মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! জনমত ভীতি (Fear of Public Opinion)
-------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
মনোবিজ্ঞানে Alloxaphobia নামে এক ধরনের ফোবিয়া বা রোগ রয়েছে যাতে রুগী অন্য কারো মতামতকে ভয় পায়। রাজনীতির জগৎে সাধারণত এই ধরনের ভয়ে ভীত থাকে স্বৈরাচারী শাসকগণ। এই ভয়ের নাম জনমত ভীতি (Fear of Public Opinion) । ইতিহাসে যুগে যুগে এই ভয়ে ভীত শাসকদের দেখা গিয়েছে।
এই জাতীয় স্বৈরশাসকরাই মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে হত্যা করেছিলো।
পরবর্তিতে তাঁর ছাত্র প্লেটো এবং প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল, এই সব স্বৈরশাসকদের সম্পর্কে জনগণকে সাবধান করে দিয়েছিলেন।
কেমন হয় স্বৈরশাসক? কি তাদের জনমতভীতির ফলাফল?
আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তির মধ্যে বরাবরই থাকে জনমতভীতি। বলা বাহুল্য যে আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গই স্বৈরশাসক হয়ে থাকে। এই স্বৈরশাসকদের সরকার হয়ে থাকে দুর্নীতিপরায়ন ও স্বভাবতই জনমতভীতিসম্পন্ন।
একজন স্বৈরশাসক ধনীদের কামনা করে, আর একজন সৎ শাসক সম্মান কামনা করে।
স্বৈরশাসকের প্রহড়ার দায়িত্বে থাকে ভাড়াটে সৈনিক, আর একজন সৎ শাসকের প্রহড়ার দায়িত্বে থাকে তাঁর নাগরিকগণ। স্বৈরশাসকগণ প্রায়ই বক্তৃতাবাগীশ নেতা হয়। তারা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করে এবং সাধারণ জনগণকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা প্রদর্শন করে ক্ষমতা দখল করে। একজন স্বৈরশাসক অসাধারণগুনসম্পন্ন যেকোন ব্যক্তির উত্থানকে প্রতিরোধ করে, প্রয়োজনে তাকে মৃত্যুদন্ড বা গুপ্ত হত্যার ব্যবস্থা করে। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করতে পারে এমন যৌথ ভোজনালয়, ক্লাব বা এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তার দেশে মানসম্পন্ন কোন সাহিত্য সম্মেলন বা এরূপ কোন আলোচনার ব্যবস্থা থাকেনা। জনগণ যাতে পরস্পরকে ঘনিস্টভাবে জানার সুযোগ না পায়, সে ব্যপারে সে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহন করে, এবং দেশের গোপন সংবাদ সংগ্রহের জন্য মেয়েদের গুপ্তচর হিসাবে নিয়োগ করে। জনগণের মধ্যে যাতে কলহের সৃষ্টি হয় এবং তাদের দরিদ্র ও নিঃস্ব করে তোলা যায়, সে তার ব্যবস্থা গ্রহন করে। মিশরের ফেরাউন যেমন প্রজাদের পিরামিড তৈরীর কাজে ব্যস্ত রেখেছিলো, স্বৈরশাসকও তেমনি বড় বড় কজে প্রজাদের ব্যস্ত রাখে। স্ত্রীলোক ও দাস শ্রেণীর মধ্যে থেকে গুপ্তচর তৈরী করে।
এই গুপ্তচররাও নিজেদেরকে সম্মানী ও গুনী লোকদের চাইতে নিজেদেরকে অধিক ক্ষমতাবান মনে করে। দেশের সংকটময় মুহূর্তে যুদ্ধ বা ব্যপক গোলযোগ জাতীয় কিছু কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করে যাতে দেশের মানুষ মনে করে যে তাদের করণীয় কিছু আছে, এবং এতে নেতার প্রয়োজনীয়তা বেশী অনুভুত হয়। আর সেই সুযোগ গ্রহন করে স্বৈরশাসক নিজেকেই সেই নেতা হিসাবে প্রচার করে। যা প্রতারিত জনগণ সত্য বলে মেনে নেয়। কেবলমাত্র দেশের অসাধারণগুনসম্পন্ন মানুষগুলোই স্বৈরশাসকের এই বুজরুকি ধরতে পারে, কিন্তু আগেই বলেছি যে, তাদের হয় দেশ বা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে নতুবা এমনভাবে দমন করা হয়েছে যে তারা খুব সহজে মতামত প্রকাশ করতে পারছে না।
স্বৈরশাসকের থাকে জনমতভীতি। তাই তারা প্রথম সুযোগেই বাক স্বাধীনতাকে হরণ করে।
স্বৈরশাসক যেহেতু নিজ দেশে জনপ্রিয় হয়না বা তার কোন জনপ্রিয়তা নেই এই ভীতি তার মনে কাজ করে তাই সে অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী রাষ্ট্রের মদদপুষ্ট হয়ে থাকে। কখনো কখনো শত্রুরাষ্ট্রই নানা ষড়যন্ত্রে ও কৌশলে স্বৈরশাসককে ঐ দেশের ক্ষমতার আসনে বসায়। এর ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে একটা ব্যবধানের সৃষ্টি হয়।
আরো ভয়াবহ হয় যখন শত্রুরাষ্ট্রের অদৃশ্য ষড়যন্ত্রে দেশরক্ষাকারী সামরিক বাহিনীকেই জনগণের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করানো হয়। এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেই অনেক কর্মকর্তা ও প্রচার মাধ্যম শত্রুরাষ্ট্রের তোষণকারী হয়ে থাকে।
আধুনিক যুগের স্বৈরশাসকদের মাথার উপর খাঁড়ার মত ঝুলছে একটি ভয়, আর তা হলো মতামতের ভয়। সংবাদপত্রের মতামতের ভয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মতামতের ভয়, আর ইদানিং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে প্রচারের এমনই উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষও বন্যার পানির মত মতামত প্রচার করতে পারছে বিভিন্ন ব্লগে, ইউটিউবে, ফেইসবুকে।
পৃথিবীতে এমন অনেক সমাজ রয়েছে যেখানে অতি সামান্য কিছু উচ্চবিত্ত বাদ দিলে, বাকী সকলকেই মাসের প্রতিটি দিনই অভাব তারা করে ফিরে।
গৃহকর্তা উদয়-অস্ত খেটেও পর্যাপ্ত আয়ের কোন পথ খুঁজে পায়না। স্ত্রী স্বভাবতই ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে সংসারের দাবী আদায়ের জন্য সচেষ্ট হয়। ক্রমে সেটা রূপ নেয় কদর্য কুৎসিৎ ঝগড়ায়। অভাব-অনটন, ঝগড়াঝাঁটি, নিঃস্বতার জীবনে ভাগ্যকে গাল-মন্দ পেড়ে চিৎকার আর কান্নাকাটিতে ভরা প্রহরগুলো কাটে। ভাগ্য-ভবিতব্য নয় আসলে মূল সমস্যাটি হলো, এরা সবাই শয়তান সমাজ ব্যবস্থার শিকার মাত্র।
স্বৈরশাসকরা কখনোই এই অসহনীয় সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তের চেষ্টা করেনা। অথবা তাদের স্বৈরশাসনের কারণেই এমন সমাজের সৃষ্টি হয়। সমাজে অপরাধ প্রবণতাও বেড়ে যায়। যে সরকার যত বেশী দুর্নীতিপরায়ন সেই সরকারের আমলে অপরাধও তত বেশী।
পক্ষান্তরে একজন সৎ শাসকের উদ্দেশ্য থাকে একটি কল্যাণকর উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা।
তিনি জানেন,
উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানুষের ভিতরে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদী আদর্শ জাগরিত করা। যা ছাড়া সমাজকে কিছুতেই ওপরে টেনে তোলা যাবেনা। সেটা করতে শিক্ষা ও পারিবারিক পরিবেশের আমুল পরিবর্তন দরকার। সর্বোপরী দেশের রাজনৈতিক পটভূমিকাও মহৎ হওয়া চাই - একমাত্র তাহলেই সে দেশের নাগরিক হিসাবে গর্ব অনুভব করে যাবে। মানুষ যাকে ভালোবাসে তারই জন্য সে সংগ্রাম করতে পারে।
তাই দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জাগ্রত করাই প্রধান দায়িত্ব।
মত প্রকাশ করাই সক্রেটিসের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আর তার ফলাফল হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুদন্ড। সেই প্রহসনমূলক বিচারের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার কালজয়ী বক্তৃতা 'এপোলজি'-তে তিনি বলেছিলেন,
“হে আমার দোষ সাব্যাস্তকারী ব্যাক্তিগণ, আমি মৃত্যুকালে ব্যকুল চিত্তে তোমাদের নিকট ভবিষ্যদ্বানী করে যাচ্ছি; আমি মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছি এবং মৃত্যুকালে মানুষ ভবিষ্যদ্বানী করার সহজাত শক্তি অর্জন করে। আমার হত্যাকারীদের নিকট আমি ভবিষ্যদ্বানী করে যাচ্ছি যে, তোমরা আমাকে যে শাস্তি দিলে, আমার মৃত্যুর পর তা অপেক্ষা গুরুতর শাস্তি তোমাদের অবশ্যই ভোগ করতে হবে........।
যদি তোমরা মনে করো যে, মানুষকে হত্যা করে তোমরা তোমাদের অশুভ জীবনযাপনের সমালোচনা করা থেকে তাদের বিরত রাখতে পারবে, তবে তোমরা ভুল করবে; সমালোচনা থেকে মুক্তির পথ এটি নয়, এবং তা সম্ভবও নয় বা সম্মানজনকও নয়। । সবচেয়ে সহজতম মহৎ উপায় হচ্ছে নিজেদের উন্নতি সাধন করা, অন্যকে আঘাত করা নয়। “
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।