মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী “আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা”।
বাড়ির সামনের জ্যোৎস্নাস্নাত বিশাল উঠোনটায় শিতলপাটি বিছিয়ে মা তাঁর আদরের সোনামণিকে ঘুম পাড়াচ্ছেন। মায়ের সেই ছোট্ট সোনামণি একদিন অনেক বড় হয়। কোন এক কালবৈশাখীর কালো মেঘে শৈশবের সেই রূপালী চাঁদটা হঠাৎ হারিয়ে গেলে তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা। ভাবে ঈশ মাকে যদি বোঝাতে পারতাম, মা তোমার সোনামণির কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে না গেলেও ঠিকই তোমার সোনামণিরা চাঁদের কপালে টিপ দিয়ে এসেছে।
জানো মা তারা শুধু এ-করেই ক্ষান্ত হই নি। খুঁটে খুঁটে তাবৎ দুনিয়ার সৃষ্টি রহস্যও বের করে এনেছে। মা শুনে আর হাসে। বলে, তাই বুঝি !
হাল ছাড়ে না ছেলে। মাকে সে বুঝিয়ে ছাড়বেই।
আসরে যোগ দেয় আরো দু’জন। দু’ছোটবোন। ছেলে শুরু করে। সে বহুদিন আগের কথা। কোন অস্তিত্বই ছিল না মানব জাতির।
কোন গাছপালা কিংবা কোন পশুপাখিরও না। এমনকি পৃথিবী,চাঁদ,তারা,সূর্যও না। ছিল শুধু একবারে ঘন,ভয়ানকভাবে উত্তপ্ত এক ছোট্ট বিন্দু। একদিন সেই বিন্দুটা তার ভেতরের উত্তপ্ত বস্তুর ভয়াবহ চাপ সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ করেই ফুলে ফেঁপে উঠলো। যত সময় যেতে থাকলো এর আকৃতি তত বেড়েই চললো।
কমতে শুরু করলো ভেতরের বস্তুর ঘনত্ব। ধীরে ধীরে তা শীতল হতে থাকলো। আর সেই মোটামুটি শীতল বিশ্বের কিছু পদার্থ পরষ্পর মিলে তৈরি করে আমাদের দেখা এই সুবিশাল বিশ্বজগৎ।
-‘তোকে এত কিছু কে বললো? কিছুক্ষণ আগে না বললি তখন কেউই ছিল না। আমি বাবা তোদের এত শত বুঝি না।
তুই তোর ছোটবোনদের বুঝা’।
মা উঠে গেলে ছেলে হতাশ দৃষ্টিতে দু’ছোটবোনের দিকে তাকায়। এদের একজন এবার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। আরেকজন নবম শ্রেণীতে। ভাইয়া যখন মহাবিশ্বের গল্প বলে তখন মুগ্ধ হয়ে ওরা শুনে।
ভাইয়ার কাছ থেকে ওরা আগেই শুনেছে এরকম একটা বিগ ব্যাং থেকে জন্ম নিয়েছে এই মহাবিশ্ব। জন্ম নিয়েছে স্থান এবং সময়। তারপর প্রায় ১২ বিলিয়ন বছর ধরে মহাবিশ্ব নিয়েছে বর্তমান রূপ।
-‘আচ্ছা ভাইয়া,তুমি বলছিলা বিগ ব্যাং এর নাকি দুইটা চাক্ষুষ প্রমাণ আছে। একটা তো হল বেলুনের ফুটকির মত গ্যলাক্সিগুলোর দূরে সরে যাওয়া।
যেটা আমরা ডপলার ক্রিয়া দেখে বুঝতে পারি। কিন্তু আরেকটা প্রমাণের কথা তো বল নাই’! বলছিল শান্তা,দু’বোনের মাঝে বড় জন।
ওহ,তাই নাকি। তবে শুন। তোরা তো জানিসই কোন বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এসে পড়লে তবেই সেই বস্তুটা আমরা দেখি।
এই আলোটা আসলে একধরনের বিকিরণ। এরকম বিকিরণ আছে অসংখ্য। এতসব বিকিরণের ভিন্নতার পেছনে আসলে কাজ করছে এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য। বিকিরণের মুল কণা ফোটনের শক্তি কমে গেলে এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। ফলে দৃশ্যমান আলো পরিণত হয় অদৃশ্য অন্য বিকিরণে।
আমাদের চোখের রড আর কোণ কোষ শুধু কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের প্রতি সাড়া দেয় বলে আমরা শুধু এই দৃশ্যমান আলো বিকিরণ দিয়েই দেখি। তাই বলে মানুষ কি আর বসে আছে ? নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে সে আবিষ্কার করছে আরো নানারকম চোখের। এক চোখ দিয়ে সে শুনে রেডিও। আরেক চোখে সে দেখে টেলিভিশন। এমনি এক চোখ ফেলে সে আবিষ্কার করে বসলো মহাবিশ্বের আদিমতম জগতের ছবি।
ব্যাপারটা একবারেই কাকাতলীয়। ১৯৬৪ সাল। এক রেডিও টেলিস্কোপ বানানোর ল্যাবে কাজ করছিলেন দুই সহকারী জ্যোতির্বিদ পেনজিয়াস আর উইলসন। তাদের ঘাড়ে দায়ীত্ব পড়লো এমন একটা অ্যান্টেনা বানানো যা দিয়ে পৃথিবী থেকে যোগাযোগের কাজ সারানো যাবে। অনেক খেটে খুটে কাজ করে বানিয়েও ফেললেন সেই অ্যান্টেনা।
কিন্তু দূঃখের বিষয় হল তাঁদের এতো কষ্টের পরেও সেই অ্যান্টেনাকে কোনভাবেই গোলমাল মুক্ত করা যাচ্ছিল না। তাঁদের রিসিভার যন্ত্রে একবারে হালকা একটা খস খস শব্দ হচ্ছিল। তার মানে কোথাও না কোথাও একটা গোলমাল রয়েই গেল। সেটা দেখতে আবার অ্যান্টেনার ভেতর গেলেন দু’জন। দেখলেন আরে সেখানে পাশের বাড়ির কবুতরগুলো মল ছেড়ে বসে আছে।
মল পরিষ্কার করে এদেরকে চিরতরে ঐ জায়গা থেকেই তাড়িয়ে দিলেন দু’বন্ধু। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। হতাশ হয়ে দিন গুনছিলেন তাঁরা। তাঁদের এই ব্যর্থতার কিংবা সফলতার খবর কানে পৌছলো আরেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট ডিকের।
বিখ্যাত সেই অ্যান্টেনা
বেশ কয়েক বছর যাবৎ যিনি কাজ করছিলেন বিশ্ব সৃষ্টিতত্ব নিয়ে।
তিনিও একই ধরনের একটা অ্যান্টেনা বানানোর চেষ্টা করছিলেন। পেনজিয়াস-উইলসনের আবিষ্কারই যে ১৯৪০ সালে আলফার আর হারমেনের ভবিষ্যৎবাণী করা পটভূমি বিকিরণ তিনি তা ঠিকই বুঝতে পারেন। আর তাই পরীক্ষা করে দেখলেন আকাশের সব প্রান্ত থেকে এ বিকিরণ সমভাবে আসে কিনা। এটি যে সেই পটভূমি বিকিরণই তাতে সন্দেহ রইলো না যখন তাঁরা দেখলেন আকাশের সব প্রান্ত থেকেই সমহারে ছুটে আসছে এই মহাজাগতিক বিকিরণ। তাঁরা এই বিকিরণের নাম দিলেন মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ (মাইক্রোওয়েভ) পটভূমি বিকিরণ [Cosmic Microwave Background Radiation] বা সি এম বি আর।
এ থেকেই বোঝা গেল আমাদের মহাবিশ্ব সব দিক থেকেই প্রতিসম। তোরা ইচ্ছে করলে নিজেরাও খুব সহজেই দেখতে পারিস। টিভিটা অন কর। এমন একটা চ্যানেলা যা যেখানে কিছুই সম্প্রচার হচ্ছে না। প্রথম দেখায় শুধু একটা নীল পর্দা ভাসবে তোদের চোখের সামনে।
তারপর আরেকটু ভালোভাবে দেখলে দেখবি সেই নীলের মাঝে সামান্য দু’একটা করে ফুটকি দেখা যাচ্ছে কিংবা হালকা একটা খচ খচ শব্দ। এটাই সি এম বি আর। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৮ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন দু’জনকেই নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।
-সবই বুঝলাম। কিন্তু এটা কীভাবে বিগ ব্যাং কে সমর্থন করে? ছোটবোন পলির প্রশ্ন।
হুম,এবার আসল ব্যাপারটা বলি। বিগ ব্যাং এর প্রায় ৩ লক্ষ বছর পরের কথা। ক্রমাগত সম্প্রসারণ আর শীতল হওয়ার ফলে মহাবিশ্বের তখনকার তাপমাত্রা প্রায় নেমে এলো ৩০০০০ কেলভিন-এ। পুরো মহাবিশ্ব তখন একটা ইলেক্ট্রন, প্রোটন আর বিকিরণ কণা ফোটনে পরিপূর্ণ এক স্যুপের মত। এই অবস্থায় ঋনাত্মক ইলেকট্রন আর ধনাত্মক প্রোটনের মাঝে ক্রিয়ারত কুলম্ব বল ঠিক ফল পাচ্ছিল না অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে।
আর সেই আয়নের স্যুপে অতি শক্তিশালী ফোটনগুলো শুধু বারবার শোষিত আর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এক ইলেকট্রন থেকে অন্য ইলেকট্রনে। ফলে সেই সময়কার মহাবিশ্বটা ছিল একবারেই অস্বচ্ছ। দিন গড়াতে থাকে। আকারে বাড়তে থেকে সেই শিশু মহাবিশ্ব। এক সময় সেই স্যুপের ঘনত্ব কমার কারণে তাপমাত্রা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে কুলম্ব বল।
অস্তিত্ব প্রকাশ ঘটে প্রথম পরমাণু হাইড্রোজেনের। আয়নের স্যুপ পরিণত হলো পরমাণুর স্যুপে। ফলে এখন আর ফোটনকে আটকে দেয়ার মত অবশিষ্ট কেউ রইলো না। একবারে স্বচ্ছ হয়ে পড়লো মহাবিশ্ব। সেই যে মুক্ত হল ফোটন তা এতটা বছর ধরে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌছলো আমাদের পৃথিবীতে।
পথ পাড়ি দেয়ায় ফোটনের শক্তি গেল কমে। আর তাই তা গামা রশ্মি কিংবা আলোর ফোটনের মত এত শক্তিশালী না হয়ে আরো কম শক্তিশালী মাইক্রোওয়েভ বা অণুতরঙ্গ ফোটনের মত হল। পেনজিয়াস আর উইলসন এই অণুতরঙ্গ ফোটনকেই ধরেছিলেন তাঁদের অ্যান্টেনায়। সে থেকে শুরু। একের পর এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার পালটে দিল মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের ধারণা।
একটু আগেই বলছিলাম এই সি এম বি আর সবদিক থেকেই সুষম। কথাটা আসলে পুরোপুরি সত্য না। আমার ল্যাপটপটা নিয়ে আস,আমি কিছু ছবি দেখাচ্ছি তোদের। এই ছবিটা পৃথিবীর। একই অ্যান্টেনা যদি পৃথিবীর দিকে তাক করাই তবে আমরা এই ঝাপসা ছবিটা পাবো।
এই ধরনের মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের ছবি তোলার কাজটা করে কিন্তু মহাকাশের কোব (COBE-Cosmic Background Explorer) স্যাটেলাইট।
সাত ডিগ্রি রেজুলেশনে কোবের তোলা পৃথিবীর ছবি
কোবের তোলা আকাশের ছবি
কি? পৃথিবীর ছবির তুলনায় আকাশের ছবিটা অনেক বেশি সাদামেটে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন মহাবিশ্বের সব দিক থেকে সমান তালে ছুটে আসছে এই সি এম বি আর। একটা সুষম আদিম মহাবিশ্বের ছবি। মহাবিশ্বের শৈশবের ছবি।
যেখানে বিরাজ করছে অগণিত আহিত কণার দল। একটা তরল স্যুপে। উপরের এই ছবিটারই কনট্রাস্ট বা উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে কমিয়ে দেখাচ্ছি তোদের। কী দেখছিস? পৃথিবীর ২ মেরুর মত এই তাপমাত্রা চিত্রেরও দুটা রঙ। এটা আসলে সি এম বি আর এর সাপেক্ষে আমাদের নড়াচড়ার জন্য দেখাচ্ছে।
ডপলার ক্রিয়া আর কি। সিএমবিআর এর যে অংশ আমাদের কাছে তাকে নীল আর দূরের অংশকে লাল দেখাচ্ছে।
১/১০০০ লেভেলে দৃশ্যমান বিচ্যুতি
-তাহলে দুই রঙের মাঝের ঐ গোলাপী রঙ্গা অংশটি কিসের?-জানতে চাইলো শান্তা।
এটা আসলে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ডিস্ক থেকে আসা কিছু মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের সাথে সিএমবিআর এর উপরিপাতনের ফল। দাড়া ছবিটা আরেকটু জুম করে দেখাই তোদের।
১/১০০০০ লেভেলে দৃশ্যমান বিচ্যুতি
হে হে ! কি দেখছিস ! ঝামেলা আছে কিছু। আবারো বলছি মাঝের ঐ গোলাপী রঙ্গা অংশ কিন্তু আমাদের মিল্কিওয়ের কারণে এরকম দেখাচ্ছে। মজার ব্যাপার হল এই লেভেলে এসে আমরা আর সমতাপমাত্রায় বন্টিত বিশ্ব দেখি না। তাপমাত্রার খুবই সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য ধরা পড়ে আমাদের সামনে।
-ধূর।
এই ছবি দেখে তো কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। পুরো অস্পষ্ট। স্যুপ তো সমবন্টিত আর সুষম ছিল। তাহলে এসব কী দেখা যাচ্ছে। আর এটাতো পুরোটাই গোলমেলে লাগছে।
ভালো কোনো ছবি নাই?
শান্তার অধৈর্য মুখ দেখে মাহমুদ লেপটপের আরেকটা ফোল্ডার খুলতে গেল। এই যা! চার্জ শেষ। কারেন্টও নাই। যা বাকিটা রাতে দেখাবো। এখন ঘুমাতে যা।
নইলে আম্মুর উত্তম মধ্যম খাইতে হবে কিন্তু !
লেখাটি পূর্বে জিরো টু ইনফিনিটি তে প্রকাশিত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।