আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রলয়ের হাতছানি-৪র্থ কিস্তি

প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন পূর্বের অংশ পড়তে ক্লিক করুন পূর্বে যা ঘটেছেঃ রাশিয়ান এক টপ সিক্রেট রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে দশ বছরের গবেষণা সফলের পর ডঃ মিখাইল দব্রোভলস্কির আত্নহত্যা, তবে তিনি সেটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে দেখাতে সফল হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ডায়রিগুলো তার ইচ্ছানুযায়ী তার এক বন্ধুর কাছে পাঠানোর আগে ক্রিপ্টোগ্রাফি বিভাগে চেক করা হয়। সব ঠিক দেখে সেগুলো তার গন্তব্যে যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যায়, তবে ক্রিপ্টোগ্রাফার দিমিত্রি মারকভ সেগুলোর এককপি নিজের কাছে রেখে দেয় অবসরে পড়ার জন্য, যা ক্রিপ্টোগ্রাফি বিভাগের এক ক্লিনার আইভানের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডায়রিগুলো অবশেষে ইংল্যান্ডের ডেভন কাউন্টির এক রাশিয়ান বংশদ্ভুত গ্রাম্য মহিলার হাতে এসে পৌঁছায়। ২৫শে জুন, এরিয়া-৫১ মিলিটারি ফ্যাসিলিটি, নেভাডা ,যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট্রাল নেভাডার টনোপাথ বেসিনের গ্রুম আর প্যাপাস মাউন্টেইন রেঞ্জের মাঝখানে অবস্থিত গ্রুম ভ্যালির ইতিহাসবিখ্যাত এরিয়া-৫১ ফ্যাসিলিটি।

সি আই এ এর দেয়া এই কোডনেম এই ফ্যাসিলিটির অনেকগুলো নামের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত। এর বাকি নামগুলো বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা। ওয়াটারটাউন, প্যারাডাইস র্যাাঞ্চ, ড্রিমল্যান্ড ইত্যাদি নামেও পরিচিত ৬০ বর্গমাইলের এই মিলিটারি বেস। ইউনাইটেড স্টেট্‌স এয়ার ফোর্সের বিশাল নেভাডা টেস্ট এন্ড ট্রেনিং রেঞ্জের আওতাভুক্ত এই ক্লাসিফাইড ফ্যাসিলিটি নিয়ে বহু বছর ধরেই মানুষের জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই। সিনেমা, গল্পের বই,গুজব আর এখানকার কড়া সিকিউরিটি এই ফ্যাসিলিটিকে বহু মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্র বানিয়েছে।

এই ফ্যাসিলিটির কাছে ইউ এফ ও বা আনআইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট দেখা যাওয়ার শত শত কাহিনী প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন এখানে ভিনগ্রহের মহাকাশযান আছে এমনকি প্রাণীও আছে। রসওয়েল, নিউ মেক্সিকোর ইউ এফ ও গুজবের সাথে এই জায়গাটাকে প্রায়ই যুক্ত করা হয়। এই রহস্যে ঘেরা ফ্যাসিলিটির অনেকগুলো কাজের একটা হচ্ছে গোপনীয় এয়ারক্রাফটের ফ্লাইট টেস্ট করা। এস আর - ৭১ ব্ল্যাকবার্ডসহ আরো অনেক ঐতিহাসিক মিলিটারি বিমানের টেস্ট সাইট ছিলো এরিয়া-৫১ ।

এরিয়া-৫১ এলাকার একটা লক্ষ্যনীয় স্থান হলো প্রায় ৩ মাইল ব্যাসের গ্রুম হ্রদ, যেটাকে মোটামুটি যেকোনো স্যাটেলাইট ইমেজেই দেখা যায়। হ্রদ বললেও সেটায় পানি নেই, আসলে সেটা একটা সল্ট ফ্ল্যাট বা সল্ট প্যান। সল্ট প্যান আসলে বিভিন্ন প্রকার লবণ আর খনিজে আবৃত ভূমি। হাজার হাজার বছর ধরে হ্রদ বা বড় জলাধার সুর্যের তাপে শুকিয়ে গেলে তার তলার সারফেসে পানিতে দ্রবীভুত খনিজ জমে সল্ট প্যান তৈরি হয়। খনিজের এই প্রলেপ সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে বলে ওপর থেকে সল্ট প্যানকে সাদা দেখায়।

লেকের দক্ষিণপশ্চিম কোণে একটা বড় এয়ার বেস, যেখানে দুটো রানওয়ে, যার একটা গ্রুম লেকের ভেতর পর্যন্ত প্রসারিত। হ্রদের ওপর আরো দুটো রানওয়ে আছে, তবে সেগুলো নির্মাণাধীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এখানে একটা বানওয়ে নির্মাণ করা হয়। তবে ১৯৪৬ সালে এটা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে সি আই এ এখানে টেস্ট ফ্যাসিলিটি নির্মাণ করে লকহিড ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানের পরীক্ষণের উদ্দেশ্যে।

এর পরে এই মিলিটারি বেস আরো অনেক বিমানের উন্নয়ন ও পরীক্ষণ কাজে ব্যবহৃত হয়। রাত নয়টা। বেসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাইরে থেকে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভেতরে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে।

গত কদিন ধরেই চলছে এ কর্মযজ্ঞ। বেসের বহু স্থানে মোশন সেন্সর, ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। জায়গায় জায়গায় লাগানো হয়েছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ডিটেক্টর, যেকোনো লং রেঞ্জ বা শর্ট রেঞ্জ রেডিও ট্রান্সমিশন ধরে ফেলার ক্ষমতা আছে সেগুলোর। বিভিন্ন জায়গায় অতিরিক্ত প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছে। এমনকি টয়লেটের কমোডও বাদ যায়নি।

সেখানে বিশেষ ফিল্টার বসানো হয়েছে, যেনো সেখান দিয়ে যা যাওয়ার কথা, সেটা ব্যতীত অন্য কিছু গেলে তা ধরে রাখা যায়। বেসের কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল রবার্ট মুর তার অফিস বিল্ডিং এর বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁতের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরূট। তিনি একটা রানওয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, এই রানওয়ের ইতিহাসে আজ আর এক ইতিহাস যুক্ত হবে।

"এরিয়া-৫১ একটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমার শুটিং স্পট,যেখানে সিনেমাটা বাস্তব হয়ে যায়" - এই রসিকতার যথার্থতা আবারো প্রমাণিত হবে এবং, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর শক্তি বহুগুণে বেড়ে যাবে। আজ এসএস - ১ বিমানের প্রথম টেস্ট ফ্লাইট এবং তা উড়বে এই রানওয়ে থেকেই। আর তিনঘন্টা পরেই বিমানটা ওই রানওয়ে থেকে মাটি ছাড়বে। ডার্পার প্রজেক্ট উইজার্ড আজ বহুদিনের পরিশ্রমের ফসল দেখবে। এস এস - ১ কোডনেম "স্কাই অ্যাসাসিন" লকহিড মার্টিন, নরথ্রপ গ্রুম্যান আর ডার্পা (ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি) এর যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত একটা হাইলি ক্লাসিফাইড স্ট্র্যাটেজিক বম্বার এবং একই সাথে গোয়েন্দা বিমান।

বিমানের স্ট্রাকচার অনেকটা বি-২ স্পিরিট বম্বারের মতো, অনেক নিচু থেকে দেখলে ডানা মেলা বাদুড়ের মতোই লাগবে দেখতে। বি - ২ এর ডিজাইন থেকে অনেক আইডিয়াই নেয়া হয়েছে এটায়, তবে বি - ২ এবং এস এস - ১ এর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। প্রথমত এস এস - ১ , বি - ২ এর অনেক দুর্বলতা থেকে মুক্ত। যেমন , এস এস - ১ প্রয়োজনে আকাশের হামলার মোকাবেলা করতে পারে। বিমানে তিনজন ক্রু এর জন্য জায়গা আছে, যার মধ্যে একজনের কাজ মূলত আকাশের হুমকি যেমন ফাইটার বিমানের মোকাবেলা করা।

তার জন্য আছে একটা অটো টার্গেটিং সিস্টেম, যেটা কমান্ড সেন্টার থেকে পাওয়া তথ্য থেকে শত্রু-বন্ধু বিমান আলাদা করতে পারে। আরো আছে তিনটা এম৬১ ভালকান ২০ এমএম রাউন্ড কামান এবং একটা মিসাইল বে যেটা ৩০টা এ আই এম সাইডওয়াইন্ডার মিসাইল ধারণ করতে পারে। এস এস - ১ এর বাকি সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বি - ২ এর মতোই, যেমন বোমা ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি। তবে যে কটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য এস এস - ১ এর কোডনেম এর যথার্থতা প্রমাণ করে আজ মূলত সেগুলোরই টেস্টিং হবে। রবার্ট মুর সেগুলো সম্পর্কে জেনেছেন তবে না দেখে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

আজ এরিয়া-৫১ এ জনসমাগম অনেকটাই বেশি। স্বয়ং ডার্পার হেড এসেছেন আজকের টেস্টিং দেখতে। আরো এসেছেন সি আই এর ডিরেক্টর, ডিফেন্স সেক্রেটারিসহ বেশ কিছু হোমড়া চোমড়া লোক। এস এস - ১ এর প্রথম প্রোটোটাইপ গত আটদিন ধরে টুকরো টুকরো করে এসেছে বেস এ। আজ বিকেলে তার জোড়া লাগানো শেষ হয়েছে।

তিনি বিমানটা গিয়ে দেখে এসেছেন হ্যাঙ্গারে, প্রায় বি - ২ এর মতোই। অধীর অপেক্ষায় আছেন তিনি এবং আরো অনেকে, এস এস - ১ কে উড়তে দেখতে এবং, তার সেই অবিশ্বাস্য ক্ষমতা দেখতে। তিনি একটু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে চলে গেলেন। অফিসের গেস্ট লাউঞ্জে তখন সি আই এর ডিরেক্টর ক্রিস মরগান , ডিফেন্স সেক্রেটারি রস ডোনাল্ড আর বিমানবাহিনী প্রধান উইলিয়াম গ্রান্ট কথা বলছেন। ডার্পার ডিরেক্টর ডেভিড ম্যাককালান ওয়াসরুমে আছেন।

তাকে দেখে গ্রান্ট হেসে বলে উঠলেন, "কিহে মুর, তোমার এয়ারবেস আর কত ইতিহাস লিখবে?" মুর একটু হাসলেন। এরপর তারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা শুরু করলেন। রাত এগারোটা ত্রিশ। বেসে টানটান উত্তেজনা। বিমানটাকে হ্যাঙ্গার থেকে বের করে রানওয়েতে আনা হয়েছে।

আরেকটা রানওয়েতে একটা এফ-১৫ সি বিমান টেকঅফের অপেক্ষায় আছে,ওটা অবজার্ভেসন বিমান হিসেবে কাজ করবে। টেকনিশিয়ানরা শেষ মুহূর্তের সিস্টেম চেকিং করছে। ডার্পার বিশজন ইঞ্জিনিয়ার তাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে বসে কম্পিউটারে এস এস -১ এর কম্পিউটারের শেষ চেকিং করছে। দুজন পাইলট বিমানের নিচে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। রবার্ট মুর সহ বাকি হাই অফিসিয়ালরা কন্ট্রোল টাওয়ারে ক্রুদের সাথে আছেন।

তাদের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে আছে এস এস - ১ এর চিফ প্রজেক্ট সুপারভাইজার স্টুয়ার্ট ওয়াইজম্যান। সে ডার্পার লোক। অবশেষে দুজন পাইলট বিমানে উঠলো। এগারোটা আটান্নো বাজে। এফ-১৫ টাকে টেকঅফের নির্দেশ দেয়া হলো।

সেটা গর্জন করে ট্যাক্সিইং করে উড়ে গেলো আকাশে। এর একমিনিট পর এস এস - ১ কে ওড়ার নির্দেশ দিলো একজন অপারেটর। রবার্ট মুর একটু হেসে ম্যাককালানকে বললেন,"দেখি আপনার বিলিয়ন ডলারের পাখি কেমন লুকোয়। আমার বেসের রাডারকে কিন্তু এফ-২২ ও ফাঁকি দিতে পারে না। " ম্যাককালান বাঁকা হেসে বললেন,"ওটাও তো ডার্পারই দেয়া।

ফাঁকি দিতে না পারলে আপনার রাডারটাই সাফল্য ধরে নেবো। " সবাই হেসে উঠলেন। এস এস - ১ ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে গেলো। শব্দ অনেকই কম। কয়েক সেকেন্ড পর মাটি ছাড়লো বিমানটা।

আওয়াজ এখনো কম। মুর রাডার স্ক্রিনে দেখে একটু অবাকই হলেন। বিমানটা এখন বেসের উপরে, ওটার স্টেলথ মুড এখনও বন্ধ,তাও সেটার রাডার ক্রস সেকসন বড়জোর একটা ঈগলের সমান। হিট সিগনেচারও তেমন নেই। এফ-১৫ টা এস এস - ১ এর পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে চলে এলো।

ওটায় একটা হাই রেজুলেসন ভিডিও ক্যামেরা আছে। সবাই একটা স্ক্রিনে এস এস - ১ কে দেখতে পাচ্ছে। এই ক্যামেরা দিয়ে এফ-১৫ টাকে পাঠানোর বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। এস এস - ১ এরিয়া-৫১ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ডামি বম্বিং করে আবার বেস এ ফিরে আসবে। বিমানটা এখন রানওয়ে থেকে এক কিলোমিটার দূরে তিনহাজার ফুট উচ্চতায় আছে।

একজন অপারেটর এস এস - ১ কে নির্দেশ দিলো,"এন্টার স্টেলথ মুড। " এরপর কন্ট্রোল রুমের সবাই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। স্ক্রিনে দেখা গেলো এফ-১৫ এর ক্যামেরা থেকে এস এস - ১ উধাও হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। সাথে সাথে রাডার থেকেও উধাও হয়ে গেলো। হাই অফিসিয়ালরা সবাই বসে ছিলেন, বিস্ময়ে উঠে দাঁড়িয়ে একে অন্যের দিকে তাকালেন।

ম্যাককালানের মুখে একটু বাঁকা হাসি,ভাবখানা এমন,"দেখো মজা"। একজন অপারেটর এফ-১৫ এর পাইলটকে জিজ্ঞেস করলো তার রাডারের কি অবস্থা। সে জবাব দিলো তারো একই অবস্থা। মুর অপারেটরকে বললেন,"অবজার্ভেসনকে ২০মিটারের মধ্যে যেতে বলো। " অপারেটর এফ-১৫ এর পাইলটকে নির্দেশ দিয়ে দিলো।

সাথে সাথে অদৃশ্য এস এস - ১ এর পাইলটকেও নির্দেশ দিলো যেনো কাছে যেতে এফ-১৫ টাকে সাহায্য করা হয়। এফ-১৫ তার শক্তিশালী সার্চলাইট এস এস - ১ এর সম্ভাব্য অবস্থানের দিকে তাক করে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। এস এস - ১ এর ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে তখনও। প্রায় ৩০ মিটার পর্যন্ত কিছুই দেখা গেলো না। ২৫ মিটারে গিয়ে আবছা একটা স্বচ্ছ কাঁচের মতো কাঠামো দেখা গেলো।

কন্ট্রোল রুমের ক্রু এবং দর্শক অফিসিয়ালদের অনেকেই অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন। ম্যাককালান মজা পাচ্ছেন সবার অবস্থা দেখে। তিনি বিমানটার এই ক্ষমতা প্রথমবার পরীক্ষার সময় উপস্থিত ছিলেন। তারও এরকমই অবস্থা হয়েছিলো। এস এস - ১ তার লক্ষ্যের ২০ মাইলের মধ্যে এখন।

এবার অপারেটর এস এস - ১ কে নির্দেশ দিলো গ্লাইড মুডে যাওয়ার, অর্থাৎ ইঞ্জিন অফ করে ভেসে থাকার। এবার যা শব্দ হচ্ছিলো আর এফ-১৫ এর তাপ অনুসন্ধান রাডার যেটুকুও সিগ্নাল পাচ্ছিলো সেটাও উধাও হয়ে গেলো। বিমানটা এখন মোটামুটি পুরোই অদৃশ্য। রাতের আকাশে অদৃশ্য এই আততায়ী তার লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে সেটার সর্বনাশ করতে। অবশেষে এস এস - ১ তার লক্ষ্যবস্তুর কাছে চলে গেলো।

এস এস - ১ এর বম্ব বে খুলে একের পর এক ডামি বোমা পড়তে লাগলো। এবার গ্রান্ট বলে উঠলেন,"এখন বিমানটার অবস্থান আন্দাজ করা সম্ভব। " ম্যাককালান তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,"তাই নাকি? দেখা যাক। " বম্বিং শেষ করার পর হঠাৎ একটা শব্দ হলো এস এস - ১ এর অবস্থান থেকে,অনেকটা খুব জোরে বাতাস বওয়ার মতো। এফ-১৫ টা অনেক কাছ থাকায় সেটা শোনা গেলো।

এবার চিফ প্রজেক্ট সুপারভাইজার ওয়াইজম্যান কথা বলে উঠলো,"বিমানটার কিছু এয়ার ট্যাঙ্ক আছে, সেখান থেকে বাতাসের একটা ব্লাস্ট তৈরি করে সেটা প্রায় ৩০ মিটার সরে গেছে অবস্থান থেকে,মাত্র ৫ সেকেন্ডের মধ্যে। " গ্রান্ট এবার কিছু না বলে অসহায়ভাবে কাঁধ উচু করলেন। এস এস - ১ এর কাজ শেষ। এবার সেটা ফিরে আসছে। সাথে এফ-১৫টাও,তবে সেটার সার্চলাইট বন্ধ,কারণ সেটার আপাতত আর প্রয়োজন নেই।

এস এস - ১ কিছুক্ষণ পর ল্যান্ড করলো,অবশ্য স্টেলথ মুড বন্ধ করে। কন্ট্রোল রুমের সবাই একে অপরের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। প্রথম ফ্লাইট টেস্ট সফল। এরিয়া-৫১ এ আরেক নীরব ইতিহাস রচিত হলো। ৩০শে জুন, ৬৪০ ভার্জিনিয়া স্কোয়্যার , ভার্জিনিয়া সকাল ৭টা ৩০।

নিজের বাড়ির উঠানে একটা চেয়ারে বসে আছে স্টুয়ার্ট ওয়াইজম্যান। তার সামনে অনেকগুলো পাখি। সে ওগুলোর দিকে খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে আর সেগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে। ওয়াইজম্যান একাজটা বহু বছর ধরেই করে আসছে। তাকে এ অভ্যাসটা রপ্ত করতে হয়েছে একটা বিশেষ কারণে।

সকালের এই সময়টা তার খুব ভালো লাগে। তার রুটিন হলো আটটা পর্যন্ত এই কাজটা করা,তারপর ঘরে ঢুকে তার স্ত্রী মার্থার বানানো নাশতা খেয়ে অফিসে ছোটা। একমাত্র ছেলের স্কুল কাছেই,কাজেই তাকে ড্রাইভ করে স্কুলে দিয়ে আসার ঝামেলা নেই,আর ছেলেও একা একা তার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে পছন্দ করে। গাড়িতে সে বড় একটা চড়ে না। এর মধ্যে এস এস - ১ এর দিনেও কয়েকটা ফ্লাইট টেস্ট হয়েছে।

দিনের বেলাতেও বিমানটার স্টেলথ পারফরম্যান্স একই রকম। কিছু ছোটখাট সমস্যা ছিলো,তবে ওগুলো সহজেই সামলে নেয়া গেছে। এস এস - ১ এর আরো একটা রেকর্ড আছে। এর আগে আর কোন বিমান প্রথম টেস্টগুলোতে এতো ভালো সাফল্য দেখায়নি। এয়ারফোর্স অবশ্য আরো অনেক টেস্ট চালাবে তবে তারা এটার পারফরম্যান্স এ খুবই সন্তুষ্ট।

আরো কয়েকটা পাখি এসে বসেছে সামনে। এরমধ্যে একটা বিশেষ পাখি তার নজর কাড়লো। এই পাখিটা গত একবছর থেকে নিয়মিত আসছে তার উঠানে,তবে প্রতিমাসেই এটার রূপ একটু পাল্টে যায়। ওয়াইজম্যান জানে ব্যাপারটার কারণ। পাখিটাকে ওভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে।

নিজে থেকেই রূপ পাল্টায়। এটার মত নিখুঁত গুপ্তচর রোবট স্টুয়ার্ট ডার্পাতেও দেখেনি। আজ একটা বিশেষ দিন। স্টুয়ার্ট তার চশমাটা খুলে রাখলো। খুলে রাখতে গিয়ে সে খুব কৌশলে চশমার দুই গ্লাসের মাঝখানের একটা ছোট্ট ক্যামেরা খুলে রাখলো।

ওটায় একই সাথে ক্যামেরা এবং মেমরি চিপ আছে। তার চশমার ফ্রেমের সাথে সুন্দর ভাবে মিশে ছিলো সেটা। প্রজেক্ট উইজার্ড শুরু হবার সময় থেকে এস এস - ১ এর ব্যাপারে যতো মিটিং, প্রেজেন্টেসন হয়েছে তার সবই এটাতে রেকর্ড করা। এর সাথে আরো অনেক তথ্য আছে যেগুলো খুব কায়দা করে এটাতে লোড করা হয়েছে ডার্পার কিংবদন্তীতুল্য সিকিউরিটি ব্যবস্থার নাকের ডগা দিয়ে। লিডারের অর্ডার ছিলো খুব কড়া, ফাইনাল না হলে তথ্য পাঠানো যাবে না।

আজ ওয়াইজম্যান তার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। ওয়াইজম্যান পাখিটার দিকে যন্ত্রটা ছুঁড়ে দিলো আরো কিছু খাবার সমেত। পাখিটার উচ্চ সংবেদনশীল ক্যামেরা যন্ত্রটাকে ট্র্যাক করে নিলো সহজেই। এরপর পাখিটা সেটা খেয়ে নিলো,তারপর আরো কয়েকটা খাবারের দানা খেয়ে উড়াল দিলো আকাশে। ওয়াইজম্যান আরো কিছুক্ষণ পাখিদের দানা খাওয়ালো।

তারপর আটটা বাজার পর উঠে তার বাসার ভেতরে চলে গেলো শিস দিতে দিতে। পাখিটা উড়াল দিয়ে তার গন্তব্যস্থলে সহজেই পৌঁছে গেলো। এটা জিপিএস ব্যবহার করে না, তার কোন দূরনিয়ন্ত্রকও নেই। সে তার ক্যামেরা ব্যবহার করে নিচের বাড়িঘর দেখেই দিক ঠিক করে নিতে পারে। দুই জিনিয়াসের প্রোগ্রামিং আর যন্ত্রকৌশল প্রতিভার ফসল সে।

পাখিটা উড়ে একটা পার্কে নামলো। সেখানে অনেক লোকই পাখিদের দানা খাওয়ায় এসময়টায়। পাখিটা উড়ে গিয়ে এক বিশেষ লোকের কাছে বসলো। লোকটা বয়স্ক, পাকা চুল, দেখলে মনে হয় অবসরপ্রাপ্ত এক লোক তার অবসর কাটাতে পার্কে বসে পাখিদের দানা খাওয়াচ্ছে। পাখিটাকে দেখে লোকটার মুখে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো।

তার হাতের ঘড়িটা একটু বিপ বিপ করে উঠলো,অর্থাৎ পাখিটা তার আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে গেছে। পাখিটা দানা খেয়ে একটু উড়ে কাচের একটা পানির পাত্রের উপর বসলো। এই পার্কে এমন অনেক পাত্র আছে পাখিদের পানি খাওয়ার জন্য । পাখিটা পানি খাওয়ার ভান করলো কিছুক্ষণ, এরপর উড়ে গেলো একদিকে। লোকটা এবার পাত্রটার দিকে এগিয়ে গেলো।

হাতে মোবাইল ফোন,সে কল করলো তার এক বন্ধুকে। পাত্রটার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ তার হাতের মোবাইলটা পানিতে পড়ে গেলো, ব্যাপারটা অবশ্য ইচ্ছে করে করা। সে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা তুলে নিলো,, সাথে ছোট্ট যন্ত্রটাও। কাছে দাঁড়ানো এক কিশোর তাকে বলল,"দাদু জলদি মোবাইলটা বন্ধ কর আর ব্যাটারিটা খুলে নাও। " বাইরে একটু হেসে তার কথাগুলো পালন করলেও মনে মনে লোকটা বলল,"পাকা ছোকরা।

আমাকে মোবাইল সামলানো শেখাচ্ছে। " এরপর লোকটা পার্কের বাইরে বের হয়ে একটা ২০০০ মডেলের ফিয়াট গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। তার কাজ অনেকটাই শেষ। এখন ছোট্ট যন্ত্রটা জায়গামতো পৌঁছানো বাকি। এরমধ্যে মস্কোতে তখন বিকেল সাড়ে চারটা।

মারকভ অফিসে খুব ব্যস্ত একটা কাজে, এরমধ্যে সে ডায়রিগুলো পড়ার সময় পায়নি। আজ কাজটা শেষ হবে এবং সে ডায়রিগুলো পড়বে বলে ঠিক করেছে। পরের অংশ পড়তে ক্লিক করুন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।