছে, ‘এই যে আমাল বাবাল ফুটু। এই যে চুক, এই যে নাক, এই যে বাবাল কান, এই যে চুল, আমাল বাবা খুপ সুন্দল। এই যে বাবা হাসে হি: হি:। ’
আমি বললাম, তোমার বাবা আসলেই খুব সুন্দর। তোমার বাবা ঈদ করতে আসবে না তোমার কাছে?
সে চোখ বড় করে বলে, ‘আমাল বাবা আততেতে।
আমাল বাবা উলুজাজে আততে। আমাল বাবা ঈদ নিয়ে আততে। আমাল লাল ফলক আনবে, ডুটা আনবে, মুজা আনবে, চিলুনি আনবে আল মজা আনবে। ’ তোমালে দিতাম না বলে সে তার সমস্ত শরীর ডাতে-বামে মোচড়াতে লাগল।
আমি বললাম, ত তুমি কী খাওয়াবে তোমার বাবাকে?
তিন্নি কিছু না বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তার বাড়ি।
এই ছোট মেয়ে বাবার জন্য যে আয়োজন করে রেখেছে, তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সে তার মাকে বলে নতুন ফরাশের চাদর আর বালিশ পেতেছে খাটে। বালিশের ওপর সে রেখে দিয়েছে একটি ফুলের তোয়ালে। বাবার পুরনো জুতো মুছে পুছে রেখেছে খাটের তলে। বালিশের পাশেই সে তার বাবার জন্য সবচেয়ে দামি প্লেট, গ্লাস মুছে রেখে দিয়েছে।
আমরা যখন খাটে বসতে গেলাম সে বসতে দিল না, ‘আমাল বাবাল খাট, বাবাল চাদল নত্ত হবে ত’ 'বলে ঠেলতে ঠেলতে আমাদের দূরে সরিয়ে দিল।
তার মা অনেকটা রাগ করেই বলল, ‘কী করব কওতো। এই বাবা পাগল মাইয়া লইয়া বড়ো বিপদের মধ্যে আছি। সারাদিন বাবা, বাবা করে, ছবি লইয়া ঘুরে, যারে দেখে তার কাছেই বাবা আসার কথা বলে। ইত্তা বাল্লাগে কতক্ষণ, কও তো।
’
তিন্নির বাবার ফোন এলো রাতে। কাঁদতে কাঁদতে জানালো, একটা সমস্যা হয়ে গেছে, ঈদের আগে দেশে আসতে পারবে না। তার এই ফোন পেয়ে তার মা কান্নাকাটি করতে লাগল। আন্টিরা গেল দৌড়ে। তিন্নির মা বারবার বলছে, ‘এখন আমি মাইয়ারে কী কমু কন।
এই মাইয়ারে তো আমি মানাইতে পারতাম না। মাইয়াডাতো কানতে কানতে শেষ অইয়া যাবে। মাইয়া যদি জানে তার বাবা আসবে না কী অবস্থাটা অইবে, কন। আমার মাথায় কিচ্ছু ধরছে না। ’ সবাই বুঝিয়ে তিন্নির মাকে শান্ত করেছে কিন্তু তিন্নিকে কী বলে শান্ত্বনা দিবে কেউ বুঝতে পারছে না।
ঈদের আগের রাতে তিন্নি তার বাবার অপোয় থেকে আর ঘুমায় না। অনেক রাতে ঘুমালো। ঘুমের মাঝেও সে নাকি বাবার সঙ্গে কথা বলে। ঈদের দিন সকালে সবাই যখন ঈদ করছে তিন্নি তখন তার বাবার ছবিটা নিয়ে একা একা কথা বলছে। তার মা তিন্নির দিকে তাকিয়ে গোপনে চোখের পানি ফেলে।
তার মা অনেক চেষ্টা করেও তিন্নিকে গোসল করাতে পারেনি, কাপড় পরাতে পারেনি। আমাদের কাছে এসে বলল তিন্নিকে গোসল করিয়ে কাপড় পরিয়ে দিতে। গেলাম। বললাম, তিনি আপুনি চলো চলো গোসল করিয়ে দেই, নতুন জামা পরিয়ে দেই, আজ না ঈদ।
তিন্নি দুহাতে সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘না, না, একন ঈদ না।
আমাল বাবা ঈদ নিয়ে আততে। আমি বাবাল থাতে ঈদ কলবো। যাও। ’
এই দিকে একটু পরে পরে তিন্নির বাবা ফোন করে কাঁদে আর তিন্নির খবর নেয়। তিন্নির বাবাও কিছু খায়নি।
খালি আফছুছ করে। তিন্নির হাতে ফোন দেয়নি। বাবার জন্য তিন্নির নানা আয়োজনের কথা আগেই বলেছিল বাবাকে। এসব মনে করে তার বাবা খালি কাঁদে।
ঈদের দিন।
সারাদেশের মানুষ আনন্দ আর হই চই করছে। তিন্নিছোট্ট একটা ঘরে বসে আছে তার বাবা অপেক্ষায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।