আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

[ফিচার সিরিজ: ২]-রেজা ও ইকবাল: ভুলেও ভুলিনি

জল কে চললো কার ঝিয়ারী সিলেট ক্যাডেট কলেজের স্টাফ লাউঞ্জে আমাদের একজন শিক্ষক বিষয়টা তুললেন। ‘ক্লাস সেভেনে পড়া ১১-১২ বছরের ক্যাডেটদের দিয়ে তিন টন ওজনের রোলার টানানো খুবই অমানবিক। যেকোনো সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তা ছাড়া মাঠ সমান করার জন্য কর্মচারীই তো আছে। ’ কিন্তু রোলার টানানোর সিদ্ধান্তটা এসেছে কলেজ অ্যাডজুটেন্টের কাছ থেকে।

অতএব প্রিন্সিপালও বিষয়টা ‘শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ঠিকই আছে’ বলে মনে করলেন। উল্টো যিনি অনুযোগটি করের্ছিলেন সেই স্যারকেই অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। এ ঘটনার দু-তিন দিন পরই ১১ নভেম্বর ১৯৯৯-এর কুয়াশাচ্ছন্ন এক ভোরে সেই রোলারের নিচেই চাপা পড়ে সকল শৃঙ্খল ছিঁড়ে চলে গেল আমাদের প্রিয় দুই বন্ধু রেজা ও ইকবাল। শিশিরভেজা মাঠ ভিজল অপাপবিদ্ধ দুই কিশোরের রক্তে। সেই রক্ত ও সেই স্নৃতি আজও একাকার হয়ে আছে স্নৃতিতে।

স্নৃতি বেদনার্ত হতে পারে, কিন্তু এই স্নৃতি কেবলই বেদনার নয়, তিক্ততার এবং ক্ষোভের। সুবিচার না হওয়ায় তা আমাদেরও অপরাধী করে দেয়। আমাদের মনে ওদের বয়স বাড়ে না, কিন্তু আমরা বেড়ে চলেছি। যতই বাড়ছি, ততই সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ওদের স্নৃতির ভার। ওদের মৃত্যুর শোক আমাদের তাই বর্তমানের আরো অনেক শোকার্ত ঘটনার দিকে টেনে নিয়ে যায়।

আমরা দেখি, সেই গাফিলতি আজো ঘটে চলেছে অনেক জায়গায়। আমরা তাই শৃঙ্খলা ভেঙে নেমেছিলাম আন্দোলনে। সমস্ত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই অমানবিক ঘটনার হোতাকারীদের শাস্তি চেয়েছিলাম। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়ে আমাদের শান্ত করলেন। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাভরা চোখে আমরা দেখলাম, উল্টো আন্দোলনে থাকার অপরাধে অনেক সিনিয়র ক্যাডেটকেই বহিষ্ককার করা হলো।

অথচ যাঁর বা যাঁদের খামখেয়ালে বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটলো, তারা কিন্তু থাকলেন বহাল তবিয়তে। শাস্তি পেলেন শুধু একজন ননকমিশন্ড আর্মি স্টাফ। এমন একটা ঘটনা তো আমাদের জাতির দৈন্যকেই উন্েনাচিত করে। প্রকৃত অর্থেই দারুণ মেধাবী ছিল ক্যাডেট রেজা ও ইকবাল। স্বপ্ন ছিল অনেক বড় হওয়ার।

যেমন আরো অনেকেরই থাকে। কিন্তু অনেকে সেটা বাস্তবায়নের সুযোগ পায়; ওরা তা পায়নি। ওদের পরিবার দেখতে পারেনি ওদের পূর্ণ জীবনের পূর্ণ অবয়ব। ইকবাল হয়তো একদিন বলল, বিজ্ঞানী হব, তো আরেক দিন বলল, না, ইঞ্জিনিয়ার হব। ‘বড় দাবাড়ু হব’−দাবার বোর্ডের সামনে বসে এমনই হয়তো হতো শপথ কিংবা কলেজ ম্যাগাজিনে যখন তার লেখা একটা সায়েন্স ফিকশন প্রকাশিত হলো, তখনই দেখে ফেলল সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন।

রেজার একসময় হয়তো মনে হলো, ‘আর্মি অফিসার হব, আবার আরেক সময় মনে হলো না, ডাক্তার হব। মানুষের সেবা করতে হবে না?’ দারুণ অ্যাথলেটও ছিল সে। স্বপ্নেরা সবে ডানা মেলতে শুরু করেছে, আর তখনই অপ্রত্যাশিত এক দুর্যোগ। আমরা শুধু প্রিয় দুজন বন্ধুকেই হারালাম না, এক ঝাঁক স্বপ্নেরও যে অপমৃত্যু হলো। স্বপ্নকে এমন কঠিন নির্মমতায় হত্যা করতে পারঙ্গম বলেই হয়তো জাতি হিসেবে আমরা আজও সামনের সারিতে দাঁড়াতে অক্ষম।

এমন একেকটা ১১ নভেম্বরের সুষ্ঠু বিচার হয় না বলেই হয়তো আমাদের শুনতে হয়−শিক্ষকের আঘাতে প্রাইমারি ছাত্রের মৃত্যুর খবর। ক্ষমতার অপব্যবহারের এমন নজির বারবার সৃষ্টি হয় বলেই হয়তো পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যু হয় মেধাবী নিরপরাধ কলেজছাত্রের। মানসিকতার এমন দারিদ্র্যের জন্যই হয়তো অপমানিত হয় দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠের ছাত্ররা। রেজা ও ইকবালের মৃত্যু ওদের মা-বাবাকে এখনো কতখানি কাঁদায়, তাঁদের সামনে দাঁড়ালে এর কিছুটা হয়তো বুঝতে পারি। এই মৃত্যু আমাদের হূদয়ে কতখানি ক্ষত সৃষ্টি করেছে তার কিছুটাও হয়তো আমাদের আশপাশের মানুষ বুঝতে পারে।

শোকাহত আমরা সবাই-ই জানি, চাইলেও আর রেজা ও ইকবালকে ফিরে পাব না। তাই আমরা চাই কোনো কারণেই আর কোনো স্বপ্ন যেন অতলে হারিয়ে না যায়। পুরোনো ব্যর্থতার জাল থেকে বেরিয়ে জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য এই বদলটার যে বড়ই প্রয়োজন। লেখক: সাবেক সভাপতি, রেজা-ইকবাল মেমোরিয়াল অর্গানাইজেশন http://www.facebook.com/mohiuddin.kawsar.1 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।