আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি আছি, বেঁচে আছি- গোধুলীর শেষ ছটায়

deceive, deceive me once again ছোটবেলায় একবার আমি আমার বাবাকে খুন করতে চেয়েছিলাম। আমার বাবা চৌধুরী মোহাম্মদ শারাফী, বেকার। আমার মায়ের একার আয়ে সংসার চলে। তবে সেই আয়ের একটা অংশ বাবাকে দিতে হয়, হাতখরচ হিসেবে! তখন আমি ক্লাস ৮ এ পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষার জন্য স্কুলে স্পেশাল কোচিং করানো হচ্ছে, সকল ছাত্রকে বাধ্যতামূলক ৩০০০ টাকা দিয়ে কোচিং করতে হবে, নয়তো যে ৮ম শ্রেণীতে ২য় বছর থাকতে হবে অথবা স্কুল ছাড়তে হবে আকারে-ইঙ্গিতে সে কথা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

শেষের আগের দিন সন্ধ্যায় মা যখন বাসায় আসেন অনেক সংকোচ নিয়ে তাঁকে এ ব্যাপারে বলি। মাস তখন শেষের দিকে, তাঁর হাতে অত টাকা নেই। তিনি বললেন, ‘বাবার কাছে হয়তো থাকতে পারে, কথা বলে দেখা যাক’। বাবাকে এ ব্যাপারে বললে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে- যা আগে থেকেই জানা ছিল, বিরাট স্বার্থবাদী সে। ‘দেখি কি করা যায়’ বলে ঘর থেকে বের হলেন মা।

সে রাতে মা বাসায় ফিরলেন না, উৎকন্ঠায় আমি সারারাত জেগে থাকি। বাবা বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত, ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। কোন সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। সকাল ৭টার দিকে দরজায় টোকার শব্দে ঘুম ভাঙলো। খুলে দেখি মা।

চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গিয়েছে এক রাতে, হাঁটছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তবে সমস্ত মুখে এক নির্লিপ্ত ভাব। আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখানে টাকা আছে’। তারপর নিজ রুমে চলে গেলেন। কিভাবে টাকা পাওয়া গিয়েছে তা জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হয়নি।

কদিন পর এক বিকেল বেলা বাবা প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। মার সামনে পড়তেই তেলানো হাসি দিয়ে বললো, ‘একটা দোকানে পান্জাবীটা দেখে পছন্দ হয়ে গেলো বুঝলা, দাম ও কম চাইসে। তাই নিয়ে নিলাম আর কি’। কেন যেন মনে হলো মার চোখ দিয়ে ২-১ ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তখন। সাথে সাথেই আমি ওই টাকা ভর্তি খাম পাওয়ার কারণ বুঝে ফেললাম ।

বাবার প্রতি প্রবল ঘৃণায় আমার মন বিষিয়ে উঠলো। সত্যি বলছি সাহস থাকলে ছুরি নিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়তাম দ্বিতীয় কোন চিন্তা না করে। আড়াই বছর আগে আমার ছোট বোন সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, ক্লাস ৩ এ পড়তো তখন সে। যেদিন সে মারা যায় সে রাতে মা আমার সাথে ঘুমোতে আসে। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিলাম।

মা বলে, ‘ছিঁচকা কান্না বন্ধ কর। মেয়েটা বেঁচে থাকলে একসময় বিয়ে দিতে হতো। অনেক টাকার ঝামেলা, মরে গিয়ে একদিক থেকে ভালোই হইসে’। আমার বাবা চৌধুরী মোহাম্মদ শারাফী, তার দাদা চৌধুরী মোহাম্মদ বিরাট জমিদার ছিলেন। সকল সম্পত্তি তাঁর ৯ পুত্র ও ৪ কন্যার মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যান।

আমার বাবারা ৪ বোন ও ৩ ভাই। আমার দাদার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার ভাগ্যে জোটে ২রুমের একটা খুপড়ি মত ১ তলা বাসা। ২টা রুমের একটায় বাবা-মা থাকেন, আরেকটায় থাকি আমি। আমার ঘরটায় রান্না-বান্নার কাজ করা হয়। বিদ্যুৎ বিল যাতে বেশী না আসে সেজন্য আমার রুমের লাইটটা খুলে রাখা হয়-কখনো বেশী গরম লাগলে হাতপাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করি, ফ্যান নেই কিনা।

এখন মনে হয় যে বোনটা মরে যাওয়ায় ভালোই হলো, একা বিছানায় আরাম করে ঘুমানো যায়। গরমবোধ একটু হলেও কম হয়। গত বছর বাসার কাছে একটা কলেজ এ ভর্তি হয়েছি, ইকোনমিক্স এ অনার্স করতে। বাসার কাছে হওয়ায় কোন যাতায়াত ভাড়ার দরকার হয়না। ঈদ কখনো পালন করা হয়েছে কিনা মনে পড়েনা, রোযাও রাখা হয়না।

নতুন জামা-কাপড় বলতে বছরে কোন এক সময় ১টা শার্ট-প্যান্ট কেনা হয় বাধ্য হয়ে, আগের গুলোর অবস্থা যদি পরিধান করার অযোগ্য হয়ে যায়। আগে এসব ভেবে মন খারাপ হতো, রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ডুকরে কেঁদে উঠতাম। এখন এসব আর কোন কষ্টের উদ্রেক করেনা। রাতের বেলা জেগে মাঝে মাঝে ভাবি- অবস্থা হয়তোবা বদলাবে কোনদিন, অনেক বছর পর মার মুখে হয়তোবা এক চিলতে হাসি দেখতে পাবো। তখন নিজের ভেতর থেকেই এক বিদ্রুপাত্মক অট্ঠাসি শুনতে পাই।

এভাবে বেঁচে থাকা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আমি চোখ মুদে ঘুমিয়ে পড়ি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।