আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিরবতাই সম্মতি নয়

চিকিৎসকদের পাসেন্টেজ বাণিজ্য দরিদ্র রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা। এটা ঠিক যে, জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্যে দেশে বতমানে অনলাইন চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং টেলিমেডিসিন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্বের ৮৭টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে এবং দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ চাহিদা দেশীয় ঔষধ দ্বারা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু যেখানে ডাক্তার ও জনসংখ্যার গ্রহণযোগ্য স্টান্ডাড অনুপাত হচ্ছে ১:৫০০ সেখানে বাংলাদেশে ১:৫০০০। আর সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে প্রতিবৎসর গড়ে ২০০০ ডাক্তার বের হচ্ছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

অবশ্য বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলোও চিকিৎসকের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক ভুমিকা রাখছে তবে তাদের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমার এক চিকিৎসক বন্ধু কিছুটা ঠাট্টাচ্ছলে এ প্রসঙ্গে বলল যে, “আগে শুনতিস না ডাক্তার আসার পূবে রোগী মারা গেল। এখন বেসরকারী মেডিকেল কলাজগুলোর কল্যাণে আর এমন কথা শুনতে হবে না। এখন শুনবি- ডাক্তার আসার পরেই রোগীটা মারা গেল। ” সে যাই হোক।

হেলথ ওয়াচ নামের এক বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়,বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক গড়ে প্রতিটি রোগীর পেছনে সময় দেন মাত্র ৫৪ সেকেন্ড। তারপরও ডাক্তার ডাক্তারই। রোগীদের যে দোষ নেই এমন নয়। যদি রোগীদেরকে সচেতন করা যেত তবে অনেক ক্ষেত্রেই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হত। প্রতিকার ও প্রতিরোধ দুটিই গুরুত্বপূণ।

যেমন-নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া,ধুমপান না করা, চবি জাতীয় খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে কিডনী রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতার একটি মূল্য অবশ্যই আছে। তাই বলে কি এটাও মেনে নিতে হবে যে, একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একই ব্যক্তির একই প্যাথলজিক্যাল টেস্টে ভিন্নরকমের রিপোট হবে। রোগ সনাক্তকরণে ভুল হলে চিকিৎসা সুষ্ঠু ও সঠিক হবে কী করে? ডাক্তারেরতো রোগীর কাছ থেকে রোগের লক্ষণ-উপসগ শোনার মত পযাপ্ত সময় থাকেনা। আর আপনি গরীব অসহায় যাই হউন না কেন কম খরচে চিকিৎসা সেবা কোথাও পাবেন না।

বাংলাদেশে যাদের মোটামুটি সামর্থ্য আছে তারাও সম্পূর্ন স্বস্তিতে নাই। কারন চিকিৎসার মান সন্তোষজনক না। যেমন “এ্যাপোলো হাসপাতাল”-এও টাকা দিয়ে মানসম্মত সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না। রোগীর পেটে কাপড়,কাচি,আন্দাজে বিল বানানো, সামান্য ব্লাড প্রেসার মাপার পর ২৫০০ টাকা বিল দেয়া ইত্যাদি। অনেক হাসপাতালেই ডাক্তার, নার্স, ঔষধ কম্পানী, বিভিন্ন ল্যাব, ক্লিনিক সবাই মিলে একটা বিশাল সিন্ডিকেটের সৃষ্টি হওয়াটা আমাদের দেশের সাধারন বৈশিষ্ট।

যদি সাধারনভাবে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখান, তাহলে দিতে হবে ৪০০/৫০০ টাকা। এ্যাপোলো কিংবা স্কয়ার, ল্যাবএইড ১২০০ টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবেন। প্রাইভেট প্রাকটিস কিংবা সরকারী-বেসরকারী চাকুরী। এটা প্রভাবশালী ডাক্তারদের একটা বিরাট সিন্ডিকেট। ডাক্তার চাকুরী-প্র্যাকটিস দুটোই করছেন।

পৃথিবীর অন্য কোন দেশেই এই ধরনের উন্মুক্ত সুযোগ দেয়া হয়না। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে ভাল নয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বারডেম, পিজি, কলেরা, পঙ্গু হসপিটাল সহ সকল হাসপাতালে নেই রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত আসন ব্যাবস্থা, গরীব রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে সুচিকিৎসা থেকে, তাদের কাছ থেকে বেশি অর্থ আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রায়শই। ছোটখাট ডাক্তাররাও এমনকি কিছু ফার্মেসীতে ভুয়া ডাক্তার বসে এক্সরে দেওয়ার নামে পারসেন্টিজ খাচ্ছে ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে। এরকম ফার্মেসী ঢাকা শহর সহ গ্রামের বিভিন্ন অলিগলিতেও পাওয়া যাবে।

মোবাইল কোর্ট, রেব, পুলিশ এদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিচ্ছেনা। এপোলো, স্কয়ার, ল্যাবএইড সহ ঢাকা শহরের অনেক হাসপাতালে চিকিৎসার যা খরচ তাতে উচ্চবিত্তদের কোন সমস্যা না হলেও নিন্মবিত্ত,মধ্যবিত্তদের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা নেয়াটা অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। উপজেলা হাসপাতালগুলোর অবস্থা এতই করুন যে রোগীর চিকিৎসার জন্য অন্যত্র পাঠালে পথিমধ্যেই রোগীর মৃত্যু হয় প্রায়ই। হাইওয়েগুলোতে ক্লিনিক করলে অনেক রোগীদের চিকিৎসা দেয়া যেত দুর্ঘটনাজনিত সময়ে এবং সেক্ষেত্রেও মৃত্যুর হার কমে আসতো কিন্তু সেটাতো বাস্তবে অসম্ভব। অদ্ভুত দেশে অদ্ভুত নিয়ম।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত এমপি, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সরকারি আমলারা, এমনকি জজ সাহেবরা সরকারি অর্থে দেশে ও বিদেশে নিজেদের চিকিৎসা করে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন। এই ব্যয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে করা হচ্ছে। কিন্তু যারা উপরোক্ত ক্ষমতাবান লোকদের চিকিৎসার জন্য এই বড় আকারে ব্যয়ভার বহন করছেন তাদের নিজেদের চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা তো দূরের কথা মোটামুটি একটা ব্যবস্থাও নেই! ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালে মোট ছয় হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের একজন শিক্ষক ও গবেষক বলেন, এর অর্ধেকটাই, তিন হাজার কোটি টাকার ওষুধ অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয়; ‘ইর্র্যাাশনাল ইউজ অব ড্রাগ’ বা ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার।

কিন্তু এটা কেমন করে ঘটে? কেন ঘটে? বাংলাদেশে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মোট বিশ হাজারের মতো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ আছেন, তাঁরা নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ বিপণনে চিকিৎসকদের মন জয় করতে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাঁরা অতি উচ্চ মাত্রায় ‘টার্গেট ওরিয়েন্টেড’, টার্গেট পূরণের জন্য চিকিৎসকদের নানা ধরনের ‘প্রণোদনা’ দিয়ে থাকেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের সম্পর্কে তথ্য রাখে, তাঁদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র মনিটর করে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া বিপণন তৎপরতার ফলে ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ওষুধ বেশি বিক্রি হলে কোম্পানির লাভ, চিকিৎসকেরও লাভ।

তাই ওষুধ বিক্রি না বাড়ার কোনোই কারণ নেই। অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল টেস্ট দিচ্ছে চিকিৎসক। রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলেই তাঁকে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো চিকিৎসক উল্লেখ করে দেন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষাগুলো করিয়ে আনতে হবে। সাধারণ মানুষের ধারণা, চিকিৎসকেরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছ থেকে ‘কমিশন’ পেয়ে থাকেন।

রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক তাঁকে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলো করতে পাঠান, তখন ভিজিট নেন, তারপর যখন রিপোর্টগুলো দেখেন, তখন আবারও ভিজিট নেন (প্রথমবারের চেয়ে কম)। অস্ত্রোপচারের রোগী অস্ত্রোপচারের পর যতবার ডাক্তারের কাছে যাবেন, ততবার ডাক্তার টাকা নেবেন। হাসপাতাল/ক্লিনিকে ভর্তি থাকলে রোগী ওই ডাক্তারের আর দেখাই পাবেন না, কালেভদ্রে তাঁর জুনিয়র কলিগ বা ছাত্ররা এসে রোগীকে এক নজর দেখে যাবেন। রোগীর মনে হবে, তিনি কাঙাল, টাকা দিয়ে চিকিৎসা কিনতে আসেননি, করুণা ভিক্ষা করতে এসেছেন। তখন তাঁর মনে হবে, ডাক্তার মানুষ না, টাকা বানানোর যন্ত্র।

প্রতি বছর দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। অথচ এই রোগীদের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশন এবং বিএসএমএমইউ-সমীক্ষা থেকে এটা প্রতিয়মান হয় যে, বতমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক দীঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০হাজার রোগীর কিডনি সম্পূণভাবে অকেজো হয়ে মারা যায়। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৮ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর ৭ লক্ষই চিকিৎসা পাচ্ছে না।

চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে মানুষ, এমন নজির অনেক রয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রতিবছর প্রায় ২১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়; বাংলাদেশী টাকায় এর অর্থমূল্য হচ্ছে ১ লক্ষ ৬০ হাজার ২৩০ কোটি টাকা! প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে বছর প্রতি ফুসফুসের ক্যান্সার ড্রাগ (Tarceva) সেবনে- ২৭ লক্ষ টাকা, স্তন ক্যান্সার ড্রাগ (Herceptin) সেবনে-২৯ লক্ষ টাকা, কোলন ক্যান্সার ড্রাগ (Avastin) সেবনে- ৪১ লক্ষ টাকা,কোলন ক্যান্সার ড্রাগ (Erbitux) সেবনে- ৮৪ লক্ষ টাকা খরচ হয়। আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবা মূলত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিনির্ভর। আর ব্রিটেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রিত।

আর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সুবিধা মূলত দুটি ধারা অনুযায়ী চলে আসছে। একঃ সরকারি হাসপাতালের স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা, দুইঃ বেসরকারি ডাক্তার চেম্বার ও হাসপাতালের চিকিৎসা। তবে দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে কোনো ধারার চিকিৎসাই গরীব মানুষদের জন্য বিনামূল্যে নেই। এ কারণে চিকিৎসার খরচ যোগাতে বহু মানুষকে সর্বশান্ত হতে হয়। পত্রিকাগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে আবেদন।

বহু মানুষ চিকিৎসার খরচ যোগাতে না পেরে অকালে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। সরকারি হাসপাতালগুলো মূলত গরীব মানুষদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এসব হাসপাতালে রয়েছে দুর্নীতি সহ বহু ধরনের সমস্যা। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসা একটি অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা। আর চিকিৎসা নামক এই মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে জনগণকে কম হয়রানির শিকার হতে হয় না।

সরকারী হাসপাতালের অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, দূর-দূরান্ত থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের প্রতারণার শিকার হওয়া, চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাব, ডাক্তার সঙ্কট, সময়মতো হাসপাতালে ডাক্তারের উপস্থিতি না হওয়া, সরকারী হাসপাতালের চেয়ে অধিক অর্থের লোভে ডাক্তারদের প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখতে অধিক যত্মবান হওয়া, আর সরকারী হাসপাতালে রোগীর সেবার ক্ষেত্রে ডাক্তারের অবহেলা, ডাক্তারের আন্তরিকতার অভাব, ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসব খবরের মধ্যে ডাক্তারের অবহেলার কারণে বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা মৃত্যুর পরিণাম সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃখ জনক। মানুষ এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করার মানে এটা নয় যে মানুষ সবকিছু মেনে নিয়েছে। মনের মধ্যে থাকা চাপা ক্ষোভ প্রতিবাদী সত্তার জাগরণে যখন জনসম্মুখে আসবে তখন যে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এটা সহজেই অনুমেয়। আমার মনে হয়, দেশের ডাক্তাররা যতদিন সাদা গাউন পরে মনে না করবেন, এটা তাঁদের সেবার প্রতীক ততদিন দেশের মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হবেই।

সুতরাং বাংলাদেশের বর্তমান বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চাই উন্নত মন। ডাক্তার আর সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতাই পারে এর সমাধান দিতে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।